১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে ২৭ শে ফেব্রুয়ারি মাসে উদ্বোধনের বাড়িতে মাকে নিয়ে এলেন সারদানন্দজী মহারাজ । মহা উদ্ -বেগ নিয়ে ভক্তের দল অপেক্ষা করছিলেন । মাকে দেখে সকলে চমকে উঠলেন । যোগিন-মা কাঁদোমাদো হয়ে বললেন,---'তোমরা কী মাকেই নিয়ে এসেছো গো ! কেবল চামড়া ও হাড় কখানি নিয়ে হাজির করলে গো ! মার শরীর যে এত খারাপ, তা আমরা মোটেই বুঝতে পারিনি ।'
ডাক্তার কাঞ্জিলাল যথানিয়মে তাঁর হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করলেন । কিন্তু জ্বর কমলেও আবার সপ্তাহখানিক পরে জ্বর দেখ দিল । এবার কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতি এসে চিকিৎসা শুরু করলেন । দিন দশেকের মধ্যে মা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলেন ।
কবিরাজি চিকিৎসায় মায়ের জ্বর দিন পনেরো বন্ধ ছিল । আবার এসে মাকে জ্বর আক্রমণ করল । দেখা দিল খাবারে তাঁর ভীষণ অরুচি । কবিরাজি চিকিৎসা অনুসারে মাকে তেঁতো পাঁচন খাওয়ানো হল । ওই পাঁচন খেতে মায়ের ভীষণ কষ্ট হত । ফলে কবিরাজি বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
আস্তে আস্তে রাধুর উপর থেকেও মায়ের মন ক্রমশ উঠে আসতে লাগল । তিনি নিজেই বললেন,-- এখন মনটা সর্বদা তাঁকে(ঠাকুরকে) চায়, অন্যকিছু আর ভাল লাগে না । এই দেখ না, রাধুকে এত ভালবাসতুম, ওর সুখ- স্বচ্ছন্দ্যের জন্য কত করেছি । এখন ভাব ঠিক উলটে গেছে । ও সামনে এলে ব্যাজার বোধহয় । ঠাকুর তাঁর কাজের জন্য এতকাল এইসব দিয়ে মনটাকে নামিয়ে রেখেছিলেন । নইলে তিনি যখন চলে গেলেন,তারপর কি আমার থাকা সম্ভব হত ? '
অবশেষে মা একদিন পরিস্কার বললেন,--'শরৎকে বল ওদের জয়রামবাটী পাঠিয়ে দিতে ।' সেবিকা জিজ্ঞাসা করলেন,--'কেন ওদের পাঠিয়ে দিতে বলছেন ? রাধুকে ছেড়ে থাকতে পারবেন কি ?' মা দৃঢ়স্বরে বললেন,--'খুব পারব, মন তুলে নিয়েছি ।' সারদানন্দজী সব শুনে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন,--'তবে আর মাকে রাখা গেল না । রাধুর উপর থেকে যখন মন তুলে নিয়েছেন, তখন আর আসা নেই ।'
এলেন বিখ্যাত ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ । কিন্তু মায়ের জ্বর ভালো হল না । শরীরে এত জ্বালাযে তিনি মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন,------- 'পানাপুকুরের জলে গা ডুবিয়ে থাকব ।' ভক্তের দল বরফে হাত ঠান্ডা করে সেই হাত মায়ের গায়ে রাখলে মা আরাম বোধ করতেন । বিপিবাবুর চিকিৎসা দেড় মাস করেও যখন কোনো লাভ হল না তখন ডাক্তার প্রাণধন বসুকে ডেকে নিয়ে আসা হল । অসুখটা যে প্রকৃত কী তা জানার জন্য ডাক্তার সুরেশচন্দ্র ভট্রাচার্য এবং সুবিখ্যাত ডাক্তার নীলরতন সরকারও উপস্হিত হলেন ।
মাকে পরীক্ষা করে নীলরতনবাবু বললেন মায়ের কালাজ্বর হয়েছে । দীর্ঘদিন রোগযন্ত্রণায় ভুগে ভুগে মায়ের মন ছোট্ট মেয়েটির মতো হয়ে গিয়েছিল । তাঁর আবদার অনুসারে একদিন রাসবিহারী মহারাজ সেখানে উপস্হিত হলেন । তাঁকে দেখেই শ্রীমা বললেন,---' আমায় কোলে করে বসো ।' তখন মায়ের সেবিকা ছিলেন সারলা দেবী । তাঁকে দেখে রাসবিহারী মহারাজ বললেন,---'মাকে একটু কোলে করে বসো, তোমরা মেয়েছেলে ।' কিন্তু সারলাদেবী সাহস পেলেন না ।
মা যখন এইভাবে রোগের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন তখন পরপর তিনটি শোকের আঘাত তাঁর উপর এসে পড়ল । মায়ের পরম স্নেহভাজন লাটু মহারাজ ১৯২০ সালে২৪শে এপ্রিল কাশীতে দেহত্যাগ করেছেন ।১৯২০ সালে ১৪ মে বলরাম বসু মহাশয়ের একমাত্র পুত্র শ্রীরামকৃষ্ণ বসু মারা গেলেন । ১৯২০ সালে ২০ জুন মায়ের পরম স্নেহের ছোট ভাই বরদাপ্রসন্ন জয়রামবাটিতে নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন । প্রথম প্রথম খবরগুলি মাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল । কিন্তু যখন তিনি টের পেলেন তখন শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন ।
