Monday, 28 August 2023

জীবন উন্নতিকরনের উপায়

 


একদিন স্বামী বিবেকানন্দ নিজের জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে গুরু রামকৃষ্ণের কাছে গেলেন। তিনি গুরুকে জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন।


স্বামী বিবেকানন্দ: আমি অবসর সময় খুঁজে পাচ্ছি না। জীবন আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  কাজ তোমাকে ব্যাস্ত করবে কিন্তু সৃজনশীলতা তোমাকে অবসর দেবে।

স্বামী বিবেকানন্দ:  জীবন এখন কেন এত জটিল ?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  জীবনের বিশ্লেষণ বন্ধ করো। .. এটা জীবনকে আরও জটিল করে তোলে।

স্বামী বিবেকানন্দ:  কেন আমরা অসুখী?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  উদ্বেগ তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই তুমি অসুখী।

স্বামী বিবেকানন্দ:  কেন ভাল মানুষ সবসময় কষ্ট পায়?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  ঘর্ষণ ছাড়া হীরা মসৃণ করা যায় না। আগুন ছাড়া সোনা বিশুদ্ধ হয় না। ভাল মানুষ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়, এটা তাদের ভোগান্তি নয়। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের জীবন আরও সুন্দর হয়ে যায়, তিক্ত নয়।

স্বামী বিবেকানন্দ:  আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে এইরকম অভিজ্ঞতা উপকারী?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  হ্যাঁ। সবসময় অভিজ্ঞতা হলো কঠিন শিক্ষকের মত। যে শিক্ষক তোমাকে আগে পরীক্ষার সম্মুখীন করে এবং পরে শিক্ষা দেয়।

স্বামী বিবেকানন্দ:  অনেক সমস্যার কারণে আমরা জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি …

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  যদি তুমি বাইরে তাকাও তাহলে বোঝবে না কোথায় যাচ্ছো। যদি ভেতরটা দেখো তুমি বোঝতে পারবে তুমি কোথায় যাচ্ছো। চোখ আমাদের দৃষ্টি দেয় আর হৃদয় আমাদের উপায় দেখায়।



স্বামী বিবেকানন্দ:  অসফলতা কি সফল পথে চলার চেয়েও বেশি কষ্টদায়ক ?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  সফলতা অন্যদের দ্বারা নির্ধারিত একটি পরিমাপ। সন্তুষ্টি নিজের দ্বারা নির্ধারিত একটি পরিমাপ।

স্বামী বিবেকানন্দ:  কঠিন সময়ে, কীভাবে আপনি অনুপ্রাণিত থাকেন?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  সর্বদা তুমি কতদূর যেতে পেরেছো তা দেখো, তুমি কতদূর যেতে পারো নি তা হিসাব করতে যেয়ো না। সবসময় তোমাকে কারা ভালোবাসে তা দেখো, কে ভালোবাসে না তা হিসাব করতে যেয়ো না।

স্বামী বিবেকানন্দ: মানুষ সম্পর্কে আপনার কী অবাক লাগে?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  যখন তারা কষ্ট করে তখন তারা অভিযোগ করে ‘এই কষ্ট কেনো আমাকে দেয়া হলো’। কিন্তু যখন তারা সফল হয় তখন তারা বলে না, ‘এই সফলতা কেনো আমাকে দেয়া হল?’

স্বামী বিবেকানন্দ:  কীভাবে আমি জীবন থেকে সেরাটা পেতে পারি?

