Sunday, 24 July 2022

টুকরো টুকরো

 

$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$

*************************************

$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$

মা আদ্যাপীঠ কালীমাতা

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য অন্নদা ঠাকুরের হাত ধরেই দক্ষিণেশ্বরের অদূরেই তৈরি হয় আদ্যাপীঠ। কোনও শাক্ত পীঠ নয়। আদ্যাশক্তি মহামায়ার বিগ্রহেই ফুল-চন্দন পড়ে নিয়মিত। ভোগও হয়। তবে অন্য দিনের থেকে একটু আলাদা আয়োজন কালীপুজোর দিন। সেদিন মহাপুজোর আয়োজন হয় আদ্যা মন্দিরে। কার্তিক অমাবস্যার আঁধার কাটিয়ে, দীপাবলির আলোয় সেজে ওঠে গোটা আদ্যাপীঠ। আদ্যাশক্তি মহামায়া। দেবীর আরাধনায় তো নিজের জীবন উত্‍সর্গ করে ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে ভবতারিণীর সংসারেই, গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়। জনশ্রুতি, শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশেই সংসার ছেড়ে দক্ষিণেশ্বরের অদূরেই আড়িয়াদহে আদ্যাপীঠ নির্মাণে ব্রতী হন অন্নদাঠাকুর। নির্দেশ ছিল, বারো বছরের মধ্যে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হলেই মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ অবাধ থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। তাই নাট মন্দির থেকেই দর্শন করতে হয় দেবীকে। শীর্ষে রাধাকৃষ্ণ, তারপর আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং দেবীর নীচে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। এভাবেই সাজানো মূল মন্দিরের কক্ষ। ভোগেও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাধাকৃষ্ণের জন্য সাড়ে বত্রিশ সের চালের রান্না হয়। দেবীর জন্য সাড়ে বাইশ সের চাল বরাদ্দ। এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্য সাড়ে বারো সের চালের রান্না হয়। এ ব্যবস্থা প্রতিদিনের। মূল মন্দিরের নির্মাণেও বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। মন্দিরের চূড়ায় সর্ব ধর্মের প্রতীক ব্যবহৃত। আছে হিন্দু ধর্মের ত্রিশুল, বৌদ্ধ ধর্মের পাখা, খ্রীষ্ট ধর্মের ক্রুশ এবং ইসলাম ধর্মের চাঁদ-তারা। জনশ্রুতি, এমন ভাবনা স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী। দেবী যে সর্বজনীন।


আদ্যাপীঠ মন্দির।

অন্নদা ঠাকুরের হাত ধরেই তৈরি হয় তিন চূড়োওয়ালা তিন ধাপে গড়া আদ্যাপীঠ মন্দির। প্রথম ধাপে শ্রী রামকৃষ্ণ, দ্বিতীয় ধাপে আদ্যামায়ের মূর্তি আর তৃতীয় ধাপে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। সনাতন পদ্ধতিতে এখানে প্রতিদিনের পূজা সম্পন্ন হয় এবং ভোগ নিবেদন করা হয়। তারপর আশীর্বাদকৃত ভোগ সমস্ত দর্শনার্থীদের প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়। মন্দিরে সকাল সন্ধ্যায় আরতি হয়। মায়ের দর্শন পেতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা ভিড় জমান এখানে ।

ভোগ নিতে চাইলে মন্দিরে গিয়ে ৫০ টাকার বিনিময়ে আগে কুপন কেটে নিন। কুপন দেয়া হয় সকাল ৯ টা থেকে। প্রসাদ পাওয়ার সময় ১১:৪৫। কুপন কেটে নাট মন্দিরে বসে পুজো দেখে নিন। এরপর একে একে ঘুরে নিন আদ্যাপীঠ মহাকাল মন্দির, মার্বেলের শিবলিঙ্গ , রাধা কৃষ্ণ মন্দির, দূর্গা মন্দির ইত্যাদি।

আদ্যাপীঠ অফিসের পাশেই আছে একটি বইএর দোকান। পেয়ে যাবেন আদ্যাপীঠের জন্মরহস্য সম্পর্কিত ও আরো অনেক বই।

এরপর প্রসাদ পাওয়ার ঘরে কুপন দেখিয়ে ভিতরে গিয়ে বসে পড়ুন। ভোগ বা প্রাসাদ গরম গরম পরিবেশন করা হয়। আমরা অনেক কে দেখলাম প্রসাদ নিয়ে নষ্ট করতে। খুব খারাপ লাগলো। তাই অনুরোধ করবো ভোগ নষ্ট করবেন না please .

এবার আসি কি ভাবে যাবেন। ট্রেনে এলে দক্ষিণেশ্বর স্টেশনে নেমে আদ্যাপীঠ যাওয়ার অটো পেয়ে যাবেন। এছাড়া বাসে ও আসতে পারেন। বাস থেকে নেমে দক্ষিণেশ্বর স্টেশন চলে আসুন। এখান থেকেই আদ্যাপীঠের অটো পাবেন। এছাড়া নিজের গাড়ি নিয়ে ও আসতে পারেন। মন্দির কমিটির নিজস্ব parking আছে।




=================================

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ভক্তির সঙ্গে যুক্তি না থাকলে ভক্তি কোনওদিন সার্থক হতে পারে না ৷ তিনি বলতেন, নৌকা জলে ভাসে, নৌকাকে ডাঙায় ভাসানো যায় না ৷ কিন্তু নৌকার মধ্যে যদি কোনওভাবে জল ঢুকে যায়, তাহলে নৌকা ডুবে যায় ৷ নৌকাকে জলে ভাসালেই  নৌকার প্রয়োজন সিদ্ধ হয় , কিন্তু নৌকায় জল ঢোকার পথ বন্ধ রাখতে হবে ৷ তেমনি, আমাদের সংসারে থাকতেই হবে ৷ সংসারের বাইরে কোথায় যাব ? কিন্তু  ' সংসার ' যেন আমাদের মধ্যে না থাকে ৷

' সংসার ' মানে হচ্ছে আসক্তি ৷ সংসারের সকল কাজেই  নিজেকে জড়িয়ে রাখব,  কিন্তু খেয়াল রাখব যেন সংসার আমাকে আসক্ত করতে না পারে ৷ শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, কাঁঠাল ভাঙতে গেলে হাতে কাঁঠালের আঠা লেগে যায় ৷ তখন ওই আঠা লাগা হাতে আর কাঁঠাল ভাঙ্গা যায় না ৷

সেজন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন , কাঁঠাল ভাঙ্গার আগে হাতে তেল মেখে নাও ৷ 

এই তেল মাখা হচ্ছে কৌশল ৷

তিনি বলতেন, জলে নামলে কুমিরের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৷ কিন্তু গায়ে হলুদ মেখে জলে নামলে হলুদের গন্ধে কুমির কাছে আসতে পারে না ৷ ' গায়ে হলুদ মাখা ' মানে জীবনযাপনের একটি কৌশলী পদ্ধতি ৷

আমরা যদি আসক্তি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে যত্নবান হই, যদি আমরা বিবেক, আমাদের বুদ্ধিকে জাগ্রত রাখি, তাহলে সংসার জীবন আমাদের কাছে প্রতিনিয়তই যেমন সুখের ও শান্তির হয়ে ওঠে, তেমনি প্রতি মুহূর্তে নির্ভয়ে সংসারের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীনও হতে পারি অবলীলায় ৷

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা ঢেঁকিতে ধান থেকে চিঁড়ে কোটে ৷ চিঁড়ে কোটার সময়ে দেখা যায়, মেয়েরা এক হাত দিয়ে ঢেঁকির গর্তে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে হাত দিয়ে ধান থেকে আলাদা চিঁড়েকে গর্তের বাইরে তুলে নিয়ে আসে ৷  হয়তো আর এক হাতে বুকে শিশুকে দুধ খাওয়ায় , আবার খদ্দেরের সঙ্গে দেনা-পাওনার হিসেবও করে ৷ সবই চলছে, কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে হাতের ওপরে , যাতে ঢেঁকির মুষলটা হাতকে না থেতলে দেয় ৷ শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ঠিক এই ভাবে সংসারের সব কাজ কর, কিন্তু মনটি আলাদা করে রেখে দাও ভগবানের পারে ৷ সংসারে থেকেও ভগবানে মন দেওয়ার কি মোক্ষম উপমা ৷ এই প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পাঁকাল মাছের উপমাও দিতেন ৷ পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু একটুও পাঁক তার গায়ে লেগে থাকে না ৷

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, এখানেই জীবনযুদ্ধে সফল হওয়ার রহস্য শুধু তাই নয়, এই রহস্যকে রপ্ত করতে পারলে যেমন জীবনে শান্তি আসবে, তেমনই মনের শক্তিও বাড়বে ৷

                                    - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ

*"”"""""""""''''''''''"""""""""'''''''''''’'''""""'''''"*

*গুরুবাক্যে বিশ্বাস*

------------+++----------

আমরা কথামৃত বইতে বার বার পড়ি, "গুরুবাক্যেতে বিশ্বাস" -

এর মানে কি?

মানে হলো গুরুর দেওয়া প্রথম যে কথা কানে এসেছে তা হলো বীজ মন্ত্র, সেই মন্ত্রে বিশ্বাস করে জীবন পথে এগিয়ে যাওয়া।

শ্বাস প্রশ্বাসে বীজ মন্ত্র জপ করার অভ্যেস করতে হবে।

অফিসে কাজ করছি অথবা বাড়িতে রান্না, যেই একটু একলা হবো - মনে মনে জপ করবো।

জপ করতে হবে শুধু গুরু আদেশ করেছেন তাই জন্যে না। গুরুবাক্য কখনো বিপথে যেতে দেবে না -  এই বিশ্বাস, এর জোর রাখতে হবে। গুরু যখন মন্ত্র দিয়েছেন তাতে আমি ঠিক জীবতরীকে পার করতে পারবো,  ঝড়ঝাপটা যাই আসুক।

ঠাকুর বলেছেন - সাধু সঙ্গে মন  উচ্চ পথে এগোয়। 

প্রতিটি মানুষের ভেতরে সাধু আছে। তাই মঠ মিশনে আশ্রমে আমি যদি নাও যেতে পারি, আমার ভেতরে যে সাধু আছেন সেই শুভ বোধকে বার বার উজ্জীবিত করবো। আমি বার বার তাকে জাগিয়ে তুলবো। অশুভ কিছু করবো না, ভাববো না। কু থেকে মন কে বার বার সরিয়ে নেবো সু পথে। আমার ভেতরের সাধু-বোধ আমাকে বার বার conscious করবে, যাতে কু কথা শোনা বলা এবং ভাবা থেকে বিরত থাকি।

শ্রী রামচন্দ্রের অস্ত্র ছিল ধনুক। শ্রীকৃষ্ণের ছিল বাঁশি, 

নারায়ণের কাছে সুদর্শন চক্র রাখা যখন কৃষ্ণ দেখতেন অসুর এবং রাক্ষস বোধ কে নাশ করতেই হবে তখন আঙ্গুল চালিয়ে সুদর্শন চক্র কে ইউজ করতেন।

আর শ্রী রামকৃষ্ণের কি অস্ত্র ছিলো?

ঠাকুরের অস্ত্র ছিল প্রণাম।

যে গিরিশ চন্দ্র কাউকে কখনো নত হয়ে প্রণাম করেননি ঠাকুর যেই থাকে প্রণাম করলেন অমনি তিনি নত হতে শিখলেন। ঠাকুর সবাইকে প্রণাম করতেন। ভক্ত ভাগবত ভগবান সেই প্রণাম অস্ত্র দিয়েই তিনি শেখালেন জগৎকে যে নত হতে পারলে সবাই তার কাছে আনত হয়।


*গুরু  ও  দীক্ষা*


১৯৬৬ সালের ১০ আগস্ট। বিকাল ছটা। দিল্লী রামকৃষ্ণ মিশনের নাটমন্দিরের নিচের বড় হলঘরটিতে বেলুড় মঠের নতুন প্রেসিডেন্ট – শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের শুভ পদার্পণে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রচুর ভক্তসমাগমে হলে তিলধারণের জায়গা ছিল না। নির্দিষ্ট সময়ে উদ্বোধন-সঙ্গীতের পর পূজ্যপাদ প্রেসিডেন্ট মহারাজকে ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্য’ সম্বন্ধে বলতে অনুরোধ করা হলো। বক্তৃতাটি ছিল ইংরেজীতে। বক্তৃতা শেষে দিল্লি মিশনের সেক্রেটারি মহারাজ – স্বামী স্বাহানন্দজী বললেনঃ “Any question?”  প্রেসিডেন্ট মহারাজ জিজ্ঞাসা করছেন। “Please raise your hand”.  শ্রোতারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। এমন সময় সেক্রেটারি মহারাজ আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেনঃ “Yes Maharaj! That girl has a question”.  আমি অবাক! আমি তো হাত তুলিনি! স্বামী স্বাহানন্দজী বললেনঃ “Yes, yes! get up, you may ask in any language you want. (হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি উঠে দাঁড়িয়ে যে-কোন ভাষায় প্রশ্ন করতে পার।)” যন্ত্রচালিতের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার *প্রশ্ন ছিলঃ* “Can’t we progress in spiritual life without Diksha?”  (দীক্ষা ছাড়া কি আমরা অধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারি না?)

পূজ্যপাদ প্রেসিডেন্ট মহারাজ আমি কি পড়ছি জিজ্ঞাসা করলেন। এম. এ. পড়ছি শুনে কয়টি বিষয় আছে এবং প্রত্যেক বিষয়ের জন্য আলাদা অধ্যাপক নিযুক্ত আছেন কিনা জানতে চাইলেন। আমার উত্তর ছিলঃ “আটটা পেপার-এর জন্য আট জন অধ্যাপক আছেন”।

*মহারাজঃ* এখন তুমি দেখ, আলাদা আলাদা বিষয়ের জন্য তোমার আলাদা আলাদা অধ্যাপক আছেন! ঠিক সেরকম আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করতে হলে আধ্যাত্মিক গুরুর প্রয়োজন। ঈশ্বর ও তোমার মধ্যে যোগসূত্র যিনি স্থাপন করেন তিনি হলেন সদ্‌গুরু এবং ঈশ্বরকে ডাকবার যে সহজ উপায় মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে – তাকে বলে দীক্ষা। মা যেমন তার শিশুকে pet name (ডাক নাম) নিয়ে ডাকে”।

*প্রশ্নঃ* সদ্‌গুরু কেমন করে পাব? এবং তিনি যে সদ্‌গুরু তা বুঝব কেমন করে?

*মহারাজঃ* তুমি ভ্যাকুয়াম কথার মানে জান?

*উত্তরঃ* হ্যাঁ! ভ্যাকুয়াম হলো একটা শূন্যস্থান।

*মহারাজঃ* হ্যাঁ! এটা একটা শূন্যস্থান, যেখানে হাওয়া পর্যন্ত নেই। যখন সদ্‌গুরুর জন্য এরকম শূন্যস্থান কারও মনে তৈরি হয় গুরু স্বয়ং আসেন। যদি মনে কোন ফাঁকা জায়গা না থাকে, গুরু কোথায় বসবেন?


তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি স্পেলবাউন্ড (মুগ্ধ)! সমস্ত প্রশ্নের অবসান হলো। মহারাজ আমার মনের সংশয় তিরোহিত হয়েছে কিনা জানবার জন্য জিজ্ঞাসা করলেনঃ “Are you satisfied with my answer?” মাথা নেড়ে আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম। - প্রব্রাজিকা অচিন্ত্যপ্রাণা


জপের প্রণালী ও লক্ষণ

দীক্ষাকালে গুরু শিষ্যকে জপ-ধ্যানের প্রণালী বলে দেন যা অবশ্য পালনীয়। 

গুরুবাক্যে বিশ্বাস না হলে সাধক এগোতে পারে না। 


ধ্যান হওয়া বড় কঠিন। চিন্তাধারা মনের চঞ্চলতাহেতু কেটে কেটে যায়। তাই প্রথমে খুব করে জপ করে নিতে হয়। 


পুনঃপুনঃ নামের স্মরণের দ্বারা ভগবানকে বুদ্ধিতে ধরে রাখবার চেষ্টার নাম *জপযজ্ঞ*। 

ভগবান গীতায় বলেছেন : 

“যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোঽস্মি।”


পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মুখে একটি অভিযোগ—

“মন চঞ্চল। কী করব?”

