অক্ষয় তৃতীয়া হলো চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। বৈদিক পরম্পরায় এটি মানা হয় যে , এই বিশেষ দিনে যে যা শুভকাজ করবেন, তার ফল পাবেন তিনি অনন্তকাল। সেইদিন প্রতিটি মানুষকে খেয়াল রাখতে হবে যে, যাতে কোনোরকম ভূল, ত্রুটি বা কলুষিত কর্ম যেন না করা হয়। কারণ ঐ কর্মটি বা কর্মের ফল অক্ষয় হয়ে ফলতে থাকে। অর্থাৎ সেই ত্রুটিপূর্ণ কর্ম সে আরও কয়েকবার করতে বাধ্য হয়। বলে জীবন নিরানন্দ হয়ে পরে।
আসলে হিন্দুশাস্ত্রের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনাই হলো এই অক্ষয় তৃতীয়ায় শুভারম্ভ। এই ঘটনাগুলির উল্লেখ এ ভাবে করা যায় ::^^^^^^^::
-=- ব্যাসদেব যখন মহাভারত লেখবার জন্য গণেশ কে আবাহন জানালেন, গণেশ ব্যাসদেবের কথা শুনতে শুনতে এই বিশেষ তিথিতেই রচনা শুরু করেছিলেন। মহাভারত এই দিনেই রচিত হয়েছিল।
-=- কুবের বহুবৎসর ভগবান শিবের আরাধনা করেছিলেন। কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয় মহাদেব কুবেরকে অতুল সম্পদ দান করেন। এই সেই বিশেষ তিথি , কুবের এই মহাসম্পদ লাভ করেছিলেন।
-=- বিষ্ণু অবতার পরশুরামের জন্ম তিথি হলো এই অক্ষয় তৃতীয়ায়।
-=- সত্যযুগের সমাপ্তি হয়েছিল এই বিশেষ তিথি তথা ক্ষণে।
-=- ভগীরথ এই তিথিতেই মা গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করান।
-=- কৃষ্ণের চন্দন যাত্রাও শুরু হয় এই দিনে।
-=- দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের তিথিও এই বিশেষ ক্ষণটি।
-=- কুবেরের লক্ষ্মীলাভকে স্মরণে রেখে বহু মানুষ এই দিন লক্ষ্মীপূজো করেন। কুবেরের মতো যেন ধন সম্পত্তির অধিকারি হন। অনেকে আবার দান ধ্যানও করেন, যাতে পুণ্যির ঝুলি বেশ ডরে ওঠে।
-=- এই দিনে হালখাতা করার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সেই দিনের অর্থাগমের মতো যেন সারা বছর অর্থাগম হতে থাকে, আবার ক্রেতাও কিছু কিনে গোটা বছরের প্রাপ্তিযোগর উপর শিলমোহর দেবার চেষ্টা করেন।
-=- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিশেষ তিথিতেই তাঁর বন্ধু তথা সুহৃদ সুদমার দারিদ্র দূর করেন।
-=- দেবপ্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মুন্ডন সংস্কার, সম্পত্তি ক্রয়, গৃহনির্মাণ, পিতৃপুরুষের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ও তর্পণ প্রভৃতি নানা শুভকার্যে অক্ষয় তৃতীয়ার বিকল্প নাই।
-=- কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী------- এই চারধামের যাত্রারও শুরু হয় এই দিনেই।
-=- জগন্নাথ মহাপ্রভুর চন্দনযাত্রা ও রথ নির্মাণের শুরুও হয় এই বিশেষ তিথিতেই
এক অহৃকারী ব্রাহ্মণ ক্ষুৎপিপাসায় কাতর এক ব্যক্তি জল চাইলে তৎক্ষণাৎ তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। দয়াবতী স্ত্রী এটি সহ্য করতে না পেরে স্বামীর নিষেধ অমান্য করে ঐ ব্যক্তিকে অন্ন ও জলদান করেন। মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণের বিদেহী আত্মার ঠাই হলো যমলোকে। সেখানে অন্ন-জল বিনা নিদারুন কষ্টে দিন কাটে আত্মার। অবশেষে পত্নীর পুন্যকর্মে যমলোক থেকে মুক্তি পায় আত্মা। ব্রাহ্মণ পুনর্জন্মলাভ করে অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রত ভক্তিভরে পালন করে যশস্বী হলেন। বিগত জন্মের পাপক্ষালন হলো তার নবজন্মের অন্ন ও জলদানের মতো পুণ্যকর্মে।
