নদী ভূ-পৃষ্ঠে প্রবাহিত হয়। কিন্তু কোন কোন সময় নদীর প্রবাহ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে হঠাৎই ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সাধারণত চুনাপাথর-গঠিত অঞ্চলে এরকম হতে পারে। চুনাপাথরের সচ্ছিদ্রতা ও প্রবেশ্যতা বেশি (চুনাপাথর জলে দ্রবীভূত হয়) বলে নদী চুনাপাথর-গঠিত অঞ্চলে এ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভূ-অভ্যন্তরে প্রবাহিত সেই নদীকে বলে অন্তঃসলিলা বা ফন্তু চুনাপাথর-গঠিত অঞ্চল পার হয়ে নদীটি নির্বারিণীরূপে পুনরায় ভূ-পূষ্ঠে আত্মপ্রকাশ করে।
আগে জেনে নিই ফল্গু নদীর উৎপত্তির কথা
গয়ায় দেখতে পাওয়া ফল্গু নদী কেন অন্তঃসলিলা? রামায়ণের কাহিনীটি ছাড়াও এই নদীর অন্তঃসলিলা হওয়ার আর ব্যাখ্যা কি?
রামায়ন "একরকম গল্প" বলে মানি। ওটাকে "ইতিহাসের রেফারেন্স" হিসেবে ধরা যায়।
রামায়নের সময়ও নিশ্চয় ফল্গু এরকম অন্তসলিলা ই ছিল। তাই ওই অভিশাপের গল্প লেখা হয়েছে।
কিন্তু একটু খোঁজ করলেই বৈজ্ঞানিক বা ভৌগলিক কারণ জানা যাবে।
আর একবার বলি প্রশ্নে উল্লেখিত "রামায়ানের কারণ" কিন্তু শুধুই একটা গল্প কথা বা পৌরাণিক চরিত্র মহিমান্বিত করা। ওটা কোনো কারণ নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে যে ফলগু এরকম, তার একটা প্রমান।
💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧💧
প্রকৃত কারণ
বিহারের গয়া এর ৫ কিমি দক্ষিণে দুটি ঝর্নার মিলিত ফল হলো এই ফল্গু। ঝর্না দুটির নাম লিলাজান আর মোহনা, যেগুলো উৎপন্ন হয়েছে হাজারীবাগ মালভূমির (ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ) করাম্বে পাহাড় থেকে।
বর্ষার জলে পুষ্ট : লিলাজান আর মোহনা দুটোই বর্ষার সময় পাহাড়ের জল বয়ে নিয়ে গিয়ে ফল্গুতে দেয়।
বেশি বর্ষাতে ফল্গুতে বন্যাও হয়, কিন্তু অন্য সময় সামান্য ঝর্নার জল ই আসে যা খুবই কম। তাই প্রবাহ নেই। আমাদের চারপাশের অনেক নদীর হাল ও একই। তাই ওপরে জল থাকেনা বর্ষা ছাড়া।
বালুময় মাটির উপস্থিতি: এই অঞ্চলের মাটি বালুকাময় এবং মোটা দানার যা জল শুষে নিতে পারে খুব তাড়াতড়ি।
এবার দেখুন বালুময় মাটির গুন
এই কারণে যে অল্প পরিমাণ জল ঝর্না থেকে আসে, টা শোষিত হয় নদীর বালুকাময় মোটা দানার মাটির ফাঁক দিয়ে।
কিন্তু সামান্য হলেও ধারাবাহিক প্রবাহ থাকায় এই শোষিত জল একটু নিচেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই জলের সরবরাহ বেড়ে গেলে অবশ্যই জল ওপর দিয়েই বইবে। বর্ষা তে যেমন হয় সেরকমই।
ঝর্নার প্রবাহ থেকে খুব কম জল আসে সেটা আগেই বললাম। কিন্তু শুধু ঝর্নার জলের ব্যাপার হলে হয়তো একটু বেশি খু৺ড়লে তবেই জল আসতো। কিন্তু একটু খু৺ড়লেই জল পাওয়ার আর একটা খুব বড়ো কারণ আছে।
দূষণ: হ্যাঁ। ফল্গু নদীতে পাশাপাশি এলাকার নর্দমার জল ফেলা হয় (বা হতো)। সেই জল ও ফল্গুর বালুকাময় মাটির একটু নিচেই জলের উৎসের কাজ করে থাকে।
এই জল খুবই দূষিত যা এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলকেও দূষিত করে চলেছে সমানভাবে।
এই হল প্রকৃত কারণসমূহ।
এবার পৌরাণিক কাহিনী কি বলছে......
