মহৎ আশ্রয়
তখন সবেমাত্র এসেছি বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন কলেজে। এগারোক্লাসে পড়ি। স্বামীজীর তিথিপূজায় দল বেঁধে আবাসিক ছাত্রীরা গেছি সারদা মঠে। সেখানে সকলে মন্দির দর্শন করবো, প্রসাদ পাবো এবং সভায় বক্তৃতা শুনবো। পনেরো-ষোল বছরের কিশোরী সবাই। গুরুগম্ভীর বক্তৃতায় তেমন উৎসাহ নেই, তবুও সভায় বসে মন দিয়েই শুনে যাচ্ছি। সবশেষে বলতে উঠলেন সভানেত্রী। রাশভারি চেহারা, মুখে মৃদু হাসি। তাঁর সামনেই মাঠে আমরা বসে আছি। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের একটা প্রেমের গল্প শোনাবো।’ চমকে উঠলাম, সাধু বলে কি? নড়েচড়ে বসলাম সবাই। ‘নাঃ, কোনো জোলো প্রেমের গল্প নয়। এ হল ঠাকুর এবং স্বামীজীর প্রেমের গল্প।” বলে চললেন তিনি, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলাম সেই অপার্থিব প্রেমকথা। গোটা মাঠ জুড়ে ছিল নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দ, কোনো চাঞ্চল্য নেই অল্পবয়সী ছাত্রীদের মধ্যে। সবাই যেন রূপকথার গল্প শুনছে। এই মানুষটিই শ্রীসারদা মঠের তৎকালীন সহ সম্পাদিকা প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণা মাতাজী।
স্বামীজী স্বপ্ন দেখেছিলেন, নারীমুক্তির জন্য একটি স্বাধীন নারীসঙ্ঘ চাই। সারা ভারতে ঘুরতে ঘুরতে মেয়েদের দুঃখ, যন্ত্রণা দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়েছিল আগে মা আর মার মেয়েরা তারপর বাবা আর তার ছেলেরা। আগে মেয়েদের মঠ চাই। সেখানে যথার্থ অধ্যাত্ম এবং লৌকিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মেয়েরা ছড়িয়ে যাবে দিকে দিকে, জ্বালিয়ে তুলবে আরও লক্ষ প্রদীপ। স্বামীজীর জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়নি, কারণ সেই বাল্যবিবাহের যুগে কোথায় পাওয়া যাবে ঘরের টান উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসা একঝাঁক স্বপ্নিল চোখকে? কিন্তু স্বাধীনতার পর একে একে জড়ো হতে শুরু করেছিল কিছু সাহসী স্বাধীন কন্যারা, যারা চিরাচরিত বাসরঘরে যাওয়ার রীতিকে মনের থেকে সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের বাইরে আসার সাহস দেখিয়েছিল। একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ - সারদা আমাদের আপন, দেশ আমাদের কর্মক্ষেত্র, স্বামীজী আমাদের নেতা। সেই গুটিকয় পুরোবর্তিনীকে নিয়ে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রীসারদা মঠ ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দে, শ্রীশ্রীসারদা দেবীর শতবর্ষে।
পাঁচ বছর বেলুড় মঠের অধীনে রইল সারদা মঠ । পাঁচ বছর পরে মেয়েদের যথেষ্ট উপযুক্ত বিবেচনা করে স্বামীজীর ইচ্ছা অনুযায়ী বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষ শ্রী সারদা মঠকে স্বাধীন স্ত্রী মঠের মর্যাদা দিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন নারীমঠ। সেই মঠে যে আট জন প্রথম সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষা নিয়ে একটা নতুন যুগের সুচনা করেছিলেন তাদের অন্যতমা ছিলেন শ্রদ্ধাপ্রাণা মাতাজী। কারণ হিন্দু মেয়েদের সন্ন্যাসের অধিকার দেন নি সমাজপতিরা। বিবাহিত জীবনই তাদের একমাত্র পরিনতি ছিল। স্বামীজী তাঁর যুগান্তকারী দূরদৃষ্টিতে প্রথম অন্য ধাঁচে