শুধু হিন্দুদের কাছে নয়, অক্ষয় তৃতীয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে অন্য এক ধর্মেও
রাজা শ্রেয়াংশ ঋষভদেবকে ইক্ষুরস দান করছেন।
অক্ষয় তৃতীয়াকে মূলত হিন্দু বা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে পালনীয় এক পবিত্র দিন হিসেবে দেখা হলেও অন্য এক ধর্মে এই দিনটির বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। সেটি জৈন ধর্ম। জৈন বিশ্বাস অনুসারে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথির গুরুত্ব অপরিসীম।
জৈন মতে, ২৪ জন তীর্থঙ্কর মানুষকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথেই মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর অতীত ‘তীর্থে’ পৌঁছতে সক্ষম। এই ২৪ তীর্থঙ্করের প্রথম হলেন ঋষভদেব এবং শেষ ব্যক্তি মহাবীর। জৈন শাস্ত্র থেকে জানা যায়, ঋষভদেব ছিলেন ইক্ষ্বাকু বংশের প্রতিষ্ঠাতা নৃপতি। তাঁর রাজত্বে কোনও দুঃখ ছিল না। পৃথিবী সেই সময়ে ছিল অগণিত কল্পবৃক্ষে পূর্ণ। এই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া যায়, তা-ই লাভ করা যায়। কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব কল্পতরুর গুণাবলি হ্রাস পেতে থাকে। মানুষও শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক সঙ্কটে পড়তে শুরু করে। সেই অবস্থায় তাঁর প্রজাদের ক্লেশ নিবারণের জন্য ঋষভদেব ছ’টি বৃত্তি অবলম্বনের নির্দেশ দেন। এগুলি অবলম্বন করলে মানুষ জাগতিক ক্লেশ থেকে দূরে থাকবে বলে তিনি বর্ণনা করেন। এগুলি হল— অসি (রণজীবী, যাঁরা দুর্বলকে রক্ষা করবেন), মসী (কলমজীবী, অর্থাৎ কবি, দার্শনিক, চিন্তকরা), কৃষি (যাঁরা খাদ্য উৎপাদন করবেন), বিদ্যা (অন্যকে যাঁরা শিক্ষিত করে তুলবেন), বাণিজ্য এবং শিল্প।
অক্ষয় তৃতীয়া, সূর্যদেবের দান আর দ্রৌপদীর হাঁড়ি: এক অনিঃশেষ ভারতকথা
দ্রৌপদীকে কৃষ্ণের অক্ষয় পাত্রের মহিমা বর্ণন। বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্কিত চোরবাগান আর্ট গ্যালারির ছবি।
মহাভারতে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা বনগমন করলে অগণিত ব্রাহ্মণ ও মুনি-ঋষি তাঁদের সঙ্গ নেন। এতে যুধিষ্ঠির পড়েন মহা বিপাকে। তাঁরা সব কিছু ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছেন। কিন্তু রাজধর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ ও অতিথির সেবা একান্ত কর্তব্য। কী করে তিনি তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ করতে আসা অতিথিদের সেবা করবেন, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে পুরোহিত ধৌম্যের শরণাপন্ন হন যুধিষ্ঠির। ধৌম্য তাঁকে সূর্যের আরাধনা করতে বলেন এবং আরাধনার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন।