মায়ের অবস্হা দেখে ডাক্তাররা বলে দিলেন মাকে আর সুস্হ করে তোলা সম্ভব নয় । ক্রমেই তাঁর কথাবার্তা বলা বন্ধ হয়ে গেল । ঔষধপথ্যও আর খেতে চাইলেন না ভক্তরা তাঁর সামনে কাঁদতে শুরু করলে তিনি ক্ষীণকন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,--'শরৎ রইল ভয় কি ? ঠাকুর আছেন ইহকালে, পরকাল দেখবেন ।
এল ২১শে জুলাই ১৯২০ । বাংলার ৪ঠা শ্রাবণ ১৩২৭ । মঙ্গলবার রাত্রি দেড়টা । শিবযোগে শ্রীশ্রীমা আমাদের কাঁদিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের চরণে গিয়ে মিলিত হলেন । তখন মায়ের বয়স ৬৬ বৎসর ।
দেহত্যাগের কয়েকদিন আগে জনৈকা এক ভক্তমহিলাকে মা বলেছিলেন,---' যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না । দোষ দেখবে নিজের । জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ । কেউ পর নয় মা , জগৎ তোমার ।' জগতের উদ্দেশ্যে এই তাঁর শেষ বাণী । আর সবাইকে জানিয়ে গেলেন আশীর্বাদ;---' যারা এসেছে, যারা আসেনি, আর যারা আসবে, আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও মা--- আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের উপর আছে ।
পরের দিন সকাল সাড়ে দশটায় । স্বামী সারদানন্দজীর পরিচালনায় মায়ের পবিত্র দেহকে গন্ধপুষ্প মালা ইত্যাদিতে সাজানো হল । দলে দলে ভক্তগণ এসে মায়ের চরণে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলেন । উদ্বোধনের মায়ের বাড়ি থেকে সন্ন্যাসী ভক্তগণ মায়ের পালঙ্ক কাঁধে নিয়ে রামনাম কীর্তন করতে করতে বেলুড়মঠে এগিয়ে চললেন । স্ত্রী ভক্তগণ মাকে গঙ্গাস্নান করালেন । নতুন কাপড় পরালেন । ফুলমালা দিয়ে সাজিয়ে আরতি করলেন ।
তখন বেলা তিনটা । বেলুড়মঠে স্বামী বিবেকানন্দের মন্দিরের উওর দিকে চন্দন কাঠের চিতা সাজানো হয়েছে । সেই চিতায় মাকে শায়িত করা হল । গঙ্গার ওপারে কলকাতায় দেখাগেল প্রবল ধারায় বৃষ্টি চলছে । কিন্তু এখানে কিছু নেই । যখন চিতাগ্নি নির্বাপন হতে চলেছে তখন শরৎ মহারাজ গঙ্গা থেকে প্রথম কলসীজল এনে চিতায় ঢাললেন । আর ঠিক তার পরেই এখানেও মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে এল । উপস্হিত শত শত ভক্তদের চোখের জলও ধুইয়ে দিয়ে গেল সেই বৃষ্টির জল ।
প্রণাম মা……
🌺🌺 যেদিন মা চলে গেলেন 🌺🌺
শরীর যাবার আগের দিন সকাল থেকেই মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার আবার তার আগের দিন পেট খুব খারাপ হওয়াতে শরীর এত দুর্বল যে নড়বার শক্তি নেই। মহারাজ (শরৎ) আমাকে তাঁর ঘরে বসেই মাছের ঝোলভাত খেয়ে নিতে বললেন।
এদিকে মার শ্বাসকষ্ট এত বাড়ছে যে তাঁর সে কষ্ট যেন চোখে দেখা যায় না। একতলা থেকে তিনতলা - সারাবাড়ি সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখদুটি যেন বেরিয়ে আসছে। মা তো কোনও বাছবিচার করেন নি। যত পাপীতাপীকে বুকে নিয়েছেন বলে তাঁর এই কষ্ট! সাধুভক্তে বাড়ী ভরে গেল।
সারারাত্রি আমি আর সুধীরাদি মায়ের পায়ের কাছটিতে বসেছিলুম। যোগীনমা আমাকে একঘটি জলে মায়ের পায়ের কাছটিতে আঙুল ডুবিয়ে চরণামৃত করে নিতে বললেন। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে ফোঁটা ফোঁটা গঙ্গাজল দিতে লাগলুম। ধীরে ধীরে শব্দ কমে আসতে লাগল, ক্রমে সব শান্ত। তখন রাত একটা বেজে গেছে। সেদিন চৌঠা শ্রাবণ (১৩২৭)।
যে মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এখন সেই মায়ের রূপ আর ধরছে না - একেবারে দুর্গাপ্রতিমার মতো!