শাস্ত্রের সরাসরি উত্তর : 

“অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশ কর।” 


শ্রীশ্রীমা বলতেন যে, 

১৫-২০ হাজার জপ প্রতিদিন করলে মন অবশ্যই শান্ত হয়। 


স্বামী শিবানন্দ একখানি পত্রে লেখেন (১৬/৬/১৯২২) : 

“মনকে স্থির করিবার একমাত্র প্রধান ও সহজ উপায় এই—

শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমূর্তির সম্মুখে বসিয়া তাঁহার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, তাঁহার নাম জপ করা এবং এই মনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা চাই যে, ঠাকুর তোমার দিকে দেখিতেছেন ও তুমি যে তাঁহার নাম জপ করিতেছ তাহা শুনিতেছেন এবং তোমায় কৃপা করিবার জন্য বসিয়া আছেন। 


এইরূপ করিলেই তোমার মন স্থির হইবে, প্রভুতে দৃঢ় বিশ্বাস হইবে এবং শান্তি পাইবে।”


ভগবানের নাম-জপ নানাভাবে করা যেতে পারে—যেমন 'বাচনিক' অর্থাৎ শব্দ উচ্চারণ করে, 

'উপাংশু' বা আস্তে আস্তে শব্দ উচ্চারণ করে যা কেবল জাপকের কর্ণগোচর হয়, এবং 'মানসিক'। 


কেউ মালা বা কর সহযোগে সংখ্যা রেখে জপ করেন। কেউ বা চক্রে চক্রে (ষট্‌চক্র ধরে) জপ করেন। অপরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জপ করেন। 


শাস্ত্র বলেন, মানুষ অহরহ অজপা জপ করে। শ্বাসগ্রহণ কালে ‘সো' শব্দ হয় এবং প্রশ্বাস ত্যাগ কালে ‘হং’ শব্দ হয়। উভয়ে মিলে ‘সঃ অহং’ (তিনিই আমি) এই মন্ত্ৰ সর্বদা জপ হয়।


এই ‘সঃ অহং’ (বা সোহহং) মন্ত্র— বিপরীতে ‘হংস’ মন্ত্র হয়। তাই একে হংস বা অজপা গায়ত্রী বলে।


“সোহহং হংস পদেনৈব জীব জপতি সর্বদা।” 

—ইহাই জীবের স্বাভাবিক জপ।


মনকে কী করে ভগবানে ধরে রাখা যায়— এর জন্য বহু সাধক বিভিন্নভাবে সাধন করেছেন এবং তাঁদের সাধনলব্ধ ফল শাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন।


যেমন চক্রে জপের দ্বারা মনকে দ্রুত অন্তর্মুখী করা যায়। 

মনুষ্যশরীরে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা নামে ছয়টি চক্র আছে। এবং সর্বোপরি সহস্রার—যেখানে পরমশিব রয়েছেন এবং মূলাধারে মা কুণ্ডলিনী শক্তি রয়েছেন। 

সাধক মূলাধার পদ্মে মন স্থির করে ইষ্টমন্ত্র জপ করে স্বাধিষ্ঠানে উঠবেন। এইরূপ ক্রমান্বয়ে প্রত্যেক চক্রে চক্রে জপ করতে করতে সহস্রারে উঠবেন, এবং সেখানে দ্বিগুণসংখ্যক জপ করে প্রত্যেক পদ্মে পদ্মে জপ করতে করতে অনাহতে নামবেন। 

এইরূপে হৃদপদ্মে ইষ্টে মন রেখে জপ করবেন। 

—একেই ‘ষট্‌চক্রভেদ’ বলে। 


তন্ত্র বলেন : 

“মূলাধারে বসেৎ শক্তি

 সহস্রারে সদাশিবঃ।

 তয়োরৈক্যে মহেশানি

 ব্রহ্মতত্ত্বং তদুচ্যতে।।” 

—অর্থাৎ মূলাধার পথে যে শক্তি আছেন, তাঁকে সহস্রারস্থ শিবের সঙ্গে মিলন করানোকেই ব্রহ্মতত্ত্ব বলে। —এ যোগ। (আত্মসমর্পণযোগ, ৯০-৯১) 

তন্ত্রে আছে যে নিঃশ্বাস রোধ করে ভাবনার দ্বারা কুণ্ডলিনীকে একেবারে সহস্রারে নিয়ে যাবে এবং তৎক্ষণাৎ মূলাধারে প্রত্যানয়ন করবে। 


এভাবে বার বার করতে করতে সুষুম্না পথে বিদ্যুতের ন্যায় বা ভ্রামিত অঙ্গারের ন্যায় শিখা অর্থাৎ দীর্ঘাকার তেজ লক্ষিত হবে। সেই শিখাতে চিত্ত একাগ্রভাবে নিবিষ্ট করলেই মন্ত্রশিখা ভাবনা হবে। 


পণ্ডিত জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ‘জপরহস্যে’ লিখেছেন, 

“সহস্রারে গুরুধ্যান, জিহ্বামূলে মন্ত্রবর্ণ ধ্যান ও হৃদয়ে ইষ্টদেবতার ধ্যান করে পরে সহস্রারে গুরুমূর্তি তেজোময়, জিহ্বামূলে মন্ত্রবর্ণ তেজোময় ও হৃদয়ে ইষ্টমূর্তি তেজোময় চিন্তাপূর্বক ঐ তিন তেজের একতা করে ঐ তেজপ্রভাবে আপনাকেও তেজোময় ও অভিন্ন ভাবনা করে হৃদয়ে তেজোময় ইষ্টমূর্তির প্রতি লক্ষ্য রেখে জপ করতে হবে।” 

(নিত্যপূজাপদ্ধতি, পৃঃ ২৬৪)


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত পড়লে মনে হয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের জ্ঞাত বা শাস্ত্রানুমোদিত যত রকম সাধন আছে প্রায় সব রকমই করেছিলেন। আবার অনেক নূতন নূতন সাধনও করেছিলেন, যেমন ভক্তদের বলতেন, 

❝ ধ্যান করবার সময় ভাববে, যেন মনকে রেশমির রশি দিয়ে ইষ্টের পাদপদ্মে বেঁধে রাখছ, যেন সেখান থেকে আর কোথাও যেতে না পারে।❞


চঞ্চল মনকে বশে আনবার জন্য অনেকে জপের সঙ্গে মূর্তিকে যোগ করে দেয়। যেমন মনকে বলা হলো— ‘তুমি কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি দেখে একশত বার জপ কর। তারপর জয়রামবাটীতে শ্রীমায়ের মূর্তিতে একশত বার, দক্ষিণেশ্বরের কালী একশত বার, কৃষ্ণ একশত বার শিব একশত বার, ঠাকুরের ঘরে একশত বার, নহবতে মায়ের সামনে একশত বার, পঞ্চবটীতে একশত বার, কাশীপুরে একশত বার, এবং বেলুড়মঠে ঠাকুরের সামনে একশত বার জপ করলে এক হাজার বার জপ হয়ে যাবে।’

চঞ্চলমন খেলতে ভালবাসে। এও তেমনি জপ নিয়ে ঠাকুরের নানাবিধ রূপের সঙ্গে খেলা।

꧁✿꧂

📙 গ্রন্থসূত্র :

শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে (‘রামকৃষ্ণ' একটি নাম ও নামসাধনা)

—স্বামী চেতনানন্দ



*✍️ স্বামী বীরেশ্বরানন্দ*

×÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷×

*অহং ত্যাগ করতে হবে*

তাঁর বাণী ছিল এইঃ

আমাদের জীবনে এত দুঃখ কেন? কারণ আমরা অত্যন্ত স্বার্থপর। আমরা শুধু নিজেদের জন্য সব কিছু বাসনা করি - তাই তো এত দুঃখ। এ থেকে নিস্কৃতি লাভের উপায় কী? আত্মবিসর্জন। ‘অহং’ বলে কিছু নেই - ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই ক্রিয়াশিল জগৎ মাত্র আছে। জীবন-মৃত্যুর গতাগতির মূলে ‘আত্মা’ বলে কিছুই নেই। আছে শুধু চিন্তাপ্রবাহ, একটির পর আর একটি সঙ্কল্প। সঙ্কল্পের একটি ফুট উঠল আবার বিলীন হয়ে গেল সেই মূহর্তেই – এইমাত্র। এই চিন্তা বা সঙ্কল্পের কর্তা কেউ নেই - কোন জ্ঞাতাও নেই। দেহ অনুক্ষণ পরিবর্তিত হচ্ছে - মন এবং বুদ্ধিও পরিবর্তিত হচ্ছে। সুতরাং ‘অহং’ নিছক ভ্রান্তি। যত স্বার্থপরতা, তা এই ‘অহং’ কে নিয়েই। যদি জানি যে, ‘আমি’ বলে কিছু নেই তাহলেই আমরা নিজেরা শান্তিতে থাকব এবং অপরকেও সুখী করতে পারব । 

----------স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#

আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ।

ঠাকুর বলেন কোনো জিনিসই বাইরে সত্য নয় যতক্ষণ না তা ভেতরে সত্য হয়ে ওঠে অর্থাৎ ভক্তের নিজের অন্তরেই বিশেষ এক ধরনের ক্ষমতা লাভ করে।তখন নিজেই নিজেকে মন যা চায় তাই দান করে।বিশ্বাস করা চাই । বিশ্বাসই হলো আসল।বিশ্বাসের মত বিশ্বাস করলে অন্তর  শুদ্ধ হয়।অন্তর শুদ্ধ হলে তাতে জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটে।ঘোলা জলে প্রতিবিম্ব ফোটেনা।পরিষ্কার জলে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।অন্তর শুদ্ধ হলে অনেক কিছুই পাওয়া যায়।অন্তর শুদ্ধ হয় একাগ্রতায়।নানা চিন্তাই বেনো জাল।এইসব চিন্তাকে সরিয়ে দিতে হবে মন থেকে।জমিতে আগাছা হলে ফসলের জোর কমে  যায়।আগাছা উপড়ে ফেললে ফসল জোরদার হয়।মনের  

 একাগ্রতা  হল আগাছা উপড়ে ফেলা ভক্তি হল নাংলা বা নিডুনি যা আগাছা উপড়ে ফেলে।

হরি ওম তৎসৎ।

~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=~

*রসে-বশে থাকা, কি*

--------------+++-----------

শ্রীরামকৃষ্ণদেব মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, মা আমায় শুকনো সাধু করিস না, রসে-বশে রাখিস। একথা শুনে চমকে উঠতে হয়। সত্যিই তো!

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের জ্ঞান বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, শক্তি- সম্পদ-দক্ষতা বাড়ে, অথচ আনন্দ কমতে থাকে। কেন এমন হয়? কারণ আমরা যে বড় হিসেবি! কোন লাইনে পড়াশোনা করতে হবে, কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, ফাংশনে কেমন জামাকাপড় পড়তে হবে, এমনকি কর্মজীবনে কোন ইউনিয়নের সদস্য হতে হবে, সবই আমরা হিসাব করে চলি। এভাবেই আমরা জীবনে দোকানদার হয়ে উঠি।

ঠাকুর শেখালেন, জীবনটাকে গণিত করে তুলো না। জীবন তো এক সংগীত, তাকে গাইতে হয়। শিল্পীর মতো তাকে রং-রূপ দিতে হয়। তাই তো বললেন 'রসে বশে' থাকতে।

সমাজ থেকে যদি অন্যায়-অনাচার দূর করতে হয়, তবে মানুষকে শেখাও -  কিভাবে আনন্দময় জীবন গড়ে তুলবে সে।

নিরানন্দ মানুষ, অস্থির মানুষ, বিভ্রান্ত মানুষই অন্যের উপর অত্যাচার করে। বিরক্ত মানুষই অন্য মানুষকে বিরক্ত করে। যে মানুষ আনন্দে আছে, নেতিবাচক চিন্তা তার থাকে না। সমস্যা জীবনকে নিয়ে নয়, সমস্যা মনকে নিয়ে। 

তাই তো ঠাকুর বললেন, *"তোমাদের চৈতন্য হোক।"*

π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆π∆


শ্রী মা সারদা দেবীর কথা :

( *একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে

তোমার ভূবন ভরা রূপটি একবার দেখি

মা নয়ন ভরে।*)

     একদিন ‘উদ্বোধনে' মায়ের অপার করুণার প্রসঙ্গ হইতেছিল। যোগেন-মা হাসিতে হাসিতে মায়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তা মা আমাদের যতই ভালবাসুন, তবু ঠাকুরের মতো নয়। ছেলেদের জন্য তাঁর কি ব্যাকুলতা, কি ভালবাসা দেখেছি, তা বলবার নয়!" মা বলিলেন, “তা হবে না ? তিনি নিয়েছেন সব বাছা বাছা ছেলে কটি—তা আবার এখানে মন্ত্র টিপে, ওখানে মন্ত্র টিপে। আর আমার কাছে ঠেলে দিয়েছেন একেবারে সব পিঁপড়ের সার !"

     শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রসঙ্গে মা একদিন বলিলেন, "ঠাকুর যে অমন ত্যাগী ছিলেন, তবু আমার জন্য ভাবনা ছিল। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, 'তোমার ক-টাকা হলে হাতখরচ চলে ?' আমি বললাম, 'এই পাঁচ-ছ টাকা হলেই চলে।' তারপর জিজ্ঞাসা করছেন, ‘বিকেলে কখানা রুটি খাও ?' আমি তো লজ্জায় বাঁচি না—কি করে বলি। এদিকে বারবার জিজ্ঞাসা করছেন। তাই বলতে হলো, 'এই পাঁচ-ছ খানা 'খাই'।"

     রাধু একদিন ক্রুদ্ধ হইয়া মাকে বলিল, “তুই কি জানিস্ ! স্বামীর মর্ম তুই কি বুঝিস্ !” মা ইহা শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই তো গো! স্বামী তো ছিলেন ন্যাংটা সন্ন্যাসী।"

শ্রীশ্রীমায়ের কথা, অখন্ড, উদ্বোধন কার্যালয়

🌸🌷🌸

(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)(:)


শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও নেতিবাচক কোন কথা বলতেন না। কিন্তু তিনি ভিতরে জ্বালিয়ে দিতেন চেতনার আগুন। সেই আগুনে নিরন্তর দগ্ধ হতে হতে অগ্নিশুদ্ধ হয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র। ঠাকুর তাঁকে বললেন না "তুমি মদ খেও না।" বরং বলেছিলেন, "খাও না, খাও না, কদিন খাবে? শুধু খাওয়ার আগে মাকে নিবেদন করে খেও।" পরবর্তীকালে দেখা গেল, গিরিশচন্দ্র মদ স্পর্শ করতে পারছেন না। মাকে মদ কেমন করে দেবেন? ভেঙ্গে ফেললেন মদের পাত্র।

     শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন না "বারাঙ্গনা গৃহে যেও না।" তিনি বললেন, "মন নিয়ে কথা। মনেই বদ্ধ, মনেই মুক্ত।" গিরিশচন্দ্র বারবনিতা পল্লীতে যাচ্ছেন কিন্তু সেখানে থাকতে পারছেন না। ভিতরে এমন অন্তর্জ্বালা হতে লাগলো যে, আর সেখানে থাকতে পারলেন না। উন্মত্তের মতো দক্ষিণেশ্বরে ছুটে এসে ঠাকুরের ঘরে ঢুকে তাঁকে বললেন, "এ তুমি আমার কি করলে ঠাকুর?"  তাঁর মুখ থেকে সব কথা শুনে শ্রীরামকৃৃষ্ণ খলখল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। বললেন, "একি ঢোঁড়া সাপে তোকে ধরেছে রে শালা? তোকে যে জাতসাপে ধরেছে পালিয়ে বাসায় গেলেও মরে থাকতে হবে।"

     যে মানুষটি বলেছেন "আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপী", তাঁর জীবনে আমরা কি দেখছি? শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন  "আমি তো তোমাকে মদ খেতে বারণ করিনি? কিন্তু তুমি খেতে পারলে না। আমি তো তোমাকে বারাঙ্গনা গৃহে যেতে নিষেধ করিনি। তুমিই তো সেখানে গিয়ে থাকতে পারলে না। কেন পারলে না জান? তোমার ভিতরে আমি আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি। অগ্নির নিরন্তর দহন জ্বালা সেখানে। সাধ্য কি তোমার পতনের সেই গভীর গহ্বরে নিজেকে তুমি নিমজ্জিত করবে! তোমাকে প্রতি মুহূর্তে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমি খাঁটি সোনা করে নেব। তোমাকে আমি অগ্নিশুদ্ধ করে নেব। জগৎ তোমাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।"

                  শ্রীরামকৃষ্ণের দংশন এমনই মারাত্মক। গিরিশচন্দ্রের জীবন ও চরিত্রের পরিবর্তন জগতের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের 'আত্মা-জাগানিয়া' ভূমিকার মহানিদর্শন।

!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!##################


ভগবানের দিকে যেতে হলে শুদ্ধ আচরণ দরকার ৷

সেগুলি হচ্ছে —

 (১) আমাদের সকলের কল্যাণচিন্তা করতে হবে ৷ সকলের সঙ্গে ব্যবহারে এমন কিছু যেন না করি যাতে কারো কোনো অকল্যাণ হয়, কারো মনে আঘাত লাগে ৷ 

এমন কিছু যেন না করি যাতে কারো অনিষ্ট হয় বা কারো মনে বা শরীরে বা মনে কাউকে আঘাত না করা, কারো অনিষ্ট হয় বা কারো মনে বা শরীরে আঘাত লাগে ৷ 

শাস্ত্র অহিংসার কথা বলে ৷ 

অহিংসা মানে শরীরে বা মনে কাউকে আঘাত না করা, কারো অনিষ্ট চিন্তা না করা বা অনিষ্ট না করা ৷এই আচরণ পালন করতে হবে কায়মনোবাক্যে—কথায়, চিন্তায় ও কাজে ৷

(২) সত্যকে সর্বদা ধরে থাকতে হবে ৷ সত্যকে এমনভাবে ধরে থাকব যে, কোন কারণেই যেন আমরা সত্য থেকে বিচলিত না হই ৷ কখনো যেন মিথ্যার আশ্রয় না নিই ৷ কথা দিলে যেন সে-কথা রক্ষা করি ৷ 

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ঃ " যে সত্যকে ধরে থাকে, সে ভগবানের কোলে শুয়ে থাকে ৷"  আবার বলছেন ঃ "সত্যকথা কলির তপস্যা ৷"

সত্যকে পালন করা সহজ কথা নয় ৷ সত্যপালন করতে হলে আমাদের জীবনে অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হবে ৷ কিন্তু এটা যে আমাদের আদর্শ, এটা যেন না ভুলি ৷

(৩) আমরা কাউকে যেন কাউকে যেন কোনোরকমে না ঠকাই, প্রবঞ্চনা না করি ৷ যেন কাউকে ঠকিয়ে কিছু না গ্রহণ করি ৷ আমাদের যা ন্যাজ্য পাওনা, যেন সেটুকুই অপরের কাছ থেকে নিই ৷ এটা হচ্ছে লোকের সঙ্গে ব্যবহারে সততা ৷ এটি সাধনপথের সহায়ক ৷

(৪) সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আমাদের বশে রাখতে হবে ৷ আমরা যেন তাদের দ্বারা চালিত না হই ৷ এক-আধটা ইন্দ্রিয়ের সংযম নয়—সবগুলি ইন্দ্রিয়ের সংযম ৷

(৫) ভগবানকে লাভ করার জন্য, তাঁকে চিন্তা করার জন্যই আমাদের জীবন ৷আমাদের জীবনযাপন হবে সহজ ,সরল, স্বাভাবিক ৷

আমাদের লক্ষ্য হবে—কত কম জিনিস আমরা আমাদের প্রয়োজনের জন্য গ্রহণ করতে পারি ৷ কোথাও যেন আমাদের লোভ না হয় ৷

ক্রমবর্ধমান আকাঙ্খা আমাদের মনকে সবসময় অস্থির করে রাখে ৷মনের স্বভাবই এই ৷ 

যে যত পায় সে আরও বেশী করে চায় ৷ পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য পেয়েও কারো মন শান্ত হয় না ৷ বাসনাই মানুষের মনকে অশান্ত, বিভ্রান্ত করার কারণ ৷

কাজেই নির্বাসনা হতে হবে ৷

 স্বামী ভূতেশানন্দ

[%][%][%][%][%][%][%][%][%][%][%][]


ভালো বাজাতেন বলে স্ত্রীর আঙুল কেটে দিয়েছিলেন রবি শংকর!