বনবাসে রাম, সীতা, লক্ষণ বেশ অনন্দেই কাটাচ্ছেন। এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মৃত পিতা দশরথের শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করার জন্য তারা সকলে ফল্গু নদীর পবিত্র তীরে উপস্থিত হলেন। নদী তীরে সীতাকে বসিয়ে রেখে রাম, লক্ষণ গেলেন শ্রাদ্ধের প্রুয়োজনীয় জিনিস জোগার করতে। সীতা নদীতীরে বসে বালু নিয়ে আনমনে খেলা করতে লাগলেন। এদিকে সময় অতিক্রান্ত হতে লাগল। কিন্ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ড ও জলদান করতে হবে ___ একথা শ্রীরাম বিস্মৃত হলেন। হঠাৎ সীতা দেখলেন রাজা দশরথ দুহাত প্রসারিত করে তাঁর কাছে পিন্ড ও জল চাইছেন।সীতা জোড়হাতে তাকেঁ একটু আপেক্ষা করতে বললেন, কেননা , তাঁর স্বামী পিন্ডদানের জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অল্প সময়ের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছেন। কিন্ত দশরথ জানালেন তিনি ক্ষুধার্ত। এখনই জলদান দরকার। সীতা জানালেন ___" পিতা আপনি কেন বিদেহী অবস্থায়? নদীতীরে বালু ছাড়া আর কিছুই তো নেই। তিনি জলদান করবেন কি দিয়ে ?? দশরথ জানালেন---- " পুত্রী, আমি অমৃতলোকে স্থান পেয়েছি। সেখানে জেনেছি তুমি স্বয়ং দেবী হরিপ্রিয়া কমলা। তোমাকেই আরাধনা করে বণিকগন। তুমি সম্পদ, ঐশ্বর্যের দেবী। তোমার কৃপায় ভিখারীও সম্রাট হতে পারে। পুত্রী সীতা, তুমি আমাকে বালি দ্বারা পিন্ড প্রদান কর। আমি তোমার পিন্ড প্রাপ্তি করে তৃপ্ত হব। তুমি আমার কাছে রামের সমান।" সীতা নিরুপায় হয়ে অঞ্জলি পূর্ণ করে বালুকারাশি নিবেদন করলেন। দশরথও আনন্দচিত্তে তা গ্রহন করে ফিরে গেলেন। কিন্ত এই ঘটনা তার কাছে এক সমস্যার সৃষ্টি করল। রাজা দশরথ যে পিন্ড গ্রহন করেছেন এবং সেই পিন্ড কেবল বালি দিয়ে পূর্ণ ----- একথা তাঁর পুত্ররা বিশ্বাস করবেন কি ? তাই তিনি পিন্ড দানের ঘটনাটির সাক্ষী রাখলেন । সাক্ষী রইল পাঁচজন _____ ফাল্গুনী নদী, অক্ষয় বট, এক ব্রাহ্মণ, তুলসী গাছ ও গাভী।
এর পরে রাম নদীতটে উপস্থিত হলেন। সীতার হাতে বালি দেখে--- সীতা বালি নিয়ে খেলা করছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। সীতা তাকে সমস্ত ঘটনা জানালেও রাম বিশ্বাস করলেন না । তাই রাম সমস্ত উপকরন দিয়ে আবার পিতৃপুরুষকে পিন্ড গ্রহনের জন্য আহ্বান করলেন। কিন্ত পিতা দশরথসহ কেউ-ই সেই পিন্ড গ্রহনের জন্য এগিয়ে এলেন না। সীতা আবার পিন্ড দানের কথা জানালেন এবং বললেন " শ্বশুর মহাশয় আমাকে দেখা দিয়ে আমার কাছে বালুকার পিন্ড ও জল চাইছিলেন। তাই তিনি দিয়েছেন। " রামচন্দ্র শুনে বললেন --- " পিতা কেন পুত্রবধুর কাছে পিন্ড চাইবেন? এই ঘটনার প্রমাণ কি ? এই ঘটনার সাক্ষী কে ? " তখন সীতা ফল্গু নদী, ব্রাহ্মণ, তুলসি গাছ, বট গাছ ও গাভীকে দেখিয়ে সেই পাচঁজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন। কিন্ত হায়, অক্ষয় বট ছাড়া কেহই সত্যকথা জানালেন না। এমত অবস্থায় রাম দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে আবার পূর্বপুরুষদের আহ্বান করলে আকাশমার্গে তাঁদের কন্ঠে উচ্চারিত হল " জনকনন্দনী সীতার কাছ থেকে আগেই আমরা পিন্ড গ্রহন করেছি। আবার কেন তুমি আমাদের আহ্বান করছ।