সোনাতপলের সূর্য মন্দির -- আলোকমন্দির
বিশ্বে ভারতবর্ষ হ'ল এক রহস্যের দেশ হিসেবে পরিচিত। সেই রহস্যময় দেশ হিসেবে এক বিশেষ গৌরবও আছে। আর এই গৌরব আরও বাড়িয়ে তুলেছে তার প্রাচীন সূর্য মন্দিরগুলি। সবগুলি মন্দিরই সূর্যদেব সূর্যকে উৎসর্গীকৃত।ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রায় প্রত্যেকটি মন্দিরই প্রাচীন ভারতীয় শাসকদের দ্বারা বহু বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরগুলি ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।
সূর্য মন্দির কি ?? সূর্য মন্দির বা সৌর মন্দির হ'ল এমন একটি ভবন যা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন প্রার্থনা বা বলিদান...... যা সূর্য বা সৌর দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এই ধরণর মন্দিরগুলো বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং ভারত, চীন, জাপান , মিশর ও পেরু সহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে কিছু মন্দির ধ্বংসস্তূপে রয়েছে, খনন, সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার কাজ চলছে এবং কয়েকটি বৃহত্তর স্থানের অংশ হিসেবে বিশ্ব-ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত।
ভারতে বেশ কয়েকটি ( প্রায় ১৪টি ) উল্লেখযোগ্য সূর্য মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে মেধরার সূর্য মন্দিরটি, যা কিনা গুজরাতে অবস্থিত। ১০২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল। চালুক্য রাজবংশের প্রথম ভীমসেনের শাসনকালে এর নির্মাণ হয়। এই মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী মারু-গুর্জরা শৈলীর। এটি পশুপতি নদীর তীরে অবস্থিত।
সূর্য মন্দির মাতন্ড..... যা জম্ম্-কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি একটি অসাধারণ মন্দির। কারকোটা রাজবংশ এটি নির্মাণ করেছিলেন ৮ম শতাব্দীতে। মন্দিরটির আশ্চর্যজনক খোদাই আজ ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে। মন্দিরটি মালভূমির উপর অবস্থিত হওয়ায়, এখান থেকে সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকার দৃশ্য দেখা যায়।
দক্ষিণার্ক মন্দির যা গয়ায় অবস্থিত। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বায়ু পুরাণে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। গয়ায় পিন্ডদান স্থানের কাছেই রয়েছে এই মন্দির। আবার বিষ্ণুপদ মন্দিরটি এর কাছেই। গয়ায় আরও দুটি সূর্য মন্দির রয়েছে..... সেগুলি হ'ল উত্তরকা মন্দির আর গয়াদিত্য মন্দির।
তবে ভারতে সূর্য মন্দিরের কথা বললেই...... যে মন্দিরের কথা মাথায় আসে তা হল কোনারকের সূর্য মন্দির। এটি সাতটি বিস্মেয়ের একটি। ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে কোণার্ক সূর্য মন্দির হ'ল একটি প্রাচীন সূর্য মন্দির। এটি পুরী থেকে ৩৫ কি মি দূরে অবস্থিত। ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মন্দিরে আপনি দেখতে পাবেন ছয়টি ঘোড়া দ্বারা পরিচালিত ২৪ চাকার সূর্যদেবের রথ। কিন্ত আজ মন্দিরের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
তবে আজ আর পুরীর সূর্য মন্দিরের কথা নয়, এমন একটি সূর্য মন্দিরের কথা লিখছি যেটা কিনা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। শোনা যায় এই মন্দির কোনারকের সূর্য মন্দিরের থেকেও প্রাচীন। তাই আজ সে ন্যাশনাল হেরিটেজের তকমায় পুরস্কৃত। কিন্ত কোথায় রয়েছে সেই মন্দির ?? সেই মন্দির রয়েছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেরই লাল মাটির দেশে, বাঁকুড়া জেলার ওন্দা থানার অন্তর্গত সোনাতপল গ্রামে সোনাতপল সূর্য মন্দির। সূর্য মন্দির বলা হয় কারন মন্দিরটি পূর্বমুখী হওয়ায় দিনের প্রথম সূর্যকিরণ এসে পড়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে। আলোকিত করে এই মন্দিরের গর্ভগৃহকে। তাই এটি সূর্য মন্দির নামে পরিচিত। এই দেউলে আগে কোন দেবদেবী ছিল না। কিন্ত বর্তমানে একটি ত্রিশূল ও শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয়েছে। দারকেশ্বর নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে, বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ১০ কি মি দূরে এই প্রাচীন গ্রাম সোনাতপল। সোনাতপলের সূর্য মন্দিরটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও কিছুটা রহস্যময়। মন্দিরে লাগানো সরকারী বোর্ড থেকে জানা যায় আনুমানিক খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মন্দিরটি তৈরী হয়েছিল। ঔপনিবেশিক সময়ে তৈরী এটি ইটের রেখা দেউল। উচু ইটের ভিতের উপর তৈরী এই সূর্য মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১২০ ফুট। এত উচু মন্দির এই অঞ্চলে আর নেই। এটি জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি।
