Saturday, 19 October 2024

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দূর্গাপূজো

 

ঐতিহ্য রক্ষায় তরবারি পুজো......

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি দূর্গাপূজোয় 

পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা শহর থেকে আট কি. মি. পূর্বে শিলাবতী অববাহিকায় সবুজ গাছপালায় ভরা মঙ্গলাপোতা গ্রাম। এখানেই রয়েছে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে এই রাজবাড়ি একদা ছিল রাজাদের আমোদ প্রোমদের  বাগানবাড়ি। এটি নির্মাণ করেছিলেন বগড়ীর রাজা ছত্র সিংহ এবং শোনা যায় যে তিনিই  র্প্রচলন করেছিলেন দূর্গাপূজোর। তৎকালীন বগড়ী পরগনার শেষ স্বাধীন রাজা তিনি ছিলেন। প্রায় ৪০০ বছর আগে সেই দূর্গাপূজো আজও চলে আসছে মঙ্গলপোতা রাজবাড়ির  দূর্গাপূজো নামে।  আবার এও শোনা যায় যে এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন গজপতি সিংহ৷ তবে এই বংশের নবম রাজার  নামও ছিল গজপতি সিংহ। ইনিও মঙ্গলপোতাতে দেবী দুর্গার আরোধনা আরম্ভ করতে পারেন। ইতিহাস বলে বা আঞ্চলিক অধিবাসীদের  বিশ্বাস এখানে যে ঘটটি আছে,  সেই ঘটটি  বাস্তবে গড়বেতার মা সর্বমঙ্গলার ঘট। ছত্র সিংহ ঘটটি জোর করে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেটা আর ফেরত দিয়েছিলেন না। আর সেই দেবী সর্বমঙ্গল ঘট এখানে পুঁতে তিনি দূর্গাপূজোর প্রচলন করেছিলেন। ঘট পোতা হয়েছিল বলে এই জায়গার নাম মঙ্গলপোতা। এও জানা যায় যে বিষ্ণুপুরের রাজা মল্লরাজ খয়েরমল্ল  দেবী সর্বমঙ্গলার এই ঘট একবার নিয়ে যান। সামসের জং বাহাদুর, রাজা ছত্র সিংহের পাশে দাড়িয়ে যুদ্ধে খয়েরমল্লকে পরাজিত করে এই ঘট আবার উদ্ধার করে আনেন। 