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  তোমার অতীতকে অনুশোচনা ছাড়াই মেনে নাও। আস্থার সঙ্গে তোমার বর্তমান পরিচালনা কর। ভয় ছাড়াই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হও।

স্বামী বিবেকানন্দ:  একটি শেষ প্রশ্ন। কখনো কখনো আমি মনে করি আমার প্রার্থনার উত্তর দেওয়া হয় না।

রামকৃষ্ণ পরমহংস:  সব প্রার্থনার উত্তর দেওয়া হয়। বিশ্বাস রাখো এবং ভয় ছেড়ে দাও। জীবন কোন সমস্যা নয় যে সমস্যার সমাধান করতে হবে, জীবন একটি রহস্য যার সমাধান করতে হবে। বিশ্বাস কর, যদি তুমি জানো কিভাবে বাঁচতে হয় তবে জীবন বিস্ময়কর সুন্দর।

পৃথিবী কত সুন্দর এটা তোমাকে যে কেউ বোঝাতে পারবে কিন্তু এর মধ্যে খুব কম মানুষই তোমাকে বোঝাতে পারবে যে, তুমি পৃথিবীতে কত সুন্দর।

অসাধারণ দার্শনিক আলোচনা....জীবন কে উন্নত করে।

@&@&@&@&@&@&@&@&@&@&@&@&@&

শয়নে প্রণামজ্ঞান নিদ্রায় করো মাকে ধ্যান ।

**************************************

সবসময় তাঁকে চিন্তা করলে উগ্র হতে পারবে না। তাঁকে চিন্তা না করলেই মনটা চঞ্চল হয় ,  মন রাগ - ঝাগ করে । স্মরণ - মনন করার অভ্যাস যে করবে সে - ই  শান্তি পাবে। এ তো আর ঔষধ নয় যে গুলে খাইয়ে দেবে। মায়ের হাতে সব আছে ।  মাকে খুব ভালবাসবে । অনুরাগ চাই। তা না হলে শুধুই বসে বসে   'ফরে ফৃষ্ট ফরে ফৃষ্ট' করবে আর ঢুলবে। কিছুই হবে না।

             "দুটি মন থাকে -----একটি বহির্মুখী ও অন্যটি অন্তর্মুখী ।  কারও দোষ দেখছ না তো ?  মা বলেছেন একথা। ঠাকুরের প্রতি ভালবাসা এলে তবে ডুব দেওয়া যায় । অভ্যাস করতে হবে।  বিনা অনুরাগ নেহি মিলে নন্দলালা ।

           --- প্রব্রাজিকা ভক্তিপ্রাণা মাতাজী

!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!@!


*꧁জপ꧂*

পবিত্র ঈশ্বরীয় নাম অথবা শক্তিশালী ইষ্টমন্ত্রের পুনঃ পুনঃ উচ্চারণই 'জপ'।

অরণি কাঠ বারবার ঘর্ষণ করতে করতে যেমন তা থেকে আগুন বার হয়, ঠিক তেমনই গোপন ইষ্টমন্ত্র সঠিক উচ্চারণে জপ করতে করতে তা থেকে শক্তি নির্গত হয়ে সাধককে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের দিকে নিয়ে যায়। তখন স্তরে স্তরে মন উপরে উঠতে থাকে।

জপের সময় মুখ বন্ধ এবং জিভ স্তব্ধ থাকা উচিৎ। অর্থাৎ জপ হবে মনে মনে। 

মন অন্যদিকে নিযুক্ত রেখেও মুখে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা সহজ। কিন্তু মনকে জপের দিকে নিযুক্ত না রেখে মানসিক জপ প্রায় অসম্ভব, তাই নীরব মানসজপই শ্রেষ্ঠ। 

মনকে অন্য সকল চিন্তা থেকে মুক্ত করে সর্ব প্রকারে ঈশ্বরমুখী করাই সাধনার উদ্দেশ্য। 

মনের চিন্তা দুই প্রকার : শ্রবণধর্মী এবং দর্শনধর্মী।

অর্থাৎ আমরা কোনও শব্দ চিন্তা করতে পারি অথবা দৃশ্য চিন্তা করতে পারি। 

এই দুইপ্রকার চিন্তনকে ঈশ্বরমুখী করতে গেলে অন্তরে ইষ্টের রূপ (দৃশ্য ) চিন্তন এবং তাঁর ভাব-প্রতিপাদক মন্ত্র (শব্দ) চিন্তন করতে হয়। তাহলে মনে আর অন্য চিন্তা আসেনা।

আর তা না হলে মুখে নাম করে যাচ্ছি কিন্তু মন তার অভ্যাসবশতঃ জাগতিক চিন্তা করে যাচ্ছে তাতে কী লাভ?  

