Saturday, 19 October 2024

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দূর্গাপূজো

 

ঐতিহ্য রক্ষায় তরবারি পুজো......

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি দূর্গাপূজোয় 

পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা শহর থেকে আট কি. মি. পূর্বে শিলাবতী অববাহিকায় সবুজ গাছপালায় ভরা মঙ্গলাপোতা গ্রাম। এখানেই রয়েছে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে এই রাজবাড়ি একদা ছিল রাজাদের আমোদ প্রোমদের  বাগানবাড়ি। এটি নির্মাণ করেছিলেন বগড়ীর রাজা ছত্র সিংহ এবং শোনা যায় যে তিনিই  র্প্রচলন করেছিলেন দূর্গাপূজোর। তৎকালীন বগড়ী পরগনার শেষ স্বাধীন রাজা তিনি ছিলেন। প্রায় ৪০০ বছর আগে সেই দূর্গাপূজো আজও চলে আসছে মঙ্গলপোতা রাজবাড়ির  দূর্গাপূজো নামে।  আবার এও শোনা যায় যে এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন গজপতি সিংহ৷ তবে এই বংশের নবম রাজার  নামও ছিল গজপতি সিংহ। ইনিও মঙ্গলপোতাতে দেবী দুর্গার আরোধনা আরম্ভ করতে পারেন। ইতিহাস বলে বা আঞ্চলিক অধিবাসীদের  বিশ্বাস এখানে যে ঘটটি আছে,  সেই ঘটটি  বাস্তবে গড়বেতার মা সর্বমঙ্গলার ঘট। ছত্র সিংহ ঘটটি জোর করে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেটা আর ফেরত দিয়েছিলেন না। আর সেই দেবী সর্বমঙ্গল ঘট এখানে পুঁতে তিনি দূর্গাপূজোর প্রচলন করেছিলেন। ঘট পোতা হয়েছিল বলে এই জায়গার নাম মঙ্গলপোতা। এও জানা যায় যে বিষ্ণুপুরের রাজা মল্লরাজ খয়েরমল্ল  দেবী সর্বমঙ্গলার এই ঘট একবার নিয়ে যান। সামসের জং বাহাদুর, রাজা ছত্র সিংহের পাশে দাড়িয়ে যুদ্ধে খয়েরমল্লকে পরাজিত করে এই ঘট আবার উদ্ধার করে আনেন। 






পূজোর ১৫ দিন আগে দেবীর ঘট স্থাপন করা হয়। আগে পূজার মন্ডপ  ছিল মাটির। ছাউনি ছিল টালির ও টিনের। কাঠের ছিল দরজা। এখন স্থায়ী মন্ডপ হয়েছে। রয়েছে পূর্বকার পঞ্চমুন্ডির আসন। বারান্দায় রয়েছে ৬টি প্রকান্ড থাম। আর ভিতরে একই রকম চারটি থাম। মণ্ডপে ভিতরে বাঁদিকে রয়েছে এক উই এর ঢিপি। শোনা যায় যে ষষ্ঠী থেকে নবমীর ভিতর যে কোনো দিন এক সাপ সেই ঢিপি থেকে বেড়িয়ে দেবীর কাছে এসে ঘোরা ফেরা করে। পরে আবার নিজে থেকে সেই ঢিপির ভিতর ঢুকে যায়। এই পূজোর বৈশিষ্ট্য হল প্রচীন রীতি মেনে  দূর্গাপূজোর ঐতিহ্য বজায়  রাখা। এই পুজোতে ৪টি তরবারি পুজো করা হয়। রাজাদের বীরত্বের প্রতীক হিসেবে তরবারীগুলোকে পুজো করা হয় দেবীর সামনে রেখে।  জিতাষ্টমীর দিন প্রথম তরবারী, দ্বিতীয় তলবারি পূজো হয় মহালোয়ার দিন, তৃতীয় তরবারি পুজো ষষ্ঠীর দিন, আর সপ্তমীর দিন পূজো করা হয় সবচেয়ে বড় চতুর্থ তলবারিটি। তৎকালীন উড়িষ্যার বীরযোদ্ধা সামসের জং বহাদুর ছিলেন মা কালীর এক পরম সাধক এবং সাধনাবলে তিনি এই তরবারি পেয়েছিলেন। বিশ্বাস  তরবারি মন্ত্রপূত ছিল। এই তরবারি দিয়ে তিনি বিষ্ণুপুরের রাজা খয়েরমল্লকে যুদ্ধে পরাজিত করে মা সর্বমঙ্গলার আসল  ঘট উদ্ধার করেন। অন্য তিনটি  তরবারি কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউ-এর মন্দিরে রাখা আছে। রাধাকৃষ্ণ, নারায়ন, সর্বমঙ্গলা ও দূর্গা ছাড়াও  এই তরবারিগুলি রোজদিন পুজো করা হয়। দূর্গাপূজোর সময় এই সব তরবাড়ি মূল মন্ডপে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের ও অন্য ভক্তদের দৃঢ় বিশ্বাস যে বড়ো তরবারিটি কালী মা। প্রতি দূর্গার সপ্তমীর দিন ও কালীপুজোর দিন দুমিটার করে চার মিটার লাল শালু কাপড় দিয়ে তরবারিটি জড়ানো হয়। পুরোনো লাল শালু কাপড়টি ফেলে দেওয়া হয় না। তার উপর এই লাল শালু কাপড় জড়ানো হয়। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল যে এটি মোটা হয়ে যাওয়ার কথা কিন্ত মোটা হয় না, একই রকম আছে।