মাকে সরু লালপেড়ে গরদের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন বেলা এগারটায় মায়ের খাট মাথায় করে কাশীপুর হয়ে বরানগর কুঠিঘাট অবধি নিয়ে আসা হলো। আমাকে গোলাপ-মা, যোগীন-মা সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। সুধীরাদি জোর করে আমার হাত ধরে বের করে নিয়ে এলেন। তখন খুব ভগবানের নাম, হরি-সঙ্কীর্তন হচ্ছে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে কুঠিঘাট পর্যন্ত গেলুম। সেখান থেকে মহারাজেরা ও ভক্তেরা মাকে নিয়ে একটা বড় নৌকায় উঠলেন। আমরা মেয়েরা পাশে পাশে একটা ছোট নৌকায়।
বেলা দুটোয় বেলুড়ের ঘাটে পৌঁছে মাকে আমতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেখানে পূজা ও ভোগ নিবেদন। পরে গঙ্গার ঘাটে মাকে স্নান করানো হবে। কাপড় দিয়ে আড়াল করা হলো। আমি আর সুধীরা-দি মায়ের শরীর তুলে নিয়ে গঙ্গার জলে রেখে তাঁকে স্নান করালুম। ইদানীং অসহ্য গায়ের জ্বালায় মা প্রায়ই বলতেন, "গঙ্গায় নিয়ে চল, গঙ্গায় নিয়ে চল।" তখন মায়ের শরীর যে কী হালকা ও নরম লাগছিল।
ঐ কাপড়খানা বদল করে তাঁকে আর একটা নতুন সরু লালপেড়ে গরদ পরানো হলো। এবার সাধুরা তাঁকে আবার আমতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে দ্বিতীয়বার মাকে আরতি করা হয়। আমি সব দেখলুম, মনে কিছুই হলো না। তারপর যেখানে বর্তমানে মায়ের মন্দির সেখানে চিতা সাজানো হলো। আমি আর সে দৃশ্য দেখতে পারছি না, কী দেখব? সুধীরা-দির পিছনটিতে শুয়ে পড়লুম।
চন্দনকাঠের চিতায় মাকে শুইয়ে দিয়ে শরৎ মহারাজ ও অন্যসব মহারাজরা বেলপাতা, ধুনো ও গুগগুল প্রদক্ষিণ করে করে আহুতি দিতে লাগলেন।
প্রবোধ-দি জোর করে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, "একবার দেখ না কী সুন্দর দেখাচ্ছে!" দেখলুম আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়ে কত উঁচুতে উঠেছে। তখন তো এখনকার মতো ট্রাম-বাসের সুবিধা ছিল না, তাই খুব বেশী ভিড় হয়নি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওপারে তখন বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এপারে বৃষ্টি নেই।
মায়ের শরীরের কিছুই চোখে পড়ল না, কি জানি কি দেখব ভেবে এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাইনি। এখন আমরাও প্রদক্ষিণ করে তিনবার আহুতি দিলুম।
ফিরে...দু-তিন দিন আর উদ্বোধনে যাইনি, মন সরছিল না। ফাঁকা বাড়ি, কী দেখতে যাব? যোগীন-মা ডেকে পাঠালেন। মায়ের ঘর তখনো খালি পড়ে ছিল। সেদিকে আর তাকানো গেল না, কেবলই চোখ ফেটে জল আসছে। যোগীন-মা কাঁদছেন আর বলছেন, "তোরাও যদি না আসবি, আমরা কি করে থাকব? মা চলে গেলেন, সব শূন্য লাগছে।"
[প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা বিরচিত শ্রীশ্রীমায়ের চরণপ্রান্তে থেকে নিবেদিত]








No comments:
Post a Comment