মুখে একটি শব্দ উচ্চারণ করা সহজ, কিন্তু দৈহিক কম্পন বন্ধ করে শুধু মানস জপ করতে গিয়ে দেখা যায় সেটা কত কঠিন! আর কঠিন বলেই সেটা অধিকতর ফল প্রদানকারী।

স্বামী বিবেকানন্দ রাজযোগের আলোচনায় বলছেন,

_‘‘...মন্ত্র জপ করিবার তিন প্রকার নিয়ম আছে — 'বাচিক', 'উপাংশ' ও 'মানস'।_

_বাচিক জপ সর্বনিম্নে এবং মানস জপ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।...’’_

মন্ত্র জপের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের অর্থ অর্থাৎ মন্ত্রের ভাবটি চিন্তা করতে হয়। মহর্ষি পতঞ্জলি শেখাচ্ছেন, _'তজ্জপস্তদর্থ- ভাবনম্';_

— অর্থাৎ জপের সঙ্গে সঙ্গে জপমন্ত্রের অর্থ ভাবার কথা বলা হয়েছে। 

এখানে 'মন্ত্র' বলতে ঈশ্বরীয় নাম এবং তার অর্থ বলতে নামের প্রতিপাদ্য ভাবের কথা বলা হচ্ছে। 

এই ভাব-চিন্তন থেকেই বিক্ষেপহীন ভাবময় স্থিতি বা ধ্যান আসে। এভাবেই জপ থেকে ক্রমে ধ্যানে উন্নীত হতে হয়।

যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণ-নাম জপ করছেন, তাঁরা জপের সাথে সাথে সেই নামের অর্থ বা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ চিন্তন করেন। 

কিন্তু ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের প্রকৃত রূপ আমাদের বুদ্ধির অগম্য। তাঁর অনন্ত ভাব আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা তাই নিজেদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব শুধু ততটুকুই তাঁকে চিন্তা করতে পারি। 

স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, 

_‘‘এই অদ্ভুত রামকৃষ্ণ-চরিত্র তোমার ক্ষুদ্র বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে যতদূর সাধ্য আলোচনা  কর, অধ্যয়ন কর। আমি তো তাঁর লক্ষাংশের একাংশও এখনও বুঝতে পারিনি। ও যত বুঝবার চেষ্টা করবে, ততই সুখ পাবে, ততই মজবে।’’_

কথামৃতে আছে — শ্রীমতি রাধিকা যত কুঞ্জবনের দিকে এগোচ্ছেন তত কৃষ্ণ-গন্ধ নাকে আসছে।

 — এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হল : আমরা যত পবিত্র হব, যত তাঁর দিকে এগোতে থাকব, ততই তাঁর স্বরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে। 

জপের পথে আমরা ভাবময় ইষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে যাই।

#$#$#$#$#$#$#%#$#$#%#$#$#%#$#$#$#$#$%#$

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মূলমন্ত্র হল “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” (নিজের মুক্তি ও বিশ্ব কল্যাণ)। স্বামী বিবেকানন্দ এই ধর্মের ব্যাখ্যা করেছিলেন। 

%&%&%&%&%&%&%&%&%&%&%&%&%&%

মনের অশান্তির জন্য কিছু ভেবো না। তিনিই শান্তি দেবেন। তোমার হবেও। তাঁর কাছে না হলে এখানে এলে কি করে সব ছেড়েছুড়েদিয়ে? খুব তাঁর নাম কর। জপ-ধ্যান কর। কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে প্রার্থনা কর। প্রার্থনা করলে তাঁর অস্তিত্ববোধটা খুব হয়। কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করে বলবে, 'ঠাকুর আমার মনের সব দুর্বলতা, মলিনতা দূর করে দাও। আমি শরণাগত। তুমি আমায় রক্ষা কর।'

