বলাগড় পাটুলির দ্বিভূজা দুর্গার বৌদ্ধতন্ত্রাচারে পূজো
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হলো দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রধান হিন্দু উৎসব। দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব, যার মধ্যে শেষ পাঁচটি দিন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। আশ্বিনের নবরাত্রির পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের নবরাত্রির পূজা বাসন্তিক বা বসন্তকালীন দূর্গাপূজা নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গোৎসব মূলত: কালিকা পুরাণ বর্নিত পদ্ধতি নির্ভর। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন । তাই এই সময়টি তাদের পূজোর যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজো বলে এই পূজোর নাম হয় " অকালবোধন "। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো উল্লেখ করেননি। কৃত্তিবাস রামায়ণ অনুসারে , রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। মা পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দিলেন পার্বতীকে পূজা করে তাকে তুষ্ট করতে । তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজ হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, সন্ধিপূজা ও মহানবমীর ও দশমীর পূজো করেন। দেবী পার্বতী রামের পূজোয় সন্তুষ্ট হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। সেই থেকেই শরৎকালে দুর্গোৎসব হয়ে আসছে।
পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলোতেই আয়োজিত হয়। এই ধনী পরিবারগুলোর দুর্গাপূজা " বোনেদি বাড়ির পূজা " নামে পরিচিত। এই পূজোগুলিতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা " বারোয়ারি " পূজা নামে পরিচিত।
আঞ্চলিক ভেদে প্রাচীন বোনেদি এই সব পূজোগুলিতে দেখাযায় দেবীর রূপবৈচিত্র, ব্যতিক্রমী আচার ও পুজোপদ্ধতি। হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের পাটুলিতে এমনই এক ব্যতিক্রমী দুর্গাপুজো হয়ে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। পাটুলির মঠবাড়ির সেই দ্বিভুজা দুর্গার প্রচলিত নাম মঠের মা।
অতীতে গ্রামে কংসাবতী নামের এক নদী বয়ে যেত।গ্রামে কুয়ো, পুকুর এমনকী বাড়ির ভিত খুঁড়তে গিয়েও নৌকার ভাঙা অংশ, হাল, পাটাতন পাওয়া গিয়েছে। বৌদ্ধ যুগে এটি ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান।এখানে ছিল একটি প্রাচীন বৌদ্ধমঠ,যার ধ্বংসাবশেষএলাকার প্রবীণরা দেখেছেন।
পাটুলির মঠবাড়ির পুজো নিয়ে শোনা যায় একাধিক কাহিনি।অতীতে পাটলিপুত্র ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। বৌদ্ধশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে এই গ্রামে গড়ে উঠেছিল একটি বৌদ্ধমঠ। পরবর্তী কালে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের ফলে বহু বৌদ্ধতান্ত্রিক দেব-দেবী হিন্দু লৌকিক দেব-দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত এই মঠবাড়িটি যে বৌদ্ধতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের সাধনস্থল ছিল,তাঁদেরআরাধ্য বৌদ্ধ দেবীপরবর্তী কালে দেবী দুর্গার সঙ্গে মিশে যান।তাইদুর্গাপুজোর পদ্ধতির মধ্যে বেশ কিছু তান্ত্রিক প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে মঠবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৌদ্ধতান্ত্রিক। আজও মঠবাড়ির পুজোয় দেখা যায় বৌদ্ধতন্ত্রাচারের বিবর্তিত রূপ।
জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজোর মধ্য দিয়েই প্রতিমা তৈরি শুরু হয়। আজও বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পরা মূর্তি নির্মাণ করনে। দেবীর সামনের দুটি হাত শুধু দেখা যায়। বাকি আটটি হাত ,যা আঙুলের মতন , চুলে ঢাকা থাকে। দেবীর গায়ের রং শিউলি ফুলের বোটার মতন। ডাকের সাজে সজ্জিত প্রতিমার চোখ বাঁশপাতার মতো। দেবীর ডান দিকে কার্তিক, আর বাঁ দিকে গণেশ। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ। তবে গায়ের রং সাদা। এই পূজোয় সন্ধিপূজো হয় না। হয় অর্ধরাত্রি পূজো। সপ্তম ও অষ্টমী সন্ধিক্ষণে এই পূজো হয়। অতীতে দেবীর উদ্দেশ্যে অর্ধরাত্রি পূজোতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। বলির মানুষটি নাকি সেচ্ছায় আসতেন। ইংরেজ আমলে এই প্রথা নিষিদ্ধ হয়। পরে পাঁঠা বলি হত। বলির পর সেই পাঁঠার ছাল ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো মাংসের সাথে মাসকলাই ও দূর্বা দিয়ে চৌষট্টি যোগিনীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হত। এখন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি নর মূর্তি বলি দেওয়া হয়। বলির পর তা একই উপায়ে নিবেদন করা হয়।অতীতে তালপাতার পুঁথি দেখে পূজো হত। সেটি আংশিক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা থেকে পুনরুদ্ধার করে এখন পূজো করা হয় এবং আসল তালপাতার পুথিটি সিন্দুকে রক্ষিত আছে।
সেই সময় এই অঞ্চল জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। আবার এ পরিবার এক আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাতো। এর মধ্যে দেবীর স্বপ্নাদেশ হল , যা কিছু সহজলভ্য তা দিয়েই ভোগ নিবেদন করতে। তখন থেকেই সাদা ভাত, নানারকম সব্জি ভাজা, মোচা, থোড়, কচুশাক, চালতার টক ইত্যাদিসহ ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিবছর দশমীর বিকেলে দেবীবরনের পর ২০ থেকে ২৫ জন বেয়ারা প্রতিমাকে নিয়ে ৩ কি মি দূরে গঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বেয়ারাও বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। যাত্রা পথে বিভিন্ন যায়গায় প্রতিমাকে নামানো হয় এবং স্থানীয় বৌ -রা সিঁদুর আলতা দেন। প্রথানুযায়ী গঙ্গার ঘাটে মঠের মা-র বিসর্জন প্রথম হয় এবং পরে অন্য সব ঠাকুর বিসর্জন হয়। আজও নৌকা করে মাঝগঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জনের সাবেক রীতি বজায় আছে।
এখানে আসতে হলে ব্যান্ডেল কটোয়া লাইনের ট্রেনে করে জিরাট ষ্টেশনে নামতে হবে। ব্যান্ডেল স্টেশনের পর জিরাট ষষ্ঠ স্টেশন। সেখান থেকে অটো বা টোটোতে করে মঠ বাড়ির কথা বললে যে কেউ নিয়ে আসবে। সড়কপথে এলে ব্যান্ডেল এর পর দিল্লীর রোড হয়ে মগড়া ফ্লাই ওভার পেড়িয়ে স্টেট হাইওয়ে ৬ ধরে জিরাট স্টেশনের দিকে আসতে হবে। জিরাট বাজারে জিঞ্জাসা করে সহজেই আপনি মঠ বাড়িতে আসতে পারেন। ব্যান্ডেল থেকে দূরত্ব ২৪ কি মি। গাড়িতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতন।
বোনেদি বাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি, ইতিহাস আর পরম্পরা। এখন হয়তো আগের মত সেই চোখ-ধাঁধানো জৌলুস নেই, ঠিকই। কিন্তু এই সব বাড়িতে পুজো হয় অতীতের পরম্পরা মেনে, নিষ্ঠা সহকারে। বাড়ির বেশির ভাগ সভ্য-সভ্যারা কলকাতার অন্যত্র, বাংলার বাইরে এমন কি বিদেশেও থাকেন। তাঁরা পুজো উপলক্ষ্যে এক সঙ্গে মিলিত হন। এই সব বাড়ির সাবেকি পুজোতে উপস্থিত হলে আপনি হয়তো পৌঁছে যাবেন সুদূর অতীতে।
শ্রী হরদাস চক্রবর্তী বলেছেন :-:
ReplyDeleteএই হল বিবরণ। না গিয়েও মনে হবে আমিই দেখে এসেছি। ছবি যেন লেখার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। যেমন লেখা তেমন ছবি। খুবই সুন্দর। চলুক লেখনী ছবির মত। গেথে যাক সবার মনে।
শ্রীমতী সন্ধ্যা বোসের মতামত এই রকম ~~~
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো আপনার এই লেখাটা।অনেক কিছু জানতে পারলাম।আমার কাছে তো একটা দুর্লভ লেখনী মনে হলো পরিবেশনের জন্য ধন্যবাদ জানাই ও সঙ্গে শুভ বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
Mr Amit Bhattacharya has expressed his comment in this manner ::
ReplyDeleteExcellent narratives thank you 😊 🙏
শ্রী অমিত চক্রবর্তী ( জয় ) বলেছেন::
ReplyDeleteTomar ei blogging er picture r description darun.khub bhalo laglo lekhata.