১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লোকের কাছে আদরের নাম " জয় বাংলা "। এ ছিল ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়ারই ঘটনা। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল এক নবীন জাতিরাষ্ট্রের আত্ম প্রতিষ্ঠার এক কঠিন সংগ্রাম। আর উপলবন্ধুর পথে দীর্ঘকাল সংগ্রামের পর জন্ম হ'ল আকাঙ্খিত নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
সে এক গভীর আবেগ, যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল রাগ, ক্ষোভ, উত্তেজনা, আশা, স্বপ্ন আর এক অদ্ভুত বুকফাটা গর্ব। তাইতো নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে আর কোনও দিন বাঙালি জাতি ঠিক ওই ভাবে উল্লাস করতে পারবে কে ?? এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে যাঁরা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির ক্রমবিকাশ, বিবর্তন ও বাংলাদেশের জন্মের অধ্যায় নিজের চোখে দেখেছেন , তাদের অনুভূতি , আর যারা পরবর্তী কালে ওই সব গল্পের কথা পড়েছেন বা শুনেছেন, তাঁদের অনুভূতি কখনোই এক হতে পারে না।


আমরা যারা প্রত্যক্ষদর্শী, তারা দেখেছি ওপারের বঙ্গভাষীরা কিন্ত প্রথম থেকেই তাদের মতামত আর আপত্তি একেবারে পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছিলেন। পাকিস্তানের উদ্ধত প্রেসিডেন্ট জিন্না ২১শে মার্চ ১৯৪৮ এ ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তানের সঙখ্যাগরিষ্ট বাঙালিদের যথেষ্ট হুমকির সুরে শাসিয়ে গেলেন যে উর্দুকে তাদের জাতীয় ভাষা হিসেবে মানতেই হবে। কিন্তু এমন গর্জন সত্ত্বেও তিনি তাদের ঘাবরাতে পারেননি। তার হুমকির উপযুক্ত জবাব দিলেন ভাষা আন্দোলনের চার শহীদ ----- আব্দুস সালাম, রফিকুন্দিন আহমেদ, আবুল বরকত আর আব্দুল জব্বার। রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে স্বীকৃতি পেল ও অমরত্ব লাভ
 |
| কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার |
করল।এর জের টেনে প্রায় দুই শতক লড়াই চালালেন ও-পার বাঙলার মানুষ। অবশেষে তাদের অপরিসীম ত্যাগ ও বীরত্বেরই জিতে হল। কয়েক লাখ শহীদের প্রানের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেল এক স্বাধীন দেশ।
 |
| আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করছেন দুই সেনা প্রধান |
 |
| দলিলের বয়ান |
সব থেকে বড় কথা, মাতৃভাষা নিয়ে এমন সঙগ্রামের ইতিহাস বিশ্বের ক'টা দেশেরই বা আছে। সারা বিশ্ব দেখলো ভাষার অপরিসীম শক্তি, যা ধর্ম, শ্রেণী ও জাতির ভেদাভেদ কে তুচ্ছ বলে প্রমাণ করল না, কয়েক লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করল তাদের জীবন বলিদান দিতে। শেখ মুজিবর রহমানের মহান ব্যক্তিত্ব তখন কেবল আকাশছোঁয়াই নয়, তাঁকে একটি বিশাল জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে গন্য করা হল।

দখীণ এশিয়া উপমহাদেশে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের আখ্যান মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। মুজিবুরের আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোটামুটি অহিংস আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সামরিক আইন কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এই দেখে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে দেয় " অপারেশন সার্চ লাইট"। আওয়ামী সমর্থক নির্বিশেষে সন্দেহভাজনদের বাড়ি বাড়ি চর্চাও হয়ে পুরুষদের গণহত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ ও হত্যা। মুজিবকে গ্রেপ্তার করে সেনারা নিয়ে যায় পাকিস্তানে। ও দিকে পূর্ব পাকিস্তানে এই হত্যা লীলা চলতে থাকে নয় মাস। সেই সঙ্গে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক সশস্ত্র প্রতিরোধ, যা মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত।
 |
| মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গবদ্ধ প্রতিরোধ :: সন ১৯৭১ |
ও দিকে কোটিরও অধিক নিরাশ্রয় ও বিপন্ন মানুষ তখন ভারত পেড়িয়ে ভারতে শরণার্থী। তাই পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীন গন্ডগোলে ভারতের জড়িয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৪ দিনের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ আরম্ভ হল, যার পরিণতি ৯৩০০০ সেনা সমেত ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে সেনা প্রধান এ এ কে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ। এর পর মুজিবের মুক্তি, এবং ১৯৭২ সালে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন।

