মানুষকে এই বস্তুবাদী দুনিয়া থেকে ত্যাগের পথে নিয়ে যায় এই গেরুয়া রং। তাই সেই বেদের সময় থেকেই গেরুয়া হয়ে গিয়েছিল বস্তুবাদী দুনিয়া ত্যাগ করে বৃহত্তম আধ্যাত্ম্য দুনিয়ায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার রং। তাই গেরুয়া হয়ে গেল সাধু মহাত্মাদের পরিধেয় বসনের রং।
স্বামীজি থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে সাধু মহাত্মাদের দেখা যায়, তাঁরা গেরুয়া বসন পরে থাকেন। যুগ যুগ ধরেই কিন্তু এ দৃশ্য মানুষ দেখে এসেছেন। কিন্তু কেনই কেবল গেরুয়া বসন? কেন অন্য কোনও রং নয়? এর কারণ খুঁজতে কিন্তু পিছিয়ে যেতে হয় বেদের সময়ে।
গেরুয়া রং হল আগুনের রং। গেরুয়া হল সূর্যের রং। ঋগ্বেদে অগ্নিকে আগুনের দেবতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বৈদিক যে কোনও ক্রিয়ায় আগুনের ব্যবহার আবশ্যিক। সে হোম হোক বা আরতি। বলা হয় আগুন সবকিছুকে পবিত্র করে তোলে। আগুনের রং হল ত্যাগের রং। আর সেই রং হল গেরুয়া। মানুষকে এই বস্তুবাদী দুনিয়া থেকে ত্যাগের পথে নিয়ে যায় এই গেরুয়া রং। তাই সেই বেদের সময় থেকেই গেরুয়া হয়ে গিয়েছিল বস্তুবাদী দুনিয়া ত্যাগ করে বৃহত্তম আধ্যাত্ম্য দুনিয়ায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার রং।
আমাদের অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীতে এত রঙ থাকা সত্ত্বেও কেন সাধু সন্ন্যাসীরা গেরুয়া রঙকে এত পছন্দ করেন? এই রং অনেকটা কমলা রঙের মতো। আসলে গেরুয়া রঙের যোগ রয়েছে পুরাণের সঙ্গে। আধ্যাত্বিক বিশ্বাস সহকারে সাধুরা এই রঙের পোশাক পরিধান করেন। বলা হয় অগ্নিদেবের রঙ্গ গেরুয়া। হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও গেরুয়া রঙের পোশাক পরতে দেখা গিয়েছে। লাল হলুদের মিশেলে পাওয়া এই রঙকে বলা হয় সুখের প্রতীক। কথিত আছে, গেরুয়া রঙের সঙ্গে মানব শরীরের অঙ্গের বিশেষ যোগ রয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে কিডনি, প্রজননতন্ত্র, মলাশয় এবং মূত্রথলি। এই রং নাকি শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখে তাই এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সুস্থ অসুস্থতার বিষয়।
সাধারণত গেরুয়া রংটি আমরা আধ্যাত্মিক চোখেই দেখে থাকি। রংটি হিন্দু পুরাণের দুটি শুভ জিনিসের সাথে অনুরণিত হয়। তা হল সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের রঙ এবং আগুনের রং। পুরাণ মতে, সূর্য এবং আগুন এই দুটিই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা উল্লেখযোগ্য শক্তি। কিন্তু আধুনিক সময় দাঁড়িয়ে কেবল পুরাণের উপর ভিত্তি করে জীবন চলে না তার সঙ্গে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় বিজ্ঞানও। আপনি কি জানেন শুধু ধর্ম নয়, সাধুদের গেরুয়া পোশাক পরার পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণও আছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন, সাইকো নিউরোবিক্স বিশেষজ্ঞ ডক্টর বি কে চন্দ্রশেখর। তাঁর মতে, সাতটি প্রাথমিক রং আমাদের শরীরের সাতটি চক্রের সাথে যুক্ত। এগুলি হল- লাল, গেরুয়া বা কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল এবং বেগুনি। প্রতিটি রঙেরই রয়েছে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য। যখন আমরা কোনও রঙের দিকে তাকাই, তখন সেই রংগুলি প্রত্যেকেই নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য মেনে আমাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এটিকেই বলে কালার ভাইব্রেশন থেরাপি।
কিন্তু কী এই কালার ভাইব্রেশন থেরাপি?