পূজোর ১৫ দিন আগে দেবীর ঘট স্থাপন করা হয়। আগে পূজার মন্ডপ  ছিল মাটির। ছাউনি ছিল টালির ও টিনের। কাঠের ছিল দরজা। এখন স্থায়ী মন্ডপ হয়েছে। রয়েছে পূর্বকার পঞ্চমুন্ডির আসন। বারান্দায় রয়েছে ৬টি প্রকান্ড থাম। আর ভিতরে একই রকম চারটি থাম। মণ্ডপে ভিতরে বাঁদিকে রয়েছে এক উই এর ঢিপি। শোনা যায় যে ষষ্ঠী থেকে নবমীর ভিতর যে কোনো দিন এক সাপ সেই ঢিপি থেকে বেড়িয়ে দেবীর কাছে এসে ঘোরা ফেরা করে। পরে আবার নিজে থেকে সেই ঢিপির ভিতর ঢুকে যায়। এই পূজোর বৈশিষ্ট্য হল প্রচীন রীতি মেনে  দূর্গাপূজোর ঐতিহ্য বজায়  রাখা। এই পুজোতে ৪টি তরবারি পুজো করা হয়। রাজাদের বীরত্বের প্রতীক হিসেবে তরবারীগুলোকে পুজো করা হয় দেবীর সামনে রেখে।  জিতাষ্টমীর দিন প্রথম তরবারী, দ্বিতীয় তলবারি পূজো হয় মহালোয়ার দিন, তৃতীয় তরবারি পুজো ষষ্ঠীর দিন, আর সপ্তমীর দিন পূজো করা হয় সবচেয়ে বড় চতুর্থ তলবারিটি। তৎকালীন উড়িষ্যার বীরযোদ্ধা সামসের জং বহাদুর ছিলেন মা কালীর এক পরম সাধক এবং সাধনাবলে তিনি এই তরবারি পেয়েছিলেন। বিশ্বাস  তরবারি মন্ত্রপূত ছিল। এই তরবারি দিয়ে তিনি বিষ্ণুপুরের রাজা খয়েরমল্লকে যুদ্ধে পরাজিত করে মা সর্বমঙ্গলার আসল  ঘট উদ্ধার করেন। অন্য তিনটি  তরবারি কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউ-এর মন্দিরে রাখা আছে। রাধাকৃষ্ণ, নারায়ন, সর্বমঙ্গলা ও দূর্গা ছাড়াও  এই তরবারিগুলি রোজদিন পুজো করা হয়। দূর্গাপূজোর সময় এই সব তরবাড়ি মূল মন্ডপে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের ও অন্য ভক্তদের দৃঢ় বিশ্বাস যে বড়ো তরবারিটি কালী মা। প্রতি দূর্গার সপ্তমীর দিন ও কালীপুজোর দিন দুমিটার করে চার মিটার লাল শালু কাপড় দিয়ে তরবারিটি জড়ানো হয়। পুরোনো লাল শালু কাপড়টি ফেলে দেওয়া হয় না। তার উপর এই লাল শালু কাপড় জড়ানো হয়। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল যে এটি মোটা হয়ে যাওয়ার কথা কিন্ত মোটা হয় না, একই রকম আছে।





ষষ্ঠীর দিন হোম থেকে, যাগযঞ্জ এবং চন্ডীপাঠ শুরু হয়। যঞ্জকুন্ডে অবিরাম ২৪ ঘন্টা এই কয়দিনে কাঠ জ্বলতে থাকে। কিন্ত অবাক লাগে যে প্রাচীন কালের সেই দূর্গাপূজোর শুরু থেকে সেখান থেকে যঞ্জের কাঠ পুড়ে ছাই হলেও কোনদিন ছাই পরিস্কার করা হয়নি অথচ গর্তটি ছাই-এ ভর্তিও  হয়নি। প্রতি বছর নতুন করে দেবী বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এখানে এক চালায় দেবীর পূজো হয়। প্রাচীন কালে এখানে নরবলি হত। যাকে বলি দেওয়া হতো সে কোথা থেকে আসতো বা কিভাবে দেবীর পিছনে এসে বসে থাকতো তা কেউ জানতে পারতো না।  এখন আর সে সব নেই। এখনও সপ্তমী ও সন্ধি পুজোতে ছাগ বলি হয়। কিছু বছর আগে পর্যন্ত মোষ বলি হত। এখন আর মোষ বলি দেওয়া হয় না। কেননা মোষ বলির পর, তার মাংস আদিবাসীরা এসে প্রসাদ হিসেবে নিয়ে যেত। এখন তারা আর আসে না, আর তার জন্য মোষ বলিও বন্ধ গেছে। 




এই পূজোয় নিয়মবিধি মেনে সবকিছু অনুষ্ঠান করাটা মুখ্য।  সুপ্রাচীন কালে যে নিয়ম ছিল তা আজও মেনে চলা হচ্ছে। দূর্গাপূজোয় এখানকার ঘট স্থাপনের সময় যে তোপধ্বনি হয়, সেই ধ্বনি শুনে গড়বেতাতে দেবী সর্বমঙ্গলার পূজো আরম্ভ হয়।  আবার গড়বেতার মা সর্বমঙ্গলার  পূজোর তোপধ্বনি শুনে গোয়ালতোড়ে দেবী সনকা মায়ের পূজো আরম্ভ হয়ে থাকে।  প্রায় ৪০০ বছর ধরে ঐতিহ্যের এই পরম্পরা রক্ষা হয়ে চলেছে।  একটি বারের জন্য তা লঙ্ঘন হয়নি।