শরনার্থী ব্যায়ভার সামলাতে তখন ডাকটিকিট , সিনেমার টিকিট, রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সারচার্জ বসালেন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। আজকের অরবিন্দ ভবন অর্থাৎ ৮ নং থিয়েটার রোডের বাড়িটি উঠলো যুদ্ধধ্বস্ত প্রবাসী সরকারের ( মুজিবনগর ) অস্থায়ী শিবির। শেখ মুজিবর রহমান তখন করাচির জেলে বন্দী। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ থাকেন, অফিস করেন থিয়েটার রোডের বাড়িতে। থিয়েটার রোডের বাড়ি থেকেই অস্থায়ী সরকারের সেনাপতি কর্নেল ওসমানী, চিফ অব স্টাফ আব্দুর রব, বিমানবাহিনীর প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকাররা রণাঙ্গনের ১১টি সেক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। লুঙ্গি গেঞ্জি পরা ডাল ভাতে


বাঙালি থেকে ভারতীয় সেনার নিয়ে রাতারাতি মুক্তযোদ্ধাদেরও বেতারবার্তায় প্রতিনিয়ত প্ররণা জোগাতো মুজিবনগর সরকারই। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর পাশে থাকা ভারতীয় সেনার মতো কলকাতা বা বাংলার আমজনতাও তখন পূর্ব বাংলার পাশে। পাকিস্তান বেতারের অপপ্রচারের মোকাবিলায় আকাশবাণী কলকাতার অধিকর্তা দিলীপ সেনগুপ্তের পরিকল্পনায় হাতিয়ার হল শ্লেষাত্মক রেডিও কার্টুন " কুঠিস্তানের ফেউ "। উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়দের সংবাদ অনুষ্ঠান তো ইতিহাসের সাক্ষীই। স্বাধীনতার লড়াই ঘোষনা করে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার আঁচে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার,অংশুমান রায়ের রবিবাসরীয় আড্ডাও পাল্টে গেল। বেতার অনুষ্ঠানের জন্য গৌরিপ্রসন্ন সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে খুঁটিয়ে লিখে ফেললেন " শোন এক মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি "। তাতে সুর বসিয়ে গাইলেন অংশুমান। এপ্রিলে কলকাতায় বাংলাদেশি পতাকা ওড়ানোর দিনটিতে উপস্থিত ছিলেন সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। চিন ভক্ত নকশাল ও অবাংলাভাষী মুসলমানদের একাংশের নতুন দেশটি নিয়ে কিছু দ্বিধা ছিল। তা বলে "জয় বাংলা" বলে হাক দিয়ে সীমান্ত পারের সশস্ত্র বীর যোদ্ধাদের বাংলা জুড়ে অবাধ যাতায়াতের সমস্যা হয়নি। বম্বের ওয়াহিদা রহমান থেকে সপরিবার কৈফি আজমি, সুনীল দত্ত, নাস্তিকরা নবজাতক রাষ্ট্রের পাশে দাড়ালো।
১৯৭১ এর ২২শে মে রাত দশটায় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আকাশবাণীর দু জন আধিকারিক, ইন্জিনিয়ারের সঙ্গে মুজিবনগরের তথ্য, বেতার, প্রচার আধিকারিক আব্দুল মান্নানের গোপন মিটিং বসেছিল। আকাশবাণীর ক্রেতারা নিজের পরিচয় পুরোটা খোলোসা করেননি। শুধু জানিয়েছিল, ভারত সরকার সীমান্তে ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার বসিয়েছেন। সেটা কোথায় বসানো, তাও ভারতীয় আধিকারিকরাই জানতেন। মুজিবনগরের প্রতিনিধি সংস্কৃতি কর্মীদের কাজ বেতার অনুষ্ঠান করা। বি এস এফ -এর লোকজনই সেই রেকর্ডিং নিয়ে গিয়ে সম্প্রচারের বন্দোবস্ত করবেন। কবি নজরুলের জন্মদিনেই (২৫শে মে) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু। দরজা, জানলার ফাঁকফোকরে কাপড় গোজা অস্থায়ী স্টুডিয়োর রেকর্ডিং। এ শহরেই তখন জয় বাংলা পত্রিকা বেড়োতে আরম্ভ করলো।
 |
| ১৯৭২ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা। ইন্দিরা-মুজিবের সূত্রে যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক শুরু , বহু ওঠানামা পেরিয়ে আজও তা চলিষ্ঞু। |
মুক্তিযুদ্ধ বনাম স্বাধীনতা যুদ্ধ ::
মুক্তিযুদ্ধ ** যখন কোন দেশ স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে তখন সেটা মুক্তিযুদ্ধ। যেমন : বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ** যখন কোন দেশ স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে সেটা স্বাধীনতার যুদ্ধ। যেমন : যুক্তরাষ্ট্র।
পৃথিবীতে ঘোষনা দিয়ে স্বাধীন হওয়ার দেশ মাত্র দুটি। একটি বাংলাদেশ অপরিসীম যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করতে ৯ মাস সময় লেগেছিল। আমেরিকার লেগেছিল ৭ বছর। বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্ত আমেরিকা যুদ্ধ করলেও ব্রিটিশদের পরাজিত করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারে নাই, "প্যারিস চুক্তি" করে তারা বৃটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বিশ্বে মাথা উচু করে দাঁড়াতে হলে সেই আদর্শের অনুসরন ছাড়া পথ নেই। বাঙালি জাতির প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের জমিতে বেড়ে উঠেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালিত্বের চেতনা মূর্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের ........আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালবাসি......অথবা ...... বাংলার মাটি, বাঙলার জল......অথবা.....সার্থক জনম আমার , জন্মেছি এই দেশে .... ইত্যাদি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতিবিদ্বেশ নয়, সম্প্রীতির কথা বলেছে। ছিলো বছর আগে বাংলার কবি চন্ডীদাস লিখেছেন " শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। " প্রায় একশো বছর আগে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন " হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিঞ্জাসে কোনজন // কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।" বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান সামরিক জুন্টা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছিল।