স্বামী শিবানন্দজী মহারাজ 

জ্ঞান আবার মানুষের অন্তর্নিহিত। কোন জ্ঞানই বাহির হইতে আসে না, সবই ভিতরে। আমরা যে বলি মানুষ ‘জানে’, ঠিক; মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হইবে মানুষ ‘আবিষ্কার করে’(discovers) বা ‘আবরণ উন্মোচন করে’ (unveils)। মানুষ যাহা ‘শিক্ষা করে’, প্রকৃতপক্ষে সে উহা ‘আবিষ্কার করে’। ‘Discover’ শব্দটির অর্থ-অনন্ত জ্ঞানের খনিস্বরূপ নিজ আত্মা হইতে আবরণ সরাইয়া লওয়া। আমরা বলি, নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। উহা কি এক কোণে বসিয়া তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল? না, উহা তাঁহার নিজ মনেই অবস্থিত ছিল। সময় আসিল, অমনি তিনি উহা দেখিতে পাইলেন। মানুষ যতপ্রকার জ্ঞানলাভ করিয়াছে, সবই মন হইতে। জগতের অনন্ত পুস্তকাগার তোমারই মনে। বহির্জগৎ কেবল তোমার নিজ মনকে অধ্যয়ন করিবার উত্তেজক কারণ উপলক্ষ্য মাত্র, তোমার নিজ মনই সর্বদা তোমার অধ্যায়নের বিষয়। আপেলের পতন নিউটনের পক্ষে উদ্দীপক কারণ-স্বরূপ হইল, তখন তিনি নিজের মন অধ্যায়ন করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহার মনের ভিতর পূর্ব হইতে অবস্থিত ভাবপরম্পরা আর একভাবে সাজাইয়া উহাদের ভিতর একটি নূতন শৃঙ্খলা আবিষ্কার করিলেন; উহাকেই আমরা মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম বলি। উহা আপেলে বা পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত কোন পদার্থে ছিল না। অতএব লৌকিক বা পারমার্থিক সমুদয় জ্ঞানই মানুষের মনে। অনেক স্থলেই উহারা আবিষ্কৃত (বা অনাবৃত) হয় না, বরং আবৃত থাকে; যখন এই আবরণ ধীরে ধীরে সরাইয়া লওয়া হয়, তখন আমরা বলি ‘আমরা শিক্ষা করিতেছি’, এবং এই আবরণ অপসারণের কাজ যতই অগ্রসর হয়, জ্ঞানও ততই অগ্রসর হইতে থাকে। এই আবরণ যাঁহার ক্রমশঃ উঠিয়া যাইতেছে, তিনি অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী; যাহার আবরণ খুব বেশী, সে অজ্ঞান; আর যাঁহার ভিতর হইতে অজ্ঞান একেবারে চলিয়া গিয়াছে, তিনি সর্বজ্ঞ। পূর্বে অনেক সর্বজ্ঞ পুরুষ ছিলেন; আমার বিশ্বাস একালেও অনেক হইবেন, আর আগামী কল্পসমূহে অসংখ্য সর্বজ্ঞ পুরুষ জন্মাইবেন। চকমকি পাথরে যেমন অগ্নি নিহিত থাকে, মনের মধ্যেই সেইরূপ জ্ঞান রহিয়াছে; উদ্দীপক কারণটি যেন ঘর্ষণ-জ্ঞানাগ্নিকে প্রকাশ করিয়া দেয়। আমাদের সকল ভাব ও কার্য সম্বন্ধে ও সেইরূপ; যদি আমরা ধীরভাবে নিজেদের অন্তঃকরণ অধ্যয়ন করি, তবে দেখিব, আমাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আশীর্বাদ-অভিসম্পাত, নিন্দা-সুখ্যাতি সবই আমাদের মনের উপর বহির্জগতের বিভিন্ন আঘাতের দ্বারা আমাদের ভিতর হইতেই উৎপন্ন। উহাদের ফলেই আমাদের বর্তমান চরিত্র গঠিত, এই আঘাত-সমষ্টিকেই বলে কর্ম।                 