পাঁচ বছর ধরে পণ্ডিত রবি শংকর নেই। তাঁর সেতার থামলেও শিল্পীর অতীত কিন্তু পিছু ছাড়ে না। যদিও ধর্ম এবং মনুষত্ব বলে, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া মানুষটি সব বিচারের উর্ধ্বে। কিন্তু সে মানুষটি-ই যদি যাওয়ার আগে দাগ রেখে যান নিজের প্রতিভার, চলে যাওয়ার পরেও তাঁর ভালো-মন্দ নিয়ে কাঁটা-ছেড়া হবেই। জীবন থেকে ছুটি পেলেও জমে থাকা স্মৃতি ফিরিয়ে আনে সেই মানুষটিকে।

রবি শংকর নিঃসন্দেহে গুণী। শিল্প রসিকদের মতে, রবি দেবী সরস্বতীর বরপুত্র। কিন্তু দেবী স্বয়ং যখন তাঁর ঘরে ঠাই পেতে চেয়েছিলেন, রবি শংকর কিন্তু খোলা মনে মেনে নিতে পারেননি। দেবীকে শ্রদ্ধার আসনে না বসিয়ে, তাঁকে ভালো না বেসে যন্ত্রণা দিয়েছিলেন মারাত্মক। শোনা কথা, সাধককে ছাপিয়ে যাওয়ার শাস্তি হিসেবে দেবীর আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন!

বারাণসী থেকে ১৬০ কিমি দূরে মাইহারে অবস্থিত বাড়িটিকে আশপাশের পড়শী বলত সুরের বাড়ি। তার যুতসই কারণও ছিল। বাড়ির কর্তা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে অগুন্তি ছেলে-মেয়ে সরোদ, সেতার শিখতে আসত। গুরুজির বড় মেয়েও ভীষণ ভালো সেতার বাজাতে পারতেন। গুরুজি নিজে হাতে তাঁকে তালিম দিয়েছিলেন। বড় ছেলে আলি আকবর সরোদের তালিম নিচ্ছেন বাবার কাছে। কিন্তু ছোট মেয়ে অন্নপূর্ণার বেলায় গুরুজি আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত। সবার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিলেও ছোট মেয়েকে গান-বাজনার ধারেপাশে ঘেঁসতে দিতেন না একদম। কারণ, বাজনা শিখিয়েছিলেন বলে শ্বশুরবাড়িতে বড্ড গঞ্জনা, অপমান শুনতে হয়েছিল বড় মেয়েকে।

কিন্তু গুরুজির ছোট মেয়ে অন্নপূর্ণা ছিলেন সুরের দেবীর সাক্ষাৎ আধার। তাই বাবা বাড়ি না থাকলেই তিনি দাদা আলি আকবর খাঁ’র চারপাশে ঘুরঘুর করতেন। দাদা ভুল করলে শুধরে দিয়ে বলতেন, ‘ভাইয়া, বাবা নে এইসা নেহি, এইসা শিখায়া….’ একদিন বাবার আড়ালে এভাবেই দাদার ভুল শোধরাচ্ছিলেন। আচমকা বাবাকে সামনে দেখে থমকে গেলেন মেয়ে। গুরুজি দেখলেন, বড় অবহেলা করেছেন কোলের সন্তানের প্রতি। সেই অভাব মেটাতে এবার দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে মেয়েকে শেখাতে বসলেন। প্রথমে রীতি মেনে ধ্রূপদ শেখালেন। তারপর সেতার তুলে দিলেন অন্নপূর্ণার হাতে।

১৯৪০-এ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মাইহারের বাড়িতে সেতার শিখতে কলকাতা থেকে এলেন রবীন্দ্র শংকর চৌধুরি বা রবি শংকর। দাদা বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর। তাঁর ইচ্ছাতেই রবির সেতার শেখা। ওস্তাদজির এই নতুন ছাত্র তখন মাত্র ১৮। আর অন্নপূর্ণা? মাত্র ১৩! সেতার শেখার ফাঁকে রবি লক্ষ্য করতেন গুরু কন্যাকে। খুব লাজুক। খুব আকর্ষণীয়। বড়বড়, উজ্জ্বল দু’টি চোখ। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বরং গুরুজির এই মেয়েকে নিয়ে বেশি উত্সাহিত ছিলেন দাদা উদয়। তাঁর ইচ্ছেতেই ১৯৪১-এর ১৫ মে সকালে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হন অন্নপূর্ণা। বিকেলে রবির সঙ্গে বিয়ে। বিয়ের আগে রবি শুধু এটুকুই জেনেছিলেন, এই বিয়েতে মত আছে গুরুজির মেয়ের।


বিয়ে ভালোভাবে মিটলেও সমস্যা বাধালো সুরের মায়াজাল। এক পেশায় স্বামী-স্ত্রী। ওস্তাদ আমির খানের মতে, অন্নপূর্ণা ছিলেন গুরুজির ৮০ শতাংশ। আলি আকবর ৭০ আর রবি শংকর মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে, তেলে আর জলে মিশ খেলো না কোনদিন। এক মঞ্চে দু’জনে বাজাতে বসলে গুনীরা অন্নপূর্ণার সেতারের মুর্ছনায় মুগ্ধ হতেন। তাঁর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে খেই হারাতেন রবি। বাজানো শেষ হলে সবাই অন্নপূর্ণাকে ঘিরে ধরতেন। হাততালির শব্দে কান পাতা দায় হতো। এসব দেখে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যেতেন রবি। শেষে খোলাখুলি বললেন স্ত্রীকে, বিয়ে টিকিয়ে রাখতে গেলে সেতার ছাড়তে হবে।

স্বামী, সংসারের মুখ চেয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করলেন অন্নপূর্ণা। তাঁর রেওয়াজ চলত বন্ধ দরজার ওপাশে। পরে এক সাক্ষাৎকারে অন্নপূর্ণা বলেছেন, ‘অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন আমায় ঘিরে ধরত, তখন মুখ নিচু করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন রবি। মুখ দেখেই বোঝা যেত, মনে মনে দারুণ অসন্তুষ্ট। বাড়ি ফিরে কথায় কথায় সেই ক্ষোভ উগরে দিতেন। চাইতেন, আমি যাতে নিজে থেকে অনুষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিই।’ যদিও পরে আত্মজীবনী ‘রাগমালা’য় শিল্পী কৈফিয়ত দিয়েছেন, ‘আমি পাশে না বসলে অন্নপূর্ণা বাজাতেই চাইত না। খুব লাজুক ছিল তো। তাই অনেক লোকের সামনে নার্ভাস হয়ে পড়ত। কিন্তু আমার পক্ষেও তো সম্ভব হতো না সব সময় আগলানো। শেষে ও ছেড়েই দিল অনুষ্ঠান করা.’

এই গল্প কি বিশ্বাস করা যায়? বিশেষ করে আলাউদ্দিন খান সাহাব যাঁকে ‘দেবী সরস্বতী’ মেনে নিজের গুরুর থেকে শেখা ‘সুরবাহার’-এর যাবতীয় মন্ত্রগুপ্তি শিখিয়েছিলেন। জামাই রবিকেও শেখাননি। কেননা, অন্নপূর্ণার মনে কোনো লোভ ছিল না। বিখ্যাত হওয়ার তাগিদ ছিল না। সেতার, সুরবাহারের তারে নিজেকে সঁপে দিতেন নীরবে। যাই হোক, স্বামীকে ধরে রাখতে, সংসার-সন্তান বাঁচাতে বাবা কাম গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহাব আর মা সারদার ছবি ছুঁয়ে অন্নপূর্ণা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর কোনোদিন অনুষ্ঠানে বাজাবেন ন। কিন্তু বন্ধ দরজার পিছনে স্ত্রীর রেওয়াজ রবির বুকের ভিতরটা জ্বালিয়ে দিত। যতবার স্ত্রী বাজাতেন, ততবার রবি বুঝতে পারতেন, স্ত্রীর কাছে তিনি কিচ্ছু না। তাই রাগে-হিংসায় জ্বলতে-জ্বলতে অন্নপূর্ণার আঙুল নাকি কেটে দিয়েছিলেন! এভাবেই সেতারের দুনিয়ায়, সুরের আকাশে উদিত হলেন রবি। অস্ত গেলেন অন্নপূর্ণা।

অন্নপূর্ণার বাজনা তারপরেও বন্ধ হয়নি। এত সহ্য করেও যখন স্বামীকে ধরে রাখতে পারলেন না তখন আজীবনের সখ্য জুড়লেন সেতারের সঙ্গে। কাটা আঙুল নিয়েই তিনি তৈরি করেছেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, নিত্যানন্দ হাল্দিপুরি, বসন্ত কাবরা, অমিত ভট্টাচার্য-র মতো দিকপাল ছাত্র। 

অন্নপূর্ণা-রবি শংকরের এই জীবনী-ই সেলুলয়েডে ধরেছেন পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, ‘অভিমান’ ছবিতে। পরে সেই ছবি দেখে হাহাকার করেছিলেন অন্নপূর্ণা, ‘ছবির দাবি মিটিয়ে ঋষি কি সুন্দর দুই শিল্পী দম্পতিকে ভালোবাসার বাঁধনে আবার জুড়ে দিলেন। কিন্তু ঈশ্বর তো আমার বেলায় তেমনটা করলেন না! আমি যে সারা জীবন ‘অধুরা’-ই থেকে গেলাম…!’  

+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+*+

আলোয়ারের সেই বুড়িমা'কে ভুলতে পারেন নি বিবেকানন্দ। 

সে অনেকদিন আগেকার কথা – ঠাকুরের দেহরক্ষার পর যখন তরুণ পরিব্রাজকরূপে তিনি ছুটে চলেছেন সারা দেশে, তখনই কোনও একটা সময়ে এসে ক'দিন আলোয়ারেও ছিলেন। সেই সময়ে দু'বেলা পেট চলে ভিক্ষার অন্নে। যেদিন কিছুই জোটে না ভিক্ষায়, সেদিন সন্ন্যাসীর জঠরাগ্নির জ্বালা কমায় এলাকার আরেক ভিখারিনি – বুড়িমা। পথের ধারে তাঁর জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘর; দিনশেষে ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত সেই তরুণ এসে বসলে বুড়ি আস্তে আস্তে কিছুটা বজরার আটা বার করে – ভিক্ষারই ধন সে সব। তারপর সে আটা মেখে, হাতের চাপে চ্যাপ্টা করে, আগুনে পুড়িয়ে খানকতক রুটি বানিয়ে সন্ন্যাসীর দিকে এগিয়ে দেয়, "এ নে, খা রে লালা।" ও, বলা হয়নি, সন্ন্যাসীকে বুড়ি ডাকে "মেরে লালা" বলে; আর সন্ন্যাসী তাঁকে ডাকে "মাঈ"। বজরার রুটির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা কামড়ে কামড়ে খেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে 'লালা', বুড়ির আদ্ধেক খাওয়া তাতেই হয়ে যায়।

তারপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে; বুড়ি জানেও না যে দেশ পেরিয়ে, মহাদেশ পেরিয়ে, সমুদ্র পেরিয়ে 'লালা' আজ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন আলোয়ারে। না, এখন তিনি ভিক্ষাজীবী নন, রাজার অতিথি। সকাল থেকে সন্ধে রাজসভায় হাজার হাজার লোক আসে যায়, স্বামীজীকে দেখে, কথা বলতে চায়, আশীর্বাদ পেতে চায়। দু'পা এদিক ওদিক গেলে সবসময় সঙ্গে থাকে রাজার দেওয়া দুই পাহারাদার – মন হাঁপিয়ে ওঠে এসবে বিবেকানন্দের। মনে পড়ে এখানে এর আগেকার আসা – আধপেটা কিন্তু স্বাধীন পায়ে ঘুরে বেড়ানো। নিমেষে মনে পড়ে যায় 'মাঈ'র কথা। সেই কুঁড়েঘরে বসে গরম গরম বজরার রুটি, বুড়ির মুখের সেই হাসি ... আহা! কেমন আছে সে, কে জানে! আদৌ আছে তো? একবার দেখে এলে হয়। প্রহরীর চোখের আড়ালে, সন্ধের মুখে একাই বেরিয়ে পড়েন বিবেকানন্দ।

জায়গাটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না, এই ক'বছরে আলোয়ার বদলায় নি তেমন একটা। ওই তো বুড়ির কুঁড়েঘর, যেন আরও কিছুটা জীর্ণ। দরজায় একটা নোংরা কাঁথা ঝুলছে। বাইরে থেকেই স্বামীজী হাঁক দিলেন, "মাঈ! ও মাঈ!"

ভিতর থেকে কর্কশ স্বর আসে বুড়ির, "ওহ! বুড়ো মানুষ, দুটো কাজ সারছি, তাতে শান্তি নেই! কে চেল্লাস এই সন্ধে করে?"

"আরে বাইরে এসেই দেখো না, কে!"

হেঁয়ালি সইতে পারে না বুড়ি, ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "ওহ, কে আমার রাজপুত্তুর এল রে, বেরিয়ে তাকে দেখতে হবে! কে রে বেটা তুই?"

"আরে, তোর লালা ... মনে নেই মাঈ? তোর লালা এসেছে।"

হাড়-জিরজিরে বুড়িমা উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে, "কই ... সত্যিই তুই লালা? তুই ... ফিরে এসেছিস? কই, কাছে আয় দেখি... দেখতে পাই না তো চোখে ভালো..."

কাঁপা হাতে স্বামীজীর গাল ছুঁয়ে, অনেক কষ্টে নিজের চিবুক উঁচু করে তাকায় বুড়ি, "সত্যিই তো, আমার লালা! কোথায় গেছিলি? কোথায় চলে গেছিলি বাপ, মাঈকে ছেড়ে?"

"সে সব অনেক গল্প রে মাঈ, হবে 'খন। দুটো খেতে দে তো আগে, বড্ড খিদে পেয়েছে!"

"ওই দ্যাখো! তখনও লালার পেটে আগুন জ্বলতো, আর এখনও! বলি, এ ক'বছর কিছু খাস নি, নাকি? বলি আমার কাছে কী আছে, যে তোকে খেতে দেবো এই অবেলায়?"

"কেন, তোর সেই বজরার রুটি দিবি না? লঙ্কা দিয়ে?"

কয়েকমুঠো বজরার আটা মেখে, গনগনে আঁচে পোড়ানো রুটি এগিয়ে দেয় মাঈ, তাঁর লালাকে। ছেলের মুখে সেই তৃপ্তির হাসি দেখে ফোকলা মা'ও হেসে ফেলে। নিজের ছেলেই তো তাঁর! বুড়ির পেটের ছেলে জোয়ান বয়সে চলে গিয়েছিল; সেই থেকে এক লালা ছাড়া আর কাউকেই তেমন আপন ভেবে বাঁচেনি বুড়ি। লালাও পালিয়েছিল বছর কয়েক আগে; এবার ফিরে এসেছে যে, আর সহজে যেতে দেবো না – এই ভেবে চোখ মোছে বুড়িমা। 

"আহা, কী স্বাদ রে মাঈ! কোথায় লাগে এসবের পাশে রাজবাড়ির মণ্ডা মেঠাই!"

"আরে ও লালা, শুনেছিস –", কী যেন মনে করে সোজা হয়ে বসে বুড়ি, "শুনেছিস, এখানের রাজবাড়িতে নাকি মস্ত এক সাধু এসেছে! সঙ্গে কত লোকজন, সাহেব মেম, ভক্ত! সে নাকি বিরাট নামডাক করেছে; এ পথ দিয়ে কত লোক রোজ যাচ্ছে তাকে দেখতে, জানিস? তুই যাবি নাকি দেখা করতে, হ্যাঁ?" লালা উত্তর দেওয়ার আগেই বুড়ি আবার বলে, "না না, থাক! তোর গিয়ে কাজ নেই! পেটই ভরলো না তোর ভালো করে, আর কয়েকটা রুটি দিই? তোর ওদিকে গিয়ে কাজ নেই!"

"কেন রে মাঈ? গিয়ে কাজ নেই কেন?"

"ও বাবা, না, ও সাধু বড়লোক, বিরাট লেখাপড়া করা! কী বলতে শেষে কী বলে দেবে, আমার লালার মনে কষ্ট হবে শুধুশুধু..."

মুখে সাঙ্ঘাতিক এক দুষ্টুমির হাসি নিয়ে তাঁর লালা ঝুঁকে পড়ে, বুড়ির কাছে এসে বলে, "এ মাঈ! একটা মজা করবি? চল, তুই-আমি দুজনেই গিয়ে ওই স্বামীজীকে দেখে আসি! চল চল, যাবি?"

"ধুর ক্ষ্যাপা! রাজবাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেবে, না তোকে? ধ্যাতানি খেয়ে ফিরে আসতে হবে! কোত্থাও যেতে হবে না তোকে, আমার কাছে বোস তো!"

"মাঈ, শোন...", যেন কিছুটা গাম্ভীর্যের ছলেই বিবেকানন্দ বলেন, "বলছি, সেই সাধু যদি আমিই হই? তবে?..."

একপল নীরব থেকে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ফোকলা বুড়িমা। "কথা শোনো আমার পাগলা বেটা'র! তুই? তুই হবি সেই সাধু? বড় হয়েও মজা করার স্বভাব গেল না তোর, বল? ওরে তুই তো আমার লালা! আমিও গরিব, তুইও গরিব! ও'সব বড় বড় সাধুর বেশি বেশি কথায় কাজ নেই আমাদের!"

