ভারত মা-এর বয়স ৭৫ বছর হ'ল। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হল। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাতে যে বিরাট আনন্দ অনুষ্ঠান হয়েছিল সেটা কি ভারতীয়দের স্বাধীনতা না ভারতবর্ষ বলে যে দেশ ছিল তারই দেশভাগ।মনের মধ্যে সবসময় প্রশ্ন জাগে প্রতি বছর এই দিনটি উদযাপনের উদ্দেশ্য কিসের ----- স্বাধীনতা না দেশভাগের।
সেই রাতে দিল্লির সংসদ ভবনে স্বাধীনতা প্রদানের যে অনুষ্ঠান হয়েছিল সেদিন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল সারা দেশ। বঙ্গের রাজভবনেও চলেছিল এক ম্যাড়ম্যাড়ে অনুষ্ঠান যেখানে বঙ্গদেশের বিলুপ্তি ও পশ্চিমবঙ্গ নামের এক নতুন প্রদেশের জন্ম হয়েছিল। পরে প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ আর তারঁ সহযোগিদের পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন রাজ্যপাল রাজাগোপালাচারি।

১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাস। নোয়খালিতে চলল এক রক্তাক্ত দাঙ্গা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে একই রকম রক্তাক্ত দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছিল কলকাতায়। সেই ১৯৪৬ এর রক্তাক্ত দাঙ্গার পরেই কলকাতা হিন্দু ও মুসলমান এলাকায় ভাগ হয়ে যায়। তার আগে কিন্ত হিন্দু- মুসলমান একই পাড়ায় থাকত। অত্যাচারিত হিন্দুদের আশ্বস্ত করার জন্য গান্ধীজী নোয়াখালিতে পৌচ্ছালেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। গান্ধীজীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে রিপোর্টেরদের তারা বাধা দিত। প্রত্যেক দিন সকালের প্রার্থনা সভায় গান্ধীজী বক্তৃতা দিতেন হিন্দিতে। সেই বক্তৃতা বাংলায় তর্জমা করে বলার সময় গান্ধীজীর ব্যাক্তিগত সচিব নির্মল কুমার বসু মূল বক্তৃতার থেকে অনেক বেশী সময় নিতেন। ফলে তার থেকে নিউজ পয়েন্ট বার করে খবর লিখতে তরুণ রিপোর্টেরদের হিমশিম খেতে হতো। দিনের শেষে ইংরেজীতে লেখা গান্ধীজীর অনুমোদিত তাঁর বক্তৃতার সারমর্ম হাতে পেলে খানিক স্বস্তি মিলতো।

জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গান্ধীজী নোয়খালির গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কংগ্রেস নেতারা গান্ধীজীর সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাই নেহেরু সমেত তাবড় তাবড় কংগ্রেস নেতারা নোয়খালির এঁদো গ্রামে হাজির। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে গান্ধীজীর আলোচনা সভায় রিপোর্টেরদের যাওয়ার অধিকার ছিল না। তবে সব খবরই তাঁরা পেয়ে যেতেন কাছাকাছি লোকেদের কাছ থেকে। এই সব কংগ্রেস নেতাদের সাথে গান্ধীজীর সম্পর্ক কেমন ছিল?? নেতারা গোল হয়ে বসতেন স্কুলের ছাত্ররা যেমন মাস্টারের কাছে পড়া বোঝে। কিন্ত পড়াটা ছিল ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব। যেটা গান্ধীজী অগ্রাহ্য করতে বললেও কংগ্রেস নেতারা অমান্য করলেন।

এ বিষয়ে আর একটু আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাব _______ ৩০শে মে মাউন্টব্যাটেন দিল্লি থেকে ফেরা মাত্র কংগ্রেসের দুই নেতা জওহরলাল নেহেরু ও বল্লভভাই প্যাটেল বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন। সেটাই ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্টব্যাটেন-এর ব্র্ডকাস্ট এ রেডিও তে সম্প্রচারিত হল। এতেই প্রশ্ন জাগে মহাত্মা বাদে কংগ্রেসের অন্য শীর্ষ নেতারা কেন পার্টিশনের দাবী করলেন ?? বা, কেনই বা তাঁরা তাঁদের সমস্ত আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ভারতমাতাকে দ্বিখন্ডিত করতে রাজী হলেন ?? আসলে পাঞ্জাব ও বাংলার ভাগ কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকে ইংরেজদের হাত থেকে নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা লাভ করতে সাহায্য করেছিল। যে সব দেশপ্রেমিক ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোতে বিশ্বাস করতেন , তাদের কন্ঠস্বর আর কেউ শুনতে রাজী হলেন না। ১৯৪৭ সালে মহাত্মা খুবই একা হয়ে পরেছিলেন। শরৎ বসু তাঁকে বলে ছিলেন ....." আপনি যদি এখনও আপনার কড়ে আঙুলের তোলেন , তা হলে দেশ ভাগ রোধ হয়ে যেতে পারে।"গান্ধীজী উত্তরে বলেছিলেন " শরৎ, সেটা সম্ভব নয়। ALL MY YES MEN BECOME MY NO MEN. যারা আমার সব কথায় হ্যাঁ বলত, আজ তারা আমার পরামর্শে না বলছে।" এই সময় মহাত্মা একজনের অভাব বিশেষ ভাবে অনুভব করেছিলেন। তিনি আর কেউ নন, তাঁর 'বিদ্রোহী' পুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। একমাত্র নেতাজী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ইশাহি সকলকে সমান অধিকার দিয়ে সম্পূর্ণ ঐক্যের ভিত্তিতে আজাদির লড়াই চালিয়েছিলেন।