—স্বামী বিবেকানন্দ।

=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=^=

🙏🏻🌺 *গুরু সচ্চিদানন্দ*🌼🙏🏻   

*রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের গুরুবাদের মধ্যে কোথাও কোন এক-ব্যক্তির স্থান নেই। প্রত্যেক সঙ্ঘগুরু বলেছেন,গুরু হচ্ছেন সচ্চিদানন্দ। গুরু কোন এক ব্যক্তি নন, গুরু একটি দেহ নন। গুরু একটি মহাশক্তি। গুরু স্বয়ং ঈশ্বর। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে তিনি "শ্রীরামকৃষ্ণ" মূর্তিতে বিরাজিত। এই গুরুবাদে গুরু কখনো আমাদের ছেড়ে যান না। একজন যান আর একজন আসেন।সেই কারণে যাঁরা দীক্ষা দেন তাঁরা সকলেই বলেন,"আমরা কেউ গুরু নই। আমাদের সকলের গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনিই ইষ্ট, তিনিই সব। যারা আমার গুরু,আমার গুরু করে তারা পুকুরের মাছের মতো নিজেদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে নিশ্চিত হয়ে আছে। স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী লিখেছেন, বিভিন্ন গুরুর জন্মদিন তাঁদের নিজেদের শিষ্যদের দ্বারাই শুধু পালিত হওয়া নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কারণ এর ফলে বিভিন্ন গুরুর শিষ্যদের মধ্যে একটা সংকীর্ণ বিভেদকামী প্রবণতার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি শিষ্যগোষ্ঠীই বলে আমার গুরু,আমার গুরু। গুরুকে কেন্দ্র করে একটা সম্প্রদায় তৈরি করা খারাপ। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে ৫০ বছর আগে দীক্ষা হোক বা আজই হোক, সবাই একই গুরুর শিষ্য। সকলের গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ।

@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@

‘পাকা আমি'  বনাম ‘পাকামি'


 পূজা করার সময় ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ অনেকক্ষেত্রে তথাকথিত শাস্ত্রীয় বিধি লঙ্ঘন করতেন বলে শোনা যায়। স্বামীজিও পূজার সময় কখনও কখনও ফুল- নৈবেদ্যদি একসাথে অর্পণ করে গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তেন; আবার কখনও কখনও মন্দিরে উপবিষ্ট শিষ্যগণ ও অন্যান্য সাধু ব্রহ্মচারীদের মস্তকে পূজার ফুল নিক্ষেপ করতেন। এসব 'বৈধী' পূজা-বিধিতে পাওয়া যায়না। 

  —এই আচরণ বৈধী-ভক্তির ঊর্ধ্বে পরা ভক্তির স্তরের। 

কিন্তু এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যদি সাধারণ স্তরের কোনও ব্যক্তি অনুরূপ আচরণ করেন তবে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় সেক্ষেত্রে বলতে হয় :

❝বিষয়ী লোকের ঈশ্বরের নাম করা — অনুরাগ নাই। বালক যেমন বলে, ‘তোর পরমেশ্বরের দিব্যি।’ 

—খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে ‘পরমেশ্বরের দিব্যি’  শিখেছে!❞

সাধারণ স্তরের মানুষ বা বিধিবাদীয় ভক্তির স্তরের ভক্তদের পক্ষেও ওইরূপ মহাজন-সদৃশ্য আচরণের অনুকরণ ও তাকে ‘ভাবের পূজা’ - নাম দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা ওই ‘খুড়ি জেঠির কোঁদল শুনে পরমেশ্বরের দিব্যি’ শেখার মতোই 'পাকামি' বলেই বোধ হয়।