আশপাশটা বড় একটা বদলায় নি মাঝের কিছু বছরে। সন্ধেবেলায় চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে আলোয়ার, তার জনবসতি, পথঘাট। আর সেই পথের ধারের কুঁড়েঘরে বসে এক মাঈ আর তাঁর লালা আগুন-পোড়া বজরার রুটি খেতে খেতে হাসিতে, খুনসুটিতে, আহ্লাদে, আদরে উড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের একটা সন্ধে, সেই রাজঅতিথি সন্ন্যাসীর থেকে বহু, বহু দূরে। 

(তথ্যঋণ : 'বন্ধু বিবেকানন্দ' – শঙ্করী প্রসাদ বসু)

{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}

শ্রী রামকৃষ্ণ ও বামাক্ষ্যাপার মহামিলন —

বামাক্ষ্যাপা একবার কলকাতায় এসেছিলেন। সেবার তিনি কালীঘাটে যান মা কালীকে দর্শন করতে। মন্দিরে যাওয়ার আগে শ্মশানঘাটে পাশের আখড়ায় গাঁজা খেয়ে বামাক্ষ্যাপা আদিগঙ্গায় স্নান করতে গেলেন৷

আদিগঙ্গায় স্নান করে তিনি এসে দাঁড়ালেন মায়ের মূর্তির সামনে। বললেন, 'চল মা, তোকে আমি তারামার কাছে নিয়ে যাব।' একথা বলে যেই তিনি মূর্তি স্পর্শ করতে যাবেন, তখনই উপস্থিত ব্রাহ্মণরা বাধা দিয়ে উঠলেন। বললেন, বাইরের কাউকে তাঁরা দেবীমূর্তি স্পর্শ করতে দেবেন না। এতে বামাক্ষ্যাপার খুব কষ্ট হল। শিশুর মতো অভিমান করে বলে উঠলেন, চাই না আমি মা কালীকে। অমন রাক্ষুসে রূপ। এর থেকে আমার তারামা ভালো। আহা, আমার তারা মায়ের রূপের কী বাহার। একথা বলে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এর পরে অন্যান্যরা যখন ভুল বুঝতে পেরে তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বললে, ঠাকুর আপনি ফিরে চলুন। আমাদের ভুল হয়েছে। আপনি মূর্তি স্পর্শ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি আর স্পর্শ করলেন না মায়ের পাষাণ বিগ্রহ। ধীর স্থির শান্ত অচঞ্চল পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে।

ক্ষোভে দুঃখে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার সময় দেখা হয় যুগাবতার ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সঙ্গে। তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছেন এদিকে রামকৃষ্ণ দেব মন্দিরে ঢুকছেন৷ দুই মহামানবের আলিঙ্গন হয়৷

রামকৃষ্ণ দেব বামাক্ষ্যাপার অমন ক্রুদ্ধ মুখ দেখে বললেন, 'চলো শ্যাম নগরে আমার আরেক মা আছে তার সঙ্গে দেখা করে আসি।' বামাক্ষ্যাপা কোন আপত্তি না করে চললেন রামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে শ্যামনগরে মা কালীকে দেখতে। রামকৃষ্ণ দেব বামাক্ষ্যাপাকে নিয়ে আদিগঙ্গা দিয়ে নৌকায় চাপিয়ে বামাক্ষ্যাপাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামনগর ''মূলিজোড় কালী মা '' দর্শন করতে৷

যে মা একসময় গঙ্গায় নৌকায় বেয়ে যাওয়া রামপ্রসাদ সেনের গান শুনতে চেয়েছিলেন৷ রামপ্রসাদ মাকে বলেছিলেন, "তোর যদি গান শুনবার ইচ্ছা হয় তো তুই ঘুরে শোন — আমার আজ কাজ আছে, দাঁড়িয়ে (থেমে) তোকে গান শোনাতে পারব না৷" ভক্তের গান শোনার জন্য মা — মন্দির সমেত দক্ষিন থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে গিয়েছিলেন৷ আজও সেই মন্দির বর্তমান৷ মন্দিরে কৃষ্ণকালী মূর্তি আছে৷ পৌষ মাসে জোড়া মূলা দিয়ে পূজা দিতে হয় সেই জন্য "মূলাজোড় কালী বাড়ী" নামে খ্যাত৷

মাকে দেখে বামাক্ষ্যাপা পরম শান্তি লাভ করেছিলেন৷ মায়ের অমন দিব্য সৌম্য রূপ দেখে বামাক্ষ্যাপা শান্ত হয়ে গেলেন। শ্যামনগরে গঙ্গায় স্নান করে বামাক্ষ্যাপা ওই রাত্রে নিজে মায়ের পূজাও করেছিলেন৷

শ্যামনগরের কালীবাড়িতে পূজা করে তারপর সেখান থেকে আবার রামকৃষ্ণ দেব ও বামাক্ষ্যাপা নৌকায় করে এসে বামাক্ষ্যাপাকে হাওড়া ষ্টেশনে ছেড়ে যান এবং নৌকায় রামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বরে চলে যান৷ বামাক্ষ্যাপা ফিরে যান তার তারা মায়ের কোলে তারাপীঠে।

জয় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, 

জয় শ্রীশ্রীবামদেব।


©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©

 

ঠাকুরকে  মথুর  বাবুর  পরীক্ষা-------


  ... সেই সময় পরমহংসদেবের বয়ঃক্রম অনুমান পঁচিশ বৎসর হইবে। তাঁহার শরীর অতিশয় বলিষ্ঠ ছিল এবং রূপ-লাবণ্যে চিত্ত চমকিত হইয়া যাইত। পূর্ণযুবক রামকৃষ্ণকে কেহই যুবা বলিয়া জ্ঞান করিত না। তাঁহার সহিত পঞ্চম বর্ষীয় বালকের ন্যায় সকলে ব্যবহার করিত। স্ত্রীলোকেরা তাঁহার সম্মুখে আসিতে কখনও লজ্জা করিতেন না, অথবা তাঁহাদের কোনমতে লজ্জার উদ্রেক হইত না।... 

   কলিকাতার অন্তঃপাতী মেছুয়াবাজারের লছমীবাঈ নাম্নী বারাঙ্গনার সহিত পরামর্শ করিয়া পরমহংসদেবকে তথায় লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। লছমীবাঈ একটি গৃহমধ্যে পনের ষোলটি  পূর্ণ যুবতী অর্ধোলঙ্গাবস্হায় রাখিয়াছিল। তাঁহাকে সেই গৃহের মধ্যে লইয়া গিয়া মথুরবাবু অদৃশ্য হইলেন।... এই সময়ে  পরমহংসদেব উলঙ্গাবস্হায় থাকিতেন; একখানি উত্তরীয় বস্ত্রের দ্বারা অঙ্গাবরণ থাকিত। তিনি দেখিলেন যে, গৃহটি যুবতীমন্ডলী দ্বারা পরিবৃত।

 তিনি তাহাদের সম্মুখে দন্ডায়মান হইবামাত্র অমনই সকলকে "মা আনন্দময়ী! মা আনন্দময়ী!"  বলিয়া মস্তকাবনতিপূর্বক প্রণিপাত  করিলেন এবং তাহাদের মধ্যস্হলে উপবেশন করিয়া "মা ব্রহ্মময়ী! মা আনন্দময়ী!" বলিতে বলিতে সমাধিস্হ হইয়া গেলেন। সমাধিকালে তাঁহার দুই নয়নে অনর্গল প্রেমাশ্রু বহির্গত হইতে লাগিল। বারাঙ্গনারা পরমহংসদেবের  ভাব অবলোকন করিয়া ভীত হইল এবং শশব্যস্ত হইয়া কেহ বায়ু ব্যজন করিতে লাগিল ও কেহ অপরাধিনী হইয়াছিল বলিয়া গললগ্নী-কৃতবাসে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল। এই ঘটনায় মথুরবাবু নিতান্ত লজ্জিত হইয়াছিলেন এবং পরমহংসদেবের প্রতি তাঁহার ভক্তি বাড়িয়া গেল। তিনি তদনন্তর তাঁহার পাদপদ্মে মন প্রাণ সমর্পণ করিয়া ক্রীতদাসের ন্যায় আপনাকে বিবেচনা করিতে লাগিলেন। 




(গ্রন্থঋণ - শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবৃত্তান্ত। লেখক - শ্রীরামচন্দ্র দত্ত)


(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন বিংশ শতাব্দীর দুই জিনিয়াস। এই দুই বিস্ময়-প্রতিভার সাক্ষাত্‍ আমাদের কৌতুহলের বিষয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিস্বরূপ দুই মনীষীর মোলাকাতজনিত মত-বিনিময়, যা কি না ৯২ বছর আগের ঘটনা, তা আজও যে-কোনও চিন্তাশীল মনের খাদ্য। এখনও তা উঠে আসে আলোচনায়। নানা প্রসঙ্গে বারবার।

কী কী বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন দুজনে? এক কথায় গূঢ়, কূট নানা প্রশ্নে আবর্তিত হয়েছিল ওঁদের বার বারের কথালাপ। প্রাথমিক পরিচয়ে দুজনে কবি ও বিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু মূলত ওঁরা দার্শনিক। ওঁদের খোঁজ রীতিমত গভীরে। জার্মান যুব আন্দোলনের উত্‍স সন্ধান, প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবজীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পে শব্দ সুর সঙ্গতি রেখা ও রঙের ভূমিকা - এ রকম সব প্রশ্নে ওঁরা চিন্তিত। তবে, যে বিষয়ে ওঁদের তর্ক এগিয়েছিল বহু দূর, যে বিষয়টা গত ৯২ বছরে ভাষ্যকারদের নজর কেড়েছে প্রভূত পরিমাণে, তা হল সত্যের স্বরূপ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাস্তব অবস্থা। তা কি মানুষের চেতনা-নিরপেক্ষ হিসেবে বিরাজমান? না কি সেই বাস্তবতা ওই চেতনারই নির্মাণ মাত্র?




কথালাপে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। 'মাই মেমরিজ অব আইনস্টাইন' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আর আমি জার্মান ভাষা জানি না। দোভাষীর পক্ষে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।" এ কারণে কারও কারও মতে, আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ আলাপ যেন দুই গ্রহের কথোপকথন। কেউ কারও বক্তব্য বোঝেননি।

তবু ওঁদের বাক্য-বিনিময় আকর্ষণীয়। দুটি কারণে। কথাবার্তায় ওঁরা দাঁড়িয়ে নিজ নিজ মেরুতে। যেন ঘোষণা করছেন জাতি-ধর্ম। কবির দাবি, সত্য চেতনা-নিরপেক্ষ নয়। তা মানুষের নির্মাণ। এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারেন কবি? তিনি যে স্রষ্টা। শব্দে-শব্দে নির্মাণ করেন সত্য। আর বিজ্ঞানী? অন্তত আইনস্টাইন মনে করেন, তিনি স্রষ্টা বই কিছু নন। নিজস্ব গুণাবলি নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আপনি বিরাজমান। গবেষকের কাজ সে সব গুণের সন্ধান। হায়, আইনস্টাইনের এই বিশ্বাস যে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে বিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তা যে বলে দিয়েছে, দৃশ্য থেকে দর্শক আলাদা নয়। দর্শক শনাক্ত না করলে দৃশ্য অবাস্তব। এ হেন বক্তব্য যে গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি আইনস্টাইনের, তা বলাই বাহুল্য। কবি আর বিজ্ঞানীর তর্কের দ্বিতীয় আকর্ষণ ঠিক এইখানে। কবির বীণায় যেন কোয়ান্টামের সুর।


{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}


শ্রী রামকৃষ্ণের অস্থি নিয়ে এক শোভা যাত্রা চলেছে সিমলা পাড়া থেকে কাকুরগাছি রামচন্দ্র দত্তর বাগানবাড়িতে। কলকাতা শহর এমন শোভাযাত্রা কোনো কালে দেখেনি। একজন সাধুর অস্থি নিয়ে তাঁর গৃহী ভক্তরা চলেছেন। কেউ সেই শোভাযাত্রাতে যোগ দিতে কোনো আমন্ত্রণ জানায় নি, পুরোটাই অন্তরের টান। 

সেই আনন্দ মিছিলে আছেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃবৃন্দ, সুফি সাধকগণ, বঙ্গ রঙ্গ মঞ্চের নট  নটী রা, গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু আবার বিনোদিনী, তিন কড়ি। আছেন পাদ্রীরা। যোগ দিয়েছেন বহু বার বনিতা। তাঁদের প্রানের ঠাকুর চলে গেছেন, তাঁদের তো আসতেই হবে। The Statesman কাগজে এই শোভাযাত্রার বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। Statesman লিখেছিল He inaugurated a spiritual movement in Bengal এক আধ্যাত্মিক আন্দোলনের নেতা রামকৃষ্ণ।

Chirstopher Isherwood স্বামী গম্ভীরানন্দের History of Ramakrishna Math and Mission এর ভূমিকাতে লেখেন Ramakrishna movement is the most important of all the existing religious movements of our time, no matter how important or large or venerable the others may be. 

হুগলী র ভাষাতে কথা বলা সহজ , সরল অথচ অতি বুদ্ধিমান ও সংবেদনশীল মানুষটি কলকাতাকে দেখছেন। কলকাতা পরাধীন ভারতের রাজধানী। গঙ্গার তীরে সাহেবরা নগরের পত্তন করেছেন। The second city after London. এই শহরের শিক্ষিত, ধনীদের চাল চলন ই আলাদা, ভারতবর্ষের অন্য কোন শহরের সাথে মিলে না। এখানে রামকৃষ্ণর জীবিত কালেই পরিশ্রুত পানীয় জলের এবং underground sewer system এর ব্যবস্থা করেছে কলকাতা পুরসভা। ঠাকুরের জন্মের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হিন্দু কলেজ যা পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ নামে বিখ্যাত। তৈরি হয়েছে ভারতের প্রথম মেডিক্যাল কলেজ, নাট্যশালা, মেয়েদের স্কুল। ঠাকুর দেখলেন একদিকে হত দরিদ্র মানুষ, অন্য দিকে শিক্ষিত জনেদের বিরাট অংশ পোকার মত কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। মিশলেন সকলের সাথে, কেশব সেন, দেবেন ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, জোসেফ কুক। গিরিশ চন্দ্রের মাধ্যমে বন্ধু হয়ে উঠলেন বাংলার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের কাছে। নাটক দেখতে গেলেন, চিড়িয়াখানায় গেলেন, সার্কাস দেখলেন আবার গঙ্গা দিয়ে জাহাজ, স্টিমার যাচ্ছে তাও দেখলেন।

তিনি মানুষের দুটো সমস্যা দেখলেন। এদেশে একদল লোক খেতে পায়ে না, আর অন্যদল অনুকরণ করতে করতে তার অতীত, ঐতিহ্য কে ভুলতে বসেছে। অন্যদিকে বিদেশে মানুষকে যন্ত্রে রূপান্তরিত করার খেলা চলছে। যন্ত্রের প্রাধান্য মানুষের চেয়ে বেশী।


তিনি ডাক দিলেন কলকাতার দিকে মুখ করে , ওরে তোরা কে কোথায় আছিস চলে আয়ে। সেই ডাক কি না শুনে থাকা যায়?  এলেন চাকুরিজীবি কিছু মানুষ, তার মধ্যে  ডেপুটি , ইংরেজি অফিসে চাকুরী করা মানুষ। এলেন যুবকের দল, এদের ওপর সবচেয়ে বেশী ভরসা তাঁর। এলেন স্কুল মাস্টার। সবাইকে নিয়ে শ্রী রামকৃষ্ণের বিশাল সংসার।

তিনি বুঝলেন গোটা পৃথিবীকে ধ্বংশের হাত থেকে বাঁচাতে পারে বেদান্ত দর্শন, যা মানুষের অনন্ত শক্তিতে বিশ্বাস করে। নরেন্দ্রনাথএর মধ্যে দিয়ে প্রচার করলেন শিব জ্ঞানে জীব সেবা। শোনালেন সেই মন্ত্র যদি জন্মেছ একটা দাগ কেটে যাও, ভালোবাসা, সেবার মধ্যে দিয়েই সেই দাগ কাটা যায়। ঈশ্বর জ্ঞানে মানব সেবা। আমার পাপী নারায়ণ, তাপী নারায়ণ, গুন্ডা, বদমায়েশ, লুচ্চা নারায়ণ।

বিদেশে বিবেকানন্দ শোনালেন দুটি নতুন কথা, universal individuality আর universal religion. নতুন কথা।নড়ে চড়ে বসল আমেরিকার শিক্ষিত সমাজ। স্বামীজী ঠাকুরের সমন্বয়ের বার্তা শোনালেন Help and not Fight, Assimilation and not Destruction, Harmony and Peace and not Dissension. 

রোল্যা বললেন two persons have drawn my respect because they with incomparable charm and power have realised the splendid symphony of the universal soul, they are Ramakrishna and Vivekananda.

স্বামীজী Sages of India বকতৃতা তে এবং পরে কলকাতার বক্তৃতায় বললেন all that have been life giving, strengthening, pure and holy has been his words, his inspiration, he himself. যা কিছু প্রেরণা দায়ক স ব তাঁর, তিনি স্বয়ং।

16 আগস্ট, 1886 চলে গেলেন  শ্রী রামকৃষ্ণ। রেখে গেলেন  মানুষ সম্বন্ধে তাঁর মহা মূল্যবান ধারণা।

_বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক aristotle বললেন_ *Man is a political animal,* _Karl Marx বললেন_ *Man is an economic animal,* _Freud বললেন_ *Man is a pleasure seeking animal,* _সবাই বললেন মানুষ পশুই তবে উন্নত তর পশু।_

_রামকৃষ্ণ বললেন -_

*Man is God,  মানুষ দেবতা।*


                            🙏🙏🙏

(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)(&)




*"নরেন,আমাকে একটা গরদের শাড়ি কিনে দিতে পারিস ? এটা আর পরা যায় না।"*

তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী (স্বামী বিবেকানন্দ'র মাতা )। আর কিছুর জন্য নয়, যে শাড়ি পরে আহ্নিক করছিলেন সেটা শতচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কথাটা : "আমাকে একটা গরদের শাড়ি কিনে দিতে পারিস ? এটা আর পরা যায় না।"মাথা হেঁট করল নরেন। সে বেকার, ভূতের বেগার খাটছে। কোথায় পাবে সে গরদ কেনার পয়সা? লজ্জা মা কেন পাবে, লজ্জা পেল ছেলে। 

সেদিনই এক মাড়োয়ারি ভক্ত এসেছে দক্ষিণেশ্বরে। সঙ্গে মিছরির থালা তার উপরে একখানা গরদের কাপড়। দেখে ঠাকুরের বড় খুশি খুশি ভাব।দুদিন পরে নরেন এসে হাজির। যাকে মানে না, সেই আবার টানে। "শোন, কাছে আয়---" নরেনকে ডাকলেন ঠাকুর ।নরেন কাছে এল। দাঁড়িয়ে রইল, বসল না।*"শোন, এই মিছরির থালা আর গরদখানা তুই নিয়ে যা-----"*উচ্চশব্দে হেসে উঠল নরেন। "আমি কি ছোট ছেলে, মিছরি দিয়ে ভোলাবেন? আর গরদ--?"