১৯৮০ সালে এই রাজবাড়ির অদূরেই জঙ্গল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল যশোবন্ত সিংহের নাম খোদাই করা তিনটি কমান । দুইটি ব্রোঞ্জের ও একটি লোহার।  এগুলিকে কলকাতার প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির সেই বনেদিয়ানা আজ আর নেই। নেই সেই আভিজাত্য।  সেইসঙ্গে হারিয়েছে দূর্গাপূজোর জৌলুস।  ভগ্নপ্রায় অবস্থা রাজবাড়ির।  পলেস্তরা খসে পড়েছে।  রয়েছে চূনসুড়কির গাঁথা মোটা মোটা দওয়াল ওয়ালা দালান কোঠা।  বহু দূর দূর থেকে একসময় মানুষ আসত এই পূজো দেখতে ও আনন্দ করতে।  পূজা মন্ডপ বা ঐ রাজবাড়ি এলাকা গম্ গম্  করতো।  চলত যাত্রা , থিয়েটার, নাটক।  বসতো বাউল গান বা কীর্তনের আসর। এখন ঐ রাজবাড়ি এলাকায় এক ছোট্ট মেলা বসে। এখন রাজবাড়ির বংশধর হিসেবে রয়েছেন শ্রী অরবিন্দ সিংহ এবং তার ভাইয়েরা।  তারাই পূজো করেন।  আর্থিক সংকটের জন্যই পূজো নিষ্প্রভ হয়ে পরেছে। তবে গ্রামের বা আশেপাশের মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।  এই ভাবেই মঙ্গলাপোতার এই সুপ্রাচীন গৌরবময় দূর্গাপূজো নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও টিকে রয়েছে। 



খুব সহজেই এখানে আসা যায়।  ট্রেনে বা বাসে বা গাড়ীতে এখানে আসতে পারেন।  ট্রেনে আসতে হলে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস বা অরন্যক এক্সপ্রেসে এসে নামতে হবে গড়বেতা স্টেশনে। আর আছে প্রচুর বাস কলকাতা বা হাওড়া থেকে গড়বেতা আসার জন্য।  গড়বেতা থেকে অটো বা যে কোনো গাড়ী ভারা নিয়ে আসা যেতে পারে মঙ্গলাপোতা গ্রামে। গাড়ী নিয়ে এলে আরামবাগ--গড়বেতা--ধাদিকা মোড় হয়ে সহজেই পৌঁছানো যায় মঙ্গলাপোতায়।  যদি কেউ রাত্রে থাকতে চান তবে গড়বেতায় ছোটোখাটো লজ আছে। এছাড়া চন্দ্রকোনা রোডে ভালো থাকার জায়গা আছে।


Tuesday, 15 October 2024

দূর্গোতিনাশিনীর আরোধনায় কুমারীপূজা

 

শুদ্ধাত্মা কুমারী ...........বিশ্বজননী ভগবতীর আর এক রূপ  


সাধারণত   পূজা হয় কোনো না কোনো দেব দেবীর। আর সব পূজাই উপাসনা পদ্ধতিতে থাকে। সেখানে ঘট বা প্রতিমা দেব-দেবীর প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। অনেকক্ষেত্রে চিত্রপট ব্যবহার করা হয়। কিন্ত দুর্গাপুজোর সময় কুমারী পুজো নিয়ে একটা প্রশ্ন জাগে......কুমারী বালিকা আবার পুজনীয় হয় কি? কুমারীতো পার্থিব একজন। তার আবার পুজো কেন?এ কি দুর্গা নাকি ছোটো  দুর্গা হিসেবে  পুজো করা হয়?

