রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন পরিচালিত বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাচীন পত্রিকার নাম " উদ্বোধন "। ইং ১৪ই জানুয়ারি, ১৮৯৮ সালে আর বা: ১৩০৫ সালের ১লা মাঘ এর প্রথম সংখ্যার প্রকাশ। তখনকার মূল্য ছিল প্রতি সংখ্যা ২ ( দুই ) আনা। আর বার্ষিক মূল্য বাবদ অগ্রিম ২ [ দুই ] টাকা দিতে হতো। এই দীর্ঘ ১২৫ বছর ধরে লাগাতার ভাবে বইটি প্রকাশের গৌরব অর্জন করেছে এই বাংলায়। প্রথম প্রকাশের স্থান ছিল---- শ্যামবাজার স্ট্রিট, কুম্বলিয়াটোলায় ১৪ নং রামচন্দ্র মৈত্র লেন, কলকাতা। " উদ্বোধন " নামটি দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আর প্রথম সম্পাদক ছিলেন ত্রিগুনাতীতানন্দ মহারাজ। যদিও স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ প্রথম সম্পাদক ছিলেন, এছাড়াও উল্লেখযোগ্য সম্পাদকরা হলেন ----- স্বামী শুদ্ধানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী প্রঞ্জানন্দ, স্বামী মধবানন্দ, স্বামী ৠতানন্দ প্রমুখ।
উদ্বোধনের একটা বিশেষত্ব রয়েছে। এটিই একমাত্র বাংলা পত্রিকা যেটি ১২৫ বছর ধরে নিরিবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা ও অসাধারণ কর্মক্ষমতার অধিকারী। ত্যাগ, নি:স্বার্থ সেবা ও প্রকৃত জ্ঞানলাভের মাধ্যমে সত্যের পথে এ গিয়ে যাওয়াই , তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শ। এই ভাবধারাকে সময়মতো করে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যে একটি প্রত্রিকার প্রয়োজনীয়তা স্বামীজী অনুভব করেছিলেন। এই প্রত্রিকায় শুধুমাত্র ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধই স্থান পেত তা কিন্ত নয়, ভ্রমণ কাহিনী, কবিতা , সমাজনীতি বিষয়ক রচনাও মুদ্রিত হয়েছে। " সংবাদ ও মন্তব্য " বিভাগে থাকত বিভিন্ন সংবাদ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা । " সমালোচনা " বিভাগ ছিল এই প্রত্রিকার একটি নিয়মিত বিভাগ। সেই অংশে সেই সময়ে নতুন প্রকাশিত বইয়ের আলোচনা থাকত।
এই পত্রিকা প্রকাশের প্রেক্ষাপট ও আরও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য আমরা স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারি। তাঁর লেখা এই অংশ পড়লে বুঝতে পারি_____ পত্রিকা প্রকাশের আগ্রহ স্বামীজী অনেক আগে থেকেই মনে মনে পোষন করছিলেন। শিকাগো থেকেই স্বামীজি আলসিঙ্গাকে লিখলেন " এখন একখানা কাগজ কোনোরূপে বার করতে খুব ঝোক হয়েছে আমার। " তার এই সঙ্কল্প বাস্তবে রূপায়ণ হয়েছিল " ব্রহ্মবাদিন " পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ( ১৮৯৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর) । শিকাগোর ধর্মসন্মেলন তথা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে বেদান্ত প্রচারের ফলে স্বদেশে ও বিদেশে বেদান্ত সম্বন্ধে একটা নতুন ধারনার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধারণাকে আরও স্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাপক প্রচারের জন্য একটি ইংরেজি পত্রিকার খুব দরকার ছিল। কিন্ত "ব্রহ্মবাদিন " ছিল খুব উচ্চধরণের দার্শনিক পত্রিকা। স্বামীজি সেইজন্য অপেক্ষাকৃত সহজ আরও একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের কথা ভেবেছিলেন। এই ভাবনার ফলশ্রুতি আত্মপ্রকাশ " প্রবুদ্ধ ভারত " ১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে।
সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটা বাঙলা মুখপাত্র প্রকাশের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সেজন্য তিনি তার গুরুভাই ও অনুরাগীদের এ বিয়ে এগিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। ২৫ শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ তারিখে গুরুভাইদের উদ্দেশ্য করে একটি পত্রে লিখলেন ------- " তোমাদের একটা কিনা কাগজ ছাপর কথা ছিল, তার কি খবর?? একটা খবরের কাগজ তোমাদের edit করতে হবে, আদ্দেক বাংলা আদ্দেক হিন্দি -- পারতো আর একটা ইংরাজিতে। পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছ, খবরের কাগজেরsubscriber সংগ্রহ করতে কদিন লাগে ? যারা বাহিরে আছে, subscriber জোগাড় করুক – গুপ্ত [সদানন্দ] হিন্দি দিকটা লিখুক, বা অনেক হিন্দি লিখবার লোক পাওয়া যাবে। মিছে ঘুরে বেড়ালে চলবে না।” সকলে হয়ত এ ব্যাপারে বেশি উৎসাহী ছিলেন না, কিন্তু স্বামীজী সকলকে পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে ক্রমাগত উদ্দীপিত করে চলেছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আমেরিকা থেকে একটা চিঠিতে (১৮৯৫) লিখেছিলেন –“যে খবরের কাগজ বাহির হইবার কথা হইতেছিল, তাহার কি হইল ?”