*"গরদখানা তোর মাকে দিবি। তার আহ্নিক করার শাড়ি ছিঁড়ে গেছে। এই গরদ পরে সে আহ্নিক করবে।"*বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল নরেনের। ---"আপনাকে কে বললে?"---"ওরে আমি জানতে পারি। শোন নিয়ে যা গরদখানা। তোর জন্য নয়, তোর মা'র জন্য বলছি।"--"মা'র জন্য আপনার কাছে ভিক্ষে করতে যাব কেন? যখন রোজগার করতে পারব তখন কিনে দেব মাকে।"

নরেন চলে গেল হনহন করে। তার তেজ দেখে ঠাকুর হাসতে লাগলেন। এই নাহলে নরেন্দ্র! রামলালকে ডাকলেন ঠাকুর। বললেন-"কাল সিমলায় নরেনের বাড়িতে যাবি। যখন দেখবি, নরেন বাড়িতে নেই, সটান চলে যাবি তার মা'র কাছে। এই মিছরির থালা আর গরদখানা দিয়ে বলবি আমি পাঠিয়েছি। সাবধান, নরেন যেন টের না পায়।"পরদিন দুপুরে লুকিয়ে অপেক্ষা করছে রামলাল। ঐ তো নরেন বেরোচ্ছে। মলিন চাদরখানা গায়ে ফেলে। অমনি ঐ ফাঁকে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে রামলাল। একেবারে ভুবনেশ্বরীর দরবারে।

'আপনাকে এই মিছরির থালা আর গরদখানা পাঠিয়ে দিলেন ঠাকুর।'--- *"গরদের কাপড় ! কি করে জানলেন তিনি? এইখানে বিলুর সাথে কি কথা হল, আর দক্ষিণেশ্বরে অমনি টেলিগ্রাম হয়ে গেল?"* .... সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এল নরেন। দেখল মা গরদের কাপড় পরে বসে আছেন পূজার ঘরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। 

চিরস্বাধীন নরেন থমকে গেল। কথা খুঁজে পেল না।।

!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%!%


ঠাকুর তখন খুব অসুস্থ।গলার ব্যাথার জন্য কেবল তরল সেবন করছেন।কতদিন তিনি ভাত খাননি।এমন সময় গিরিশ ঘোষ সেখানে এলেন।সব শুনে গিরিশ বললেন,

"আজ আপনাকে ভাত খেতেই হবে।"ঠাকুর বললেন,"বলো কি?তরল খেতেই কষ্ট পাই,ভাত খাই কি করে?গিরিশ জোর

করে বললেন,"আমার যিনি গুরু,তাঁর নামে যমরাজ পর্যন্ত

ভয় পায়।সেই গুরুর বলে বলিয়ান আমি।তোমার এ সামান্য

ব্যাথা আমি মুহূর্তে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি।"একথা শুনে

ঠাকুর ভয় পেয়ে গেলেন।গিরিশের যে পাঁচ সিকে পাঁচ আনা

ভক্তি বিশ্বাস।কি করে কে জানে।গিরিশ হাত জোড় করে চোখ বুজে মনে মনে একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে ঠাকুরের গলার উপর তিন বার ফু দিলেন।গলার উপর হাত বুলিয়ে

ঠাকুর বললেন,"কি আশ্চর্য্য,ব্যাথা ত নেই! এ শুধু গিরিশের

মন্ত্রের বলেই সম্ভব হয়েছে।"ঠাকুরের কথা শুনে ভক্তেরা সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের জন্য ভাত এবং মাগুর মাছের ঝোল প্রস্তুত করলেন এবং অতি শীঘ্র ঠাকুরের সামনে এনে রাখলেন।অনেক দিন পর ভক্তেরা মহানন্দে ঠাকুরের অন্ন ভোজন দর্শন করলেন।এই অন্ন ভোগ ঠাকুরের শেষ অন্ন ভোগ।কি মন্ত্র বললেন গিরিশ?"হে আমার গুরুদেব,তুমি যদি সত্যি সত্যি বানছাকল্পতরু হও ,তবে আমার প্রার্থনা,

তোমার কৃপায় তোমার গলার ব্যাথা মুহূর্তের মধ্যে সেরে যাক।তাহলেই বুঝব তুমি সত্যিই ভগবান।"ঠাকুর জানতেন

গিরিশ বিশেষ একটা কিছু ঘটাতে চলেছে,তাই ফু দেবার সাথে সাথে তার মনবাসনা পূর্ণ করে দিলেন।কে জানে যদি আরো কিছু চেয়ে বসে গিরিশ।আর কিছু চাইতে পারেনি সে।

তাই পরদিন থেকে ঠাকুরের পূর্বের  মতই যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো।

জয় ঠাকুর 🙏




**  দ্বাদশ বছর কঠোর সাধনার পরে  সিদ্ধি লাভ করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ । ভিন্ন মত ও পথ পরিক্রমা করে আবিষ্কার করলেন---  ""  যত মত,  তত পথ  । ""  

                        তারপর তিনি গেলেন ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের  রাজধানী কলকাতা জয় করতে  । শরীর কোমল ।  তাই একদিন ঠাকুর কেঁদে বলেছিলেনঃ 

     গৌর নিতাই ঘরে ঘরে পায়ে হেঁটে যেতেন ,  কিন্তু আমি গাড়ি না হলে যেতে পারি না !  "" নড়বড়ে ছ্যাকড়া ঘোড়ার গাড়িতে ঠাকুর কলকাতায় যেতেন ।  

    কাশীপুর  ---  বরানগরের ইট   ---  পাথরের এবড়ো  -- থেবড়ো রাস্তার গাড়ির ঝাঁকুনিতে পেটের ভাত হজম হয়ে যেত  -----    এখনো যায়  । তাঁর সঙ্গে যেতেন নিরক্ষর লাটু  ,  বাবুরাম বা রামলাল ।  তাঁর কাছে থাকত নিজের গামছা খানি  এবং বোটুয়াতে মৌরী,  কাবাবচিনি  ও    লবঙ্গ  ।  ঐসব চিবোতে চিবোতে ঠাকুর যেতেন কলকাতা অভিযানে  ।  গাড়িতে বসে হাসি- ঠাট্টা চলত আর দরজার ফাঁক দিয়ে ইতিউতি চাইতেন  ।  কলকাতায় পৌঁছে ঠাকুর তাঁর প্রথম মহাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন ব্রাহ্মদের  ।  ব্রাহ্মমন্দিরে মাথা নুইয়ে প্রনাম করলেন  ;  তারপর ব্রাহ্মমন্ডলীকে উদ্দেশ করে """  আধুনিক   ব্রহ্মজ্ঞানীদের প্রনাম ""  বলে মাথা নত করে প্রনাম করলেন ।  কেশব সেনের সঙ্গে  ""  কলুটোলার  বাড়িতে  দেখা হলো  ;  হৃদে সঙ্গে ছিল  ।  কেশব সেন যেঘরে ছিল  ,  সেই ঘরে আমাদের বসালে ।  টেবিলে কি লিখছিল  ,   অনেকক্ষণ পরে কলম ছেড়ে কেদারা থেকে নেমে বসলো  ;   তা আমাদের নমস্কার-  টমস্কার করা নাই  ,,,,, ।  এখানে অনেকবার এসেছিল দলবল নিয়ে ।  তারা এলেই আমি নমস্কার করতুম  ,   তখন ওরা ক্রমে ভূমিষ্ঠ হয়ে নমস্কার করতে শিখলে   ।  """""ঠাকুর ব্রাহ্ম নেতার মাথা মাটিতে নত করে দিলেন ।

 

          ডঃ আব্দুল ওয়াজীজ রামচন্দ্র দত্তের সঙ্গে ঠাকুরকে দেখতে দক্ষিণেশ্বর যান । তিনি তাঁর স্মৃতিকথাতে বলেছেনঃ   """"     আমরা প্রনাম করিব না,  ইহাই ঠিক করিয়াছিলাম,   কারণ আমাদের ধর্ম অনুসারে একমাত্র আল্লা ভিন্ন কাহারও নিকট মাথা নোয়াইতে নাই  ।  কিন্তু তিনি  (ঠাকুর  )  আমাদের সম্মুখে আসিয়া নতভাবে আমাদিগকে প্রনাম করিলেন,

আমরাও তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া তাঁহাকে প্রনাম করিতে বাধ্য হইলাম ।   """""

তারপর এল ইয়ং বেঙ্গল ।  গিরিশচন্দ্রের ভাষায়, 

"""   তাহারাই সমাজে মান্যগণ্য ও  বিদ্বান পরিগনিত ছিলেন ।   বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার  তাহরাই প্রথম ফল । তাহাদের মধ্যে অনেকেই জড়বাদী  , অল্পসংখ্যক ক্রিশ্চিয়ান হইয়া গিয়াছিলেন  এবং কেহ কেহ  ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করেন  ।  কিন্তু হিন্দু ধর্মের প্রতি আস্থা তাহাদের মধ্যে প্রায় কাহারো ছিল না  , বলিলেও বলা যায়  ।  """ 

     এই ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিনিধি গিরিশচন্দ্র ঘোষকে ঠাকুর স্টার থিয়েটারে ""  চৈতন্যলীলা ""   দেখতে গিয়ে 

নমস্কার করেন ।  গিরিশচন্দ্র প্রতি  --  নমস্কার করলে ঠাকুর আবার নমস্কার করেন । শেষে ঠাকুরের প্রনাম-- 

 অস্ত্রে পরাজিত হয়ে গিরিশ পরে বলেনঃ  """"  রামঅবতারে ধনুর্বাণ নিয়ে জগৎ জয় হয়েছিল, 

কৃষ্ণঅবতারে জয় হয়েছিল বংশীধ্বনিতে  ,  আর রামকৃষ্ণঅবতারে জয় হবে প্রণাম অস্ত্রে ।  """""


    ঠাকুর বাগবাজারের সেরা গুন্ডা মন্মথকে  ""  কি গো  """  ? বলে একটু ছুঁয়েই কাৎ করে দিলেন । সে 

হাঁটু গেড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে ।  যোগীন-- মার ভাইয়ের পরামর্শে মন্মথ ঠাকুরকে ভয় দেখাতে এসেছিল । পরবর্তী কালে মন্মথ ঠাকুরের বিশেষ ভক্ত হয়ে দিনরাত """  প্রিয়নাথ  প্রিয়নাথ  "" বলে কাঁদত ।  """"""""""""

স্বামী চেতনানন্দ ।


🌼  বারাণসী রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনন্য 

       কিছু বিশেষত্ব  🌼


স্বামীজীর শেষ ইচ্ছে, শেষ স্বপ্ন বারাণসী ধামে রামকৃষ্ণ আশ্রম।যা কিনা বিশ্বের আর কোথাও রামকৃষ্ণ আশ্রমের সঙ্গে মেলে না।

বিষয়টি এই রকম :

বিশ্ব বিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ এসেছেন কাশী বিশ্বনাথ দর্শনে। সঙ্গে গুরুভাই শিবানন্দজী মহারাজ ( মহাপুরুষ মহারাজ )।

এখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে কিছুদিন তাঁরা ছিলেন। সেই সময় স্বামীজীর নাম ডাক দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

স্বামীজী যে ভাড়া বাড়িতে ছিলেন, ঠিক তার থেকে কিছু দূরে একটি বাগান বাড়ি ছিল, এবং সেই বাগান বাড়িতে একজন রাজা তপস্যা করতে এসেছিলেন। তার নাম ছিল উদয় প্রতাপ সিং। তিনি স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তার ব্রত চলাকালীন তিনি নিজে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে পারেন নি। 

তার অনুরোধে স্বামীজী নিজেই তার সঙ্গে দেখা করতে যান। স্বামীজীর সঙ্গে কথা বলে তাঁর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে মহারাজ উদয় প্রতাপ সিং অবাক হয়ে যান। 

স্বামীজীকে তিনি প্রস্তাব দেন কাশীতে একটি রামকৃষ্ণ আশ্রম গড়তে। উত্তরে স্বামীজী বলেন - এই মুহূর্তে আমার লোকবল তেমন নেই, তবে ভবিষ্যতে অবশ্যই আপনার ইচ্ছের সম্মান রাখবো।

পরদিন মহারাজ স্বামীজীকে পাঁচশো টাকা দিয়ে পাঠান। স্বামীজী সেই অর্থ সাদরে গ্রহণ করেন।

এরপর স্বামীজী কলকাতায় ফিরে আসেন।এই ভাবে বেশ কিছুকাল কেটে যায়।

একদিন স্বামীজী, স্বামী শিবানন্দজী মহারাজকে কাশীতে মহারাজ উদয় প্রতাপের কথাগুলো মনে করিয়ে দেন।কাজে বিলম্ব হওয়ায় স্বামীজী মহাপুরুষ মহারাজজীকে একটু ধমক দিয়ে বলেন - আমরা সন্ন্যাসী, রাজার কাছে পাঁচশো টাকা নিয়ে চুপ করে বসে আছি, এতে কি আমাদের মান সম্মান থাকে ? 

এই কথার পর কাজে বিলম্ব না করে মহাপুরুষ মহারাজ কাশীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সঙ্গে নিলেন আরেক সন্ন্যাসী স্বামী অচলানন্দজীকে।

প্রথমে তাঁরা একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে মোটামুটি ভাবে সঙ্ঘের কাজ শুরু করেন। এই ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর কাশীতে কিছু ভক্ত অনুরাগী এসে এই সঙ্ঘে যোগ দেন। শুরু হয় নতুন জায়গার খোঁজ।খুঁজতে খুঁজতে একটি বাগান বাড়ি পেয়ে যান। সেই বাগান বাড়ির নাম ছিল খাজাঞ্চীর বাগান বা স্থানীয় ভাষায় শেঠজীর বাগান। 

মাসিক দশ টাকা ভাড়ায় বাগানটি নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি চিত্রপট যোগার করা যাচ্ছিল না। শেষে সেটিও যোগাড় হয়ে যায়। 

এরপর মহাপুরুষ মহারাজজী বলেন - ঠাকুরের সঙ্গে স্বামীজীরও পূজা করা প্রয়োজন।কারণ ঠাকুর আর স্বামীজী অভিন্ন। শেষে স্বামীজীর এক শিষ্যের কাছে স্বামীজীর একটি চিত্রপট পাওয়া যায়। 

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কাশীর রামকৃষ্ণ আশ্রমের সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো রামকৃষ্ণ আশ্রমের মিল নেই। এইখানে একমাত্র স্বামীজী হাতে একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির পূজা হয়। বাকি পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় ধ্যান রত মূদ্রার চিত্রপটের পূজা হয়। সারা বিশ্বে এই  প্রথম আশ্রম যেখানে প্রথম ঠাকুরের পাশে স্বামীজীকে বসিয়ে পূজা করা হয়। 

দিনটি ছিল ৪ঠা জুলাই ১৯০২, স্বামীজীর মহাপ্রয়াণ দিবস।

এই আশ্রমের আরও বৈশিষ্ট্য আছে :

১৯১২ সন,  সঙ্ঘ জননী কাশী বিশ্বনাথ দর্শন এবং এই আশ্রম দর্শনে এসেছেন। কিন্তু শাড়ির আঁচলের নীচে ঢেকে রেখেছেন আরও একটি চিত্রপট।  মা সেদিন নিজে  পূজা করতে বসলেন। কিন্তু সেদিন মা যে চিত্রপটের পূজা করলেন, সেটি আর অন্য কারো নয়, স্বয়ং মা নিজের চিত্রপট বসিয়ে নিজের পায়ে প্রথম ফুল দিলেন।  ঠাকুর ও স্বামীজীর সহিত এই প্রথম মায়ের পূজা শুরু হলো।

কাশীধাম রামকৃষ্ণ আশ্রম পরিণত হলো শক্তিপীঠে। 

অবশ্য পরে মা কোয়াল পাড়ায় নিজের ছবির পূজা নিজে করেছিলেন, তবে সেখানে ঠাকুর ও স্বামীজী ছিলেন না। মা এই কাশীর আশ্রমে নিজের পূজা করার পর স্বামী সান্তনানন্দ মহারাজকে আদেশ দেন, প্রতিদিন দুটো করে ফুল তাঁর ঐ চিত্রপটের শ্রীচরণে দিতে।

কাশী রামকৃষ্ণ মন্দিরের  ড্রইং করেছিলেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী মহারাজ। স্থানীয় আদলে নির্মিত হয় মন্দিরটি,যা কিনা অন্য কোনো রামকৃষ্ণ আশ্রমের সঙ্গে মিল নেই।১৯৩৬ সালে মন্দিরটি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করা হয়।

এই মন্দির নির্মাণকালে শিবানন্দজী মহারাজ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। বাগান বাড়িটি ঝোঁপ জঙ্গলে ভরা ছিল।  ছিল না কোনো দরজা। মহারাজজী শীতের রাতে ঘাস বিছিয়ে তার উপর হরিণের চর্ম পেতে শুতেন। মশার কামড়ের জন্য সারারাত আগুন জ্বালিয়ে রাখতেন। দরজা না থাকার দরুণ শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সামনে বস্তা ঝুলিয়ে রাখতেন।

এই সময় মহারাজজীর সঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। একরাতে মহারাজজী ধ্যানে বসেছেন।যখন তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন,  তখন তিনি দেখলেন, ওনার সামনে স্বয়ং শিব দাঁড়িয়ে আছেন। এই দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে মহারাজজীর সবকটি কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে যায় এবং মহারাজজীর জীবন যায় যায় অবস্থা পৌঁছে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে শিব অদৃশ্য হয়ে গেলেন, এবং সেই স্থানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবির্ভাব হলেন। ঠাকুর ব্যাস্ত হয়ে মহারাজজীকে বললেন - ওরে থাম থাম, এক্ষনি নয়, এখনও ঢের দেরি আছে, তোকে অনেক কাজ করতে হবে। এই দর্শনের পর মহারাজজী আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।

পরে  মহারাজজী এই কথাগুলো বলতে গিয়ে বলেছিলেন - কাশীর আশ্রম আমি চালাই না। ঠাকুরের আশ্রম ঠাকুরই পরিচালনা করেন আমার মাধ্যম দিয়ে। 