নারীমুক্তির কল্পনা করেন। আর সেই কল্পনার সাকার রূপ দেন একাধারে রামকৃষ্ণ মঠ এবং এই সব অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিতা, অথচ বৈরাগ্যপ্রবণ গার্গী মৈত্রেয়ীরা। শ্রদ্ধাপ্রাণা মাতাজী, আগের জীবনে লক্ষ্মী সিংহ, সে যুগে ইংরাজীতে মাস্টার ডিগ্রি করে কাশীতে একটি কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন। কিন্তু স্বামীজীর ডাক প্রাণে বাজলে ঘর তুচ্ছ হয়, যেমন স্বাধীনতার যুগে তাঁর বাণী সম্বল করে ঘর ছেড়েছিল বহু তরুণ তরুণী। স্বাধীনতা চলে এলেও গড়ে ওঠার এবং গড়ে তোলার লড়াই তো থামে নি, তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিলেন এসব অলোকসামান্যারা, বুকের রক্ত দিয়ে তৈরি করেছিলেন রাস্তা , যে রাস্তায় আজ আমরা অতি সহজে হাঁটছি।
অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী মাতাজীকে ছাত্রীজীবনে আমরা পেয়েছিলাম প্রধাণত বক্তৃতামঞ্চে। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর কথাগুলি যেন শুধু কান দিয়ে নয়, প্রতিটি জ্ঞানেন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতাম। প্রতি বছর বিদ্যাভবনে হত তিনদিনের আধ্যাত্মিক শিবির। সেখানে প্রায় প্রতিবার তাঁর বলা থাকতো। কখনো কথাপ্রসঙ্গে বলছেন, ‘ব্যাকুল সুদাস কহে, প্রভু আর কিছু নহে চরণের ধুলি এককণা।’ কখনো বা বলছেন, ‘যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি/ তাহারই খানিক/ মাগি আমি নতশিরে।’ রবীন্দ্রকবিতাগুলি অক্ষরের বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতো। এখন অনেকে বক্তৃতার সঙ্গে projector এ ছবি দেখান। তিনি কথার তুলিতে সেই ছবি আঁকতেন আমাদের চোখের সামনে।
একবার আধ্যাত্মিক শিবির থেকে ফিরে যাব যা যা মম্প আমরা কেমনভাবে সেটা বোঝাতে গিয়ে মাতাজী একটি কাহিনি বলেছিলেন। এক সন্ন্যাসী প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করে ওঁকার ধ্বনি করতে করতে ফিরতেন। কেমন ছিল সেই প্রণব ধ্বনি সেটা বোঝাতে মাতাজী মাইকের সামনে নিজে সেই প্রণবধ্বনি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, ‘ ও -ও -ও - ও - ও -ম্’। কী সেই ওঁকারের অনুরণন! সারা সভাগৃহে ছড়িয়ে পড়লো সেই অপূর্ব ধ্বনির রেশ। মাতাজী বললেন, ‘তোমরা এইরকম রেশ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।’ প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা, ‘তোমার আলোয়’ প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণা জন্মশতবর্ষ স্মরণিকা, পৃঃ৮২
দীক্ষা কী দিচ্ছি তা মা-ই জানেন ! সব(দীক্ষার্থীগণ) আসে --আমি কেবল নৈবেদ্য ফুলের মতো মায়ের পায়ে দিয়ে দিই ! বেশ লাগে !!! আমাদের তো গুরুবুদ্ধি নেই --ঠাকুরই তো সব। যদি গুরুবুদ্ধি থাকত তাহলে এত মজা লাগত কি না কে জানে ? আমি আর কী ? আমি তো কেবল সম্বন্ধ পাতিয়ে দিয়েই খালাস --আমি তো কেবল ঘটকালির কাজ করি।...দেখ, ঠাকুর একটা কানাকড়ি দিয়ে কী করছেন ! ..সব (দীক্ষাপ্রার্থীগণকে) তো আমি দেখেশুনে নিতে পারি না। শান্তিজল, আচমনটা ওরা (সহকারী সন্ন্যসীগণ) করে দেয়। অধ্যক্ষদের ওপর এটার ভার দিয়েছি।...গুরুকে নিয়ে মাতামাতি করতে বলি না। করতে চাও তো বাড়িতে বসে কর। আমি বলি,গুরুকে অল্প ধ্যান করে ইষ্টে লীন করে।আমি তো পাঁকাল মাছ।