ধৌম্যের কথা মতো যুধিষ্ঠির সূর্যদেবের পুজা করলেন। সূর্য তুষ্ট হয়ে তাঁকে এক তামার পাত্র দান করলেন এবং বললেন, “বনবাসের দ্বাদশ বৎসর এই তাম্রস্থালীই তোমাদের অন্ন দেবে। সকলের আহার শেষ হলে যতক্ষণ না পর্যন্ত দ্রৌপদী আহার করছেন, ততক্ষণ এই পাত্রের আহার্য ফুরবে না।” সূর্যের কাছ থেকে সেই পাত্র লাভ করে যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত মনে বনবাসী হয়ে সাধুসঙ্গ ও অতিথি সেবা করতে লাগলেন। সূর্যের দেওয়া পাত্রের কথা কৌরবদেরও কানে পৌঁছল। তাঁরা পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করার নানা উপায় খুঁজছিলেন। এমতাবস্থায় মহাতেজা, মহাক্রোধী তপস্বী দুর্বাসা দুর্যোধনের আতিথ্য স্বীকার করলেন। সঙ্গে ১০ হাজার শিষ্য। দুর্বাসা কখনও কৌরবদের বলতেন যে, তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। স্নান সেরে আসছেন। কৌরবরা যেন তাঁদের আহার প্রস্তুত রাখেন। কিন্তু অনেক সময়েই স্নান করতে গিয়ে প্রচুর দেরি করতেন। ফিরে এসে বলতেন, খিদে নেই। কখনও মধ্যরাত্রে উঠে অন্নপাক করতে বলতেন। ব্যপারটা বুঝে দুর্যোধন ঠিক করলেন, দুর্বাসাকে সশিষ্য বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে পাঠালে তাঁরা জব্দ হবেন। কিন্তু সূর্যপ্রদত্ত তাম্রস্থালির গুণে অনন্ত অতিথি সেবা পাণ্ডবদের কাছে কোনও সমস্যার বিষয়ই নয়। তখন শকুনির পরামর্শে তিনি দুর্বাসাকে বললেন, পাঞ্চালীর ভোজন হয়ে যাওয়ার পর অপরাহ্নে তিনি যেন পাণ্ডবদের আতিথ্য গ্রহণ করে আহার্য চান। দুর্বাসা তাতে রাজি হয়ে বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে শিষ্যদের নিয়ে উপস্থিত হন। পাণ্ডব ও দ্রৌপদী— সকলেরই তখন মধ্যাহ্নভোজন হয়ে গিয়েছে। সূর্যপ্রদত্ত তাম্রপাত্র শূন্য। দুর্বাসা বললেন, তিনি স্নান সেরে আসছেন। ফিরে ন আহার্য পান।
পাঞ্চালী পড়লেন মহা বিপদে। উগ্রতেজা মুনিকে তুষ্ট করতে না পারলে পাণ্ডবরা ভস্ম হয়ে যেতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি তাঁর প্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, তিনি নিজেই দারুণ ক্ষুধার্ত। কৃষ্ণা যেন তখনই তাঁর আহারের ব্যবস্থা করেন। পাঞ্চালী জানালেন, সব আহার্য নিঃশেষিত। তাম্রপাত্র শূন্য। কৃষ্ণ বললেন পাত্র খুঁটিয়ে দেখতে। কিছু না কিছু তাতে লেগে থাকবেই। দ্রৌপদী পাত্রটি নিয়ে এলে কৃষ্ণ দেখলেন, তার কানায় সামান্য শাকান্ন লেগে রয়েছে। তিনি সেটুকুই খেয়ে বললেন, “বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন। তুষ্ট হন।” তার পর সহদেবকে বললেন, দুর্বাসাদের ভোজনের জন্য ডেকে আনতে। দুর্বাসাদের আহ্নিক তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু তাঁরা টের পেলেন, উদর পরিপূর্ণ। তাঁদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। শিষ্যরা দুর্বাসাকে জানালেন, আর আহার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। দুর্বাসা প্রমাদ গণলেন। তিনি ভাবলেন এখন যদি পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে তিনি আহার্য অস্বীকার করেন, তবে তো মহা অকল্যাণ ঘটতে পারে। পাণ্ডবরা হরিচরণে আশ্রিত। তিনি সশিষ্য পলায়ন করলেন। ওদিকে পান্ডবরাও দুর্বসার সশিষ্য পলায়নের বৃত্তান্ত জানতে পেরে নিশ্চিন্ত বোধ করলেন।
সূর্যপ্রদত্ত তাম্রপাত্রকে যে দিন অক্ষয়পাত্রে পরিণত করেছিলেন কৃষ্ণ, পৌরাণিক কাল থেকে মনে করা হয় সেই দিনটিই ছিল অক্ষয় তৃতীয়া।
মনে রাখতে হবে হিন্দু ধর্মানুভূতির সঙ্গে এই দিনটির গভীর যোগ রয়েছে। ভুল না করার শপথ নেবার এক বিশেষ ক্ষণ হলো এই অক্ষয় তৃতীয়া। সেজন্যই এই তিথি বা লগ্নে শুভক্ষণটি নিজের জীবনে অক্ষয় ও চিরসবুজ রাখবার জন্য অপরের প্রীতি সম্পাদনে নিজের সর্বস্ব নিয়োজিত করতে সকলে উন্মুখ হয়ে থাকে।







No comments:
Post a Comment