শিবানন্দজীকে এই সময় অনেক অপমানও সহ্য করতে হয়েছিল।

মহারাজজী একজন স্থানীয় যুবককে মন্দিরের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। একদিন সেই যুবক বেশ কয়েকমাসের বাড়ি ভাড়ার পঁচাত্তর টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। রেখে যায় এক পয়সা।  বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর মহারাজজী যুবকটির উপর রাগ না করে বরং প্রশংসা করে বলেন - দাখো, ছেলেটি সমস্ত কিছু নিয়ে যায় নি, ঠাকুরের জন্য বাতাসা কেনার পয়সা টুকু রেখে গেছে। আজ এই এক পয়সার বাতাসা কিনে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হবে। 

কিন্তু বাড়ির মালিক ভাড়া না পেয়ে সারাদিন মহারাজ জীকে একপ্রকার বন্দি বানিয়েছিল।  পরে সন্ধ্যায় ভক্ত অনুরাগীদের হস্তক্ষেপে মহারাজজীকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য এখানেই শেষ হয় না।

ঠাকুরের প্রথম মূর্তি এখানেই স্থাপন করা হয়।  কলকাতার একজন মহিলা প্রথম এই কাশীর আশ্রমে ঠাকুরের মার্বেল মূর্তি স্থাপন করিয়েছিলেন। পরে মূর্তিটি বাতিল করা হয়।কারণ, মার্বেলের গায়ে কিছু কালো দাগ ছিল। পরে  ব্রহ্মানন্দজী, সারদানন্দজী,  গৌরী মায়ের হস্তক্ষেপে ঠাকুরের মূর্তির আরও কিছু খুঁত সংশোধন করা হয়।  যেমন, ঠাকুরের কান দুটি শুরু হয়েছিল, তাঁর চোখের নীচ থেকে।আর দ্বিতীয় খুঁত ছিল, ঠাকুর কখনও কুঁজো হয়ে বসতেন না। তিনি সর্বদা সোজা হয়ে বসতেন। তাঁর হাত জোড়া অন্য সকলের থেকে আলাদা ছিল।যা কিনা প্রায় লম্বায় হাঁটুর কাছে পৌঁছাতো। তাই ঠাকুরকে কোনদিন ঐ মুদ্রায় বসবার জন্য কুঁজো হতে হয় নি।

এই মন্দিরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল :

লাটু মহারাজ ( অদ্ভুতানন্দজী )  প্রায় এসে এখানে থাকতেন। ওনার জন্য দ্বিতলে একটি ঘর রাখা হয়েছিল। আর ঠিক তার নীচেই একটি হনুমানজীর মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। কারণ, লাটু মহারাজের হনুমানজীর প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল।  এই একটি মাত্র রামকৃষ্ণ আশ্রম যেখানে নিত্য হনুমানজীর পূজা হয়। 

পৃথিবীর আর কোথাও কোনো রামকৃষ্ণ আশ্রমে এমন হয় না।

বর্তমানে এই আশ্রমে একটি গোশালা নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিত্য অরুণোদয়ের সময় গরুগুলোকে ভজন কীর্তন শোনানো হয়, যা বিশ্বের আর কোনো রামকৃষ্ণ মঠ, মিশন বা মন্দিরে হয় না।

এই হলো কাশী রামকৃষ্ণ মন্দিরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

  জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ 🙏 

  জয় মা 🙏

  জয় স্বামী বিবেকানন্দ 🙏


[¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢][¢]


দক্ষিণেশ্বরের রাণী রাসমণির রুপোর রথ —

  

একদিন পুজোয় বসে রাণী মা স্বয়ং রঘুবীরের আদেশ পান। রঘুবীর তাঁকে জানান যে তিনি রথে আহরণ করতে চান। তাঁকে যেন রথে আহরণ করিয়ে ভ্রমণ করানো হয়। রঘুবীরের এই আদেশ পাওয়ার পর রাণী মা সিদ্ধান্ত নেন তিনি ঐ বছর রথ বার করবেন। সেই অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

রাণী মা খুব ঘটা করে পুজো উৎসবাদি করতেন। শহরের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যেত। রাণীর কথা ছিল, যা হবে কখনো ছোট খাটো হবে না। সকলকে নিয়েই উৎসব। আর উৎসব উপলক্ষে যতটা পারা যায় মানুষের সেবা করার প্রবণতা। "আমি এক রাণী সদাই তোমাদের পাশে আছি"

একদিন রাণী মা তার প্রিয় জামাতা মথুরামোহন কে ডেকে বলেন, "মথুর, আমার ইচ্ছে হয়েছে রুপোর রথে আহরণ করিয়ে রঘুবীর কে কলকাতার রাজপথে ভ্রমণ করাবো, "চকচকে রুপোর রথ"। মথুরামোহন বললেন, ঠিক আছে আমি আজই বিখ্যাত সাহেব  হ্যামিলটন কোম্পানিতে বায়না দিয়ে দিচ্ছি"। রাণী মা মৃদু হেসে মিষ্টি গলায় বললেন, দেশি কারিগর থাকতে বিদেশি কারিগরের কাছে যাবে কেন ?


মথুরা মোহন কলকাতার উদয়মাণ বড়লোক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি রাণী মার কথায় একটু চমকে গেলেন। বললেন, 'বেশ তাই হোক' দেশি কারিগর ডাকা হোক। ঠিক সময়ে রথ প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রভূত আড়ম্বরে স্নানযাত্রার পূণ‍্য দিনে রথ প্রতিষ্ঠা করা হলো। রথ তৈরি করতে সেইসময়ে খরচ হয়েছিল এক লক্ষ বাইশ হাজার একশো পণেরো টাকা।

রথের দিন রাণীমা সুসজ্জিত রথ সাজিয়ে তাতে তাঁর ইষ্ট দেব রঘুবীর কে চাপিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রা আয়োজন করেন। তার জামাইরা খালি পায়ে রথ এর আগে চলছেন। রাণীর নাতি-নাতনিরা বিভিন্ন রকমের গাড়ি চড়ে রথের পেছনে, এরপর বিরাট শোভাযাত্রা। গোটা কলকাতার মানুষ একটা সমরোহ দেখলে বটে।

রাণী রাসমণি প্রচলিত সেই রথ উৎসব আজো পালিত হয়ে আসছে মহাসমারোহে দক্ষিণেশ্বরে। সেই প্রাচীন রুপোর রথ তাতে অধিষ্ঠান করেন জগন্নাথ। তারপর গোটা দক্ষিণেশ্বর ভ্রমণ করেন।

@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@

জয় জগন্নাথ 

রথযাত্রার ইতিহাস —

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অনেকদিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। একদিন তিনি গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর রাঙা চরণকে টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসল এক শবর। নাম তার জরা। বাণের আঘাতেই অবশেষে দেহত্যাগ করলেন শ্রীকৃষ্ণ।

অপঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ তো পুড়ছে না !

তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর – জরা। শেষ অবধি তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের ! 

দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলা। অবশেষে এখানেই ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে, এখন থেকে তোর বংশধর, শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি’। তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ।

এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে। এখন আমরা তাকে চিনি জগন্নাথধাম রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই।

রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীলমাধবের কথা। ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা। এঁদের প্রত্যেকেই ধার্মিক ব্রাহ্মণতনয়। বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন – বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি।

ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের। বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান বিশ্ববসু ! স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু।্

ষ্নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন, তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে। বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত।দিলেন। তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোন ভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু।

বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল।

বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, অমনি দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’

ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে। বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ভগবানকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায় ! আটক হলেন শবররাজ।


তখন দৈববাণী হল যে, 'পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণ করার।'

হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। শেষে কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে !

রাজা তাঁর কারিগরদের লাগালেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। মূর্তি নির্মাণের জন্য রাজা, একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী পরিচয়ে, তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য একুশদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে একটি শর্ত দেন, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।

বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় মূর্তি নির্মাণের কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ খোদাইয়ের কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। কী হল !


অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত হয়েছেন। কথিত আছে, এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন আসলে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।


কিন্তু মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কৌতুহলবশত, তারা যে ভুল করে ফেলেছেন, তার জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তৎ মুহূর্তে দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। একদা দ্বারকায় আগমনকালে নিজ মাতার মুখে নিজেরই বাল্যলীলার কথা শ্রবণে আনন্দবিহ্বল কৃষ্ণ, সুভদ্রা ও বলরামের হস্ত-পদ গলে গিয়েছিল। জগন্নাথ অনন্য, তাঁর হস্ত-পদ নিষ্প্রয়োজন, কারণ যিনি সর্বব্যাপী তার স্থানপরিবর্তন এর কোনরূপ প্রয়োজন হয় না। তিনি যে চিরদ্রষ্টা পরমাত্মা, তাই তাঁর জগদপ্রসারী চক্ষু বর্তমান। জীব তাঁকে যা অর্পণ করে তিনি তাই সহাস্যবদনে দশগুণ ফিরিয়ে দেন।


এরপর জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা পুরুষোত্তমক্ষেত্র নীলাচলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর সম্মুখে দারুব্রহ্মরূপে প্রকটিত হয়েছিলেন। রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন যে এমনটা আগে থেকেই পুনর্নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।


পুরীর মন্দিরের বর্তমান স্থান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্ত্তৃক নির্বাচিত হয়। ১১১৯ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাবংশের রাজা ভীমদেব কর্তৃক জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মিত হয় এবং পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত বৈশাখ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়।


জগন্নাথদেবের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। ‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।

পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এরপর আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীর দিন পূর্ণযাত্রা বা উল্টোরথ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যদিও আষাঢ় মাসের পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম। কিন্তু প্রতি বছর তো আর পুষ্যানক্ষত্রের সঙ্গে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথির যোগ হয় না, তাই কেবল ওই শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা শুরু হয়ে থাকে। তবে কখনও এই তিথির সঙ্গে পুষ্যানক্ষত্রের যোগ হলে সেটি হয় একটি বিশেষ যোগ-সম্পন্ন রথযাত্রা।

আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব, বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি। প্রথমে যাবেন বলরামের রথ, তারপর সুভদ্রা এবং সর্বশেষে মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ এবং উল্টোরথ বলে।

জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা তিনজনের রথ তিন রকমের হয়। জগন্নাথের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। উচ্চতা ৪৫ ফুট। রথের গায়ে হলুদ এবং সোনালি রং। চলার জন্য এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। রথের সারথির নাম দারুক। লাল ও সবুজ রঙের বলরামের রথ ‘তালধ্বজ’। উচ্চতায় জগন্নাথের তুলনায় এক ফুট ছোট। রথে ছ’ফুট ব্যাসের চোদ্দটি চাকা থাকে। সারথি মাতলী। সুভদ্রার রথ ‘দর্পদলন’। উচ্চতা ৪৩ ফুট। রথের রঙ লাল এবং কালো। চাকা বারোটি, প্রত্যেকটির ব্যাস পাঁচ ফুট। এই রথের সারথি স্বয়ং অর্জুন। প্রতিটি রথেই সাতজন করে পার্শ্বদেবী অধিষ্ঠিত। সেই সঙ্গে দু’জন করে দ্বারপাল, একজন করে সারথি এবং একজন করে ধ্বজাদেবতা।

জগন্নাথদেবের রথের প্রতিটি অংশই অতি পবিত্র, কারণ তিনটি রথেই বিরাজ করেন তেত্রিশ কোটি দেবতা। তাই এই রথের রশি একটু স্পর্শ করা বা টানা মানে এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ স্পর্শ করা। জগন্নাথদেবের রথের রশির নাম বাসুকি। ধার্মিক সনাতনী হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, রথের রশি ছোঁয়ার থেকে বড় পুণ্য আর কিছুতে হয় না। জগন্নাথদেবের রথের রশি ধরে টানতে পারলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। পুুরাণের মতে, জগন্নাথের রথের রশি সামান্য স্পর্শ করলেও পুনর্জন্ম হয় না। কপিল সংহিতায় উল্লেখ আছে - ”গুণ্ডিচাখ্যং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি মুদনিতাঃ/সর্বপাপ বিনির্মুক্তাস্তে যান্তি ভুবনং মম।” অর্থাৎ ‘গুণ্ডিচা যাত্রায় যে ব্যক্তি আমায় দর্শন করবে সে কালক্রমে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমার (জগন্নাথদেবের) ভুবনে যাবে।‘

বাংলাতেও অনেক জায়গায় সাড়ম্বরে রথযাত্রা পালিত হয়। যেমন - ইস্কনের রথ, মাহেশের রথযাত্রা। বাংলায় রথযাত্রা সংস্কৃতির সম্ভবত সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল অর্থাৎ পুরী যাওয়ার পর। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। যাত্রা শব্দের অর্থ গমন। তাই জগন্নাথের রথযাত্রা এবং উল্টোরথ হিন্দু-বাঙালিদের কোনও কাজ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সূচনার পবিত্রদিন হিসেবে গণ্য করা হয়। বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপূজোর সূচনাও হয় এই রথ কিংবা উল্টোরথের দিন।

জয় জগন্নাথ 

&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*&*

খাদ্যরসিক বিবেকানন্দ  :: 

 খাদ্যরসিক স্বামী বিবেকানন্দ আইসক্রিম খেতে খুব ভালবাসতেন। বেলুড়ে বোধ হয় তখন আইসক্রিম বানানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না থাকায় তিনি এই মনোহর জিনিসটি বানানোর ইচ্ছা দমন করে রেখেছিলেন। 

বিলেত যাওয়ার আগে পিতৃগৃহে স্বামীজি কুলপি খেতেন; কলকাতায় যখন প্রথম বরফ  আসে তখন ওই দুর্লভ কুলপি খুব কম সময়ের মধ্যেই সিমলের দত্ত বাড়িতে হাজির হয়েছিল। সেই প্রাক-রেফ্রিজারেটর যুগে দত্তবাড়িতে বরফের বাক্সের মধ্যেই খাবার, ফল, দুধ রাখার রেওয়াজ ছিল। আমরা এও দেখেছি, নরেন্দ্র ডাবের খোলের ভিতরে চিনি দিয়ে সেই ডাবের খোলে বরফ দিয়ে খেতে খুব ভালবাসতেন। তিনি কুলপি-বরফের স্বাদ আগে থেকেই জানতেন, তাই বিদেশে আইসক্রিমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সহজেই। দেশে এই কুলপিকেই আইসক্রিম বলে চালিয়ে দিতেন তিনি।   

বারংবার বিদেশ গিয়ে আইসক্রিমের উপরে তাঁর একটা টান তৈরি হয়েছিল। স্বামীজির প্রিয় ছিল চকোলেট আইসক্রিম।  

একবার স্বামীজি আইসক্রিম আস্বাদন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন –“ম্যাডাম, ফুড ফর গডস। আহা সত্যিই স্বর্গীয়!”  

লেগেট পরিবারে থাকার সময়ে ধূমপানের টানে স্বামীজি সান্ধ্য-আহারের পর ঝটপট ডিনার টেবিল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন। স্বামীজিকে ধূমপান থেকে বিরত করে টেবিলে আটকে রাখার জন্য স্নেহময়ী মিসেস বেটি লেগেট খুব সহজতম উপায়টি আবিষ্কার করেছিলেন; স্বামীজি টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়ার ঠিক আগেই ঘোষণা করতেন –“আইসক্রিম আছে।” অমনি ছোটছেলের মতো স্বামীজি নিজের সীটে বসে থাকতেন আর তৃপ্তি সহকারে তা খেতেন। 


বিদেশে তিনি বক্তৃতার  পরে আইসক্রিম খেতেন প্রায়ই। একদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর সান্ধ্য বক্তৃতায় নরক সম্বন্ধে তিনি অনেক কথা বলেন। বক্তৃতার শেষে তাঁকে নিয়ে ভক্তেরা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার পথে বাইরের ঐ হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে স্বামীজি বলেন –“এ যদি নরক না হয় তাহলে নরক কাকে বলে জানি না।” 

রেস্তোরাঁয় ঢুকে ঐ ঠাণ্ডাতেও স্বামীজি আইসক্রিমই খেতে চাইলেন; দোকানের মালিককে বললেন –“দয়া করে দেরী করবেন না, তাহলে ফিরে এসে দেখবেন একতাল চকোলেট আইসক্রিম।” অর্থাৎ সকলে ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে গেছেন।  

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে বিদেশের এই অঢেল ঠাণ্ডা খাবার নিয়ে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন  স্বামীজি –

“দুধ আছে, দই আছে, ঘোল অপর্যাপ্ত।”  ক্রিমের চমৎকার বাংলা করেছেন তিনি –‘মাঠা’; - “মাঠা সর্বদাই ব্যবহার চায়ে, কফিতে, সকল তাতেই মাঠা – সর নয়, দুধের মাঠা। মাখন তো আছেন – আর বরফ জল – এন্তের বরফজল – আর কুলফি – এন্তের নানারকমের(আইসক্রিম)।” 



আইসক্রিমের প্রতি অস্বাভাবিক টান তাঁর দেশে এসেও অব্যাহত ছিল।  নিবেদিতার চিঠিপত্র পড়ে জানা যায় – তিনি নিবেদিতার কাছে একআধ বার আইসক্রিম খাওয়ার আব্দার করেছেন। নিবেদিতা বেশ চিন্তায় পড়েছিলেন – কারণ স্বামীজি তখন ডায়াবিটিসের রোগী। তবুও গুরুগতপ্রাণা প্রায় নিঃস্ব নিবেদিতা চেষ্টা করেছেন গুরুর  ইচ্ছা পূরণ করতে; বাগবাজার থেকে আমেরিকায় মিস ম্যাক্লাউডকে লিখেছেন সেই কথা –

“আগামীকাল এস(সদানন্দ?) এবং আমি ওঁর আইসক্রিমের জন্য পাঁচটাকা খরচ করবো – বেজায় বড়লোকি, কিন্তু উনি চাইছেন!” 

অনেকের সবিনয় অনুসন্ধান – খাওয়ার জন্য অযথা দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হলে স্বামী বিবেকানন্দ কি একটু অধৈর্য হয়ে উঠতেন?  