তিনিই সব,ঠাকুরই সব।...ঠাকুর ও মায়ের ছবি সামনে নিয়ে অভ্যাস করবে,ক্রমে হবে।প্রথম প্রথম পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না, তার কারণ মন এখন চঞ্চল অভ্যাস করতে করতে মন যখন রজঃ থেকে একটু সত্ত্বে উঠবে তখন স্পষ্ট ধ্যান হবে। উন্নতি যে হচ্ছে, তা বোঝা যাবে মনের তৃপ্তিতে।..কাজকর্মের মধ্যে তাঁর কাজ ; ঠাকুরকে কেন্দ্র করেই সব --এটি সবসময় চিন্তা করতে হবে।সংসার --কেবল 'আমি',' আমার' ,'আমিময়'। আমাদের এখানে --কেবল 'ঠাকুর','ঠাকুরের','ঠাকুরময়।'তুমি','তোমার', 'তুমিময়'। "কাজকর্মের মধ্যে মধ্যে এই চিন্তাটি থাকা চাই।তাই একটু সময়মতো ঐ চিন্তাটি করে ঐ ভাবটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।ঐ চিন্তাটি না থাকলে কাজ চাকুরীর সামিল। ঠাকুরের জন্যই সব।তাঁকে ভালবাসতে হবে।...আগে 'রামকৃষ্ণ' পরে 'মিশন' ; আগে 'মিশন'পরে 'রামকৃষ্ণ' নয়।
*-------স্বামী বিশুদ্ধানন্দ।
স্থানঃ সারগাছি।জানুয়ারী,১৯৬০খৃঃ।* মুসাফিরের গাঁটরি -- স্বামী সুহিতান্দ।
হর হর মহাদেব
শিবের সাতটি জিনিসের মহাত্ব্য ::
ঘুমাতে পারবেন না।
২) ভষ্মঃ এটা জীবনের অনিত্যতাকে স্মরন করিয়ে দেয়। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদেরও একদিন ভষ্মে পরিণত হতে হবে।
৩) চন্দ্রঃ চন্দ্র সর্বদাই মনের সাথে সম্পর্কিত। এটি জীবনের সকল পরিস্থিতিতে সুখী থাকা এবং মনের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার প্রতীক।
৪) ডমরুঃ এটা দেখতে ইনফিনিটি চিহ্নের মত। যা শিবের অসীম তথা উন্মুক্ত চিন্তাচেতনার প্রতীক।
৫) ত্রিশুলঃ শিব প্রকৃতির তিনগুন নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন, এটি তারই প্রতীক। তিনি এটির মাধ্যমে সকলকে নিজ নিজ ধর্ম
পালনে উৎসাহিত করে থাকেন।
৬) নীলাভ শরীরঃ আকাশ অন্তহীন, শিবও তেমনি অন্তহীন। নীলাভ শরীর অন্তহীন আকাশের মতই শিবের অন্তহীনতা
তথা অসীমতার প্রতীক।
৭) গঙ্গাঃ গঙ্গা নিষ্কলুষ জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। যখন শিবের মতই আমাদের হৃদয় স্থির হয়, তখনই তাতে নিষ্কলুষ জ্ঞান প্রবাহিত হয়।
💥💥💥💥💥💥💥
🕉️ হর হর মহাদেব 🕉️
*********** অমৃত কথা ***********"***""""""" স্বামী বিশুদ্ধানন্দ
কাশী সেবাশ্রমের জনৈক ডাক্তার এসেছেন মহারাজকে প্রণাম করতে। মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন " কেমন আছ ? " ডাক্তার বাবু ---- " ভাল নয়। মন একটুতেই চঞ্চল হয়ে যায়। মনের এরূপ অস্থিরতার জন্য বড়ই অশান্তি ভোগ করছি।"
মহারাজ সব কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, " সত্যিই তো বড় মুশকিলের কথা। তুমি এক কাজ করো। যখনি ঐসব মনে হবে, তখন জোর করে হাততালি দিয়ে দিয়ে ' জয় রামকৃষ্ণ , জয় রামকৃষ্ণ ' বলবে। মনে মনে জপ নয় --- জোরে জোরে। তাহলে দেখবে সব চলে যাবে। এই রকম মনের অশান্তির কথা অনেকেই বলে। আমি তাদের বলি, ' মন্দিরের সামনে বসে ঠাকুরের দিকে চেয়ে খুব জপ করো, দেখবে সব চলে গেছে। '
" মনে কর নর্দমায় ময়লা জমেছে। তখন জোর করে বালতি বালতি জল ঢাললে তবেই ময়লা যায়। সেইরকম জোর করে নাম, জপ আর প্রার্থনা করতে হয়। ছাড়বে না , দেখবে তাতেই সব ময়লা চলে গেছে। উপাসনা মানে কি ? ' উপ ' মানে নিকটে ---- ' আসনা ' মানে