অনেকে বলে থাকেন : ঠাকুরের পূজায়  কেক, ঝালমুড়ি বা পিৎজা দেওয়া যাবে, অর্থাৎ আমরা যা খাই সেই সবই পুজোর উপাচার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। কিংবা উচ্ছিষ্টপূর্ণ খাবার টেবিলের উপরে ইষ্টের প্রতিকৃতি রেখে আমাদের সাথেই তাঁকেও ওখানেই ভোগ নিবেদন করা যাবে - ইত্যাদি।

—এইসব বক্তব্য আমাদেরকে বিস্মিত করে।  

শ্রীশ্রীঠাকুরের বাহ্যপূজা প্রবর্তন করেছিলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী। পরবর্তীকালে প্রেমানন্দজী ঠাকুরের বাহ্যপূজার দায়িত্ব নেন। শ্রীশ্রীমাও ঠাকুরের বাহ্যপূজা করতেন।  এঁদের পূজা সম্পর্কে অনেক তথ্য আমরা বিভিন্ন বইপত্র থেকে পাই। সেখানে দেখেছি, ঠাকুরের পূজা কোনও ছেলেখেলা নয়। অত্যন্ত শুদ্ধাচারে তা করতে হয়। 

কেউ যদি মনে করে থাকেন ঠাকুরের পূজায় কেক, ঝালমুড়ি, পিৎজা এসব নিবেদন করবেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতা হতে পারে,  তবে 'ভাবের পুজো' নাম দিয়ে ওই অশাস্ত্রীয় ছেলেখেলাকে সর্বজনীন করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত হানিকর। 

শিশুরা বড়দের মতো আচরণ করলে যদি তাকে 'পাকামি' বলা হয়, তাহলে এসব ক্ষেত্রেও ভক্তিরাজ্যে নিম্ন অধিকার বিশিষ্টরা যদি পরা ভক্তির রাজ্যে অধিষ্ঠিত উচ্চ অধিকারীর অনুকরণ করতে থাকে তবে সেই কর্মটিকেও অনুরূপ বিশেষণে কেন ভূষিত করা যাবে না?

'ভাবের পুজো' অনেক উচ্চস্তরের ব্যপার। ওটা সর্বজনীন হতে পারেনা। ঠাকুর বলতেন 

❝ছাদে উঠে দু'হাত তুলে নাচলেও কোনও ভয় নেই কিন্তু সিঁড়িতে নাচানাচি করলে পতনের সম্ভাবনা।❞

—বৈধীভক্তির স্তরে এ'রকম স্বেচ্ছাচারিতা আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। 

শোনা যায় ত্রৈলঙ্গস্বামী এমন অনেক আচরণ করতেন, যা সাধারণের চোখে অশাস্ত্রীয়। কিন্তু যে আচরণ ত্রৈলঙ্গস্বামীর মতো মহাপুরুষের পক্ষে সম্ভব তা  সর্বজনীন হ'তে পারেনা। 

কেমন হবে ঠাকুরের পূজা? —এর উত্তর স্বয়ং শ্রীশ্রীমা বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। সেখানে দেখেছি খুব আপৎকালীন অবস্থা ছাড়া তিনি ঠাকুরের পূজায় যথেষ্ট সাবধানতা ও শুদ্ধাচার অবলম্বন করেছেন। 

ঠাকুরের পুজোয় সাদা ফুল দিতে হয়। ধূপ,  বেশী গন্ধযুক্ত ফুল এসব ঠাকুরের বিগ্রহ থেকে একটু দূরে রাখতে হয়। চন্দনে খিঁচ থাকা চলবেনা। ঠাকুরের জন্য নিবেদনযোগ্য আহার্যে যেন কোনওভাবেই নিঃশ্বাস না পড়ে এটা দেখতে হয়। ঠাকুরের জন্য নিবেদনযোগ্য আহার্যের অগ্রভাগ কাউকে না দেওয়া, স্পর্শদোষ যথাসম্ভব বাঁচিয়ে চলা — এরকম বিভিন্ন বিধি-নিষেধ স্বয়ং মা শিখিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। 