সেটাই স্বাভাবিক। বাবামায়ের কত আদরের সন্তান, অথচ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে  দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য নিতান্ত সহায়সম্বলহীন অবস্থায় বাকি জীবনটা পথে পথেই কাটিয়েছেন। পরের দিনের অন্ন কিভাবে আসবে তা পর্যন্ত সন্ন্যাসীর অজানা ছিল। শরীর যখন আর নিতে পারছে না, রোগে জর্জরিত স্বামীজি কাছের মানুষদের কাছে অভিমান করতেই পারেন। এছাড়া স্বামীজি নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতায় একনিষ্ঠ, তা শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য। 

সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে ১৮৯৫ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন –“ভোগের নামে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না।” 

আর এক চিঠিতে লিখে সাবধান করে দিয়েছেন গুরুভাইদের  – ঠাকুরের জন্মোৎসবে যেন খাওয়াতে খাওয়াতে দিন না চলে যায়। কি ধরণের আয়োজন করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে থাকবে ভাবছেন যখন, তখন তিনি নিজের কথা মোটেও ভাবছেন না। তবে স্বামীজির রাগ-অভিমান সবই নিজের আপনজনেদের মধ্যে। সকলেই তাঁরা জানতেন – রাগ হলে স্বামীজি খাবার ফিরিয়ে দিতে পারেন। 


মধুমেহ রোগের জন্য স্বামীজির আইসক্রিম-প্রীতি চলে গেলেও, ইলিশ আর পুঁইশাকের কম্বিনেশন স্বামীজির শেষ পর্যন্ত বহাল ছিল। এক স্নেহময়ী বলেছেন –“পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি মাছ হলেই নরেনের কথা মনে পড়ে যায়।” 

যেমন চাবি আর তালা, হাঁড়ি আর সরা, হর আর পার্বতী – তেমনি এই ইলিশ আর পুঁইশাক স্বামীজির জীবনে। কান টানলেই মাথা আসার মতো, স্বামীজি ইলিশ এলেই পুঁইশাকের খোঁজ করতেন। একবার তিনি গোয়ালন্দের পথে চলেছেন স্টিমারে করে। একটা নৌকায় জেলেরা ইলিশ মাছ জালে তুলছে। তিনি বললেন –“বেশ ভাজা ইলিশ খেতে ইচ্ছে করছে।” সারেঙ বুঝে গিয়েছে সব খালাসীদের খাওয়ানোর ইচ্ছা হয়েছে স্বামীজির। বড় বড় ষোলোটি ইলিশ এক টাকার বিনিময়ে কিনলেন স্বামীজি, সঙ্গে  দুচারটি ফাউ। স্টিমার এক জায়গায় থামানো হল। স্বামীজি অমনি বললেন –“পুঁইশাক হলে বেশ হত, আর গরম ভাত।” কাছেই গ্রাম, একটি দোকানে চাল পাওয়া গেল, কিন্তু বাজার নেই, তাই কোথায় পুঁই? এক ভদ্রলোক বললেন –“চলুন, পুঁইশাক আমার বাড়ির বাগানে আছে। তবে একটা শর্ত, স্বামীজিকে একটিবার দর্শন করাতে হবে।”  সেদিন স্টিমারে পুঁইশাক সরবরাহ করায় স্বামীজি এতো খুশী হয়েছিলেন যে, ইলিশ-পুঁই  খেয়ে পরিতৃপ্ত স্বামীজি সেই পুঁই-বাগানের মালিককে সেই দিনই ফিরবার পথে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্যবান ভক্তটি বলেছেন, “আমাকে কৃপা করবেন বলেই স্বামীজির মাছ আর পুঁইশাক খাবার কথা মনে উঠে ছিল।” 

আর ছিল মা-দিদিমার হাতে করা শুক্তো, মোচার ডালনা; প্রায়ই চলে যেতেন মায়ের হাতের রান্না খেতে মধ্যাহ্নে। নিরামিষ খেয়ে প্রকাশ্যে সগর্বে স্বামীজি বলেছেন –“বাংলা  দেশের এই দুটোর জন্যে আবার কিন্তু জন্ম নেওয়া যায়।”  

তবে খাদ্যরসিক স্বামীজির জীবনে সবথেকে প্রিয় জিনিসটি নিজের সঙ্গেই থাকত। সাধক সন্ন্যাসী, জগতের হিতের জন্যই যাঁর সংসারে আসা আর জীবনধারণ; বিদেশের মাটিতে সেই সন্ন্যাসীকে দেখা গেছে একটা ছোট্ট শিশি থেকে কিছু পান করতে। স্বদেশে ও প্রবাসে নিত্যসাথী এই দুর্লভ বস্তুটি সম্বন্ধে সন্ন্যাসীর একান্ত স্বীকারোক্তি – 

“কখন প্রয়োজন হবে ঠিক নেই, তাই সবসময় সঙ্গে, যখনই সুযোগ পেয়েছি তার  সদ্ব্যবহার করেছি অগনিত মানুষের জনস্রোতে, সভ্যতার বিস্ফোরণের কাছে দাঁড়িয়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুরন্ত পদক্ষেপে নিষ্পেষিত হবার সম্ভাবনাময় মুহূর্তে আমি শান্ত হয়ে গিয়েছি, আমি স্থির হতে পেরেছি, দুএকটি ফোঁটায়।”  

একটা ছোট্ট শিশিতে ভরা গঙ্গাজলই ছিল বিশ্বপথিক বিবেকানন্দের চিরসাথী, তাঁর সবথেকে নির্ভরযোগ্য শক্তি। 

(শঙ্করের ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ থেকে নেওয়া).


(**)(**)(**)(**)(**)(**)(**)(**)(**)(**)(**)


*মঠের মহারাজদের জ্যোতি রহস্য* 


- “দেখেছিস মহারাজদের কি গ্ল্যামার !”

- “হবে না কেন? ফ্রিতে দুধ ফল সব পাচ্ছে, আর কাজ করতে হয় কতটুকু?”

স্বামী অন্নপূর্ণানন্দ, বছর ৬৫ ঊর্ধ্ব মহারাজের সঙ্গে দেরাদুনের রামকৃষ্ণ মিশনে বাঙালি মধ্যাহ্নভোজ করতে করতে মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছিলাম । যেমন তার গায়ের রং, গঠন, তেমন তার জ্যোতি । বার্ধক্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি ।

প্রশ্ন এসে যায়, বেশিরভাগ রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের মুখমণ্ডলী কেন এত জ্যোতির্ময় হয় ? সে বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মহারাজ শোনাচ্ছিলেন এক মা এবং তার যুবক ছেলের গল্প, যারা মনে করেন ফ্রিতে দুধ আর ফল পেলে মুখের গ্ল্যামার ধরে রাখা যায়।

আমি বললাম – “আপনি কিছু বললেন না?”

স্বামী অন্নপূর্ণানন্দ বললেন – “আলবাত, সেই ছোকরাকে বললাম, আয় তোকে ফ্রিতে দুধ আর ফল খাওয়াবো, রামকৃষ্ণ মিশনে থাকবি আয় ।“

সে শুনে মা ছেলে পেছন ঘুরে দৌড়।

আমরা সকলেই হেসে উঠলাম, আর যাই হোক ঘর সংসার ছেড়ে মহারাজ চাট্টিখানি কথা নয়।

ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যাস্পদ শোনালেও প্রশ্নটা থেকেই যায়, মহারাজদের জ্যোতির রহস্য কি ?

এই জ্যোতি বেলুড় মঠের বিদ্যামন্দিরেও চোখে পড়েছে। মাইন্ডস্ট্রোলজি এবং রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির আয়োজিত ডিজিটাল মিডিয়া কোর্সের জন্য বেশ কয়েকবার বেলুড় মঠ যেতে হয়েছে।এখানে প্রত্যক্ষ করেছি তাদের মুখমণ্ডলের জ্যোতি, চির যৌবনের তেজ এবং দীপ্তি। বিশেষত দেবর্ষি মহারাজের কথা না বললেই নয় । তাদের কর্মব্যস্ততা দেখে কখনোই মনে হয়নি যে কর্পোরেট লিডারদের চেয়ে কোন অংশে তারা কম কাজ করেন কিংবা তাদের কাজের চাপ কম। তাদের খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত সাধারণ এবং সীমিত।

তাহলে কি সংযত আহারই আমাদের শরীরে দীপ্তি আনে? নাকি সাংসারিক টানা পড়েন আমাদের আপাত বার্ধক্যের দিকে নিয়ে যায়? দুশ্চিন্তার ভাঁজ কি আমাদের কপালে বলিরেখা তৈরি করে ?

এগুলোর কোন বাক্যই অস্বীকার করা যায় না, তথাপি জ্যোতি রহস্য নিরুত্তর থেকে যায়।

আর এই সুযোগে ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।ল্যাকমি প্রোডাক্ট আসে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ।সেই আপাত উজ্জ্বল্যকে উপেক্ষা করে কিছুদিনের মধ্যেই প্রকৃত স্বরূপের বহিঃপ্রকাশ হয়।

অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে আমরা যতই চেষ্টা করি , শারীরিক উজ্জ্বল্য পেতে অভ্যন্তরীণ বিকাশ অপরিহার্য। মানসিক বিকাশ, অবচেতনের সেই স্তর করায়ত্ব না হলে সেই জ্যোতির প্রকাশ ঘটে না।

অভ্যন্তরীণ বিকাশের যে দশটি গুণ বারংবার সাক্ষাতে আমি মহারাজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি, তা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করলাম।


১) এক কাজ থেকে অন্য কাজে যাওয়াই বিশ্রাম। নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং নিজের মন যা চায় সে নিয়ে আমৃত্যু কাজ করাই জীবনের সুখী হওয়ার মন্ত্র। মনে রাখবেন, অলস মস্তিষ্ক আসলে শয়তানের কারখানা।


২)সারল্য - কোন ছেলের সঙ্গে কেবলমাত্র স্নেহ বাৎসল্য নয়, শিশুদের মত সরলতা নিয়ে মিশে যাওয়া এক বিশাল বড় গুণ। মনে রাখবেন জটিলতা অনেক সময় সীমাবদ্ধতা তৈরি করে, যেটাকে অবচেতনের ভাষায় বলে মেন্টাল ব্লক, আর সারল্য ধারণ করে অনেক ক্ষমতা, অসীমকে জয় করার দুঃসাহস।জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়।


৩) অন্যের জন্য কাজ করাতেই সবচেয়ে বড় সুখ। আপনি যতই নিজের ব্যাপারে ভাববেন, ততই মায়া জালে জড়িয়ে যাবেন। অন্যের থেকে আশা আপনাকে কষ্ট দেয়, অন্যকে সাহায্য করা আপনাকে আনন্দ দেয়। আমরা বাস্তবে ঠিক উল্টোটি করি।


৪) জীবনের বেশিরভাগ সুখী হওয়ার উপাদান ফ্রি। মুক্ত মনে হাসা, অন্যকে ভালোবাসা, প্রকৃতির মধ্যে থাকা, অন্যকে ভাল রাখা, সবই বিনামূল্যে করা যায়। তাই আপনার সুখী হওয়ার জন্য অর্থ লাগেনা।


৫) নিরন্তর শিখে যাও। শিক্ষার চর্চা, আমাদের ব্রেনকে অবচেতনের নতুন স্তরে উন্নীত করে। প্রত্যেকটি মহারাজ দিনে কোন না কোন সময় পঠন পাঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।


৬) ধ্যান বা সূর্য প্রণাম - মনকে স্থির করতে, কিংবা নিজের অবচেতনকে সংযত রাখতে এর চেয়ে বড় শক্তি নেই। বেলুড় মঠে ঘন্টার পর ঘন্টা আরতি প্রকারান্তরে একটা ধ্যানেরই রূপক।


৭) সর্বদা ইতিবাচক - এটি একটি বিশাল বড় গুন।এই পৃথিবীতে খুব কম লোকের মধ্যে এই গুনটি দেখেছি। আমাদের চিন্তার শতকরা ৭৮ ভাগ নেতিবাচক। রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার রামকৃষ্ণ মিশনের ডোনেশন অনেকাংশে কম করেছে, অথচ হা হুতাশ না করে, বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজতে মহারাজরা বদ্ধপরিকর।


৮) অহেতুক পারস্পরিক তুলনা আমাদেরকে নেতিবাচক চিন্তায় নিয়ে যায়, এটা মহারাজদের কোনদিন করতে দেখিনি।


৯) কৃতজ্ঞতা - ওনারা যার যার প্রতি কৃতজ্ঞ , উন্মুক্তচিত্তে স্বীকার করেন। কৃতজ্ঞতার চেয়ে বড় থেরাপি এই মহাবিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই I  সদ্য তৈরি হওয়া নিউটাউনের বিবেক তীর্থের জন্য শ্রী দেবাশীষ সেন এবং HIDCOর প্রতি তারা অসীম কৃতজ্ঞ I ধন্যবাদ জ্ঞাপনে  কখনো পিছপা হতে দেখিনি মহারাজদের । স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন -  "মন কে শান্ত করতে হলে, তোমার কাছে যা আছে তার জন্য ঈশ্বর কে মন থেকে ধন্যবাদ জানাও, তার সাথে প্রেমের বন্ধন তৈরি কর দেখবে মনের অশান্তি কোথায় হারিয়ে গেছে।"


১০) আপনি আপনার চিন্তার মতন বড়। আপনি এই বিশ্বকে যত ভালো ভাবেন, আপনার মস্তিষ্ক ততখানি উন্নত । মুখমণ্ডল কেবল তার বহিঃপ্রকাশ। কারো প্রতি ঘৃণা নয়, কেবল ভালোবাসা, কারো কাছে ঠকে যাওয়ার ভয় নয়, তাকে অকৃত্রিমভাবে সাহায্য করা, অমলিন চিত্তে ঠাকুর আর  স্বামীজীর প্রার্থনা করা, তাদের বাণী বারংবার উচ্চারিত করলে অবচেতন ঐশ্বরিক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, তার দীপ্তি মুখমণ্ডলে প্রকাশ পায়।


মহারাজদের জীবন প্রমাণ করে মানব জীবন আনন্দময়।

নিরলস শ্রম, অকৃত্রিম জীবে প্রেম, অদ্বৈত রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাধনা, অকুণ্ঠ জ্ঞানপিপাসা, সর্বদাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য ভাবা, হাস্যকৌতুক এবং আনন্দের মধ্যে দিয়ে জীবনের রস গুলোকে উপভোগ করা। আর যখন কঠিন পরিস্থিতি আসবে  সুচিন্তার মাধ্যমে নেতিবাচক শক্তিদের পরাস্ত করে  আপনিও জ্যোতির্ময় হবেন। 


{£€$₹}{£€$₹}{£€$₹}{£€$₹}{£€$₹}{£€$₹}


ঠাকুরের কন্ঠে অন্তিম গান –


কাশীপুর উদ্যানবাটী তে ঠাকুর রোগশয্যায় শুয়ে রয়েছেন। তার জন্য রোগপথ্য তৈরি করে, সেই খাবারের বাটি টি নিয়ে তার পাশে বসে রয়েছেন সারদামণি। ঘরে আর কেউ নেই। সব চুপচাপ।

হঠাৎ ঠাকুর আকুল হয়ে শ্রী মাকে বলে উঠলেন, "দেখো, কলকাতায় লোক গুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের একটু দেখো।"

অবাক ও লজ্জাবণত হয়ে সারদা দেবী বললেন, "আমি মেয়ে মানুষ। আমার পক্ষে তা কি করে সম্ভব ?"

এবার পরমহংসদেব নিজের দেহ টি দেখিয়ে শ্রী মাকে বললেন, "এ আর কি করছে ? তোমায় এর চাইতে অনেক বেশি করতে হবে।"

শ্রী মায়ের মনে হল, কথায় কথা বাড়ে। তার স্বামীর যা শরীরের অবস্থা, উত্তেজনা এলে তা ক্ষতিকর হতে পারে। তাই তিনি প্রসঙ্গটিকে চাপা দেওয়ার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ঠাকুরকে – "সে যখন হবে, তখন হবে। আপনি এখন পথ্যিটা খেয়ে নিন।"




এইরকম অবস্থায় ঠাকুর গেয়ে উঠলেন সেই গান। গানটি ঝিঁঝিট রাগে টিমে তোতলায় নিবন্ধ। যার সম্পূর্ণ বাণীটি এইরকম –

এসেছি ঠেকেছি যে দায়, কারে কব দায়।

যার দায় সে তো জানে, পর কি জানে পরের দায়।

মরে দায় কতবার রূপ ধরি,

কখন পুরুষ হই সই কখন হই নারী,

হয়ে বিদেশিনী নারী, লাজি মুখ দেখাতে নারি,

কথা বলতে নারি কইতে নারি

নারী হওয়া বিষম দায়।

যার দায়ে কতবার কত রূপ ধরি,

জহরিণী ণাপতিণী হয়ে চরণ ধরি,

রাখবো না আর কাল অঙ্গ, স্বরুপে মিশাব অঙ্গ,

হবে গৌরাঙ্গ দেখাইবো দাও বিদায়।


শ্রী শ্রী মা ই ছিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুরের গানের শেষ শ্রোতা।

গানটি গেয়েই ঠাকুর শ্রী মাকে বলে উঠলেন,"ওগো শুধু কি আমারি দায় ? তোমারও যে দায়।"

– এরপর বোধহয় আর কিছু বলার দরকার হয় না॥

জয় মা 

জয় ঠাকুর

💐💐💐💐💐💐💐💐

                                     ###############

"নরেন, খেয়ে নে ।  দেরি করিসনি । গাড়ি ছাড়বে এখুনি । কাশী এখনও অনেক দূর নরেন !" ....

