সংস্কৃত 'কৃ' ধাতু থেকে কর্ম শব্দের উৎপত্তি। এই কর্ম শব্দের অর্থ হল কিছু কাজ করা। শারীরিক বা মানসিক সব ধরনের কাজ করা কর্ম। এই কর্মের সাথে কর্মফলের একটি কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করে। সৎ কর্মের ফল পুন্য এবং অসৎ কর্মের ফল পাপ বলে আমাদের ধারনা।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে স্বজন বধের আশঙ্কায় বিষন্ন অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্ধত বা উদ্বুদ্ধ করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ২ প্রকার কর্মের কথা বলেছেন। প্রথমত সকাম কর্ম ও দ্বিতীয়ত নিষ্কাম কর্ম। ফল আকাঙ্ক্ষা সহ কর্ম হল সকাম কর্ম এবং ফল আকাঙ্ক্ষা বর্জিত যে কর্ম তা হলো নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্ম যেমন কর্মফল সঞ্চয় করে না, তেমনি আবার সঞ্চিত কর্মফলকেও বিনষ্ট করে। নিষ্কাম কর্মে কোনো বাসনা না থাকায় কোন ফল ভোগ থাকে না। নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করে অর্থাৎ ফলাফলের চিন্তা না করে কামনা, বাসনা শূন্যভাবে অর্থাৎ নিষ্কাম ভাবে নিজে ও বুদ্ধিকে পরমাত্তা ঈশ্বরের বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করে কর্ম সম্পাদন করলে সংসার থেকেই মুক্তি লাভ করতে পারে।
অবার নিষ্কাম কর্ম হল অহং মুক্ত বা অকাঙ্খাহীন কর্ম, কোন ফলাফল ছাড়া সম্পাদিত কর্ম এবং মুক্তির কর্মযোগ পথের কেন্দ্রীয় নীতি। এটি ভগবত গীতার কেন্দ্রীয় বার্তা হিসাবে সুপরিচিত। অর্থাত যে কর্ম স্বার্থযুক্ত থাকে তাকে সকাম কর্ম আর যে কর্ম স্বার্থবর্জিত তাহাই নিষ্কাম কর্ম।
ভগবত গীতার নিষ্কাম কর্মের ফলাফল সম্বন্ধে বলা হয়েছে ..... শরীর দিয়ে, মন , বুদ্ধি দিয়ে, এমনকি নিছক ইন্দ্রিয় দিয়ে যোগীরা আসক্তি ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধির কাজ করে। যিনি যোগে শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মফল ত্যাগ করেন, তিনি স্থির শান্তি লাভ করেন।
যে কর্মের ফল আকাঙ্ক্ষা নেই, ফল ভোগ নেই, সেই কর্মই নিষ্কাম কর্ম। আর যে কর্মে ফল আকাঙ্ক্ষা আছে, ফলভোগ আছে, বাসনা আছে, সেই কর্মই সকাম কর্ম। প্রসঙ্গত গীতার নিস্কাম কর্মকে কর্মযোগ বলা হয়েছে।
তবে স্বাভাবিকভাবেই সংশয় হতে পারে যে নিস্কাম কর্ম কি উদ্দেশ্যবিহীন? কিন্ত উদ্দেশ্য ছাড়া কোনও কর্ম করা যায় না। নিষ্কাম কর্ম যদি উদ্দেশ্যবিহীন হয় তবে এই কর্মের অনুষ্ঠান অসম্ভব। তাহলে এর উত্তর যে নিষ্কাম কর্ম উদ্দেশ্যবিহীন নয়। সকাম কর্মের মত নিষ্কাম কর্মেরও উদ্দেশ্য থাকে। পার্থক্য হল, সকাম কর্মের উদ্দেশ্য হল বিষয়াশক্তি, যা জীবের বন্ধনের কারন। অপরদিকে নিষ্কাম কর্মের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বর। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যঞ্জরূপে কর্ম সম্পাদন করলে সেই কর্ম নিষ্কাম হয়।