তবে কবে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই মন্দির বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের তত্ত্বাবধনে গড়ে উঠেছিল। আবার একসময় বাঁকুড়া ছিল বৌদ্ধ ও জৈনদের বাস। তাই এই অঞ্চলে রয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নানা পুরাকীর্তির। এই মন্দিরের গায়ে অনেক উপরে দেখা যায় এক ছোট্ট বৌদ্ধ মূর্তি। তাই কেউ মত প্রকাশ করেন যে এই মন্দির বৌদ্ধ বা জৈনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল। ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পায় যে সোনাতপল গ্রামের প্রাচীন নাম ছিল হামিরডাঙা। মন্দিরটির নির্মানকাল এগারো শতকে। শোনা যায় যে শালবাহন নামের কোনও এক রাজা এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তৎকালীন হামিরডাঙায় শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণদের বাস ছিল। তাঁরা সূর্যের উপাসনা করতেন। তবে অন্য এক ঐতিহাসিকের মত যে জনশ্রুতির মাধ্যমেই ঐ রাজার নাম জানতে পারা যায়। ওন্দার কোথাও সেই রাজার কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সূর্য মন্দির যে জৈন বা বৌদ্ধ স্থাপত্য---- এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ট্রেনে যেতে হলে নিকটতম রেল ষ্টেশন বাঁকুড়া জংশন। এখান থেকে দশ কি মি গাড়ী বা অটোতে যেতে পারেন। আর গাড়ি নিয়ে গেলে আরামবাগ- জয়পুর-বিষ্নুপুর-ওন্দা হয়ে কিছুটা গিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে সোনাতপল গ্রামে পৌঁচ্ছাতে পারেন। এছাড়া বাঁকুড়া-বিষ্নুপুর রাস্তা ধরে ধলডাঙ্গার মোর থেকে বেকে এই মন্দিরে যেতে পারেন।
হাজারো বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের সংস্কার এখনই প্রয়োজন। স্থানীয়দের দাবী...... এত পুরানো মন্দির আজ ভেঙে পরেছে সংস্কারের অভাবে। এখানে যাতায়াতের রাস্তা পর্যন্ত নেই। আলপথ পেরিয়ে এই মন্দির দেখতে যেতে হয়। একখানা সরু রাস্তা থাকলেও বর্ষাকালে তা বেহাল হয়ে পরে। আগাছায় পরিপূর্ণ মন্দির। এলাকাবাসী বারবার বিভিন্ন মহলে মন্দির সংস্কারের আবেদন জানালেও কোনো কাজ হয়নি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক হলেও সরকার শুধুমাত্র এলাকাটির চারপাশে প্রাচীর দিয়েছে। মন্দিরের অবস্থা বেশ জরাজীর্ন ও ভগ্নপ্রায়। মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমানে শ্রী ষষ্ঠী মল্ল নামে একজন গ্রামবাসী নিযুক্ত আছেন। এর আগে তাঁর মা শ্রীমতী সবিতা মল্ল দেখাশোনা করতেন। তবে একার পক্ষে এই স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়। কথায় কথায় ষষ্ঠী মল্ল ক্ষোভের সাথে জানালেন ......" অনেকেই মন্দির দেখতে আসেন। গ্রামে আসার রাস্তাটি লাল মাটির। কিন্ত মন্দির দেখতে হলে জমির আলপথ মাড়িয়ে আসতে হয়। সেই কারণে অনেকে দূর থেকে মন্দির দেখে ফিরে যান। সরকার সচেষ্ট হলে এই মন্দিরটিকে ঘিরে গ্রামটিকে একটি পর্যটন স্থল হিসেবেও গড়া যেতে পারে। আর তখনই স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের মানুষের রুজি রোজগারের একটা ক্ষেত্রও তৈরি হতে পারে।"
এখন প্রশ্ন হ'ল ........ ইতিহাসের হাত ধরে এই এলাকা কি ভবিষ্যতের পর্যটন স্থান হিসেবে উঠে আসবে ?? এর জবাব পেতে হলে আগামী দিনগুলির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

























Darun information.Post ti pore khub jete ichhe hochhe.Snehasishda ke dhanyabad
ReplyDeleteশ্রীমতি কেয়া এন্ডো জানিয়েছেন:::
ReplyDeleteঅজানা তথ্য সমৃদ্ধ এই পোস্ট পড়ে খুব ভাল লাগল।
শ্রী কল্লোল বসু লিখেছেন :-----
ReplyDeleteআগেও বহুবার বলেছি কোনো
ভ্রমন পত্রিকা তে লিখতে কিন্তু
আপনি কোনো গুরুত্ব দেননি
তাই আর কিছু বলিনা। অথচ
আপনার লেখা অত্যন্ত বলিষ্ঠ.
আর আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি কারো মন রেখে
কথা বলিনা.
ভালো থাকবেন.
প্রণাম নেবেন।