সীতা যে পিন্ড দান করেছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। " এবার রাম সীতার কথায় বিশ্বাস করলেন। কিন্ত সীতার মন ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠল এই ভেবে যে তিনি পাঁচজনকে সাক্ষী রেখেছিলেন তারা কেউ -ই তাকে মান্য করল না। ক্রদ্ধ সীতার মুখ থেকে অভিশাপ বাক্য উচ্চারিত হল। ব্রাহ্মণকে শাপ দিলেন " ঘরে যতই দ্রব্য থাকুক , ব্রাহ্মণ তবুও ভিক্ষা বা চেয়ে বেড়াবে। তীর্থ ক্ষেত্রে থেকেও কখনও তুষ্টি হবে না, লোভী বলে সকলে চিহ্নিত করবে। আর এই অভিশাপ কলিযুগে আরও প্রভাবশালী হবে। " তিনি গাভীকে বললেন " কেউ তোমার মুখের দিকটি পূজো করবে না "। তুলসীকে অভিশাপ দিলেন " তুমি হরির পাদপদ্মে থাকো, অথচ তোমার মুখে এমন অসত্য বচন। আমি যদি সত্য হই তবে আমার অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলবে। তোমাকে এই বলে শাপ দিলাম যে নারায়ণের পদচিহ্ন ধারণ করে এই তীর্থে পবিত্র হলেও এই তীর্থের কোথাও তোমার স্থান হবে না।" এরপর সীতাদেবী ফল্গু নদীকে জিজ্ঞেস করলেন ------ বলো নদী, তুমি তো দেখেছ যে আমার শ্বশুরের আত্মা এখানে এসেছিলেন। আমার কাছে পিন্ড চেয়েছিলেন। আমি দিয়েছি। রঘুনাথকে সব সত্য বল। ফল্গু উত্তরে বলল ----- জানকী দেবী, আপনি কেন রঘুনাথের সামনে অসত্য বলছেন। আমি পবিত্র নদী। এই গয়াধামে আমার জলে সকলে পিন্ড দেয়। আমি কিভাবে মিথ্যা বলি। এখানে স্বর্গীয় রাজা দশরথের আত্মা আসেননি। আর আপনিও পিন্ড দেননি। এই কথা শুনে সীতা ক্রোধে ফেটে পরলেন। তিনি ফল্গু নদীকে অভিশাপ দিলেন " বিষ্ণুর কৃপায় তোমার জলে এই তীর্থে পিন্ড দান সম্পন্ন হয়। কিন্ত আজ থেকে এই গয়া তীর্থেই তুমি অন্ত:সলিলা হবে।" এবার বট বৃক্ষকে বললেন ----- বাছা বট, তুমি সত্যি বলো, নাহলে স্বামী ভাববেন আমি অসত্য বলছি। তুমি বল যে এখানে আমি আমার শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বালি দিয়ে পিন্ড দিয়েছি। বট একথার ভক্তিভরে উত্তর দিল ------ মা, প্রভু অন্তর্যামী। তিনি সব জানেন। তবুও আমি বলছি ---- আমি দেখেছি আপনার শ্বশুর তথা শ্রীরামচন্দ্রের পিতা স্বর্গীয় রাজা দশরথের আত্মা এখানে এসে আপনাকে পিন্ড দিতে বলেছিলেন। আপনি বালুকা দ্বারা পিন্ড দিয়েছেন। আমি এই ঘটনার সাক্ষী। সত্য সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন একমাত্র এই অক্ষয় বট। তাই সীতা তাকে বললেন "আজ থেকে এই তীর্থে এসে যে অক্ষয় বটের তলায় পিন্ডদান করবে তার পূর্বপুরুষ অর্চনা সার্থক হবে। তোমায় আশীর্বাদ করি , তুমি চিরজীবি ও অক্ষয় হও।"এই জন্য দেখা যায় যে বট বৃক্ষের ঝুড়ি যেখানে নামে , সেখানে অপর গাছ হয় । বট বৃক্ষ তলে দেবতারা থাকেন। সাধনার উপযুক্ত যে বৃক্ষ গুলি আছে তাদের মধ্যে বট একটি। অপরদিকে দশরথের আত্মা রামসীতাকে দেখা দিলেন। বললেন ----- পুত্র রাম, আমি সীতা প্রদত্ত বালুকার পিন্ড তৃপ্তির সাথে নিয়ে প্রসন্ন হয়েছি। আমিই সীতাকে এরূপ আদেশ করেছিলাম। " রাম সীতা দশরথকে প্রনাম জানালেন।
বোধগয়াতে এই ফল্গু নদীর শাখাই "নিরাঞ্জনা" বা "নৈরঞ্জনা" নামে খ্যাত। এই নদীর পাশেই কঠোর তপস্যায় মগ্ন হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বেশ কয়েক বছর ধরে কঠোর সাধনার পর তিনি একদিন এই নৈরাঞ্জনা নদীতে স্নান করে সুজাতা নামে এক নারীর কাছ থেকে এক পূর্ণ পাত্র পায়েস গ্রহন করে আবার সাধনায় বসে সিদ্ধিলাভ করেন। সুতরাং বৌদ্ধদের কাছেও এই ফল্গু নদী অত্যন্ত পবিত্র রূপে পূজিত হয়। কিন্ত সীতার অভিশাপে সেই দিন থেকে ফাল্গুনী বা ফল্গু নদীর স্রোত মাটির তলায় বহমান। উপর থেকে দেখা যায় শুধুই বালুকারাশি। ফল্গু, ফাল্গুনী বা নৈরাঞ্জনা যে নামেই ডাকি না কেন , এই নদীর উপস্থিতি ভিন্নরকম। নদী একাধারে পুণ্যতোয়া অপরদিকে অভিশপ্ত। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে এই নদীর গুরুত্ব অসীম।