যখন আমরা একটি রং দেখি, তখন এটি আমাদের রেটিনায় একটি চিত্র তৈরি করে যা বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় এবং তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্কে নির্দেশ পাঠায়। চোখের অপটিক নার্ভ এটিকে ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত করে। প্রতিটি রংই আমাদের মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা কম্পন তৈরি করে। এবং এই কম্পন থেকেই মানসিক প্রভাব বিস্তার হতে পারে মনে করেন তিনি।
গেরুয়া রংকে এমনিতেই আমরা ত্যাগ ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে জেনে থাকি। পাশাপাশি ডাঃ চন্দ্রশেখর ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, এই রঙের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার ফলে মানুষের মস্তিষ্কে যে কম্পন তৈরি হয় তা একজনের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। মানুষের কোলন, মূত্রাশয়, কিডনি, প্রজনন ব্যবস্থা এবং মূত্রথলি জনিত বিভিন্ন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই রং।
যদিও বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন কমলা আনন্দের রঙ কারণ এটি লাল এবং হলুদের সংমিশ্রণ। কিন্তু বিশ্বাস যাই হোক এই রঙের যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও যথেষ্ট রয়েছে তা জানা যায় চিকিৎসকের ব্যাখ্যা থেকেই। গেরুয়া রঙের উপর মনোনিবেশ করা একজনের জীবনে মানসিক এবং শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই একাধিক উপকার করতে পারে এটি। এমনকী ক্লান্তি দুর করতেও সহায়তা করে।
সুতরাং সাধুদের পোশাকের এহেন রং কেবল একটা মিথ নয়, অভ্যাসও নয়। এটির নেপথ্যে রয়েছে বিজ্ঞান। আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ব্যাখ্যার পাশাপাশি একজন সাধুর প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এবং আকর্ষণ জোরালো করতেও সাহায্য করে পরনের ওই গেরুয়া বসনটিই।
তবে পুরানো নথিপত্র ঘাটলে এই গেরুয়া রং-এর পোশাক কেন সন্ন্যাসীদের পোশাকের রং হল, তা সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। জানা যায় এইরকম..........
শ্মশানে মৃতদেহ নামিয়ে রাখার পর পুরোনো কাপড় ফেলে দিয়ে দেহটি গঙ্গায় স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে শুরু করা হয় মৃতের অন্তিম যাত্রা। ওই ফেলে দেওয়া কাপড় সংগ্রহ করে আনতেন বৌদ্ধ শ্রমণেরা। লাল মাটির উপর অনেক দিন ফেলে রাখলে সেই কাপড়ে মাটির রঙ ধরত। তখন মাটি থেকে কাপড় তুলে নিয়ে সামান্য ধুয়ে তাঁরা গায়ে পরতেন। এইভাবে তৈরি হত সন্ন্যাসীর পরিধেয় আড়াই হাজার বছর আগে।
বৈদিক যুগের সন্ন্যাসী প্রায়শই নগ্ন, লজ্জা তাঁকে ছেড়ে গেছে। তবু দিন পাল্টায়। অরণ্য কেটে যতই বসতি স্থাপন করা হল, ততই সন্ন্যাসীরও প্রয়োজন হল বসনের। সামাজিকতার কারণে তো বটেই, শীত এবং রৌদ্রের তাপ হতে বাঁচার তাগিদেও।
কাপড়ে মাটির রঙ ধরানো হত একথা মনে রাখার জন্যেই যে, এ দেহ একদিন মাটি হয়ে যাবে। তাই, জড়িয়ে পোড়ো না এ দেহের মায়ায়। মাটির রঙে রাঙানো কাপড় সদাই সেকথা মনে করাতো।