সন্ন্যাসী সঙ্ঘের সভ্যরা ছাড়াও আর যারা ‘উদ্বোধনে’ লিখেছেন তাদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, শ্রীঅরবিন্দ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা গান্ধী, বিনয়কুমার সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, জীবনানন্দ দাস, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, বনফুল, কালিদাস রায়, আশাপূর্ণা দেবী, নরেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, রমা চৌধুরী, দিলীপকুমার রায়, নন্দলাল বসু, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, জ্যোতির্ময়ী দেবী, আশুতোষ দাস, শেখ সদরউদ্দীন, রেজাউল করীম, এস.ওয়াজেদ আলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রসিত রায়চৌধুরী, রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সান্ত্বনা দাশগুপ্ত, চারুচন্দ্র বসু, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় , প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখ একাল ও সেকালের নাম করা লেখকেরা। একমাত্র রাজনীতি বাদ দিয়ে সব ধরণের লেখাই ‘উদ্বোধনে’ প্রকাশিত হত। একদা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী তরুণ ও যুবকেরা স্বামীজীর তেজদৃপ্ত বাণী ও ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; ‘উদ্বোধন’-এর বিভিন্ন লেখা তাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল। তদানীন্তন গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট চার্লস টেগার্ট বৃটিশ সরকারকে ‘উদ্বোধন’ বাজেয়াপ্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বামীজীর ভাষণ ও গীতা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
শ্রীম- রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ থেকে কিছু কিছু অংশ অর্থাৎ আংশিক ভাবে এই প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । পত্রিকার একটি নিয়মিত বিভাগ ছিল ‘সমালোচনা’, এতে সে সময়ে নতুন প্রকাশিত বইয়ের আলোচনা থাকত। ‘সংবাদ ও মন্তব্য’ বিভাগে ছিল বিবিধ সংবাদ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনা। লক্ষণীয় যে ‘উদ্বোধনে’ শুধুমাত্র যে ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধই স্থান পেত তা কিন্তু নয়। কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ক রচনাও মুদ্রিত হয়েছে। বহু রচনা, বিশেষ করে বিবেকানন্দ রচিত, পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
স্বামীজীর শেষ ইচ্ছা ছিল ‘উদ্বোধন’ যেন নিছক ধর্মীয় পত্রিকা বা নিছক সাহিত্য-পত্রিকা না হয়। তিনি চেয়েছিলেন পত্রিকা-জগতে ‘উদ্বোধন’ বিভিন্ন দিকের পথপ্রদর্শক হবে, সাহিত্যের আঙিনায় এক বিশিষ্ট স্থান পাবে, বাঙলা ভাষার উন্নতি সাধন করবে, আবার ধর্মের ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ করবে। ‘উদ্বোধন’-এ কেবলমাত্র গঠনমূলক ভাবের প্রবন্ধ প্রকাশিত হবে, কোন নেতিবাচক লেখা ‘উদ্বোধন’-এ প্রকাশিত হবে না। স্বামীজী বলেছিলেন যে, একমাত্র গঠনমূলক ভাবই জনসাধারণকে তুলতে পারে।”
স্বামীজীর ইচ্ছায় ও নির্দ্দেশে ‘উদ্বোধন’ কেবলমাত্র এক ধর্মীয় পত্রিকার গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি – ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে সুখপাঠ্য অথচ সুগভীর রচনা প্রকাশ করে একটি পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক পত্রিকারূপে ‘উদ্বোধন’ আজ সকলের কাছে সমাদৃত।”







No comments:
Post a Comment