' আসন গ্রহণ করা ' অর্থাৎ নিকটে আসন গ্রহণ করা। কার নিকট ? --- না ভগবানের নিকট। তিনি কোথায় ? আমাদের হৃদয়ে ! অর্থাৎ হৃদয়ে তাঁকে চিন্তা করাই উপাসনা। তিনি আমাদের সর্বাপেক্ষা নিকটে আছেন। তাঁর কাছেই যেতে হবে, তাঁকেই চিন্তা করতে হবে।
" কথামৃতের একটি scene চিন্তা করলে তাতেও উপকার হবে। মা কি বাবা যাকে হোক ধরে থাকো। তাঁদের চিন্তা করতে করতে দেখবে, ক্রমে ক্রমে সব চলে যাচ্ছে। কেমন জানো --- একটা কড়াইতে জল গরম করতে দিয়েছ। প্রথম তাপ লাগলে কড়ার চারপাশে ছোট ছোট ফুট হয়। পরে যত ই কড়াই গরম হতে থাকে, তত ই জলটা টগবগ করে ফুটতে থাকে। সেইরকম প্রথমে নাম করতে হয়। নাম ও প্রার্থনা করতে করতে জপ হয়। জপ করতে করতে ধ্যান হবে। তারপর আরও কত কী? প্রথমে ভক্তি ও ভালবাসা চাই।
#কালিবাড়ির_প্রতিষ্ঠাদিবস ১৮৫৫ সাল, ৩১ শে মে, বৃহস্পতিবার
আজ এক বিশেস দিন। আজ দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির
১৬৬তম প্রতিষ্ঠা দিবস।
১৮৫৫ সালের ৩১এ মে , ১৮ই জ্যৈষ্ঠ , বৃহস্পতিবার ,
পুণ্য স্নানযাত্রার দিনে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা
করেন লোকমাতা রানী রাসমণি।
১৮৪৭-তে মন্দির নির্মাণ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৮৫৫-য়।
১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের স্থাপত্য
দেখার মতো। গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য-পদ্মের
উপর শায়িত শিবের বুকে দেবী কালী দাঁড়িয়ে। এক
খণ্ড পাথর কুঁদে তৈরি হয়েছে এই দেবীমূর্তি।আট
বছরে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় এই মন্দিরটি।
মন্ত্র কি এবং এর উপকার :::
ভক্ত – তা একটু একটু রোজই করি-খানিকক্ষণ জপ, ধ্যান, প্রার্থনা নিত্যই করে থাকি। কিন্তু তাতে তো তৃপ্তি হয় না। ইচ্ছা হয় আরো করি, কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না ।
মহারাজ – যা করছ, তাই করে যাও অন্তরিকতার সঙ্গে। তাতেই তোমার কল্যাণ হবে ।
ভক্ত –আর একটিমাত্র কথা জিজ্ঞসা করব । আপনার শরীর অসুস্থ তাই বেশি কথা বলতে ভয় হচ্ছে।
মহারাজ-তা বল না, বেশ তো।
ভক্ত – মা ঠাকরুন যে মন্ত্র দিয়েছেন, সেই মন্ত্রই জপ করে যাচ্ছি। কিন্তু মন্ত্রের কি অর্থ তা তো জানিনে, আর তিনিও বলে দেননি ।
মহারাজ – ঐ মন্ত্র জপ করছ তো? তবেই হলো। মন্ত্রের আবার অর্থ কি? মন্ত্র হলো ভগবানের নাম । আর নামের সঙ্গে যে বীজ আছে, তা হলো সংক্ষেপে বিশেষ দেবদেবীর ভাবপ্রকাশ। বীজ এবং নাম একত্রেই হলো মন্ত্র। মোট কথা মন্ত্র ভগবানকেই বোঝাচ্ছে । মন্ত্র জপ করলে তাঁকেই ডাকা হয় । আর বেশি অর্থ জেনে কি হবে, বাবা? সরল বিশ্বাসে সেই মহামন্ত্র জপ করে যাও, তাতে তোমার কল্যাণ হবে ।
ভক্ত – আপনি আশীর্বাদ করুন যাতে এ ভববন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।
মহারাজ-খুব আশীর্বাদ করছি, বাবা তাই হবে । মায়ের কৃপায় তুমি মুক্ত হয়ে যাবে ।
-- শিবানন্দ বাণী।
রামকৃষ্ণ ওঁ হরি ॥
হাওড়া হইতে বালী পর্যন্ত বাস চলাচল আরম্ভ হইবার প্রায় তিন মাস পরে একদিন বৈকালে পূজনীয় শঙ্করানন্দ মহারাজ কলিকাতা হইতে বাসে বেলুড় মঠে ফিরিতেছিলেন। কিয়দ্দুর বাসটি আসিবার পর পার্শ্বস্থ জনৈক সহযাত্রী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ আপনি কি রামকৃষ্ণ পরমহংস মঠের ”? মহারাজজী বলিলেন, “হাঁ, কিছু বলবেন কি ?”