কিন্তু কাপড়ের রাঙানোর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ বলে মনে হল একদিন। কনখলে আর রাজমহেন্দ্রীর মত জায়গায় এমন সব পাহাড় পাওয়া গেল যাদের রঙ লালচে গেরুয়া। তখন সেখান থেকে পাথর নিয়ে আসা হল। দুই খণ্ড বাদামী পাথর দুহাতে ধরে জলের মধ্যে ডুবিয়ে ক্রমাগত ঘষে ঘষে রঙ তৈরি হত। জলের সঙ্গে গুলে সেই আশ্চর্য রঙ তৈরি হলে, কাপড় বারবার ডুবিয়ে ডুবিয়ে নিংড়ে নিংড়ে থুপে থুপে রঙ করার প্রক্রিয়া চলতে লাগল। হাত ব্যথা, কোমর ব্যথা, শিরদাঁড়া ব্যথা হয়ে গেলেও গৈরিক কাপড় শুকিয়ে গেলে গায়ে পরবার সময় সন্ন্যাসীরা অনির্বচনীয় শান্তি ও স্থির ধ্রুব আনন্দের অধিকারী হতেন।
অনেকের মনে প্রশ্ন হতে পারে, কেন বাজার থেকে গেরুয়া থান কাপড় কিনে আনলেই তো হতো। তার থেকে জামা, কাপড় বানিয়ে নিলেই হল। এত কাণ্ডের দরকার কী? কিন্তু অমন রেডিমেড কাপড়ে এত বছরের ইতিহাস মাখা থাকত কি? মাটির সুঘ্রাণ, মাটি হয়ে যাবে সব একদিন, মনে পড়ত কি? দশনামী সাধুদের কাপড় অন্তত মাটিতে ছুপিয়েই পরার রীতি।
কালক্রমে কনখল কিংবা রাজমহেন্দ্রীর সেই গিরিশ্রেণী ধ্বংস হয়ে গেল। মাটির নীচে পাওয়া গেল কপারের মাইন। লাল পাথর চলে গেল, এল এক কেমিকাল। খুব সহজে জলে গুলে যায়। রঙ উজ্জ্বল, পাক্কা। এখন এই কেমিকালেই সাধুরা কাপড় রাঙান। একটা ইতিহাস হারিয়ে গেল।
এই রঙের মূল বৈশিষ্ট্য হল এই রঙ মনের ওপর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রভাব সৃষ্টি করে। ক্রমাগত গৈরিক রঙ ব্যবহার করলে আর কোনও রঙের পোশাক পড়তেই ইচ্ছা করবেনা। এই রঙ পরিধান করলে মনে শান্তি আসে, কালিমা দূর করে, ধীরে ধীরে আত্মচেতনা বৃদ্ধি পায়। মানব জীবনে গৈরিক রঙের প্রভাব সূদূর প্রসারী। গৈরিক রঙ অত্যন্ত শুভ রঙ। এই রঙ মনের কুসংস্কারকে দূর করে সংস্কারি করে তোলে চিত্তকে। ত্যাগের অন্যতম প্রতীক এই গেরুয়া রঙ। এই জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৈরিক রঙটি ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বা উপনয়নের মতো অনুষ্ঠানে এই বসন আবশ্যিক।
গেরুয়া রঙ 'ত্যাগ, সাহস, শক্তি এবং বীরত্বের ' প্রতীক।
একজন সন্ন্যাসী তার সমস্ত কামনা ত্যাগ করেছেন, তার লাভের কিছুই নেই। যেহেতু তার কিছু পাওয়ার আশা নেই, তাই কিছু হারানোর ভয়ও তার নেই। যেহেতু তার কোনো ভয় নেই, তাই তার সাহস ও মানসিক শক্তির কোনো অভাব নেই। এই কারণে সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরেন।
<< সংগৃহীত >>




শ্রী হরদাস চক্রবর্তীর এই লেখা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন ৸৸৸৸৸卐৸৸৸৸৸
ReplyDeleteখুব ভাল সঙ্গ্রহ। বর্তমান সময়ে অবিশ্যাসীর যুগে এই ধরনের বিজ্ঞান যুক্তিবাদী মতবাদের খুব প্রয়োজন। সকলের মনযোগ সহকারে পড়ে এর সারবত্তা গ্রহণ করা উচিৎ। তাতে নিজের সাথে সাথে সমাজ ও উপকৃত হবে। আবার বলি সঙ্গ্রহ খুব দৃষ্টান্ত মূলক। রইল ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
শ্রী কল্লোল বসু জানিয়েছেন >>>>>>>
ReplyDeleteখুব ভালো সংগ্রহ. পড়ে আনন্দ পেলাম.
শ্রী রণেন চক্রবর্তীর মতামত এই রকম ¤¤¤¤¤
ReplyDeleteOpurbo, gerua r somporke onek kichu jante parlam.
Khub bhalo laglo.
শ্রীমতি শোভা বিশ্বাস মন্তব্য করেছেন এই রকম ::
ReplyDeleteAjana totho lekha gulo pore khoob bhalo laaglo onek kichu jana gelo .