কুমারী পূজার দার্শনিক তথ্যে সেখানে বলা হয়েছে...... পরমার্থ ও দর্শন নারী পরমার্থ অর্জন। এই বিশ্বে প্রতিনিয়ত সৃস্টি, স্থিতি ও লয় সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিশক্তি বীজকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী প্রতিক ও বীজ। এই ভাবনায় ভাবিত হতে দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্ত্রীকে ষোড়শী ঞ্জানে পুজো করতেন। 

 কুমারী পূজার শুরু ঠিক কবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যোগীনিতন্ত্র নারী কুমারী দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে দেবীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে....... হে দুর্গা, তুমি নারী ও কুমারী। আমরা কাত্যায়নকে জানার জন্য তোমার ধ্যান করছি। আপনি আমাদের প্রেরণা প্রদান করেন।  যোগীনিতন্ত্রে কুমারী পূজা সম্পর্কে উল্লেখ আছে...... ব্রহ্মাশাপবশে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ঞুর তপস্য মহাকালী সন্তুষ্ট হন৷ দেবী সন্তোষষ্টি মাত্র বিষ্ণুর পদ্ম হতে "কোলা" নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেব গণকে পরা করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও আদিদেব দেবীর স্তব শুরু করেন। দেবগণের স্তবে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, “হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবন্ধবে বধ করিব ৷ অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বদ করেন এবং------সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবীগন সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারী অর্চনা করেন। কথিত  আছে, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তৃতীয় পান্ডব অর্জুন কুমারী পুজো করেন।

শিশুকন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করার এক সুক্ষ্ম নিদর্শন রয়েছে 'বৃহদ্ধর্ম পুরাণ'-এ। সেখানে আছে, রাম কর্তৃক রাবন বধের জন্য   দেবতারা  ব্রহ্মার  কাছে যজ্ঞ করার জন্য অনুমতি চাইলে ব্রহ্মা দেবীকে জাগরিত করার কথা উল্লেখ করেন। দেবতারা তখন আদ্যাশক্তির স্তব করেন। সেই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে এক কুমারী দেবী আবিভূত হয়ে দেবীর বোধন করে পূজা করার নির্দেশ দেন।

সেই নির্দেশমতো ব্রহ্মা দেবতাদের  সঙ্গে পৃথিবীতে এসে  ঘুরতে ঘুরতে এক নির্জন স্থানে বেলগাছের একটি পাতায়  সোনার বরণ এক শিশুকন্যাকে নিদ্রিত দেখে 'সোনাবিশ্বপ্রসবিনী জগজ্জননী মহামায়া'  বলে স্তব করেছিলেন । ব্রহ্মার সেই স্তবেই শিশুকন্যা জাগরিত হয়ে দেবীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং দেবতাদের অভীষ্ট পূরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

 শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারী পুজোর কথা উল্লেখ আছে। এছাড়াও প্রাচীন শাস্ত্র ও বই থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমের কুমারী পুজোর উল্লেখ করা যায়। সুদূর অতীতের কুমারী পূজার প্রচলন ছিল এবং তার ব্যবহার পাওয়া যায় "কুমারী পূজাদি আবেদন" বইয়ের পুথি থেকে। আর লেখা থেকে অনুমান করা কঠিন নয় দেবীর কুমারীর নাম অনেক পুরানো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরানো, তার আরাধনা ও পূজার ঘটনা আচরনও প্রাচীন।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর প্রথম কুমারী পুজো করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণের সময়। এক  মুসলমান মাঝির শিশুকন্যাকে কুমারী হিসেবে পুজো করেন স্বামীজি। যা দেখে তার মানসকন্যা নিবেদিতা সহ তার অন্যান্য পশ্চাত্য শিষ্যও  বিস্মিত হন। প্রব্রাজক হিসেবে উত্তরপ্রদেশের রায়বাহাদুর গগনচন্দ্রের শিশুকন্যা মণিকা রায়কে কুমারী রুপে পুজো করেন। ১৮৯৮ সালের অক্টোবরে কাশ্মীরের ক্ষীরভবানীতে কুমারীপূজো করেন।  ক্ষীরভবানী কাশ্মীরের এক অতি প্রাচীন দেবীপীঠ। স্বামীজি এই সময় প্রায় একাকীই থাকতেন এবং ক্ষীরভবানীর প্রথা অনুযায়ী পূজা করে "পায়েস"  নিবেদন করতেন।   ১৯০১ সালে যখন তাঁর হাতে বেলুড় মঠে দুর্গা পুজো শুরু হয়, তখন নয়জন কুমারী এক সঙ্গে পুজিত হন। তবে এখন শাস্ত্রীয় রীতি মেনে একটি কুমারীকে পুজো করা হয়।

