ইলিশের ঝাঁক জলে থাকলে নাকি ভেসে আসে এক বিশেষ আঁশটে গন্ধ। বাচ্চার জন্ম দিতে তারা সমুদ্র থেকে আসে মিষ্টি জলের নদীতে। ইলিশ ধরতে গেলে তাই পড়তে হয় জলের মন। এসব জানেন শুধু পোড় খাওয়া মাছ শিকারিরা। এই নিয়েই আজকের তরজা " গঙ্গা - পদ্মার ইলিশ "।
'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে রায়গুণকার ভারতচন্দ্র একত্রিশটি মাছের উল্লেখ করেছিলেন, যার শেষেরটি ইলিশ । হুমায়ূন আহমেদ মনে করতেন, বাংলা বর্ণমালার বইয়ে "আ" তে যদি আম হয়, তাহলে "ই" তে ইলিশ। পদ্মার অরিজিনাল ইলিশ দেখে বোঝার উপায়---- ইলিশের নাক ভাঙ্গা। বলা হয় ইলিশ যখন পদ্মায় ঢোকে , তখন হার্ডিন ব্রিজের স্পানে ধাক্কা খায়। আর তাতেই ইলিশের নাক থেঁতো হয়ে যায়। আর এই সব নাক ভাঙ্গা ইলিশই পদ্মার আসল ইলিশ। এদেশীয়রা গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের তুলনা টানলেও বাংলাদেশের মানুষজন গঙ্গার ইলিশকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। তাঁদের তুলনার বিষয় হলো ---- পদ্মার ইলিশের বেশি স্বাদ না যমুনার ইলিশের। সুরমা নদীর ইলিশের স্বাদ বাঙলাদেশের মানুষ মোটেই পছন্দ করে না। কারণ সেটা খেতে গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো।
গঙ্গা, পদ্মা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, তাকে ইলিশ বললেও, অন্য নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলেও তাকে আর ইলিশ বলে ডাকা হয় না। সৈয়দ মুজতবা আলী 'পঞ্চতন্ত্র' এ লিখেছেন, নর্মদা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, ভৃগুকচ্ছের মানুষ তাকে 'মদার' বলে ডাকে। পার্সিদের কাছে তার নাম 'বিম'। সিন্ধু নদ উজিয়ে এলে ওই মাছের নাম 'পাল্লা'। তামিলরা ইলিশকে বলে 'ইলম'। গুজরাতিরা পুরুষ ইলিশ কে বলে 'পালভো' আর স্ত্রী ইলিশকে বলে 'মোদেন'। এছাড়াও ইলিশের অনেক নাম আছে-------- চন্দনা ইলিশ, মুখপোড়া ইলিশ, খয়রা ইলিশ, গৌরি ইলিশ, সকড়ি ইলিশ, ফ্যাসা ইলিশ, জটকা ইলিশ, খ্যাপতা ইলিশ, গুর্তা ইলিশ ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিলে যে ইলিশ পাওয়া যায়, তাকে 'বিলিশ' বলে।
যা সুন্দর তাতেই কাঁটা থাকে। যেমন গোলাপ। ইলিশ-সুন্দরীর খেত্রেও একই ব্যাপার। তার পেটের কাছের কাঁটা দেখে প্রজাতি ঠিক করা হয়। এই কাটাগুলি দেখতে ইঙরাজীর 'ভি' এর মত। একে স্কুট বলা হয়। এই স্কুটের সংখ্যা অনুযায়ী ইলিশের প্রজাতি পাঁচ রকম। ইলিশ আবার বহুরুপী আছে ইলিশ-সুন্দরীর মতো দেখতে হলেও স্বাদে গন্ধে তারা কিন্তু ইলিশ নয়। তেমন চাপিলা মাছ এবং কই-পুটি।
অন্য মাছের তুলনায় ইলিশের কৌলীন্য বেশি। মৎস্য সমাজে ইলিশ একমাত্র উপবীতধারী। তার দুপিঠে যে দুটো সূতো থাকে, তার নাম পৈতা। আজ থেকে প্রায় ন'শো বছর আগে জীমূতবাহন তাঁর "কালবিবেক" গ্রন্থে এই বিখ্যাত মাছটির নাম দিয়েছিল ইলিশ। আর ১৮২২ সালে মৎস্যবিঞ্জানী হ্যামিলটন সাহেব এই মাছটির বিঞ্জানসন্মত নাম দিলেন --- হিলসা, হিলসা। ১৯৫৫ সালে এই মাছের বিঞ্জানসন্মত নামটি পালটে হলো টেনুয়ালোসা হিলসা। এই টেনুয়ালোসা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ' টেনিয়াস ' থেকে, তাঁর অর্থ পাতলা। ঝরঝরে চকচকে পাতলা শরীরের সুন্দরীর এমন নাম মানানসই।