সুতরাং সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকারী নির্বিশেষে 'ভাবের পুজোর' নাম করে স্বেচ্ছাচার প্রবর্তন অনুচিত বলেই মনে হয়।

পূজা হ'ল ভক্তিযোগের একটি সাধন-পদ্ধতি।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে ভক্তিযোগে ভক্তিই একাধারে উদ্দেশ্য এবং উপায় দুইই। অপরপক্ষে অন্যান্য যোগের পদ্ধতিগুলি শুধু উপায়মাত্র, উদ্দেশ্য নয়।

অর্থাৎ ভক্তিযোগে সাধক চান ইষ্টের প্রতি নিবিড় ভক্তি। আবার এই ভক্তিলাভের উপায়ও ভক্তি।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখান, 'ভক্তিকামনা কামনার মধ্যে নয়।'

 অর্থাৎ অন্য কামনায় মানুষের বদ্ধতা বাড়ে, মানুষ জাগতিক মোহের জালে ছটফট করে; কিন্তু 'ভক্তি-কামনা কামনার মধ্যে নয়', কারণ এই কামনার তীব্রতায় মানুষের স্বরূপের জাগতিক আচ্ছাদন ক্ষীয়মাণ হয়।

ভক্তি খুব মন্থর পদ্ধতি কিন্তু ভক্তি থেকে উৎপন্ন আনন্দ সাধককে সাধনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে, তাই এক্ষেত্রে সাধককে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বা কষ্ট করে সাধনা করতে হয়না।

 সাধনার আনন্দই নেশার মত সাধককে সাধনায় ডুবিয়ে রাখে।

 ভক্তিপথে জোর করে ইন্দ্রিয়দমন করতে হয়না। কারণ ভক্তের জাগতিক উদ্দীপনাগুলির অভিমুখ ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ভক্তিযোগে। 

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষা দেন কামকে ঈশ্বরীয় প্রেমে পরিণত করতে, ক্রোধকে আধ্যাত্মিক তেজে পরিণত করতে।

ভক্তরাজ প্রহ্লাদ প্রার্থনা করছেন, 'হে প্রভু বিষয়ী লোকের যেমন জাগতিক ভোগ্যবিষয়ে তীব্র আসক্তি, তোমার প্রতি আমার সেইরূপ আসক্তি দাও।'

- এই হল ভক্তের প্রার্থনা। 

মহর্ষি নারদ বলছেন : 

'সা তস্মিন পরম প্রেমরূপা।' --- ঈশ্বরের প্রতি পরম প্রেম বা অনুরক্তিই হল ভক্তি। 

ঈশ্বর-বিরহে ক্রন্দন, তাঁর সান্নিধ্য লাভের জন্য জপ-ধ্যান, সেবা , পূজা প্রভৃতি হল ভক্তির সাধন।

 আমাদের মধ্যে যে শারীরিক ভোগবাসনা, বিষয় বাসনা, ক্ষুদ্র আসক্তি এইসব রয়েছে; এগুলো আমাদের স্বরূপের ওপর আচ্ছাদন ফেলে দেয়। নিজেকে চিনতে দেয়না। এগুলোই আমাদের বহির্মুখী করে রেখে দেয়।

 কিন্তু আমাদের স্বরূপ রয়েছে অন্তরে। ভক্তিযোগে ঈশ্বরের প্রতি প্রবল ভালোবাসার শক্তিতে আমরা এই জাগতিক আসক্তি জনিত বন্ধন অতিক্রম করতে পারি।