বিশেষত দুর্গাপুজোর অংশ হিসাবে কুমারী পূজা করা হয়।এছাড়াও কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপূজা, অন্নপূর্ণা পূজা এবং কামাখ্যাই কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী দেবী মন্দিরে ও কুমারীতে মহা ধুমধামে কুমারী পূজা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে কুমারীপুজো ছাড়া হোম- যঞ্জ করে দুর্গাপুজোর সম্পূর্ন ফল পাওয়া যায় না। সাধারণত দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে কুমারী পুজো করা হয়। তবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নমবী ---- এই তিনদিনই বা নিয়মনীতি অনুসারে কুমারী পূজো করা যেতে পারে।

পুরোহিতদর্পন গ্রন্থে কুমারী পুজোর পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য সবিস্তারে লেখা রয়েছে। বলা হয়েছে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্নভেদ নেই। দেবী , এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত সুলক্ষণ যে কোনো কুমারী পূজনীয়। তবে সাধারন ব্রাহ্মণ কুমারী নারী পুজাই সর্বাত্মক। তবে এ কথা বলা যাবে না যে ব্রাহ্মণ্যই কেবলমাত্র পূজ্য।


পুরাতন ক্রমানুসারে পূজা কাল এই সকল কুমারীদর বিভিন্ন প্রকারের নামে  অভিহিত করা হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন  পুজোয় বিভিন্ন ফল লাভ করা যায়। তবে দুই থেকে দশ বছর কুমারী হওয়া ভালো।

[১] এক বছরের   নারী কুমারীকে সন্ধ্যা  বলা হয়েছে। [২] দুই বছর বয়সী কুমারীকে সরস্বতী বলে ডাকা হয়। পূজার ফল :-: দুঃখ ও দারিদ্র কাটানোর জন্য, ভাগ বৃদ্ধির জন্য, ছাত্র ওনা ও আয়ু বৃদ্ধির জন্য। [৩] তিন বছর বয়স্ক কুমারীকে ত্রিমূর্ত্তি বলা হয়েছে। পূজার ফল :÷: পুত্র সন্তান, বিদ্যা ও বুদ্ধির জন্য এবং সব ধরনের মনস্কামনা পূরণের জন্য। [৪] চার নারী কুমারীকে কালিকাগ্রাম   নির্দেশ করা হয়। কথিত আছে রাজসুখ প্রাপ্তি, অত্যন্ত জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই পুজো থেকে। [৫] পাঁচ বছর পুরানো কুমারীকে সুতাপা বলে   নামকরণ করা হয়। বলা হয়, সমস্ত রোগমুক্তির জন্য এবং সব ক্ষেত্রে জয় লাভের জন্য এঁর পুজো ফলপ্রদ৷  [৬]  ছয়  বছর বয়সী কুমারীকে  উমা ডাকা হয়। জয়ের জন্য এবং সবার প্রিয় পূজার জন্য এঁর জো করা হয়। [৭] সাত বছর পুরানো কুমারী মালিনীগ্রাম  পরিচিত। প্রকৃত ধনসম্পদ ও মান সন্মান লাভের জন্য এঁর পুজো হয়ে থাকে । [৮] আট বছর  কুমারীকে কুঞ্জিকা আখ্যা দেওয়া হয়েছে।  ঝগড়ার অবসান ও সিদ্ধিলাভের আশায় এঁর পূজো করা হয়।  [৯] নয় বছর নারী কুমারীকে কলিসংমা  বলা হয়েছে।  কঠিন থেকে  কঠিনতর মমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এঁর পূজো হয়ে থাকে। [১০] দশ বছরের কুমারীকে অপরাজিত ডাকা হতে পারে।   অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এঁর পূজার আয়োজন।      [১১] এগারো বছরের কুমারীর নাম রুদ্রাণী । [১২] বরো রছর কুমারী হলে  ভৈরবী    ডাকা হয়। [১৩] তেড় বছরের পুরনো কুমারীর নাম হবে মহালক্ষী । [১৪] চোদ্দ বছরের কুমারীর  নাম পাঠক । [১৫] পনেরো বছরের কুমারীকে এলাকাঞ্জা মনে হবে। [১৬] ষোল বছরের পুরনো কুমারীর  নাম অন্নদা বা অন্য রাষ্ট্রে অম্বিকা নাম হবে।

