শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসাবে পরিচিত। মহালয়া শব্দের আক্ষরিক সমার্থক 'আনন্দ নিকেতন'। দেবী পক্ষের সুচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়াগ্রাম পরিচিত। মানে দেবী পক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অন্য পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমায় পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা সত্য পাঁচদিনের দেখতে , কিন্তু মহালয়ায় স্থিরসূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।
‘ মহালয়া ’ শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয়। কিন্তু ‘মহালয়া’ শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়। হিন্দুদের বিশ্বাস যে এই দিন পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে। এই মহালয়া সম্পর্কে অনেকগুলি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে জানা যায়, মহাপ্রলয়ের সময় সমগ্র পৃথিবীকে কারণ-সমুদ্রে রূপান্তরিত করে দেবতা শ্রীবিষ্ণু সমুদ্রে অনন্তনাগের উপরে যোগনিদ্রায় ধ্যানস্থ হন। ঠিক এই সময়েই বিষ্ণুর কানের ময়লা থেকে মধু আর কৈটভ নামের দুটি দৈত্যের জন্ম হয়। তারা বিষ্ণুর নাভিপদ্মে অবস্থানকারী ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগিয়ে তোলেন এবং পাঁচ সহস্র বছর ধরে তিনি ঐ দুটি দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এই মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান ব্রহ্মার কাছ থেকে। ব্রহ্মার বরেই সেই মহিষাসুর মানুষ ও দেবতাদের কাছে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল। ফলে তাকে পরাস্ত করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর একত্রিত হয়ে মহামায়ারূপী যে নারীশক্তি তৈরি করেন, তিনিই হলেন দেবী দুর্গা। দশ অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে দশভূজা দেবী দুর্গা টানা নয় দিন যুদ্ধ করে মহিষাসুরকে বধ করেন। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনের পরেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা আর তাই হিন্দুদের মধ্যে শুভ শক্তির আরাধনায় মহালয়া তিথির গুরুত্ব অপরিসীম।
লোককথায় রয়েছে, এই মহালয়ার দিনেই কৈলাস পর্বত থেকে মর্ত্যধামে তথা হিমালয়ের কাছে বাপের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে উমা তথা দেবী দুর্গা। স্বামীগৃহ ছেড়ে পিতৃগৃহে রওনা দেয় উমা আর তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সন্তানেরা –গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী আর সরস্বতী। এই সময় বিভিন্ন বাহনে চড়ে উমা আসেন পিতৃগৃহে। লোকবিশ্বাস এবং পঞ্জিকাদি অনুসরণ করলে দেখা যায় দেবীর মর্ত্যে আগমনের বাহন বিচার করে আগামী বছরের শুভাশুভ আন্দাজ করা যায়। যেমন কথায় আছে দোলায় আগমন ঘটলে বন্যা হবে, গজে গমন ঘটলে পুণ্য-সমৃদ্ধি হবে ইত্যাদি। দেবীর এই বাহন মূলত চার রকমের হয়ে থাকে – পালকি, নৌকা, হাতি এবং ঘোড়া। শাক্তপদাবলীতে উমার আগমন এবং প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু লোকপ্রিয় গান।
মহাভারত অনুযায়ী দাতাকর্ণের মৃত্যুর পরও তাঁকে মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে যেতে হয়। তিনি গিয়ে পৌঁছোন স্বর্গে। সেখানে তাঁকে ইন্দ্রলোকে মণিমানিক্য, স্বর্ণ ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। তিনি পড়েন বেজায় বিপদে। কিছুই খেতে পারেন না। তখন কর্ণ অপারগ হয়ে ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তাঁকে এই সমস্ত খেতে দেওয়া হচ্ছে।
এর উত্তরে ইন্দ্রদেব বলেন, তিনি সারা জীবন ধরে সবাইকে কেবল এই সমস্ত দ্রব্যই দান করে গিয়েছেন। কখনোই পিতৃগণের উদ্দেশে খাদ্যদান করেননি।
এর জবাবে কর্ণ বলেন, তিনি তো জানতেনই না তাঁর পিতৃপরিচয়। অবশেষে মাতা কুন্তী তাঁর জন্মের রহস্য প্রকাশ করেন। তা-ও যুদ্ধের আগের রাত্রে। ফলে পরের দিনই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি ভায়েদের হাতেই প্রাণ হারান। ফলে পিতৃপুরুষদের জল খাদ্য দান করার মতো সময় তিনি পাননি।
এর থেকে ইন্দ্রদেব বুঝতে পারেন এতে কর্ণের কোনো রকম দোষ ছিল না। তাই তিনি কর্ণকে পিতৃপুরুষদের জলখাদ্য দান করার সুযোগ করে দেন। কর্ণকে ১৫ দিন অর্থাৎ এক পক্ষকালের জন্য মর্ত্য ফিরে যাওয়ার ও পিতৃপুরুষদের জল দেওয়ার নির্দেশ দেন।
আর সেই নির্দেশ পেয়ে কর্ণ আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন পিতৃপুরুষদের জল ও খাদ্য দান করতে। তিনি জল অন্ন দান করে পাপস্খালন করে আবার স্বর্গে ফিরে যান।
পুরাণ অনুযায়ী যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে অন্নজল দান করার জন্য ছিলেন তাকে বলা হয় পিতৃপক্ষ। এই ঘটনাই তর্পণ। এই কাহিনিতে ইন্দ্রের কথা বলা হলেও মতান্তরে যমরাজের উল্লেখও পাওয়া যায়।
এ তো গেল মহাভারতের কথা। ত্রেতাযুগ অর্থাৎ রামায়ণেও তর্পণ নিয়ে কাহিনি আছে।সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন রামচন্দ্র। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য অকাল বোধন অর্থাৎ দেবী দুর্গার অসময়ে পুজো করেছিলেন রাম। সেই পুজো হয়েছিল শরৎকালে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী যে কোনো শুভ কাজ করার আগে পিতৃপুরুষদের জল দান করে সন্তুষ্ট করতে হয়। সেই মতোই রামও পুজোর আগে জল দান করে ছিলেন পিতৃপুরুষদের। সেইটিই তর্পণ নামে পরিচিতি পেয়েছে।এর পর থেকেই ওই দিনটিতে তর্পণ করার প্রথা শুরু হয় এবং ওই অকালবোধনই বাঙালির দুর্গাপুজো।
মহালয়া শুধুই একটা তিথি নয়। বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠত্ব শার্দোৎসবের গেটওয়েও বটে৷ "আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং তৃপ্যতু”-এই হল মহালোয়ার সার কথা। অকালবোধনের আগে দাদা রামের তর্পন হয়ে গেছে। হাতে সময় খুব কম, তাই লক্ষণ বললেন আমি একবার সার্বিক তর্পণ করছি। তখনই এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তাকে জলাঞ্জলি স্থান। এই বাক্য যে ভাবনাকে ব্যাপ্তি করে, আজও মহালোয়ার তাৎপর্য তাই-ই। ওই শ্লোকের অর্থ-'ব্রহ্ম হতে তৃণ পর্যন্ত জগৎ তৃপ্ত হউক'। অন্য মহালয়ার তর্প পরিধি শুধুমাত্র পিতৃতর্প কর্মে আবদ্ধ নয়। মহালোয়ার বার্তা সার্বজনীন উদারতা।
যার সাহায্যে তৃপ্তি হয় তাই তর্পণ। দেহ বিলীন দেখতে, আত্মা অবিনশ্বর-পৃথিবীর সব ধর্মে ই আছে। তিলজল দিয়ে পূর্বপুরুষের আত্মার তৃপ্তিসাধর্মে বলা হয় তর্পণ। তর্পণ একপ্রকার নয়। তর্প প্রচার নিয়ম, মন্ত্র, আচার, উৎসের উপাচার এক আধ্যাত্মিক দিকদেশ। বেদের বিভা অনুযায়ী চতুরাশ্রমের কাল থেকে শুরু হয়েছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের তর্পণ সংক্রান্ত বিষয়ে। যেমন সামবেদী তর্পণ, যজুর্বেদী তর্পণ, ঋগ্বেদী তর্পণ।
পৃথিবীর উত্তর দিক যখন সূর্যের মুখোমুখি ,তখন উত্তরায়ণ। ব্যাপ্তি ছয় মাস। পরবর্তী ছয় মাস দক্ষিনায়ণ। উত্তরায়ণকালে দেবলোকে দিন ,দক্ষিনায়ণকালে রাত।দক্ষিনায়নের ছয়মাস দেবতারা নিদ্রিত,কিন্তু যমলোকে তখন দিন। তাই পিতৃপুরুষরা ছুটে আসেন মর্তলোকে। এই সময় তাঁদের ক্ষুধা ,তৃষ্ণা থাকে। উত্তর পুরুষদের কাছে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তাঁরা পরমতৃপ্ত।
মহালয়ার দিনটাই কিন্তু পিতৃপুরুষের তর্পনের জন্য একমাত্র নির্ধারিত নয়। প্রকৃতপক্ষে মহালয়ার ১৪ দিন আগে অর্থাৎ কৃষ্ণাপ্রতিপদ থেকেই শুরু হয় পিতৃতর্পণপক্ষ। অর্থাৎ ওই দিন পরলোকগত পূর্বসূরিরা মর্ত্যে নেমে আসেন। কিন্তু মহালয়ার দিনেও যদি কেউ তর্পণ করে উঠতে না পারে তা হলে কী হবে? তর্পণের আর সুযোগ নেই? এর পরেও পূর্বপুরুষের আত্মা অপেক্ষা করেন। কতদিন? একমাস। দীপান্বিতা অর্থাৎ কালীপুজো পর্যন্ত। তারপর তারা ফিরে যাবেন। কেউ তৃপ্ত হয়ে,কেউ অতৃপ্তি নিয়ে অভিশম্পাত দিতে দিতে। দীপান্বিতার দিন যেহেতু পূর্বপুরুষরা ফের প্রেতলোকে ফিরে যান তাই এদিন রীতি হল,তাদের ফিরে যাওয়া সুগম করতে পথ আলোকিত করা। এই আচারই কালীপুজোর দিন প্রদীপ জ্বালানো বা মোমবাতি দিয়ে গৃহসজ্জা কিংবা আতসবাজি পোড়ানোর রূপ নিয়েছে।
সর্বত্রই যখন পিতৃতন্ত্রের দাপট, তর্পণ মন্ত্রে পাওয়া যায় সাম্যবাদের বিবর্তন।' পিতৃ' শব্দে জনকজননী উভয়কেই বোঝান হয়েছে।
তোমারমহ, পিতামহী,মাতামহ,মাহি সহ,গুরুকুল,এমনকি বিশ্বসংসারের স্তবর,জঙ্গম,সব প্রাণীর জন্য তর্পণ রূপ আছে। যাতে তর্পন করারসময় উপলব্ধি করা যায়, আপনার আত্মা আর বিশ্ব আত্মায় কোনো ভেদ নেই। ব্যক্তিগত অখিল বিশ্ব তার নিজের পরিবার।
================









শ্রী কল্লোল বসু বলেছেন ::-
ReplyDeleteখুব তথ্য সমৃদ্ধ ভালো লেখা।
এ ভাবেই কলম চলুক।
শ্রীমতি শোভা বিশ্বাস মন্তব্য করেছেন --
ReplyDelete👍🙏bistar bhabe lekha ta pore khoob bhalo o gayanarjon holo.