ইলিশ একা একা থাকতে পারে না। সপরিবারে বেঁধে বেঁধে থাকে। ছোট বড় সকলেই। পুরোনো দিনের অনেকেই একে বলে 'গন্ধঝাক' । ইলিশরা এক সঙ্গে থাকলেই জলের উপর দিয়ে একটা আলাদা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। তখনই বোঝা যায় ইলিশের ঝাঁক আছে নদীর বুকে। আর জলের মন পড়তে গেলে চিনতে হয় জলের রং। ডাব জল, কালো জল, গাব জল, মাছ ধোয়া জল, চখা জল, চেরটা জল ইত্যাদি। চখা জল চোখের জলের মতো পরিষ্কার। আর চেরাটা জলে থাকে অনেক শেওলা। তবে ঘোলা জলে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ইলিশ নদীর গভীরে যত যায়, তত খাবার কমিয়ে দেয়। তখন সে তার শরীরে জমে থাকা ফ্যাট থেকে শক্তি সংগ্রহ করে । ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ কমতে থাকে। আর ইলিশ নরম ও সুস্বাদু হয়ে উঠে। এ ছাড়াও মাছের শরীরে কিছু ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্ম হয় ও তার রূপান্তর ঘটে। এর ফলেও বাড়ে ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ।
ঘটি আর বাঙালিদের মধ্যে চিরকালের লড়াই ইলিশ নিয়ে। বলা ভালো , ইলিশের স্বাদ নিয়ে। সমুদ্রে থাকার সময় ইলিশের শরীর ছোট, পাতলা ও কম স্বাদের হয়। নোনা জলের সঙসার থেকে মিষ্টি জলে ঢোকার সময় থেকে ইলিশ পুষ্ট হতে থাকে। তার স্বাদ বাড়াতে থাকে। ইলিশ যে সব খাবার খেয়ে বাঁচে, তারা হল নীল-সবুজ শেওলা , কোপেপড, ক্লাদাকেরা, রেটিফারের মতো জলে মিশে থাকা খাবার। ভালো মানের খাবার খেয়ে ইলিশের স্বাদ বাড়বে, এটাই মৎস্যবিঞ্জানীদের মত।
"মাইগ্রের" একটা ল্যাটিন শব্দ। তার মানে ভ্রমন। ইলিশ মাছ ভ্রমনপ্রিয়, তাই একে বলে মাইগ্রেটরি ফিস। কিছু দিন সাগরে, তো কিছু দিন নদীতে। নোনা জলের দেশে থাকে ইলিশ। ওটা ওর শ্বশুর বাড়ি। সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে বাপের বাড়ি আসতে হয়। মিষ্টি জলের নদী ইলিশের বাপের বাড়ি। ইলিশের মা হল গঙ্গা, আর মাসি পদ্মা। বছরে দুবার, শীতে ও বর্ঝায় ডিম ফাটিয়ে সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে আসতে হয় মা-মাসির কাছে। ঝাঁক বেঁধে সমুদ্র থেকে যখন ওরা ঢোকে নদীর বুকে, তখন তাঁকেই বলে অ্যানাড্রোমাস পরিযান। গঙ্গা ভাগীরথী হুগলি রূপনারায়ন ব্রহ্মপুত্র গোদাবড়ী নর্মদা তাপ্তী পদ্মা যমুনা মেঘনা কর্ণফুলী ইরাবতী সবেতেই সাগর উজিয়ে ইলিশ আসে।
আমাদের রাজ্যে ইলিশের জন্য একটা জল-জঙ্গল তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালে রাজ্য সরকারের মৎস্য দপ্তর তার জন্য একটা আইনও তৈরি করে ফেলেছে। সেই আইনের অধীনে ইলিশের জন্য তৈরি হয়েছে "ইলিশ অভয়ারণ্য"। গঙ্গার মোহনা থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত কয়েকটি অংশে ডিম পাড়ার জন্য ইলিশের বড় পছন্দের। যেমন লালগোলা থেকে ফারাক্কা অঙশ, কাটোয়া থেকে হুগলি ঘাট, ডায়মন্ড হারবার থেকে নিশ্চিন্তিপুর গদখালি অঙশে ইলিশ ডিম পেড়ে তার বাচ্চাদের বড়ো করে। আর বাঙলাদেশে ছ'টি অভয়াশ্রম স্থাপিত হয়েছে ..... যেগুলি মেঘনা অববাহিকা এবং পদ্মা-মেঘনার সংযোগ স্থলে অবস্থিত। পদ্মা ও মেঘনা নদী ছাড়াও শাহবাজপুর নদী, তেতুলদিয়া নদী , আন্ধারমানিক নদীতেও ইলিশ পাওয়া যায়।
