Saturday, 27 April 2024

ভগবান সাধনায় জপ ও দীক্ষা



(******** দীক্ষা********)

'' মানুষ গুরু দীক্ষা দেয় কানে , জগৎ গুরু দীক্ষা দেন প্রাণে ।

আপনারা খুব করে জ্ঞান অর্জন করুন । বিজ্ঞান , দর্শন , ইতিহাস আলোচনা করুন ।

মূর্খ থেকে কি লাভ ?

লোকের কথায় কেবল চালিত  হবেন , কোন কিছুতে নিষ্ঠা সহকারে লেগে থাকতে পারবেন না । তীক্ষ্ণ , তীক্ষ্ণতর বুদ্ধির নিকট ভয় পেয়ে যাবেন ।

একটু জ্ঞান লাভ হলেই বুঝতে পারবেন দেশকাল - ভেদে আপনাদের প্রাণ কি চায় । আপনাদের আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ টি কি , আপনার আদর্শই বা কি ।

শুধু হুজুগ করে দীক্ষা দীক্ষা করে মাতলে কি হবে ?

জমি প্রস্তুত হলে ভগবান আপনি ই দীক্ষা দেবেন । সে দীক্ষা লাভের জন্য হৃদয় কপাট খুলে সতত উন্মুখ হয়ে বসে থাকুন । সময় হলে কার মুখ দিয়ে কার হৃদয় থেকে প্রেরণা লাভ করবেন তা কে বলতে পারে ?

কোন পথ দিয়ে প্রভু কাকে তাঁর আঙ্গিনায় নিয়ে যাবেন কে বলতে পারে ?

কিন্তু মনে প্রাণে সত্যি কারের দীক্ষা পেলে তা অমনি বুঝতে পারবেন ।

বাহ্য আনুষ্ঠানিক দীক্ষা র একটা সংক্রামক শক্তি আছে । একজন দীক্ষা র আগ্রহ প্রকাশ করলে তা বহুর মধ্যে সংক্রামিত হয় ; কিন্তু কিছুদিন পরে ঐ আগ্রহ কেটে যায় । তখন সে লোক যে সেই । তাতে বরং অনিষ্ট হয় ।

হুজুক কেটে গেলে জ্ঞান - মার্জিত বিচার - বুদ্ধি নিয়ে গুরুকে পরীক্ষা করে স্থির শান্ত চিত্তে , বজ্র দৃঢ় সংকল্প নিয়ে দীক্ষা গ্রহণ করতে হয় । ''

 দীক্ষা শব্দের বর্ণদুটির প্রথমটি দান-বাচক, কিন্তু দ্বিতীয়টি 'ক্ষয়-বাচক'।

দ-> দান

ক্ষ-> ক্ষয় বা ধ্বংস।

অর্থাৎ দীক্ষা হ'ল সেই প্রক্রিয়া, যার দ্বারা দীক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে গুরু আধ্যাত্মিক শক্তি ও জ্ঞান *দান* করেন, যা শিষ্যের অজ্ঞান ও বন্ধনকে *ক্ষয়* বা ধ্বংস করে।

আর একটি অর্থে দীক্ষা মূল ক্রিয়াপদ 'দীক্ষ' থেকে উদ্ভূত,  যার অর্থ 'বৃদ্ধি করা', 'উন্নত করা' কিংবা পবিত্র করা। এই অর্থে দীক্ষা হ'ল 'পবিত্রকরণ', যা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়।

সুতরাং দীক্ষা একমাত্র তাঁর কাছ থেকেই নেওয়া যেতে পারে যাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি দানের যোগ্যতা আছে। 

গুরু এইরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন না হ'লে কিন্তু দীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে মন্ত্রে কোনও কাজ হয় না। 

_দীক্ষাপ্রসঙ্গে_ 🌼🌼🌼

*দীয়তে (দেওয়া) এবং ক্ষীয়তে (ক্ষয় পাওয়া) এই দুটি শব্দ সমন্বয়ে 'দীক্ষা' শব্দটির ব্যুৎপত্তি। আলো দেওয়া এবং অন্ধকার ক্ষয় —এই হল সকল দীক্ষাকর্মের মূল ভাবনা।* 

*কুলার্ণবতন্ত্রে বলা হয়েছে—*

*'দীয়তে বিমলং জ্ঞানং*

*ক্ষীয়তে কর্মবাসনা'*

*—অর্থাৎ দীক্ষা হল তাই যাতে বিমল জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে ও জীবের কর্মবাসনা নিঃশেষে ক্ষয় পায়।*

*দীক্ষা মানে 'দয়াপূর্বক ঈক্ষণ'— পরমেশ্বরের অর্থাৎ সদ্গুরুর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টিপাতের নাম দীক্ষা।*

*একটি সুনিদ্দিষ্ট জীবনাদর্শের নিকটে নিজেকে নিঃশেষে নিবেদনের জন্য সঙ্কল্প গ্রহণের নাম দীক্ষা। সেই আদর্শটি কোনও দেবতা, মন্ত্র, মূর্তি, প্রতীক, ভাব, ব্যক্তি বা মতবাদকে অবলম্বন করে প্রকটিত হতে পারে।* 