কিন্ত নিস্কাম কর্ম করব কি ভাবে ? গীতায় নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানকে এক প্রকার কৌশল বলা হয়েছে। এই কৌশল হল :: যোগস্থ হয়ে কর্ম করতে হবে। কর্মফলে অধিকার ত্যাগ করতে হবে। তাই গীতায় বলা হয়েছে :: যোগস্থ কুরু কর্মাণি । কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, কর্ম করার কুশলতাই হল যোগ শব্দের অর্থ। মনে রাখতে হবে ঈশ্বর এই জগতের স্রষ্টা, প্রতিপালক ও পরিচালক। মানুষ হল সৃষ্ট জীব। মানুষের সত্তা ঈশ্বরে আশ্রিত। মানুষের কর্ম ঈশ্বর দ্বারা পরিচালিত। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী মানুষ কর্ম করে। মানুষ যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনিই আমাদের কর্মের কর্তা। আমরা নিমিত্ত মাত্র। তারই উদ্দেশ্যে কর্ম করতে হবে । কিন্ত মূঢ় ব্যাক্তি অহংকার বশে মনে করে যে আমিই সব। তাই অহংবোধ ত্যাগ করে ঈশ্বর প্রীতির জন্য বা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কর্ম সম্পাদন করতে হবে।
বিবেকানন্দও নিষ্কাম কর্মের অনুশীলনের কথা বলেছেন। কর্মফলের প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করে আনাসক্তভাবে কর্ম সম্পাদনই নিষ্কাম কর্মের অর্থ। আসক্তি বর্জনের দুটি পথ রয়েছে। একটি হল কর্মফল ঈশ্বরে সমার্পন করা। গীতা এইরূপ নিষ্কাম কর্মের প্রচার করে। দ্বিতীয় পথের অনুসারী ব্যক্তিরা বলেন নিজের ইচ্ছাশক্তি, মনের শক্তি ও বিচার বিশ্লেষণ অনুযায়ী কর্ম করলে কর্ম অনাসক্ত হয়। অনাসক্ত কর্ম কর্ম জগতের মঙ্গল সাধন করে। জীবনকে মহৎ করে। মহৎ ব্যক্তিরা জগতের মঙ্গলের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন।
এই নিষ্কাম কর্ম সংসারের মধ্যে থেকে দু ভাবে হয়ে থাকে। এক অনাগ্রহ ভাবে , অপরটি অনাসক্ত ভাবে। অনাগ্রহ ভাবে কাজ করলে এর মধ্যে একটা বিতৃষ্ঞা ভাব জড়িয়ে থাকে। তখন সবসময়ই মনে হয় এই কাজটা করে আমি তো কোনো কিছু পাবো না। তাই যখন কাজটা করতেই হবে, তখন কোনো রকমে সেরে ফেলি। কিন্ত অপরদিকে অনাসক্ত ভাবে কাজ করার মধ্যে নিজের একটা স্বাধীনতা লুকিয়ে থাকে। সেই কাজটার দ্বায়িত্বভাব নিজে নিয়ে , চারদিক দেখে শুনে কাজগুলির সমস্ত খুটিনাটি নিজেই আগ্রহভরে সেরে ফেলি। যেমন পূজো করবার সময় নিজের ইচ্ছামতন যতটা পারি যোগারযন্ত্র করে থাকি, ইচ্ছামতন ঠাকুর সাজানো, মন্ত্র উচ্চারণ জোরে না আস্তে ....... সব কিছুই যিনি পূজো করেন তার উপর নির্ভর করে। কিন্ত এসবের পিছনে কোনও চাওয়া পাওয়ার থাকে না। জীবনে আধ্যাত্মিক পথে কিছুটা এগোলেই এগুলি করা সম্ভব। তাই জীবনকে আধ্যাত্মিক করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ সংসার দৃষ্টি ত্যাগ করে ব্রহ্মদৃষ্টির অনুসন্ধান করার চেষ্টা........ এক কথায় যে দৃষ্টির দ্বারা মানুষ সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পাবে, ঈশ্বরের কৃপা অনুভব করতে পারবে, তবেই সে আসল ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারবে।
