Tuesday, 15 October 2024

দূর্গোতিনাশিনীর আরোধনায় কুমারীপূজা

 

শুদ্ধাত্মা কুমারী ...........বিশ্বজননী ভগবতীর আর এক রূপ  


সাধারণত   পূজা হয় কোনো না কোনো দেব দেবীর। আর সব পূজাই উপাসনা পদ্ধতিতে থাকে। সেখানে ঘট বা প্রতিমা দেব-দেবীর প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। অনেকক্ষেত্রে চিত্রপট ব্যবহার করা হয়। কিন্ত দুর্গাপুজোর সময় কুমারী পুজো নিয়ে একটা প্রশ্ন জাগে......কুমারী বালিকা আবার পুজনীয় হয় কি? কুমারীতো পার্থিব একজন। তার আবার পুজো কেন?এ কি দুর্গা নাকি ছোটো  দুর্গা হিসেবে  পুজো করা হয়?

কুমারী পূজার দার্শনিক তথ্যে সেখানে বলা হয়েছে...... পরমার্থ ও দর্শন নারী পরমার্থ অর্জন। এই বিশ্বে প্রতিনিয়ত সৃস্টি, স্থিতি ও লয় সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিশক্তি বীজকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী প্রতিক ও বীজ। এই ভাবনায় ভাবিত হতে দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্ত্রীকে ষোড়শী ঞ্জানে পুজো করতেন। 

 কুমারী পূজার শুরু ঠিক কবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যোগীনিতন্ত্র নারী কুমারী দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে দেবীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে....... হে দুর্গা, তুমি নারী ও কুমারী। আমরা কাত্যায়নকে জানার জন্য তোমার ধ্যান করছি। আপনি আমাদের প্রেরণা প্রদান করেন।  যোগীনিতন্ত্রে কুমারী পূজা সম্পর্কে উল্লেখ আছে...... ব্রহ্মাশাপবশে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ঞুর তপস্য মহাকালী সন্তুষ্ট হন৷ দেবী সন্তোষষ্টি মাত্র বিষ্ণুর পদ্ম হতে "কোলা" নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেব গণকে পরা করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও আদিদেব দেবীর স্তব শুরু করেন। দেবগণের স্তবে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, “হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবন্ধবে বধ করিব ৷ অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বদ করেন এবং------সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবীগন সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারী অর্চনা করেন। কথিত  আছে, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তৃতীয় পান্ডব অর্জুন কুমারী পুজো করেন।

শিশুকন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করার এক সুক্ষ্ম নিদর্শন রয়েছে 'বৃহদ্ধর্ম পুরাণ'-এ। সেখানে আছে, রাম কর্তৃক রাবন বধের জন্য   দেবতারা  ব্রহ্মার  কাছে যজ্ঞ করার জন্য অনুমতি চাইলে ব্রহ্মা দেবীকে জাগরিত করার কথা উল্লেখ করেন। দেবতারা তখন আদ্যাশক্তির স্তব করেন। সেই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে এক কুমারী দেবী আবিভূত হয়ে দেবীর বোধন করে পূজা করার নির্দেশ দেন।

সেই নির্দেশমতো ব্রহ্মা দেবতাদের  সঙ্গে পৃথিবীতে এসে  ঘুরতে ঘুরতে এক নির্জন স্থানে বেলগাছের একটি পাতায়  সোনার বরণ এক শিশুকন্যাকে নিদ্রিত দেখে 'সোনাবিশ্বপ্রসবিনী জগজ্জননী মহামায়া'  বলে স্তব করেছিলেন । ব্রহ্মার সেই স্তবেই শিশুকন্যা জাগরিত হয়ে দেবীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং দেবতাদের অভীষ্ট পূরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

 শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারী পুজোর কথা উল্লেখ আছে। এছাড়াও প্রাচীন শাস্ত্র ও বই থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমের কুমারী পুজোর উল্লেখ করা যায়। সুদূর অতীতের কুমারী পূজার প্রচলন ছিল এবং তার ব্যবহার পাওয়া যায় "কুমারী পূজাদি আবেদন" বইয়ের পুথি থেকে। আর লেখা থেকে অনুমান করা কঠিন নয় দেবীর কুমারীর নাম অনেক পুরানো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরানো, তার আরাধনা ও পূজার ঘটনা আচরনও প্রাচীন।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর প্রথম কুমারী পুজো করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণের সময়। এক  মুসলমান মাঝির শিশুকন্যাকে কুমারী হিসেবে পুজো করেন স্বামীজি। যা দেখে তার মানসকন্যা নিবেদিতা সহ তার অন্যান্য পশ্চাত্য শিষ্যও  বিস্মিত হন। প্রব্রাজক হিসেবে উত্তরপ্রদেশের রায়বাহাদুর গগনচন্দ্রের শিশুকন্যা মণিকা রায়কে কুমারী রুপে পুজো করেন। ১৮৯৮ সালের অক্টোবরে কাশ্মীরের ক্ষীরভবানীতে কুমারীপূজো করেন।  ক্ষীরভবানী কাশ্মীরের এক অতি প্রাচীন দেবীপীঠ। স্বামীজি এই সময় প্রায় একাকীই থাকতেন এবং ক্ষীরভবানীর প্রথা অনুযায়ী পূজা করে "পায়েস"  নিবেদন করতেন।   ১৯০১ সালে যখন তাঁর হাতে বেলুড় মঠে দুর্গা পুজো শুরু হয়, তখন নয়জন কুমারী এক সঙ্গে পুজিত হন। তবে এখন শাস্ত্রীয় রীতি মেনে একটি কুমারীকে পুজো করা হয়।

বিশেষত দুর্গাপুজোর অংশ হিসাবে কুমারী পূজা করা হয়।এছাড়াও কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপূজা, অন্নপূর্ণা পূজা এবং কামাখ্যাই কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী দেবী মন্দিরে ও কুমারীতে মহা ধুমধামে কুমারী পূজা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে কুমারীপুজো ছাড়া হোম- যঞ্জ করে দুর্গাপুজোর সম্পূর্ন ফল পাওয়া যায় না। সাধারণত দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে কুমারী পুজো করা হয়। তবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নমবী ---- এই তিনদিনই বা নিয়মনীতি অনুসারে কুমারী পূজো করা যেতে পারে।

পুরোহিতদর্পন গ্রন্থে কুমারী পুজোর পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য সবিস্তারে লেখা রয়েছে। বলা হয়েছে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্নভেদ নেই। দেবী , এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত সুলক্ষণ যে কোনো কুমারী পূজনীয়। তবে সাধারন ব্রাহ্মণ কুমারী নারী পুজাই সর্বাত্মক। তবে এ কথা বলা যাবে না যে ব্রাহ্মণ্যই কেবলমাত্র পূজ্য।


পুরাতন ক্রমানুসারে পূজা কাল এই সকল কুমারীদর বিভিন্ন প্রকারের নামে  অভিহিত করা হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন  পুজোয় বিভিন্ন ফল লাভ করা যায়। তবে দুই থেকে দশ বছর কুমারী হওয়া ভালো।

[১] এক বছরের   নারী কুমারীকে সন্ধ্যা  বলা হয়েছে। [২] দুই বছর বয়সী কুমারীকে সরস্বতী বলে ডাকা হয়। পূজার ফল :-: দুঃখ ও দারিদ্র কাটানোর জন্য, ভাগ বৃদ্ধির জন্য, ছাত্র ওনা ও আয়ু বৃদ্ধির জন্য। [৩] তিন বছর বয়স্ক কুমারীকে ত্রিমূর্ত্তি বলা হয়েছে। পূজার ফল :÷: পুত্র সন্তান, বিদ্যা ও বুদ্ধির জন্য এবং সব ধরনের মনস্কামনা পূরণের জন্য। [৪] চার নারী কুমারীকে কালিকাগ্রাম   নির্দেশ করা হয়। কথিত আছে রাজসুখ প্রাপ্তি, অত্যন্ত জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই পুজো থেকে। [৫] পাঁচ বছর পুরানো কুমারীকে সুতাপা বলে   নামকরণ করা হয়। বলা হয়, সমস্ত রোগমুক্তির জন্য এবং সব ক্ষেত্রে জয় লাভের জন্য এঁর পুজো ফলপ্রদ৷  [৬]  ছয়  বছর বয়সী কুমারীকে  উমা ডাকা হয়। জয়ের জন্য এবং সবার প্রিয় পূজার জন্য এঁর জো করা হয়। [৭] সাত বছর পুরানো কুমারী মালিনীগ্রাম  পরিচিত। প্রকৃত ধনসম্পদ ও মান সন্মান লাভের জন্য এঁর পুজো হয়ে থাকে । [৮] আট বছর  কুমারীকে কুঞ্জিকা আখ্যা দেওয়া হয়েছে।  ঝগড়ার অবসান ও সিদ্ধিলাভের আশায় এঁর পূজো করা হয়।  [৯] নয় বছর নারী কুমারীকে কলিসংমা  বলা হয়েছে।  কঠিন থেকে  কঠিনতর মমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এঁর পূজো হয়ে থাকে। [১০] দশ বছরের কুমারীকে অপরাজিত ডাকা হতে পারে।   অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এঁর পূজার আয়োজন।      [১১] এগারো বছরের কুমারীর নাম রুদ্রাণী । [১২] বরো রছর কুমারী হলে  ভৈরবী    ডাকা হয়। [১৩] তেড় বছরের পুরনো কুমারীর নাম হবে মহালক্ষী । [১৪] চোদ্দ বছরের কুমারীর  নাম পাঠক । [১৫] পনেরো বছরের কুমারীকে এলাকাঞ্জা মনে হবে। [১৬] ষোল বছরের পুরনো কুমারীর  নাম অন্নদা বা অন্য রাষ্ট্রে অম্বিকা নাম হবে।