তিনি বলিতে লাগিলেন,
“ বাল্যকালে বাবার নিকট শুনেছি রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাদের যে কি উপকার করেছেন তা মুখে বলা যায় না। আমরা জাতিতে মুসলমান এবং কামারপুকুর অঞ্চলে আমাদের বাড়ী। এখন কলকাতার চাঁদনীতে একটি দোকান আছে। বাবা কয়েক বৎসর হল গত হয়েছেন।
“ বাবা বলেছিলেন, আমাদের তখন মধ্যবিত্ত অবস্থা ও তদুপযুক্ত ঘরদ্বার খামার ধানের গোলা ইত্যাদি ছিল। কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে প্রতি বৎসর আগুন লেগে সমস্ত পুড়ে যেত। এইরূপ ২।৩ বার হওয়ার পর একদিন জনৈক ব্রাহ্মণবন্ধুর নিকট আমার দুঃখের কাহিনী বলছিলাম। সে সময়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস ঐ পথ দিয়ে লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে কীর্তন করতে করতে গ্রামান্তরে যাচ্ছিলেন। আমার বন্ধু তাঁকে অদূরে দেখে আমাকে বলেন, ঐ যে মহাপুরুষ কীর্তন করতে করতে যাচ্ছেন, তাঁহার শরণ লও। তিনি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন।
“ পিতা এই কথা শুনে সেই মহাপুরুষকে নিবেদন করবার জন্য ভক্তিভাবে বিনয়সহ ভূমিস্পর্শ ক’রে সেলাম করতে করতে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন। পরমহংস পিতাকে প্রশ্ন করেন, ‘ কি বাবা ?’ পিতা বলিলেন, ‘ বাবা, আমরা ছা-পোষা মধ্যবিত্ত লোক, যা কিছু ঘর বাড়ী খামার আছে প্রতি বৎসর আগুনে পুড়ে গেলে কি প্রকারে আমরা বাঁচতে পারি ? এইজন্য আপনার শরণ নিচ্ছি, একটা উপায় দয়া করে করুন’ । এই কথা শুনে পরমহংস জিজ্ঞাসা করলেন, - ‘কোথায় তোমার ঘর ?’ রাস্তার অনতিদূরে নির্দেশ করিয়া পিতা বলিলেন, -‘ঐ খানে, এখনও পোড়ার সব চিহ্ন রহিয়াছে।’
পরমহংস পিতাকে বলিলেন, ‘ আচ্ছা চল’। অন্যান্য লোকজনদের একটু অপেক্ষা করতে বলে নিজে পিতার সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলেন। বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছলে তিনি বাবাকে কয়েকটি ফুল আনতে বললেন। পিতা কয়েকটি ফুল নিয়ে এলে তিনি হাত পেতে নিলেন ও বললেন, ‘ কতটা জায়গা জুড়ে তোমার বাড়ী খামার যা আগুনে নষ্ট হয়, দেখিয়ে নিয়ে চল ’। পিতা তাঁর কথামত আগে আগে চলতে লাগলেন। পরমহংস বিড়বিড় করে কি বলে যাচ্ছেন ও মধ্যে মধ্যে এক একটি ফুল ফেলতে লাগলেন। এইভাবে বাড়ী খামার প্রদক্ষিণ করে পিতা একস্থানে দাঁড়ালে পরমহংস জিজ্ঞাসা করলেন ‘ সবটা হয়েছে ?’ পিতা তদুত্তরে ‘আজ্ঞে হয়েছে ’ বললেন। এর পর থেকে এযাবৎ আর আমাদের বাড়ীতে আগুন লাগে নি। এজন্য আমরা পরমহংস মহাশয়ের নিকট চিরকৃতজ্ঞ।”
