সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির, বহুলাড়া, বাঁকুড়া
পশ্চিম বাংলার মন্দির স্থাপত্যের কথা বলতে গেলে যার নাম প্রথমেই উঠে আসে .... সে হ'ল বিষ্ণুপুর । এটা ঠিক যে বাংলার স্থাপত্যশৈলীর বিকাশে বিষ্ণুপুরের এক বিরাট অবদান রখেছে। তবে এই আবদান শুধুমাত্র বিষ্ণুপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় । এই উদাহরণ বিষ্ণুপুরের ঠিক বাইরে আশে পাশেও ছড়িয়ে রয়েছে।
সে রকমই বাংলার এক গ্রামের নাম বহুলারা। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ওন্দা সি ডি ব্লকের ওন্দা ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বহুলারা গ্রাম। দ্বারকেশ্বর নদীর দক্ষিণে, এটি মন্দির নগরী বিষ্ণুপুরের থেকে প্রায় ২৫ কি মি বা ওন্দাগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় ৫ কি মি দূরে অবস্থিত। এখানেই রয়েছে অনন্য স্থাপত্য শৈলী ও কাটা ইট এবং চুন-স্টুকো অলঙ্কার পরিচিত সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির। মধ্যযুগীয় রেখা দেউল মন্দিরের সর্বোত্তম নমুনা হিসেবে এটিকে অনুমান করা হয়। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুটের মতন। মন্দিরটির ভিত্তিমাত্রা প্রায় ২৩ বর্গফুটের মতন যা মন্দিরটিকে তার স্থাপত্য এবং অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত করে তুলেছে। এটি আনুমানিক ৮ম -- ১১শ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে বৌদ্ধ / জৈন মন্দির হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। কিন্ত পরে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা এটিকে শৈব স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পুন নির্মাণ করেছিলেন। তবে এটি কখন হিন্দুমন্দিরে রুপান্তরিত হয়েছিল তার কোনও নথিপত্র নেই। তাই শিবলিঙ্গ ছাড়া গর্ভগৃহে গনেশ, জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং মহিসাসুরমর্দিনির মূর্তি রয়েছে। নগ্ন জৈন দন্ডায়মান মূর্তিটি সেই সময়ের জৈন ধর্মের অস্তিত্বর স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। তবে যাই হোক এখানকার শিবলিঙ্গ সিদ্ধেশ্বর মহাদেব নামে পরিচিত। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী এবং ওড়িশার মন্দিরগুলির সাথে কিছু কিছু মিল দেখা যায়। অতীতে কোনও এক সময়ে এর চূড়ার সর্ব্বোচ্চ অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে সরকার কিছু সংস্কার করা সত্ত্বেও মন্দিরের মূল অলংকরনে বেশিরভাগ অংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহটি একটি নিখুঁত বর্গাকার হলেও বাইরে থেকে এটি দেখা যায় না। কারণ বাইরের পৃষ্টটি " রথ " শৈলীতে নির্মিত। উত্তর ভারতীয় নাগর স্থাপত্য শৈলীর একটি উপাদান রথ। সেইজন্য এই মন্দিরটি এক অসাধারন চেহারা এবং দুর্দান্ত গভীরতা বহন করে। উড়িষ্যা বা খাজুরাহোর মন্দিরগুলি এই রকম রথ শৈলীতে নির্মিত এবং এই মন্দিরটিও ঐ রকম ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
বহুলাড়া মন্দিরের চারপাশের আবাসস্থল এবং যে ধর্মীয় ঢিবি রয়েছে সেগুলি দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে এটি প্রাচীনকালে একটি জৈন / বৌদ্ধ কেন্দ্র ছিল। দেউলের পাশে ইট ও পাথরের তৈরী ঢিবিগুলি দেখে ধারনা করা হয় যে এগুলি বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ। মনে করা হয় যে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুক বা ভিক্ষুণীদের দেহাবশেষ দাহের পর সমাহিত করা হত। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে এই অঞ্চল অর্থাৎ বাঁকুড়া অঞ্চল বৌদ্ধ / জৈন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মল্লরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মন্দিরগুলি শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়।
ওন্দাগ্রাম রেল ষ্টেশনের কাছেই বহুলাড়া গ্রাম। তাই ষ্টেশন থেকে সাইকেল রিক্সা বা টোটোতে করে মন্দিরে যাওয়া যায়। কিন্ত এই পথের উপর নির্ভর না করায় শ্রেয়। কেননা এই পথে রেল পরিষবা এখনও যথেষ্ট নয়। তাই রেলে বা বাসে বাঁকুড়ায় এসে, সেখান থেকে বাসে করে ওন্দা বাস ষ্টপে নেমে রিকশা বা টোটোতে যাওয়া যেতে পারে মন্দিরে। এছাড়া যদি সড়ক পথে গাড়ি নিয়ে আসা যায় তবে ওন্দা মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে বহুলারা গ্রামে আসা যায়।
চৈত্র মাসে আজও বহুলারা শিবমন্দিরে তিন দিন ধরে গাজন উৎসব পালিত হয়। তাতে আঞ্চলিক ও দূরের শত শত ভক্ত যোগদান করে। এছাড়াও শিবরাত্রি আর বাংলার নববর্ষ ধুমধামের সাথে পালিত হয়। মন্দিরটি গ্রামের এক মনোরম শান্তিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। তাই আপনি যদি বাংলার গ্রামীণ জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চান তবে বহুলাড়া সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির দেখতে পারেন। আর আপনি যদি একটু ঐতিহাসিক মনোভাবাপন্ন হন অর্থাত আপনার ইতিহাস জানার আগ্রহ থাকে তবে অবশ্যই এটি আপনার সঠিক পচ্ছন্দের স্থান হবে।




























শ্রী শচীবিলাস রায় জানিয়েছেন =*=
ReplyDeleteপড়ে খুবই ভালো লাগলো। অনেক অজানা জিনিস জানলাম। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
শ্রীমতি শোভা বিশ্বাস লিখেছেন ----
ReplyDeleteKhoob bhalo laaglo onek ajana totho jaante parlam 🙏🙏
শ্রী হরদাস চক্রবর্তী এই রকম মন্তব্য করেছেন >>
ReplyDeleteঅপূর্ব জায়গা। গ্রামের মধ্যে খুব সুন্দর করে সাজানো। বিশ্বাস করে ঘুরে আসলে অবশ্যই ভাল লাগবে। লেখা এবং জায়গার বর্ণনা সাথে ছবির মুন্সীয়ানা চোখে না দেখলেও অনুভব করতে কোন অসুবিধা হবে না। আর চোখ দিয়ে মন ক্যামেরায় তুলে রাখলে তা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। এই অজানা জায়গা তুলে ধরার জন্য লেখকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। আগামীতে আরও এই রকম অচেনা সুন্দর জায়গার বর্ণনার আশায় রইলাম। উনার মনের দৃষ্টি শরীরের সামর্থ আরও বৃদ্ধি পাক এই কামনা করি।
শ্রীমতি অর্চনা চক্রবর্তী লিখেছেন <><><>
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম। একেবারে নতুন আমার কাছে।