১৯৭২ এর ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশের ফিরে আসেন। ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে কয়েক ঘন্টার জন্য দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর জন্য বিশাল গনসংবর্ধনার আয়োজন করেন। এই সভায় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার, সশস্ত্র বাহিনী এবং সর্বস্তরের জনগনের অতুলনীয় সহযোগিতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেছিলেন " আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কিসের এত মিল ? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্ব শান্তির জন্য। "সদ্য সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমক্ষে আবারো বলেছিলেন " বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
 |
| শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর : ঢাকা : ১৯৭২ |
৪ই নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষধের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষন ৪ই নভেম্বরের। এই ভাষনে বঙ্গবন্ধুর জীবনের জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। এই ভাষনেই বঙ্গবন্ধু ' গণতন্ত্র' , 'সমাজতন্ত্র ' ও 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলছেন...... " ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।"
ধর্মনিরপেক্ষতা'র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বহুবার বলেছেন....... প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, কোনও বিশেষ ধর্মকে প্রায় দেবে না।
আমেরিকার তখনকার ঘৃণ্য ভূমিকা আলোচনা না করলেই ভালো। ওঁদের বিদেশমন্ত্রী হেনরি কি কিসিঙ্গার হেয় করে বলেছিলেন.........বাংলাদেশ এক দানপত্র যার চাহিদার কোনও শেষ নেই। দেশটিকে পাকিস্তান শুধু লুটপাট আর ধ্বংসই করেনি , তার অর্থনীতির মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ চার্জ করে গিয়েছিল। বিশাল প্রতিবেশী ভারতের পাশে দেশটিকে কতই না ছোট্ট মনে হত। আজ সেই বাংলাদেশ কত বিষয়ে ভারতের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। ২০০৭ এ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল অর্ধেক, আর ২০২০-২১ এ সেই আয় আমাদের চেয়ে ২৮০ ডলার বেশি। টানা সাত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব লিঙ্গগত ব্যবধানের সূচকে (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) অনেক এগিয়ে। শেষ হিসেব অনুযায়ী ১৫৬ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান লজ্জাদায়ক ১৪০ নম্বরে আর বাংলাদেশ ৬৫তে। এই নিরীক্ষার বিচার হয় অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের ভিত্তিতে। এর সঙ্গে হিসাব নেওয়া হয় তাঁদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার, যা নারীর ক্ষমতা অর্জন ও উন্নতির মান চিহ্নিত করে। দেখা যাচ্ছে এর সব কটিতেই ভারত ভয়াবহ ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে।
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাঙালি কী ভাবে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করছে ও করে চলেছে, এই পরিসংখ্যানগুলি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ১৯৭১ এর আসল তাৎপর্য শুধু বাঙালির সত্তার জয়ী নয়, বাঙালির কর্মক্ষমতা ও তাঁরা কি অর্জন করতে পারেন তার এক দৃষ্টান্ত।
 |
| আবেগী বাংলাদেশকে ভরসা দেয় ক্রিকেট। মাঠে সমর্থকদের মুখগুলোই যেন স্বাধীনতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। |
স্বাধীনতার সুবর্ণ পালন করছে বাংলাদেশ। দু'দেশের সম্পর্ক স্থাপনেরও ৫০ বছর এই ২০২২ সাল। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে '৭১ এর পর থেকে আওয়ামীলীগ যখনই বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছে, বন্ধুত্ব বেড়েছে ভারতের সাথে। মধুরতর হয়েছে রসায়ন , কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য। এর কূটনৈতিক ব্যাখ্যা..... বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বন্ধন, ইন্দিরা গান্ধী ও মুজিবর রহমান যা অচ্ছেদ্য করে গিয়েছেন। কূটনীতিতে ' স্থায়ী বন্ধু' হয় না, দুটি দেশকে 'স্থায়ী শত্রু দেশে হিসেবে চিহ্নিত করাও মূর্খামী। দু'দেশের মধ্যে " দেনা পাওনা" র বোঝাপড়া যত ক্ষণ ঠিক থাকবে, এগিয়ে চলবে এই সম্পর্ক।
No comments:
Post a Comment