গীতায় ভগবান বলেছেন যে, আমাকে যেখানে ভজুক , আমি তাকে সন্তুষ্ট করি। আর ইলিশ যেন আমাদের বলে , যে যেমন করেই আমাকে ভাজুক আমি তাকে তুষ্ট করি। বাঙালি দাম্পত্য জীবনের সাথে ইলিশের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির বিয়ের পরবর্তী অবস্থাকে জালে পরা ইলিশের সাথে তুলনা করেছিলেন। আর এক নোবেলজয়ী অমর্ত সেনও ইলিশ প্রেমিক। কলকাতায় থাকলে গঙ্গার ইলিশ তাঁর মেনুতে থাকবেই। আর স্বামী বিবেকানন্দও মাঝগঙ্গার ইলিশ খেতেই বেশি পছন্দ করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো লিখেইছেন, ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পোনে দু কিলোয়। তিনি বিশ্বাস করতেন...... দুধের স্বাদ তেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই খাঁটি ইলিশের স্বাদের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর সমঝোতা চলে না। আবার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন ...... সপ্তমী পূজোর দিনে আমি সওয়া দেড় কেজি ওজনের এমন একটা সুলখ্খন ইলিশ মাছ কিনব, যার পেটে সদ্য ডিমের ছড় পড়েছে। সুলখ্খন বলতে তিনি সেই ধরনের ইলিশের কথা বলেছেন, যার চেহারা একটু গোলাকার, পেট সরু এবং মাথাটা আকারে ছোটখাটো।
সাধারণত খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইলিশেরা মিঠে জলে ১৫ লাখ থেকে ১৮ লাখ ডিম পাড়ে। ডিম ফেটে ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চারা ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে যায়। এর পর খোকা ইলিশ পাঁচ থেকে ছয় মাস নদীতে কাটিয়ে শুরু করল তার ক্যাটাড্রোমাস পরিযান। মানে মিষ্টি জল থেকে ফিরে গেল মাটির টানে সাগর পানে। বড় হয়ে বের শীতে আসবে বলে।
বাঙালি বড় উন্নাসিক জাত। কেবল দুজনের জন্য বছরভর
হা করে থাকে। প্রথমটি তার কাছে একমাত্র মিনিংফুল সামাজিক উৎসব, দ্বিতীয়টি বাজারে নিত্তি মেপে, টনের হিসেবে পৌচ্ছানো ইলিশের সংবাদ। তার জীবনে মা দুগ্গা আর ইলিশ ছাড়া কারুর আগমন ঘটে না। শরৎকাল জগজ্জননীর। বর্ষাকাল যার নামে দেগে দেওয়া আছে, যার আগমনে বেঁচে থাকা অর্থবহ হয়ে উঠে, যাকে মাঝে মধ্যেই আদর আপ্যায়ন করে ঘরে না আনলে অনর্থের আশংকা এবং প্রভূত অর্থব্যায় ছাড়া যার এক কুচি আঁশেরও দর্শন মেলা ভার, সেই ইলিশ। আর কোনও মাছের নামে গোটা একটা মরশুম উৎসর্গ করেছে কভু বাঙালী ?
উঁহু, গোটা জাতির মানিব্যাগ যার গন্ডুষ, সে মৎসরাজ ইলিশ।ভৃত্যের কাছে ইলিশ প্রভু, নির্ধনের কাছে ইলিশ ধনী, বেয়াক্কেলের কাছে ইলিশ ফিশ। পুই, কুমড়ো, ঝিঙে, একটু আলু, বেগুন, গোটাকতক পটল আনাজের চুপড়ির কোনে পড়ে ছিল, তাদের চচ্চড়ি নাম দিয়ে তুলত কে, ইলিশের মাথা, লেজা,তেল, লুকা না থাকলে ? বহু কোটি বছর ধরে এভোলিউশনের ফলে উদ্ভুত, কচুর লতি, নারকেল শর্ষে বাটাকেই বা ব্রহ্মাণ্ডে মিনিংফুল করে তুললো কে ?
পেট ডিম-ভরা হলেও রাগ, না থাকলেও দুঃখ। তার পর ঝাল
ঝোল, সর্ষে বাটা, চচ্চড়ি, অম্বল । যে মাছ সামান্য রাধুনিকে রন্ধনশিল্পী বানিয়ে দেয় রাতারাতি, সে একমাত্র ইলিশ। গরীব থেকে বড়লোক হয়েছে বোঝানোর জন্যেও এই মাছের কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। ইলিশের পোলাও এবং বিরিয়ানি নামক কিম্ভুত মাল খুব উঠেছে আজকাল। অর্থাৎ যে মাছ খেলে এবং জোর করে খাওয়ালে সামাজিক উন্নতি বাঁধা ‐-- তারই নাম হচ্ছে ইলিশ। অতএব আমরা সাগর- " পার" অর্জিত দ্রব্য বিশেষের প্রহারসহিষ্ঞুতাাকে চারিত্রিক উন্নতি এবং অবনতির কারণ হিসাবে আনন্দেের সাথে মেনে নিয়েছি। এই যে আমরা বাঙালরা পর পর ক'বছর লিগ ফিগ নিচ্ছি না, তার কারণ তো ইকোনমিক কন্ডিশন দিিয়ে বুুঝতে হবে, তাই না? পয়সাকড়ির অবস্থা ভালো নয়, ইলিশ কিনতে পারবো না জোড়ায় জোড়ায়, তাই কাপ, শিল্ড একে একে দিয়ে দিচ্ছি।_______ তোরাও নে, নেওটা প্র্কটিস কর। অপরের প্রহারসহিষ্ঞুতার ওপর আমাদের অগাধ আস্থা যে মৎসের কারনে, বলাই বাহুল্য সে আমাগো ইলিশ।





Very informative.
ReplyDeleteThank you.
Delete