পুজোর আগে কুমারী কে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়। ফুলের গয়না দিয়ে অঙ্গ সাজানো হয়। পা ধোয়ানো হয়।  পায়ে আলতা ও কপালে সিঁদুরের টিপ দেওয়া হয়। কুমারীকে দেবী জ্ঞানে উপচারে পুজো করা হয়। পূজারী ও ভক্তগণ কুমারীর মধ্যে দেবীকে অভিবাদন করে। কুমারীর মধ্যে মাতৃ ধর্মকে পুজো করা হয়। সাধারণ মনের পশুত্ব নাশ করতেই এই পুজো। ১৬ টি উপকরণ ব্যবহার করা হয়। পাঁচ উপকরণ দিয়ে কুমারীকে পুজো করা হয়। 


কুমারী,  মহিলা দেবী... কালীতন্ত্রে। কুমারীর চরণ ধুয়ে দিয়ে কেশর ও তিল দিয়ে ভক্তিপূর্বক পুজোতে অসুর, বিরুদ্ধ গ্রহ, ভূত, পিচাশ, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, দেবীগন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, সকলে  প্রীত ও প্রসন্ন হন।

নিয়ম পূর্বক কুমারীপূজা নাশ করে বিঘ্ন, ভয় ও শত্রু। রোগ আরগ্য হয়। শান্ত ও প্রসন্ন এই পুজো, বিরুদ্ধ ও রুষ্ট গ্রহদি শুভ ফলদান করে। মানুষ সম্মান, ভূমি, লক্ষ্মী, বিদ্যালাভ করেন। মহাতেজ প্রাপ্তি হয়। অপ্রত্যাশিত দৈবপাত, দুঃস্বপ্ন, অমৃত্যু ব্যক্তি মানুষের সমস্ত দুঃখদায়ক দূর হয় কুমারী পূজার সময়।

শক্তিপীঠে কুমারী পূজার ফল অশেষ। যেকোনও জাতির কুমারী পুজো করা বাধা নেই। তন্ত্রের কথায়, কুমারী পূজায় জাতিভেদ বিচার করতে নেই। জাতিভেদে মানুষ নরকগামী হয়।

জাগতিক সমস্ত দুঃখ দারিদ্র ও শত্রু এবং শক্তি প্রাপ্তির জন্য কুমারী পুজো সর্বোত্তম। কুমারী পূজার ফলে অপ্রাপ্তি পূরণ করেন দেবতারা। তবে এক নারীপূজোর ফল, শত কুমারী পুজো ফল একই, তারতম্য নেই। 

ব্যবস্থায় বলা হয়েছে, কুমারী পুজো স্বয়ং ভগবতী প্রসন্ন হন। যেখানে কুমারী পুজো হয়, সেখানেই ভগবতীর নিবাস। সেইজন্য কুমারীকে মান্য করা হয় ভগবতীতে। যে রাজরূপ রূপক পুজোর দেবীকে নৈবেদ্য ও ভোজনে তৃপ্ত করে, সে ত্রিলোক তৃপ্ত করে

2 comments:

  1. শ্রী শচীবিলাস রায়ের মন্তব্য.....

    খুবই informative.
    অনেক অজানা জিনিষ জেনে, সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete