Tuesday, 13 July 2021

স্মৃতির কোঠায়

 



স্মৃতির কোঠায় জমে ওঠা তথ্যগুলিতে একবার চোখ বোলাতে গেলে ধরা পরে যায় অনেক ঘটনাই। যা উল্লেখ করার আগে "স্মৃতি " জিনিসটা আমাদের জীবনে কি রকম , সে সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নেওয়া মনে হয় ভালো  হবে। 

মস্তিষ্কে তথ্য ধারন করে রাখার প্রক্রিয়া কিংবা মস্তিষ্কে ধারনকৃত তথ্যকেই স্মৃতি বলে থাকি। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে তথ্য আহরন করে মস্তিষ্কে জমা করা হয় এবং দরকার  আনুযায়ী সেই তথ্য আবার ভান্ডার থেকে খুঁজে নিয়ে আসা  হয়। অর্থাৎ অতীতে যা শেখা / দেখা হয়েছে তাকে মনে করার মধ্যে স্মৃতির অস্তিত্ব বর্তমান।  তাইতো বলে "Memory is the  diary that we all carry with us. "  শিক্ষণীয় বিষয় বা পরিস্থিতি আমাদের সাথে সাথেই থাকে। স্মৃতির  একটা সুন্দর  দিক আমাদের কাছে ধরা দেয়। " You may have  lost things,  persons in your life.  But you can capture  them in your memories forever. " এর সাহায্যে বিষয়বস্তু আমাদের সামনে না থাকলেও মানসছবির সাহায্যেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা বা ধারনা করতে পারি।স্মৃতিই বিষয়বস্তু মনে রাখতে পারে এবং প্রয়োজন মত আমাদের  মনে করিয়ে দেয়।

কথায় আছে---- " পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে, পুরোনো স্মৃতি রাতে বাড়ে।"  তবে রাতে বাড়ে কিনা জানিনা, কিন্ত  অবসর সময়ে বা কোনো বিশেষ পরিস্থিতির সন্মুখীন হলে কোনোও এক অজানা শক্তি এই মনে জমে থাকা স্মৃতিগুলোকে নারাচারা দিয়ে উৎতক্ত করে তোলো। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের কথা ::::

::  ছোটবেলায় বাঁ হাতে দুটো টিকা দেওয়া হত যার দাগ সারা জীবন থাকে।

:: জন্মানোর পর একুশ দিন  আতুর ঘরে থেকে পরে শুদ্ধ হয়ে ঘরে উঠতে হতো। 

:: সেই  ষষ্ঠীপুজোতে বাড়ীতে এক আলাদা আনন্দ ও গাম্ভীর্য  ছিল। 

:: ঠাকুমা বা অন্যেরা যে কেঁথা করে দিত, সেটাতো শিশুর এক আবশ্যিক  শষ্যা বলে ধরা হত। 

:: অন্নপ্রাশনের আগে চালের কোনো জিনিসই  বাচ্চাকে খেতে দেওয়া হত না।

:: একটু বড়ো হলে ঘুটের ছাই বা যে কোন দাতন দিয়ে দাঁত মাজতে শেখানো হত । তারপর দাত মাজতাম কলগেটের সাদা পাউডার মাজন দিয়ে। Forhans Tooth Pest এর কথা মনে পরে। এর বিঞ্জাপনে লেখা হত _____ এটি একটি দাঁতের ডাক্তারের তৈরি। 

:: সরস্বতী পূজোর দিন  নতুন  জামা কাপড় পরিয়ে পাথরের শ্লেটে শ্লেট পেন্সিল দিয়ে হাতেখড়ি হত।

:: ভালো জুতো বলতে বাটার  জুতো বোঝাতো। আর সেই  বিঞ্জাপন এখনও  মনে পরে ---- পূজোয় চাই নতুন জুতো।

:: ঝুলন সাজানোতে বন্ধুদের মধ্যে এক  রেষারেষি চলত। কে কত বিভিন্ন ধরনের পুতুল জোগার করতে পারে।

:: সন্ধায় বড়েদর সাথে গাজনের মেলা দেখতে যাওয়ার  এক বিশেষ আনন্দ  ছিল। খাবার জিনিসের সাথে কোনো একটা খেলনা কেনা হবে ---- এই  আশায়।

:: রথের দিন  পাতাবাহারী গাছের ডাল/পাতা যোগার করে রথ সাজিয়ে নিয়ে বিকেলে রথ রাস্তায় নিয়ে টানা হত।

:: রাতে গোল হয়ে এক লন্ঠের আলোতে সব ভাই বোন মিলে পড়া আর দিনের বেলায় মা-র কাছে রান্নাঘরে গিয়ে পড়ার কথা ভোলা যায় না। 

:: স্কুলে যাওয়া হত হেটে হেটে, সে যত দূরত্বই হোক না কেন। কাঁধে থাকত বই বা কারও জুটতো বই নেওয়ার জন্য একটা টিনের বাক্স।

:: স্কুল থেকে ফেরা হত পাড়ার  সবাই প্রায় একসাথে গল্প করতে করতে। আর  বর্যাকালে ফেরার সময় যদি বৃষ্টি হত তবে  সবাই মিলে ভিজতে কি আনন্দ  হত ----- সে এখন সব স্মৃতি। ভিজে বাড়ীতে ফিরে এসে যথারিতি কারও কপালে জুটতো মায়ের হাতে মার। 

:: স্কুল থেকে ফিরে একটু কিছু খেয়ে নিয়ে ডাকাডাকি পরে যেত মাঠে খেলতে যাওয়ার জন্য। 



:: সপ্তাহের একটা দিন বিকেলের খেলা বাদ যেত রেশন তোলার জন্য। 

:: স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে সবার  নতুন বই জুটতো না। উপরের ক্লাসের দাদাদের বলে রাখলে সেই বই  কিনে নেওয়া হত। আবার কেউ কেউ বন্ধুদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়াশোনা চালাতো। 

:: ছুটির দিনে গরমকালে সবাই মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা  পুকুরে স্নান,  তার আনন্দ আলাদাই ছিল।  আর শীতকালে তেল মেখে এসে পুকুর পাড়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করা হত___ কে আগে জলে নামবে তার অপেক্ষায়। 

:: স্নানের সময় চুলে দেবার জন্য সর্ষের তেল জুটতো।  বল সাবান বা ৫০১ সাবান  দিয়ে কাপড় ধোয়া আর  লাইফবয় সাবান গায়ে মাথায় দেওয়া হত। কাছে পুকুর না থাকলে , টিউবওয়েলের তলায় বসে একজন স্নান করত আর আর একজন টিপে দিতো। স্নান করে উঠতে গিয়ে প্রায়সময়ই কলে ঠোক্কর লাগতো। 

:: যেদিন  খাবারে ভাতের সাথে ডিমের ঝোল হত, সেদিন  আনন্দের সীমা থাকত না। যদিও  অর্ধেক করে ডিম সকলের কপালে জুটত।

:: জাম্বুরা দিয়ে বল খেলতে ভালই লগতো। পুরোনো টায়ার আর একটা লাঠি দিয়ে গাড়ি চালাতে কি মজায় না হতো।

:: পেয়ারা বা কুল কিনে খেতে হয়, সে তো বড়ো হয়ে জানলাম। পাড়ার যে বাড়িতে এর গাছ  আছে সেখান থেকে পেরে খাবার  অধিকার  পাড়ার  ছেলেদের ছিল।  

:: চাকতি সাজিয়ে ছোট বল দিয়ে খেলা বা ডাং ঘুটি খেলা বা বিভিন্ন  ভাবে কাচের গুলি দিয়ে খেলা এখানকার  ছোটেদর বললে হাসবে। 

:: কলাপাতা ভাঁজ করে বাঁশী বাজানোর অনন্দই ছিল আলাদা।

:: ফুটবলের  ব্লাডারের লিক সারাতে বা ফুটবলের চামড়া সেলাই করতে অনেকেই ছুটতো মুচির কাছে।

:: একটু বড় হয়ে সিনেমা হলে ৭৫ পয়সার  লাইনে খাচার মধ্যে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখেছি। 

:: বিয়ে বাড়িতে হ্যাজাকের আলো আর গেট সাজানো হত কলা গাছ দিয়ে---- সে তো অনেকেই জানেন।  আর বড়লোকেদের বিয়ে বাড়িতে দু-তিন দিন  আগে থেকে ভিয়েন বসত মিষ্টি বানানোর জন্য।

:: প্রায় প্রত্যেক ব্যাপার  বাড়িতে প্রথম পাতে বেগুন ভাজা আর শেষ পাতে মিষ্টির সাথে দই এক পদ থাকতই। কলার পাতায় মাটিতে বসে খেতে কোনই অসুবিধা হত না।

 :: বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে বা যে কোনো পূজা পার্বনে মা, কাকিমা , জ্যাঠিমারা আলতা পরতেন।

:: দুর্গাপুজোর কদিন বিভিন্ন রকমের নাড়ু, মোয়া , মুড়খি দিয়ে জলখাবারের পাট মেটানো হত।

:: সন্ধায় ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালানো , ধূপ-ধূনো দেওয়া আর শঙ্খ বাজানো মায়েদের নিত্যদিনের কাজ বলে ধরা হত।

:: মাকে দেখতাম  জ্যাঠার / ঠাকুরদার  সামনে ঘোমটা দিয়ে থাকত আর  সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কোনো সময়ই কথা বলতেন না।

:: ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন আর রান্নাবাটি বা পুতুল বা এক্কা-দোক্কা খেলে না। 




:: শীতকালে ছোটরা বাড়ির ছাদে কজন মিলে পিকনিক করত। পয়সার অভাবে সেখানে মাংসের বদলে ডিম হত।

:: বাসের সব চেয়ে কম ভাড়া ১০ পয়সা ছিল,  এতো অনেকেই জানেন।  কিন্ত  একটি রূটে এটা ৮ পয়সা ছিল।  সেই  বাসে চরার কথা এখনো অনেকের মনে আছে। 

:: আমরা বোধহয় শেষ প্রজন্ম যারা হাতে লেখাশংসাপত্র বা সার্টিফিকেট পেয়েছি, এর পর উচ্চ মাধ‍্যমিক আর স্নাতক স্তরে মার্কশিটেই সার্টিফাই করা পেয়েছি তাও ছাপান।



:: অল্প জিনিসপত্র  পরিবহনের জন্য  নীচের  গাড়িটা আমরা ব্যবহার করতাম।  এখন এটি দেখতে পাওয়া যায় না।



 :: " আমরাই ভারতের প্রথম সাজগোজের মাল্টিপারপাস ভ্যানিশিং ক্রিম " ------ এক কালের প্রসাধনী পন্য নির্মাতা এক কোম্পানীর এই দাবী আজ ইতিহাসে পরিনত হয়েছে।



:: শ্মশানে মড়া নিয়ে যাওয়া হত কাধে করে। পুরো রাস্তা এভাবে হেটেই যাওয়া হত। কোনো লোকের মড়ার খবর শুনলে সারা পাড়ার লোক সেখানে জড়ো হত।

♤♡◇♤♡◇♤♡◇♤♡◇♤♡◇♤♡◇♤♡◇♤♡◇


অনেকেই তাদের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে তাদের কার্যকলাপের জন্য  আমরাই শেষ জেনারেশন  বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।  দেখুনতো আপনারা, এই বক্তব্যের  যৌক্তকতা কতখানি।

তারা প্রায়শ বলে থাকেন____এই পৃথিবীতে যত পরিবর্তন আমাদের এই জেনারেশন দেখতে পেয়েছে তা মনে হয় আগে কোনো জেনারেশনই দেখতে পায়নি অথবা ভবিষ্যতে পাবেও না  ! 

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা গরুর গাড়ি থেকে সুপার সনিক কনকর্ড জেট দেখতে পেয়েছি। পোস্টকার্ড, খাম, ইনল্যান্ড লেটার থেকে শুরু করে আজ হোয়াটস্যাপ চ্যাটিং,ই-মেইল পর্যন্তও করছি।  অসম্ভব মনে হওয়া অনেক জিনিসই সম্ভব হতে দেখেছি। 

আমরা সেই জেনারেশন, যারা টেলিগ্রাম এসেছে শুনলেই বাড়ির সবার মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছি.. 

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা মাটিতে বসে ভাত খেয়েছি এবং প্লেটে ঢেলে চা খেয়েছি। বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে কলাপাতার পরিবেশন থেকে ক্যাটারিং দেখেছি

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে সেই পরম্পরাগত খেলা যেমন লুকোচুরি, কুমীরডাঙ্গা, ডাঙ্গুলি, কবাড্ডি, মার্বেল খেলেছি, আকাশের বুকে রং বেরঙের ঘুড়ি উড়িয়েছি

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা হ্যারিকেন আর বাল্বের হলুদ আলোতে পড়াশুনা করেছি এবং চাদরের ভিতরে লুকিয়ে আনন্দমেলা, শুকতারা,  পড়েছি। 

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা ফ্যান, এসি, হিটার, ফ্রীজ ছাড়াই ছোটবেলা কাটিয়েছি।

আমরাই শেষ জেনারেশন যারা দেখেছি ১পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে কয়েকটা ট্রাম পুড়িয়ে দিতে।  দেখেছি অফিস কাছাড়ির কাজকর্মে computer ঢুকতে না দিতে রাত জেগে / দিনের বেলায় অফিসের সামনে কি বিক্ষভ হতে।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা সুলেখা কালি আর খাগের কলম থেকে রাইটার্স, হিরো বা উইংসঙ পেন ব্যবহার করেছি এবং নতুন বই খাতার একটি আলাদা গন্ধ আর আনন্দ উপভোগ করেছি।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা  শিক্ষকদের হাতে মার খেয়েছি এবং ঘরে আসার পর নালিশ করাতে দ্বিতীয়বার মা-বাবার হাতে মার খেয়েছি।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা বয়স্ক বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের সম্মান করেছি এবং করেও যাচ্ছি।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন  যারা জোৎস্না রাতে রেডিওতে BBC'র খবর, রেডিও  সিলোনের " বিনাকা গীতমালা" , শনিবার এর বারবেলা  ছাড়াও আকাশবানী কলকাতার শুক্রবারের রাত আটটার নাটক, অনুরোধের আসর, দুপুরে মহিলামহল, রবিবার সকালে পঙ্কজ মল্লিকের সংগীত শিক্ষার আসর, আরো কতো কিছু শুনেছি l 

 আমরাই সেই শেষ জেনারেশন  যারা টেলিভিশন এ " চিত্র-হার ", "রামায়ণ " , "মহাভারত" সহ রাত জেগে খেলা দেখার জন্য ছাদে উঠে এ্যন্টেনা ঘুরিয়ে স্যিগনাল ধরার চেষ্টা করেছি ।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসার জন্য অপেক্ষা করতাম।

আমরা সেই শেষ জেনারেশন যারা স্কুল থেকে ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফিরেছি, গরমে  পুকুরে সাঁতার কেটেছি, বর্ষায় মাছ শিকার করেছি.. 

আমরা সেই শেষ জেনারেশন যারা বিকেল বেলা সময়মত ঘরে না ফিরলে বার বার শাস্তি পেয়েছি...

আমরা সেই শেষ জেনারেশন যারা পুজোর সময় শুধু একটা নুতন জামার জন্য অপারগ বাবার হাতের দিকে চেয়ে থেকেছি.

আমরা সেই শেষ প্রজন্ম যারা রাস্তাঘাটে স্কুলের স্যারকে দেখামাত্র রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ে আত্মগোপন করে থেকেছি.. কেননা সেসব স্যার খুব রাগী ছিলেন আর তাদেরকে ভয়ও পেতাম খুব। তবে অন্য যেকোনো মাষ্টারমশাই কে দেখলে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতাম।  তিনিও নিজের ছেলের মত ভালবাসতেন ও আশীর্বাদ করতেন।

আমরাই সেই শেষ জেনারেশন যারা  মা-বাবার কথা শুনতাম এবং এখন বাচ্চাদের কথা শুনে দিনপাত করছি

আমাদের এই প্রজন্ম এই সংসারের আমূল পরিবর্তন দেখে নিয়েছি 😊



2 comments:

  1. Opurbo,choto choto ghotona ke khub sundor bhabe likhechen, amar kono bhasa nei. Isswar apnake dirghayu korun.

    ReplyDelete