হিন্দুধর্ম অনুসারে জীবিত ব্যক্তির তিন পূর্বপুরুষ প্রয়াত হওয়ার পরে পিতৃলোকেই বসবাস করেন। এই পিতৃলোক হল স্বর্গ ও মর্ত্য এই দুই লোকের মাঝাখানে অবস্থিত। এই লোকের প্রধান হলেন যমদেবতা। তিনিই মৃত ব্যক্তিকে পিতৃলোকে নিয়ে যান।

মহাভারত অনুযায়ী দাতাকর্ণের মৃত্যুর পরও তাঁকে মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে যেতে হয়। তিনি গিয়ে পৌঁছোন স্বর্গে। সেখানে তাঁকে ইন্দ্রলোকে মণিমানিক্য, স্বর্ণ ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। তিনি পড়েন বেজায় বিপদে। কিছুই খেতে পারেন না। তখন কর্ণ অপারগ হয়ে ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তাঁকে এই সমস্ত খেতে দেওয়া হচ্ছে।

এর উত্তরে ইন্দ্রদেব বলেন, তিনি সারা জীবন ধরে সবাইকে কেবল এই সমস্ত দ্রব্যই দান করে গিয়েছেন। কখনোই পিতৃগণের উদ্দেশে খাদ্যদান করেননি।

এর জবাবে কর্ণ বলেন, তিনি তো জানতেনই না তাঁর পিতৃপরিচয়। অবশেষে মাতা কুন্তী তাঁর জন্মের রহস্য প্রকাশ করেন। তা-ও যুদ্ধের আগের রাত্রে। ফলে পরের দিনই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি ভায়েদের হাতেই প্রাণ হারান। ফলে পিতৃপুরুষদের জল খাদ্য দান করার মতো সময় তিনি পাননি।

এর থেকে ইন্দ্রদেব বুঝতে পারেন এতে কর্ণের কোনো রকম দোষ ছিল না। তাই তিনি কর্ণকে পিতৃপুরুষদের জলখাদ্য দান করার সুযোগ করে দেন। কর্ণকে ১৫ দিন অর্থাৎ এক পক্ষকালের জন্য মর্ত্য ফিরে যাওয়ার ও পিতৃপুরুষদের জল দেওয়ার নির্দেশ দেন।

আর সেই নির্দেশ পেয়ে কর্ণ আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন পিতৃপুরুষদের জল ও খাদ্য দান করতে। তিনি জল অন্ন দান করে পাপস্খালন করে আবার স্বর্গে ফিরে যান।


পুরাণ অনুযায়ী যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে অন্নজল দান করার জন্য ছিলেন তাকে বলা হয় পিতৃপক্ষ। এই ঘটনাই তর্পণ। এই কাহিনিতে ইন্দ্রের কথা বলা হলেও মতান্তরে যমরাজের উল্লেখও পাওয়া যায়।

এ তো গেল মহাভারতের কথা। ত্রেতাযুগ অর্থাৎ রামায়ণেও তর্পণ নিয়ে কাহিনি আছে।সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন রামচন্দ্র। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য অকাল বোধন অর্থাৎ দেবী দুর্গার অসময়ে পুজো করেছিলেন রাম। সেই পুজো হয়েছিল শরৎকালে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী যে কোনো শুভ কাজ করার আগে পিতৃপুরুষদের জল দান করে সন্তুষ্ট করতে হয়। সেই মতোই রামও পুজোর আগে জল দান করে ছিলেন পিতৃপুরুষদের। সেইটিই তর্পণ নামে পরিচিতি পেয়েছে।এর পর থেকেই ওই দিনটিতে তর্পণ করার প্রথা শুরু হয় এবং ওই অকালবোধনই বাঙালির দুর্গাপুজো।

মহালয়া শুধুই একটা তিথি নয়। বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠত্ব শার্দোৎসবের গেটওয়েও বটে৷ "আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং তৃপ‍্যতু”-এই হল মহালোয়ার সার কথা। অকালবোধনের আগে দাদা রামের তর্পন হয়ে গেছে। হাতে সময় খুব কম, তাই  লক্ষণ বললেন আমি একবার সার্বিক তর্পণ করছি। তখনই এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তাকে জলাঞ্জলি স্থান। এই বাক‍্য যে ভাবনাকে ব‍্যাপ্তি করে,  আজও মহালোয়ার তাৎপর্য তাই-ই। ওই শ্লোকের অর্থ-'ব্রহ্ম হতে তৃণ পর্যন্ত জগৎ তৃপ্ত হউক'। অন্য মহালয়ার তর্প পরিধি শুধুমাত্র পিতৃতর্প কর্মে আবদ্ধ নয়। মহালোয়ার বার্তা সার্বজনীন উদারতা।


যার সাহায্যে তৃপ্তি হয় তাই তর্পণ। দেহ বিলীন দেখতে, আত্মা অবিনশ্বর-পৃথিবীর সব ধর্মে ই আছে। তিলজল দিয়ে পূর্বপুরুষের আত্মার তৃপ্তিসাধর্মে বলা হয় তর্পণ। তর্পণ একপ্রকার নয়। তর্প প্রচার নিয়ম, মন্ত্র, আচার, উৎসের উপাচার এক আধ‍্যাত্মিক দিকদেশ। বেদের বিভা অনুযায়ী চতুরাশ্রমের কাল থেকে শুরু হয়েছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের তর্পণ সংক্রান্ত বিষয়ে। যেমন সামবেদী তর্পণ, যজুর্বেদী তর্পণ, ঋগ্বেদী তর্পণ।