ষষ্ঠীর দিন হোম থেকে, যাগযঞ্জ এবং চন্ডীপাঠ শুরু হয়। যঞ্জকুন্ডে অবিরাম ২৪ ঘন্টা এই কয়দিনে কাঠ জ্বলতে থাকে। কিন্ত অবাক লাগে যে প্রাচীন কালের সেই দূর্গাপূজোর শুরু থেকে সেখান থেকে যঞ্জের কাঠ পুড়ে ছাই হলেও কোনদিন ছাই পরিস্কার করা হয়নি অথচ গর্তটি ছাই-এ ভর্তিও  হয়নি। প্রতি বছর নতুন করে দেবী বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এখানে এক চালায় দেবীর পূজো হয়। প্রাচীন কালে এখানে নরবলি হত। যাকে বলি দেওয়া হতো সে কোথা থেকে আসতো বা কিভাবে দেবীর পিছনে এসে বসে থাকতো তা কেউ জানতে পারতো না।  এখন আর সে সব নেই। এখনও সপ্তমী ও সন্ধি পুজোতে ছাগ বলি হয়। কিছু বছর আগে পর্যন্ত মোষ বলি হত। এখন আর মোষ বলি দেওয়া হয় না। কেননা মোষ বলির পর, তার মাংস আদিবাসীরা এসে প্রসাদ হিসেবে নিয়ে যেত। এখন তারা আর আসে না, আর তার জন্য মোষ বলিও বন্ধ গেছে। 




এই পূজোয় নিয়মবিধি মেনে সবকিছু অনুষ্ঠান করাটা মুখ্য।  সুপ্রাচীন কালে যে নিয়ম ছিল তা আজও মেনে চলা হচ্ছে। দূর্গাপূজোয় এখানকার ঘট স্থাপনের সময় যে তোপধ্বনি হয়, সেই ধ্বনি শুনে গড়বেতাতে দেবী সর্বমঙ্গলার পূজো আরম্ভ হয়।  আবার গড়বেতার মা সর্বমঙ্গলার  পূজোর তোপধ্বনি শুনে গোয়ালতোড়ে দেবী সনকা মায়ের পূজো আরম্ভ হয়ে থাকে।  প্রায় ৪০০ বছর ধরে ঐতিহ্যের এই পরম্পরা রক্ষা হয়ে চলেছে।  একটি বারের জন্য তা লঙ্ঘন হয়নি।





১৯৮০ সালে এই রাজবাড়ির অদূরেই জঙ্গল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল যশোবন্ত সিংহের নাম খোদাই করা তিনটি কমান । দুইটি ব্রোঞ্জের ও একটি লোহার।  এগুলিকে কলকাতার প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির সেই বনেদিয়ানা আজ আর নেই। নেই সেই আভিজাত্য।  সেইসঙ্গে হারিয়েছে দূর্গাপূজোর জৌলুস।  ভগ্নপ্রায় অবস্থা রাজবাড়ির।  পলেস্তরা খসে পড়েছে।  রয়েছে চূনসুড়কির গাঁথা মোটা মোটা দওয়াল ওয়ালা দালান কোঠা।  বহু দূর দূর থেকে একসময় মানুষ আসত এই পূজো দেখতে ও আনন্দ করতে।  পূজা মন্ডপ বা ঐ রাজবাড়ি এলাকা গম্ গম্  করতো।  চলত যাত্রা , থিয়েটার, নাটক।  বসতো বাউল গান বা কীর্তনের আসর। এখন ঐ রাজবাড়ি এলাকায় এক ছোট্ট মেলা বসে। এখন রাজবাড়ির বংশধর হিসেবে রয়েছেন শ্রী অরবিন্দ সিংহ এবং তার ভাইয়েরা।  তারাই পূজো করেন।  আর্থিক সংকটের জন্যই পূজো নিষ্প্রভ হয়ে পরেছে। তবে গ্রামের বা আশেপাশের মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।  এই ভাবেই মঙ্গলাপোতার এই সুপ্রাচীন গৌরবময় দূর্গাপূজো নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও টিকে রয়েছে। 



খুব সহজেই এখানে আসা যায়।  ট্রেনে বা বাসে বা গাড়ীতে এখানে আসতে পারেন।  ট্রেনে আসতে হলে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস বা অরন্যক এক্সপ্রেসে এসে নামতে হবে গড়বেতা স্টেশনে। আর আছে প্রচুর বাস কলকাতা বা হাওড়া থেকে গড়বেতা আসার জন্য।  গড়বেতা থেকে অটো বা যে কোনো গাড়ী ভারা নিয়ে আসা যেতে পারে মঙ্গলাপোতা গ্রামে। গাড়ী নিয়ে এলে আরামবাগ--গড়বেতা--ধাদিকা মোড় হয়ে সহজেই পৌঁছানো যায় মঙ্গলাপোতায়।  যদি কেউ রাত্রে থাকতে চান তবে গড়বেতায় ছোটোখাটো লজ আছে। এছাড়া চন্দ্রকোনা রোডে ভালো থাকার জায়গা আছে।


2 comments:

  1. Comment of Sri Ranen Chakraborty:

    Ei itihas amar o ojana. Garhbeta r prosonge ami ektu besi nostalgic karon khub choto boyos theke Garhbeta amader kache ek anonder jaiga,karon amader Mamabari. Onek lok jon ,sob samoy gomgom korto, ar amder saishober onek smriti.Age Garhbeta te Ma Sarbomongola chara onyo kono Dev/devir pujo hotona, ekhon oboshyo hoi. Mongolapota Rajbari r ei kahini amar ojana, ami sombridhyo holum.

    ReplyDelete
  2. Snehasish dar post kora Mongalpota Rajbarir Durga Puja pore khub bhalo laglo.Itihash r myth niye lekhati onoboddo.Porei mone hochhe akbar ghure ashi.Ei rokom aro lekha pawar opekkhai roilam.

    ReplyDelete