ভগবান শ্রী কৃষ্ণ সকাম কর্মের কতগুলি উন্নতির জন্য সকাম ও নিষ্কাম কর্মের পৃথক পৃথক (সকাম এবং নিস্কাম কর্মের মধ্যে পার্থক্য) উল্লেখ করেছেন –
১) সকাম কর্মে নানা আয়োজন প্রয়োজন হয় বলে তা অনেক জটিলতায় পূর্ণ , এজন্য কর্মটি অনেক ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ থাকে এবং ওই অসম্পূর্ণতার জন্য কর্মকর্তাকে ভীত থাকতে হয়, বিনাশের ভয় এবং প্রাননাশের ভয় ইত্যাদি। কিন্তু নিষ্কাম কর্মে কর্মটি আংশিকভাবে নিস্পন্ন হলেও ফল আকাঙ্খিত না থাকার জন্য বিভিন্ন ভয় থেকে মুক্তি থাকে।
২) সকাম কর্মের ক্ষেত্রে যাগ-যঞ্জ তপস্যাদি শেষ না হলে তা চালু হয়। কাজটি পুনরায় আরম্ভ করতে হয়। কৃষি কর্মাদি ও উচ্চবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে বন্ধ হয় এবং কাজটি পুনরায় আরম্ভ করতে হয়। কিন্তু নিষ্কাম কর্মে কখনো কখনো দেখা যায় না এবং সেই কর্মের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই তা কখনো ব্যার্থ হতে পারে না।
৩) সকাম কর্ম কেবলমাত্র ব্যার্থ না হয়, তা অঞ্চল বিশেষে পাপের কারণও হয়। অপরের সম্পদ অন্যায় ভাবে অধিকারের জন্য যে প্রবঞ্চনামূলক, প্রতারণামূলক কর্ম তা পাপের কারণ হয়। নিষ্কাম কর্মে আকাঙ্ক্ষা আর্থাৎ ফলাকাঙ্ক্ষা না থাকায় সেই কর্ম কখনো প্রতারণামূলক হতে পারে না এবং পাপের কারণও হয় না।
৪) সকাম কর্মে শক্তি বহির্মুখী হওয়ায় প্রকাশ-বাসনার অন্ত থাকে না। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধিকে পরমাত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করার ফলে সেই জ্ঞান নিশ্চয়াত্মক ও একনিষ্ঠ হয়ে থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না। ফলে নিষ্কাম কর্মে-বাসনাও থাকে না।
৫) সকাম কর্মের ক্ষেত্রে সমস্ত রকম কর্ম স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং স্বপক্ষে কর্মে সম্পাদিত হয়। অন্যদিকে নিষ্কাম কর্ম হলো এমন কর্ম যা সকল প্রকার স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকে এবং ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করা হয়।
৬) সকাম কর্ম মূলত আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। অর্থাৎ এইরূপ কর্মে আকাঙ্ক্ষা থাকে, চাহিদাও থাকে। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে এরূপ কোন চাহিদা থাকে না। অর্থাৎ তা সমগ্রভাবে আকাঙ্ক্ষা মুক্ত এবং যেখানে কোনও রূপ কামনার জায়গা থাকেনা।
উপসংহার হিসেবে বলা যায় ... কর্ম হল এমন একটা বিষয় যার মধ্যে ভালো এবং মন্দ উভয়েরই স্থান রয়েছে। তাই কামনা বাসনা দ্বারা ঘটিত কর্ম এবং কামনা বাসনা বর্জিত কর্ম, এই দায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সকাম ও নিষ্কাম কর্মের পার্থক্য করা যায়। কিন্ত সর্বপরি নিষ্কাম কর্মেই হল শ্রেষ্ঠ যা সকাম কর্মের থেকে ভিন্ন এবং উৎকৃষ্ট।