*যিনি যে মত বা পথেই দীক্ষিত হয়ে থাকুন না কেন, কোন একটা উচ্চ লক্ষ্য বা আদর্শ সামনে না থাকলে তা যথার্থ দীক্ষা হয় না।*

*জন্ম, মৃত্যু, বিবাহের মতনই দীক্ষা মানুষের জীবনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অথবা বলা চলে জন্ম, মৃত্যু বিবাহের চেয়েও তা গুরুত্বপূর্ণ কারণ জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ জড় জীবজগতকে নিয়েই কারবার করে। দীক্ষার মধ্য দিয়ে জড় ছাড়িয়ে আমি চৈতন্যের অভিসারী হই অথবা জড়ের মধ্যে চৈতন্যকে খুঁজে পাই।...* 

*দীক্ষা শুধু নবজন্ম নয়, জন্ম-জন্মান্তরের মধ্যে এক ভিন্নতর জন্মের নিশানা।*

*দীক্ষাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক বিবাহ -জীবের সঙ্গে পরমেশ্বরের মিলন। গুরু হলেন সেই বিবাহের ঘটক। লৌকিক বিবাহে যেমন দুটি দেহ মন ও প্রাণ একত্রে মিলিত হয়, দীক্ষারূপ বিবাহে জীবাত্মা তেমনি পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার উদ্যোগ নেয়। দীক্ষার মধ্য দিয়ে ঘটে সেই দিব্য মিলনের সূচনা।* 

*ঋগ্বেদের কাল থেকে বর্তমানের মহাকাশ যুগ পর্যন্ত দীক্ষার উপযোগিতা সমভাবে বিদ্যমান।*

*দীক্ষা হল সাধারণ অর্থে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের অন্তরস্থ আত্মিক সাম্রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে। সাংসারিক জীবের আত্মিক ব্যাপারে আলোর জন্য তাগিদ অনুভব করাই হল দীক্ষার যথার্থ মূল প্রেরণা।*

><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><

○●○●○●○●সাধনা○●○●○●○●

আমরা ভগবানের নাম করব, কত হাজার জপ করব...এটি বড় কথা নয়।

কেউ হয়ত নিরামিষ খায়, কেউ হয়ত এক বস্ত্রে থেকে ভগবানের জন্য তপস্যা করে ।

সেসব কিন্তু কিছুই নয়,যদি না সেগুলিতে আন্তরিকতা থাকে।

আসল কথা হচ্ছে,আমাদের সমস্ত অন্তর দিয়ে ভগবানকে ভালোবাসতে পারছি কি না তা দেখতে হবে...

যে ভালোবাসায় সংসারের অন্য সমস্ত আকর্ষণ তুচ্ছ হয়ে যাবে। এই কথাটি মনে রাখতে হবে।

ভাগবতে বলেছে....

তাঁর প্রতি যে অনুরাগ তা জগতের অন্যসব অনুরাগকে ভুলিয়ে দেয়। সুতরাং তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা কতখানি হলো...এই বিচার করে আমাদের সাধন পথে হাঁটতে হবে।

আমরা তাঁর নামে মুহুর্মুহু মূর্ছা গেলেও কিছু হবে না বা আমাদের সমস্ত জীবনটা বসে বসে ধ্যান করলেও হবে না, বছরের পর বছর লক্ষ লক্ষ জপ করলেও হবে না। তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেও হবে না।

হবে তখন, যখন দেখব তিনি আমাদের অন্তরকে সর্বদা পরিপূর্ন করে রয়েছেন। তিনি ভিন্ন আর কোনো চিন্তা বা বস্তু বা ব্যক্তির সেখানে স্থান নেই।

আমাদের অন্তরের পূর্ন অনুরাগ তাঁকে দিতে হবে। তাঁর চরণে নিজেদের পরিপূর্ন ভাবে সমর্পণ করতে হবে।

....... এটিই সাধনার সার কথা ।

♤♧♤♧♤♧♤♧♤♧♤♧♤♧♤♧♤

*꧁জপ꧂*

পবিত্র ঈশ্বরীয় নাম অথবা শক্তিশালী ইষ্টমন্ত্রের পুনঃ পুনঃ উচ্চারণই 'জপ'।

অরণি কাঠ বারবার ঘর্ষণ করতে করতে যেমন তা থেকে আগুন বার হয়, ঠিক তেমনই গোপন ইষ্টমন্ত্র সঠিক উচ্চারণে জপ করতে করতে তা থেকে শক্তি নির্গত হয়ে সাধককে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের দিকে নিয়ে যায়। তখন স্তরে স্তরে মন উপরে উঠতে থাকে।

জপের সময় মুখ বন্ধ এবং জিভ স্তব্ধ থাকা উচিৎ। অর্থাৎ জপ হবে মনে মনে। 

মন অন্যদিকে নিযুক্ত রেখেও মুখে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা সহজ। কিন্তু মনকে জপের দিকে নিযুক্ত না রেখে মানসিক জপ প্রায় অসম্ভব, তাই নীরব মানসজপই শ্রেষ্ঠ। 