   বিবেকানন্দের কাছে খবর এল হঠাৎ একদিন –

স্বামী অভেদানন্দ হৃষীকেশে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।  সঙ্গে সঙ্গে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন তিনি এবং অভেদানন্দকে কাশীতে নিয়ে আসার ব‍্যবস্থা করলেন।

     বিবেকানন্দ বুঝলেন,  তাঁরও গাজিপুর ত‍্যাগ করার সময় এসেছে । তাঁকে কাশী যেতে হবে । অসুস্থ অভেদানন্দকে সেবা করে তাড়াতাড়ি সুস্থ করতে হবে ।

কাশী যাওয়ার পথে ঘটনাটা ঘটল। স্বামীজী ট্রেনে চলেছেন গাজীপুর থেকে কাশী। একটি তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ছাড়া তাঁর কাছে আর যা আছে তা হল, একটা কম্বল, পরনে গেরুয়া আলখাল্লা আর হাতে একটি দণ্ড।  কানাকড়ি নেই সঙ্গে।  তিনি যে কামরায় এক কোণে বসে আছেন তার সবটুকু দখল করে চলেছে এক অর্থবান বেনে, সঙ্গে তার কিছু ইয়ারবন্ধু।

 তারা স্বামীজীকে দেখেই বুঝল, এই তরতাজা সন্ন‍্যাসী না খেয়ে আছে। কিনে জল খাবারও পয়সা নেই তার।  বড়লোক বেনে বেশ মজা পেল স্বামীজীর এই দুর্দশা দেখে। সে তার ইয়ারদের নিয়ে স্বামীজীকে দেখিয়ে - দেখিয়ে নানা সুখাদ‍্য খেতে লাগল।

খাওয়া–দাওয়া সেরে এবার তো জল খেতে হয়। স্টেশন থেকে জল কিনে খেল সেই বেনে আর তার বন্ধুরা। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে বিবেকানন্দের।তৃষ্ণার্ত সন্ন‍্যাসীকে দেখিয়ে– দেখিয়ে জল পান করার পর সুখ লাভ করল ধনী সহযাত্রী।

     ট্রেন বেশ কিছুক্ষণের জন‍্য থামল তাড়িঘাট স্টেশনে। সবাই নেমে গেল ট্রেন থেকে। স্বামীজীও নামলেন‍।  বসতে গেলেন প্ল‍্যাটফর্মে ছায়ার নীচে। চৌকিদার এসে তাড়িয়ে দিল। কী করবেন স্বামীজী ?  তিনি প্ল‍্যাটফর্মের বাইরে কম্বলটি পেতে একটি খুঁটিতে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।

উত্তর ভারতীয় সেই বেনে স্বামীজীকে সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। সে স্বামীজীর কাছেই একটি ছাউনির নীচে দামি সতরঞ্চি বিছিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মজলিস করে বসে আবার ক্ষুধার্ত সন্ন‍্যাসীকে দেখিয়ে দেখিয়ে রীতিমতো ভোজ শুরু করে দিল।

এতেও সেই বেনের যথেষ্ট আহ্লাদ হল না।  তখন সে বিবেকানন্দকে শুনিয়ে – শুনিয়ে বলতে লাগল, ওহে দেখছ ? এত সব খাবার–দাবার কেমন মজা করে খাচ্ছি ! আর তোমার কাছে তো জল কেনারও পয়সা নেই। এই ঠান্ডা জল যদি তুমি পেতে তোমার খিদে না যাক, তেষ্টা তো মিটত। এই দ‍্যাখো, আমি কেমন আরাম করে জল খাচ্ছি। রোজগার করতে জানতে হয়, বুঝলে ? রোজগারের ক্ষমতা নেই, তাই সন্ন‍্যাসী হয়েছ। এখন বোঝো পয়সার কী ক্ষমতা। ইচ্ছে করলেই আমি কিনে খেতে পারি।  তোমার মতো খিদেয় জ্বলতে হয় না।

এসব কথা শুনেও বিবেকানন্দ এতটুকু রেগে গেলেন না। কোনও ক্ষোভ নেই তাঁর মুখে।  যেন অন‍্য কিছু, অন‍্য কারও কথা ভাবছেন তিনি।  তাঁর দৃষ্টি দূরের আকাশে----যেন মনে- মনে কাউকে ডাকছেন। 


'নরেন !'

     সামনে দাঁড়িয়ে এক অতি সাধারণ মানুষ ।

     কিন্তু মুখে তাঁর সেই হাসি !  শ্রীরামকৃষ্ণের হাসি মনে পড়ল বিবেকানন্দের।

     ইনিই কাকে ডাকলেন 'নরেন' বলে! এ তো শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর ! 

সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই মানুষটি তাঁর থলে থেকে বার করলেন নরেনের সব প্রিয় খাবার, ডাল, রুটি, তরকারি। একটি মাটির পাত্রে কত যত্নে সাজিয়ে দিলেন তিনি!  পাশে রাখলেন ঠান্ডা জল !

বিবেকানন্দর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল কান্নায়। তাঁর কণ্ঠস্বর কান্নায় ঢাকা পড়ে গেল। বড় তৃষ্ণার্ত তিনি, হাত বাড়ালেন জলের দিকে।

এ  কী !

     তাঁর ঝাপসা দৃষ্টির সামনে ক্রমে মিলিয়ে গেলেন সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটি !  

বিবেকানন্দ কী করে ধরে রাখবেন তাঁর অবেগ, তাঁর কান্না ? তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ বলে উঠল, হে রামকৃষ্ণ, কত বছর তুমি নেই, তবু আমাকে ছেড়ে যাওনি, ভুলে যাওনি !  কেন এত ভালবাসো আমাকে তুমি ?

 ঠাকুর, আমি কেমন করে হব তোমার প্রেমের যোগ‍্য ? মাঝে মাঝে মনে হয়, এ পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর, এখানে ভালোবাসা নেই।  হে রামকৃষ্ণ, তুমি ফিরে-ফিরে এসে মনে করিয়ে দাও, পৃথিবীতে ভালোবাসার মরণ নেই।

বিবেকানন্দ বিস্মিত হয়ে তাকালেন মাটির থালা ভরতি খাবারের দিকে। এ  তো  দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর প্রসাদ !

সেই একই সুবাস----ভবতারিণীর প্রসাদের সুগন্ধ নাকে লেগে আছে বিবেকানন্দর।  তারিঘাট স্টেশনে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মহাপ্রসাদ।  সমস্ত প্ল‍্যাটফর্ম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই সৌরভ !

হৃদয়গহনে বিবেকানন্দ স্পষ্ট শুনলেন শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহময় কণ্ঠ, -- 'নরেন, খেয়ে নে ।  দেরি করিসনি । গাড়ি ছাড়বে এখুনি । কাশী এখনও অনেক দূর নরেন !' ...





🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️বলরাম মন্দিরে একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ব্রহ্মানন্দ মহারাজ যখন বিশ্রাম করতে যাবেন, তখন একজন বিধবা মহিলা তার ভাইকে সঙ্গে করে মহারাজকে দর্শন করতে আসে। আমি মহারাজের ঘরের দরজার পাশে একটি বেঞ্চিতে বসেছিলুম। সেই ভদ্রমহিলা আমাকে খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করে, “রাখাল মহারাজ কোথায়? আমি তাকে একবার দর্শন করতে চাই শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) আমায় এখানে পাঠিয়েছেন।” আমি বললুম, “এখন তার সঙ্গে দেখা করার সুবিধা হবে না। তিনি এখন বিশ্রাম করতে যাবেন। আমার কথা শুনে মহিলাটি খুবই বিষন্ন হয়ে পড়ে। আমি তার সেই ভাব দেখে মহারাজকে গিয়ে তার কথা জানালুম। তিনি খুব স্নেহভরে আমায় বললেন, “দেখ, খাওয়া- দাওয়ার পরে, এই বুড়াে বয়সে আর কথাবার্তা বলতে পারি না। ঘণ্টা দুই বাদে আসতে বলল।”


 এই কথা শুনে মহিলাটি নীরবে অবিরলধারে অশ্রু

বিসর্জন করতে লাগল। পরে কাতরস্বরে আমায় বলে, “দেখুন, আমি শুধু প্রণাম করে চলে যাব—এরূপ একটু ব্যবস্থা আমায় করে দিন। তার এই ব্যাকুল ভাব দেখে পুনরায় মহারাজকে গিয়ে জানালুম, “শরৎ মহারাজ এই মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন, শুধু একবার প্রণাম করে যেতে চায়।” এইবার শরৎ মহারাজের নাম করাতে আর কোনরূপ আপত্তি না করে বললেন, “বেশ যদি শুধু প্রণাম করে যায়, তা হলে আসতে বল।”


সে তখন খুব আনন্দে সন্ত্রস্তভাবে গিয়ে মহারাজকে প্রণাম করল। প্রণত অবস্থায় মহিলাটি ভাবােচ্ছাসে কাঁদতে লাগল। মহারাজও হঠাৎ নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে বসে রইলেন। আমার তখন মহারাজকে দেখে মনে হলাে, তিনি কোন এক ভাবরাজ্যে চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে ভাব একটু প্রশমিত হলে সেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওঠ মা ওঠ, কি হয়েছে বল।” মহিলাটি তখনও কাঁদছিল। মহারাজের স্নেহপূর্ণ সম্বােধনে উঠে দাঁড়াল; কিন্তু ভাবাবেগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারছিল না। পরে মহারাজের ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুরের একখানা ছবি দেখিয়ে বললে, “ইনিই আমায় আপনার নিকট আসতে আদেশ করেছেন।" তার এই কথা শুনে চমকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে, বলতাে মা?” মহিলাটি তখন নিঃসঙ্কোচে বলতে লাগল ঃ 'আমার চৌদ্দ বৎসর বয়সে বিয়ে হয়, শ্বশুরবাড়ি বহরমপুর। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই স্বামী মারা যান। তখন ভগবানের নিকট কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতুম, ঠাকুর, সারাটা জীবন কি করে কাটাব? তুমি আমায় পথ দেখিয়ে দাও!' 


প্রায় এক বৎসর পর একদিন রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় ঠাকুর দেখা দিয়ে বললেন, ‘দুঃখ করাে না, বাগবাজারে আমার ছেলে রাখাল আছে, তার নিকট যাও—সে তােমার সব ব্যবস্থা করে দেবে!' কে শ্রীরামকৃষ্ণদেব, কে রাখাল, তখন কিছুই জানি না। আমি কি করেই বা একলা বাগবাজারে যাব? “শ্বশুরবাড়ির কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলিনি। আমার মা থাকেন কলকাতায় টালিগঞ্জে। শ্বশুরবাড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে মা-র কাছে এসে সব বললুম। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে জানতেন। তাঁর কাছে খবর নিয়ে আমার ভাইকে

সঙ্গে করে বাগবাজারে যাই। সেখানে খোঁজ খবর করে উদ্বোধন কার্যালয়ে শরৎ মহারাজের সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলতে তিনি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।”


প্রায় ঘণ্টা দুই বাদে মহারাজ আমায় ডেকে বললেন, “দেখ, এই মেয়েটি এখনও উপবাসী রয়েছে। এর একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।” ইতােমধ্যে তার দীক্ষাদি হয়ে গেছে। মহারাজের আদেশ পেয়ে তাকে বলরামবাবুদের অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলুম এবং কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললুম। মেয়েটি যখন মহারাজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তখন তাকে দেখে মনে হলাে সেই শােক দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণার লেশমাত্রও তার ভিতরে নেই ।


শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র রাখালরাজের কৃপা-কটাক্ষে এমন একটা কিছু ঘটেছিল—যার ফলে সে এখন আনন্দে ভরপুর। এর পর সে প্রায়ই মহারাজকে দর্শন করতে আসত। মহারাজের মহাসমাধির পর দু-একবার তাকে মঠে আসতে দেখেছি। তারপর বহুকাল তার আর কোন খোঁজ খবর জানতুম না। প্রায় ২০ বৎসর পরে খোঁজ নিয়ে বেলুড় মঠে একবার সে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তখন তার গেরুয়া-পরিহিত সন্ন্যাসিনীর বেশ। এই দীর্ঘকাল কোথায় ছিল—জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, “মহারাজের নির্দেশে কাশী, বৃন্দাবন এবং হরিদ্বারে তপস্যায় কাটিয়েছি। তার কৃপায় বেশ আনন্দেই বৎসরগুলি কেটে গেছে। এখন কলকাতায় টালিগঞ্জে থাকি।” তার তপস্যাপূত শান্ত পবিত্র জীবন, বিনয়ন ব্যবহার এবং অল্প কথাবার্তায় আমার ধারণা হয়েছিল যে, সত্যের কিছু সন্ধান না পেলে এরূপ হওয়া সম্ভব নয়। এর তিন বৎসর পর তার শরীরত্যাগ হয়। এই তপস্বিনীর শরীরত্যাগ এক বিস্ময়কর ঘটনা। হঠাৎ একদিন তার পেটের অসুখ করে, কয়েকবার দাস্ত হয়। সেইদিনই তার সঙ্গিনী মেয়েদের (শিষ্যাদের) সকলকে সম্বােধন করে বলে, “আগামী পরশু আমার নশ্বর দেহের অবসান ঘটবে, তােমরা ভয় পেওনা— দুঃখ করাে না।” এই নিদারুণ কথাগুলি শুনে সকলে শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে গেল। কিন্তু বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়; ধীরে ধীরে সেই নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হলাে। সেদিন পূর্বাহুে ইষ্ট ও গুরুর নাম স্মরণ করতে করতে সেই তপস্বিনী ৩ার নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করল।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব এবং তার মানসপুত্রের মধ্যে এই যে লীলা—সাধারণের পক্ষে তা বােঝা অসম্ভব।

     🙏🌺


{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}{$}

নরেনের কালী দর্শন

🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸

পিতার মৃত্যুর পর ঘোর অভাব অনটনে পরে নরেন্দ্রনাথ। শত করেও অভাব কে দূরে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বাড়িতে মা-ভাই-বোনের কষ্ট মিটবে কীসে? ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে পড়লে নরেন। 

'আপনার মা কে একবার বোলুন' ।

অবাক হয়ে তাকান ঠাকুর, কী বলব রে?

নরেন ক্লিষ্টকণ্ঠে বলে ওঠে, মা-ভাই-বোনের কষ্ট আর দেখতে পারি না। মায়ের কাছে বোলুন আপনি, যদি একটা চাকরি বাকরি হয় আমার...

ঠাকুর জিজ্ঞেস করে নরেন কে, "আমার মা, তোর কে ?"

কালী মানে না নরেন। তার কাছে মা প্রস্তরপুত্তলিকা। 

মাথা হেঁট করে থাকে নরেন, "আমার কে তাতে কী আসে যায়? আপনার তো সব।  বলুন না যাতে একটু টাকাকড়ির মুখ দেখি।"

ঠাকুর বলেন, "ওরে ও সব বিষয়ের কথা আমি কইতে পারব না। ও আমার কাছে বিষ ।" তুই বল।  একবার মা বলে ডাক ।

নরেন বলে, "আমার ডাক আসে না।"

"তাই তো তোর এত কষ্ট। ওরে একবার তাঁর কাছে গিয়ে বল। মা তো জগৎজননী। তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন?আজ মঙ্গলবার। রাত্তিরে কালীঘরে গিয়ে প্রণাম করে মার কাছে যা চাইবি তিনি তাই দেবেন। "



"সত্যি"

"দ্যাখ না, সত্যি কি না! "

নরেন কালীঘরে প্রবেশ করলো। রাত্রির একপ্রহর কেটে গেছে। মন্দিরে কেউ নেই। শুধু নরেন আর মা ভবতারিণী। 

মা আনন্দময়ীর ত্রিলোকমোহিনী মূর্তি। 

এখানে কোথাও কোনো দুঃখ নেই, শোক নেই, অভাব-অভিযোগ নেই। 

কেবল এক অপার শান্তি বিরাজমান। 

এই মায়ের সামনে কী চাইবে নরেন?

সে প্রণাম করে বলে উঠল, "মা জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও।"

ফিরে এল নরেন ঠাকুরের কাছে। "কীরে কী চাইলি? টাকাকড়ি চাইলি?"

"না, সব ভুল হয়ে গেল, চাইতে পারলাম না।"

ঠাকুর বললেন "যা যা, আবার প্রার্থনা করে বল, মা আমায় চাকরি দাও, টাকাকড়ি দাও...."

নরেন আবার এসে দাঁড়ান মায়ের সম্মুখে। কিন্তু আবার একি হল তাঁর? কী চাইলে সে মায়ের কাছে?

তুচ্ছ টাকাকড়ি? না, না, তা সে কেমন করে চায়?

"মা আমাকে জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য দাও। "

ফিরে এল নরেন ঠাকুরের কাছে। 

"কীরে চাইলি?"

"না এবারো পারলুম না। মা কে দেখামাত্র কেমন আবেশ হয়, কিছুই মনে করতে পারি না।"

"দূর বোকা , আর একবার যা। মনকে বশেরেখে মায়ের কাছে যা চাইবার চেয়ে নে। "

নরেনকে মন্দিরের ভেতর ঠেলে পাঠালেন ঠাকুর ।

নরেন দেখল শুদ্ধা চৈতন্যময়ী মা রয়েছেন চরাচর ব্যাপ্ত করে। সেখানে নিরান্দের কোনো স্থান নেই। সবেতেই আনন্দের প্রকাশ। 

হীনবুদ্ধির মতো সে চৈতন্যময়ীর কাছে টাকা পয়সা চাইবে? "মাগো, আর কিছু চাই না, কেবল জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য দাও। "

বারে বারে প্রণাম করতে লাগল নরেন। 

"কী রে চাইলি?" জিজ্ঞেস করলেন ঠাকুর। 

" চাইতে লজ্জা করল। "



ঠাকুর হাসলেন। আনন্দে হাত বুলিয়ে দিলেন নরেনর মাথায়। " মা বলে দিয়েছেন , মোটা ভাত কাপড়ের অভাব তোদের কোনো দিন হবে না। "

ওসবে আর আগ্রহ নেই নরেনের। শ্রী জগৎমাতা যেন নরেনের মধ্যে থাকা বিবেকানন্দের সুপ্ত বীজ কে অঙ্কুরিত করে দিলেন। 

নরেন ঠাকুর কে বলল," আমাকে মায়ের গান শিখিয়ে দিন। " ঠাকুর তাকে মায়ের গান শিখিয়ে দিল। " আমার মা ত্বংহি তারা/ তুমি ত্রিগুণ ধরা পরাৎপরা/ তোরে জানি মা ও দীনদয়াময়ী/ তুমি দুর্গমতে দুঃখহরা।"  

নরেন সারারাত ওই গান গাইল। ঘুমাতে গেল না। পরের দিন দুপুরবেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে নরেন। 

পাশে বসে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ। কী আনন্দ ঠাকুরের, " ওরে নরেন কালী মেনেছে, মা মেনেছে-কী বলো, বেশ হয়েছে। কেমন? তাই না?!!!

🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷 

জয় শ্রী শ্রী ভবতারিণীর কালী মাতা ঠাকুরানি।

🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷

জয় লোকমাতা রানি রাসমণি, জয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব, জয় শ্রী মা সারদা, জয় স্বামীজি। 

🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼

মা ভবতারিণী সবার মঙ্গল কোরুক। 

🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