রামকৃষ্ণ শরণম্ ।
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ও শ্রী শ্রী তোতাপুরি ::
তোতাপুরী গঙ্গাসাগর হইতে ফিরিয়া রামকৃষ্ণের কাছে কয়েকমাস অবস্থিতি করিলেন। এই অবস্থিতি সময়ে তোতাপুরির সহিত রামকৃষ্ণের নানা বিষয়ে আলোচনা হইত। তোতাপুরি নানা শাস্ত্রপাঠে কঠোর সাধনার যে সব বিষয় বুঝিয়াছিলেন-রামকৃষ্ণ লেখাপড়া না শিখিয়া সেই সব বিষয়ের সরল মীমাংসা কি প্রকারে করেন ইহা ভাবিয়া অবাক হইতেন। তোতাপুরির সহিত রামকৃষ্ণের কোনও কোনও বিষয়ে মিলিত না। রামকৃষ্ণ কথায় কথায় মা, মা কহিতেন। একদিন তোতাপুরি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেন “বাবা! তুমি ‘মা’ বল কাকে? মা আবার কি?”রামকৃষ্ণ কোন উত্তর করিলেন না। আপন গৃহে গিয়া ধ্যানস্থ হইয়া মাকে নিবেদন করিলেন! “মা, আমার গুরু কি তোকে জানে না? গুরু বলেন, মা আবার কি? গুরুকে কি বলবো বলে দাও মা?”
মা কহিলেন “তোর গুরুকে আজ রাত্রি দুটার সময় আমার মন্দিরের পিছনে যাইতে বলিস; আমি তোর কি প্রকার মা বুঝিতে পারিবে।“
রামকৃষ্ণ অমনি গুরুর নিকটে গিয়া সমুদয় নিবেদন করিলেন। গুরু বলিলেনঃ আচ্ছা বাবা! আজ রাত্রে আমি যাব।
তোতাপুরি সেই রাত্রে ঠিক দুটার সময় খরমপায়ে কালী মন্দিরের পিছনে চলিলেন। তখন আকাশের চাঁদ অস্ত গিয়াছে। মন্দিরের পিছনে বৃক্ষসকলের ছায়ায় অন্ধকার বড় ঘন হইয়াছে। তোতাপুরি ধীরে ধীরে যাইতে ছিলেন হঠাৎ পায়ে কিসের আঘাত লাগল। পা হইতে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বলিয়া উঠিল-হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গেলেন-একবারে অজ্ঞানবৎ ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িয়া গেলেন। জীবনে কখনও এমন হোঁচট খান নাই।
রামকৃষ্ণ আপন ঘর হইতে যোগশক্তির বলে এই ঘটনা জানিতে পারিয়া দ্রুত বেগে গুরুর কাছে ধাবিত হইলেন। মন্দিরের পিছনে গিয়া বলিলেন, “বাবা! পড়ে গেছ?”