মনকে অন্য সকল চিন্তা থেকে মুক্ত করে সর্ব প্রকারে ঈশ্বরমুখী করাই সাধনার উদ্দেশ্য। 

মনের চিন্তা দুই প্রকার : শ্রবণধর্মী এবং দর্শনধর্মী।

অর্থাৎ আমরা কোনও শব্দ চিন্তা করতে পারি অথবা দৃশ্য চিন্তা করতে পারি। 

এই দুইপ্রকার চিন্তনকে ঈশ্বরমুখী করতে গেলে অন্তরে ইষ্টের রূপ (দৃশ্য ) চিন্তন এবং তাঁর ভাব-প্রতিপাদক মন্ত্র (শব্দ) চিন্তন করতে হয়। তাহলে মনে আর অন্য চিন্তা আসেনা।

আর তা না হলে মুখে নাম করে যাচ্ছি কিন্তু মন তার অভ্যাসবশতঃ জাগতিক চিন্তা করে যাচ্ছে তাতে কী লাভ?  

মুখে একটি শব্দ উচ্চারণ করা সহজ, কিন্তু দৈহিক কম্পন বন্ধ করে শুধু মানস জপ করতে গিয়ে দেখা যায় সেটা কত কঠিন! আর কঠিন বলেই সেটা অধিকতর ফল প্রদানকারী।

স্বামী বিবেকানন্দ রাজযোগের আলোচনায় বলছেন,

_‘‘...মন্ত্র জপ করিবার তিন প্রকার নিয়ম আছে — 'বাচিক', 'উপাংশ' ও 'মানস'।_

_বাচিক জপ সর্বনিম্নে এবং মানস জপ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।...’’_

মন্ত্র জপের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের অর্থ অর্থাৎ মন্ত্রের ভাবটি চিন্তা করতে হয়। মহর্ষি পতঞ্জলি শেখাচ্ছেন, _'তজ্জপস্তদর্থ- ভাবনম্';_

— অর্থাৎ জপের সঙ্গে সঙ্গে জপমন্ত্রের অর্থ ভাবার কথা বলা হয়েছে। 

এখানে 'মন্ত্র' বলতে ঈশ্বরীয় নাম এবং তার অর্থ বলতে নামের প্রতিপাদ্য ভাবের কথা বলা হচ্ছে। 

এই ভাব-চিন্তন থেকেই বিক্ষেপহীন ভাবময় স্থিতি বা ধ্যান আসে। এভাবেই জপ থেকে ক্রমে ধ্যানে উন্নীত হতে হয়।

যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণ-নাম জপ করছেন, তাঁরা জপের সাথে সাথে সেই নামের অর্থ বা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ চিন্তন করেন। 

কিন্তু ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের প্রকৃত রূপ আমাদের বুদ্ধির অগম্য। তাঁর অনন্ত ভাব আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা তাই নিজেদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব শুধু ততটুকুই তাঁকে চিন্তা করতে পারি। 

স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, 

_‘‘এই অদ্ভুত রামকৃষ্ণ-চরিত্র তোমার ক্ষুদ্র বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে যতদূর সাধ্য আলোচনা  কর, অধ্যয়ন কর। আমি তো তাঁর লক্ষাংশের একাংশও এখনও বুঝতে পারিনি। ও যত বুঝবার চেষ্টা করবে, ততই সুখ পাবে, ততই মজবে।’’

কথামৃতে আছে — শ্রীমতি রাধিকা যত কুঞ্জবনের দিকে এগোচ্ছেন তত কৃষ্ণ-গন্ধ নাকে আসছে।

 — এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হল : আমরা যত পবিত্র হব, যত তাঁর দিকে এগোতে থাকব, ততই তাঁর স্বরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে। 

জপের পথে আমরা ভাবময় ইষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে যাই।

<><><><><><><><><><><><><><><><><><><><>

(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)(*)


&&&&&&&&&&&প্রনাম &&&&&&&&&&&&


সাধারণত আমরা মন্দিরে প্রবেশ করেই শ্রীরামকৃষ্ণের পট বা বিগ্রহের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ বা সাষ্টাঙ্গ হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রনাম পর্ব শেষ করে ফেলি। কিন্তু প্রনামের এক আদর্শ পদ্ধতি আছে । এ প্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর সেবক ও সচিব এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সপ্তম প্রেসিডেন্ট স্বামী শঙ্করানন্দ একবার বলেছিলেনঃ মন্দিরে ঠাকুরকে কি ভাবে প্রনাম করতে হয় জানো? কখনও মন্দিরে গিয়ে ঢিপ করে প্রনাম করবে না। আগে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ঠাকুরকে কিছুক্ষণ দেখবে। ভাববে, ঠাকুর জীবন্ত, তোমায় দেখছেন। এইভাবে মন স্থির হলে তখন প্রনাম করবে এবং ভাববে ঠাকুরকে পা জড়িয়ে ধরে প্রনাম করছো।

                                                   

No comments:

Post a Comment