পুজোর আগে কুমারী কে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়। ফুলের গয়না দিয়ে অঙ্গ সাজানো হয়। পা ধোয়ানো হয়।  পায়ে আলতা ও কপালে সিঁদুরের টিপ দেওয়া হয়। কুমারীকে দেবী জ্ঞানে উপচারে পুজো করা হয়। পূজারী ও ভক্তগণ কুমারীর মধ্যে দেবীকে অভিবাদন করে। কুমারীর মধ্যে মাতৃ ধর্মকে পুজো করা হয়। সাধারণ মনের পশুত্ব নাশ করতেই এই পুজো। ১৬ টি উপকরণ ব্যবহার করা হয়। পাঁচ উপকরণ দিয়ে কুমারীকে পুজো করা হয়। 


কুমারী,  মহিলা দেবী... কালীতন্ত্রে। কুমারীর চরণ ধুয়ে দিয়ে কেশর ও তিল দিয়ে ভক্তিপূর্বক পুজোতে অসুর, বিরুদ্ধ গ্রহ, ভূত, পিচাশ, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, দেবীগন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, সকলে  প্রীত ও প্রসন্ন হন।

নিয়ম পূর্বক কুমারীপূজা নাশ করে বিঘ্ন, ভয় ও শত্রু। রোগ আরগ্য হয়। শান্ত ও প্রসন্ন এই পুজো, বিরুদ্ধ ও রুষ্ট গ্রহদি শুভ ফলদান করে। মানুষ সম্মান, ভূমি, লক্ষ্মী, বিদ্যালাভ করেন। মহাতেজ প্রাপ্তি হয়। অপ্রত্যাশিত দৈবপাত, দুঃস্বপ্ন, অমৃত্যু ব্যক্তি মানুষের সমস্ত দুঃখদায়ক দূর হয় কুমারী পূজার সময়।

শক্তিপীঠে কুমারী পূজার ফল অশেষ। যেকোনও জাতির কুমারী পুজো করা বাধা নেই। তন্ত্রের কথায়, কুমারী পূজায় জাতিভেদ বিচার করতে নেই। জাতিভেদে মানুষ নরকগামী হয়।

জাগতিক সমস্ত দুঃখ দারিদ্র ও শত্রু এবং শক্তি প্রাপ্তির জন্য কুমারী পুজো সর্বোত্তম। কুমারী পূজার ফলে অপ্রাপ্তি পূরণ করেন দেবতারা। তবে এক নারীপূজোর ফল, শত কুমারী পুজো ফল একই, তারতম্য নেই। 

ব্যবস্থায় বলা হয়েছে, কুমারী পুজো স্বয়ং ভগবতী প্রসন্ন হন। যেখানে কুমারী পুজো হয়, সেখানেই ভগবতীর নিবাস। সেইজন্য কুমারীকে মান্য করা হয় ভগবতীতে। যে রাজরূপ রূপক পুজোর দেবীকে নৈবেদ্য ও ভোজনে তৃপ্ত করে, সে ত্রিলোক তৃপ্ত করে