“হাঁ বাবা আমার আর উঠিবার শক্তি নাই। তোমার মা আমায় ফেলিয়া দিয়াছেন। আমার বোধ হয় শরীরের হাড় চূর্ণ হইয়াছে। আমি উঠিতে পারিতেছি না-বাবা তোমার মাকে বলে আমায় ভাল করে দাও। তোতাপুরি অতি কাতর স্বরে এই কথা কহিলে রামকৃষ্ণ বালকের মত কাঁদিয়া মাকে ডাকিতে ডাকিতে কহিলেন “মা! ওমা। আমার গুরুকে ফেলে দিলি কেন মা। আমার গুরুকে ভাল করে দে না মা!” রামকৃষ্ণ বালকের ন্যায় রোদন করিতে লাগিলেন, সে কান্না শুনিয়া তোতাপুরির প্রাণের ভিতরে এক আশ্চর্য্য ভক্তিভাবের উদয় হইল। তোতাপুরির জ্ঞান-চক্ষে দেখিলেন “সচ্চিদানন্দ যিনি, তিনি অবিকৃত মূর্ত্তি ধারণ করিতে পারেন!” অমনি সব যাতনা দূর হইল। তোতাপুরি উঠিলেন। রামকৃষ্ণের পৃষ্ঠে মৃদুভাবে চাপড় মারিতে মারিতে কহিলেন, “বাবা! আমি তোর গুরু নই তুই আমার গুরু বাবা। তোর মা যে কেমন মা, তা বুঝিয়াছি। আজ আমার শুষ্ক ব্রহ্মজ্ঞান সরস হইল।“ –শ্রী শ্রীতোতাপুরী-প্রসঙ্গ (পার্থ প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়)
🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺🌼🌹🙏🏻🌺
শ্রী ঈশ্বর তোতাপুরী সম্বন্ধে দু-চার কথা :
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গুরু, শ্রী ঈশ্বর তোতাপুরীর একমাত্র ছবি। ছবিটি সম্ভবত ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৬ সালের মধ্যে তোলা হয়।
শ্রী ঈশ্বর তোতাপুরী ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাবে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি একজন পরিব্রাজক সন্যাসী ছিলেন যিনি অদ্বৈত্ব বেদান্তের পথ অনুসরন করতেন। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলকাতার দক্ষিনেশ্বরে আসেন ও শ্রী রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ করে, তাঁকে অদ্বৈত্ব বেদান্তের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। তোতাপুরী কোন বস্ত্র পরিধান করতেন না (নাগা সন্যাসীদের ন্যায়)। এর জন্য তাঁকে 'উলঙ্গ সন্যাসী' বলেও ডাকা হত। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে, ৮৬ বছর বয়সে, তাঁর দেহাবসান ঘটে।
বিরাটপুরুষ রূপে শ্রীরামকৃষ্ণ
-----------------------------------------------
গদাধরের (ঠাকুরের) বয়ঃক্রম তখন সাত-আট মাস হইবে। শ্রীমতী চন্দ্রা একদিন প্রাতে তাহাকে স্তন্যদানে নিযুক্তা ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে পুত্রকে নিদ্রিত দেখিয়া মশক দংশন হইতে রক্ষা করিবার জন্য তিনি তাহাকে মশারির মধ্যে শয়ন করাইলেন। অনন্তর ঘরের বাহিরে যাইয়া গৃহকর্মে মনোনিবেশ করিলেন। কিছুকাল গত হইলে প্রয়োজনবশত ঐ ঘরে সহসা প্রবেশ করিয়া তিনি দেখিলেন, মশারির মধ্যে পুত্র নাই, তৎস্থলে এক দীর্ঘকায় অপরিচিত পুরুষ মশারি জুড়িয়া শয়ন করিয়া রহিয়াছে। বিষম আশঙ্কায় চন্দ্রা চিৎকার করিয়া উঠিলেন এবং দ্রুতপদে গৃহের বাহিরে আসিয়া স্বামীকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তিনি উপস্থিত হইলে তাঁহাকে ঐ কথা বলিতে বলিতে উভয়ে পুনরায় গৃহে প্রবেশপূর্বক দেখিলেন কেহ কোথাও নাই, বালক যেমন নিদ্রা যাইতেছিল তেমনি নিদ্রা যাইতেছে। শ্রীমতী চন্দ্রার ভয় দূর হইল না। তিনি পুনঃপুনঃ বলিতে লাগিলেন, "নিশ্চয়ই কোন উপদেবতা হইতে এরূপ হইয়াছে। কারণ স্পষ্ট দেখিয়াছি পুত্রের স্থলে এক দীর্ঘকায় পুরুষ শয়ন করিয়াছিল। কিছুমাত্র ভ্রম হয় নাই।" শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম তাঁহাকে আশ্বাস প্রদানপূর্বক কহিলেন,"বাটীতে রঘুবীর স্বয়ং বিদ্যমান।... জানিও রঘুবীর সন্তানকে সর্বদা রক্ষা করিতেছেন।"









No comments:
Post a Comment