ভক্তের কান্না ঈশ্বরের অদর্শন জনিত ব্যাথা থেকে আসে। ভক্তের ঈশ্বর সেবা ও পূজা শুধু মাত্র ঈশ্বরের স্মরণ-মনন জনিত আনন্দের জন্যে। ভক্তের সমস্ত দেহ মন প্রাণ ঈশ্বরের জন্যে নিবেদিত।

ভক্ত আসক্তি ত্যাগ করেননা, শুধু সেই আসক্তিকে ঈশ্বরের অভিমুখী করে দেন।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : 'এমনি মিষ্টি খেলে অসুখ হয়, কিন্তু মিছরির মিষ্টি মিষ্টির মধ্যে নয়।'

 ঠিক তেমনি কামনা-বাসনা ঈশ্বরীয় পথের প্রতিবন্ধক, কিন্তু 'ভক্তি-কামনা' কামনার মধ্যে নয়।

ভক্তিপথে জাগতিক আসক্তিকে ঈশ্বরীয় প্রেমে রূপান্তরিত করতে হয়। ঈশ্বরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভয়মুক্ত হতে হয়।  

শ্রীম (মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত) বলতেন, 'সর্বদা বাপ-মা ওয়ালা ছেলের মতো নির্ভয়ে থাকো।'

 এভাবেই ভক্ত ঈশ্বরে শরণাগতির মাধ্যমে জাগতিক ভয় ও দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে এক আনন্দঘন জগতে বিরাজ করেন।

অর্থাৎ সর্বদা সর্বভাবে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থাকাই ভক্তিপথের সাধনা।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ শেখাচ্ছেন একটি পাত্র থেকে আরেকটি পাত্রে তেল ঢাললে যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে তেলের ধারা পতিত হয় , তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরের স্মরণ-মনন করতে হয়। খুব সহজ উপমা দিয়ে তিনি বোঝাচ্ছেন : যেমন যার দাঁতে ব্যাথা হয়েছে সে সব কাজ করে, সবার সাথে কথা বলে; কিন্তু মনটি সর্বক্ষণ ওই ব্যাথার দিকে পড়ে থাকে। ঠিক তেমনি সব অবস্থায় ভক্ত নিজেকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত রাখেন। 

সর্বদা ইষ্টের স্মরণ ভক্তের স্বাভাবিক অবস্থা। কোনও প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদে যেমন সর্বদাই সেই মানুষটিকে মনে পড়ে, ঠিক তেমনই ভক্ত সর্বদা ইষ্টস্মরণে নিয়োজিত না থেকে পারেন না। তিনি সংসারে থাকেন, সব কাজ করেন কিন্তু অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রিয়তমের রূপ ও তাঁর নাম সর্বদাই স্মরণপথে উদিত হয়। 

স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ইষ্টমন্ত্র তাঁর মনে উচ্চারিত হয়ে চলে। ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন প্রাণপণে কোনও অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে, ভক্তও তেমনি ইষ্টের নাম ও রূপকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করেন।

ক্রমে তাঁর নিজের সকল জাগতিক সত্তা ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে, মুছে যায় সকল পার্থিব কামনা বাসনা দুঃখ সুখ। তখন কেবল ঈশ্বর বিরহে তাঁর কষ্ট, ঈশ্বরীয় আবেশে তাঁর সুখানুভব। তখন তাঁর জগৎ কেবলই ইষ্টময়, ঈশ্বরময়।তখন তাঁর থাকেনা কোনও জাগতিক পরিচয়। কেবল 'আমি ঈশ্বরের অংশ', 'আমি তাঁর চরণাশ্রিত দাস' -- এই পরিচয়টুকুই অবশিষ্ট থাকে।

এই অবস্থাই হ'ল

'পাকা আমি'। 

আর পরাভক্তির নামে  'আমিত্বরহিত' এই উচ্চস্তরের মিথ্যা অনুকরণ হ'ল 'পাকামি'।

❉✤❉✤❉§§§§§¥¥¥¥¥¢¢¢¢¢$$$$$

No comments:

Post a Comment