এই ১৫ই আগষ্ট একাধারে আনন্দের ও অন্য দিকে চরম দু:খের দিনও বটে। ওই দিনটি আনন্দের, কারণ সে দিন আমরা ইংরেজের শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। আবার দু:খের দিনও বটে কারণ ধর্মের ভিত্তিতে সেদিন আমাদের দেশ ভাগ হয়েছিল। এই পার্টিশন প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাব ও বাংলার ভাগ হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের ৯ থেকে ১৪ই মে মহাত্মা গান্ধী কলকাতার কাছেই সোদপুরে ছিলেন। বাংলাকে কি ভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখার যায় , তা ঠিক করতে হিন্দু মুসলমান নেতাদের সাথে কথা বলছিলেন। সেই সময় শরৎ চন্দ্র বসু গান্ধীজীকে কেন ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ রোধ করা জরুরি, সে কথা বললেন। শরৎ চন্দ্র বসুর অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা গান্ধীজী সমর্থন করেছিলেন। এই খবর পেয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সোদপুরে ছুটে এলেন। গান্ধীজী শ্যামাপ্রসাদকে বললেন " এই পরিকল্পনা একটি বার্তা দেয় যে বাংলার হিন্দু-মুসলমান এক হবে। যা মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।"গান্ধীজীর পরামর্শে অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা সামান্য অদলবদল করলেন শরৎ বসু। এর পর এই পরিকল্পনার রূপরেখা জর্জ ক্যাটলিন নামে এক ইংরেজ এম পি-র হাত দিয়ে লন্ডনে লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর কাছে পাঠানো হয়। ১৯৪৭ সালের ২৮শে মে লন্ডনে মাউন্টব্যাটেন দুটি আলাদা রেডিও ব্র্ডকাস্ট বা বেতার ভাষন রেকর্ড করেন। ব্র্ডকাস্ট এ ও বি। ব্র্ডকাস্ট বি অনুসারে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতারা একটি কোয়ালিশন সরকার গড়বেন। অন্য দিকে একমাত্র পাঞ্জাবই পার্টিশন হবে। বাংলা কিন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকবে। কিন্ত তারপর ..............!!!

নেতাজীই একমাত্র নেতা যিনি সমস্ত ধর্মীয় মতালম্বী, সকল ভাষাভাষি মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী নেতাজীকে পাশে পেলে দেশভাগের ট্রাজেডি থেকে ভারত হয়ত রক্ষা পেত। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, ১৯৪৭ -এর ১৪ বা ১৫ই আগষ্ট ভারত বা পাকিস্তান কোনও দেশের দেশবাসীরা জানতো না , যে কোথায় রাডক্লিফ সাহেব দেশভাগের " লাইন " এঁকে রেখেছেন। একথা সবার জানা আছে যে স্বাধীনতা দিবসে গান্ধীজী নয়াদিল্লির উৎসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে কলকাতায় শান্তি বজায় ছিল। তবুও সমস্ত উপমহাদেশের শেষ রক্ষা হল না। দেশ ভাগের ফলে প্রায় বিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। প্রায় দেড় কোটি মানুষ পার্টিশনের সীমারেখা পার হয়ে সর্বহারা উদ্বাস্ততে পর্যবসিত হয়েছিল। বাংলায় অবশ্য ১৯৪৭-এ পাঞ্জাবের মতো পরিস্থিতি হয়নি। সেখানে প্রায় সমস্ত মুসলমানকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে যেতে হয়েছিল। আবার সমস্ত শিখ ও হিন্দুকে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছিল। তথাপি পরবর্তীকালে দলে দলে হিন্দুরা তাদের জন্মভূমি, মাটি, ভিটে ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে লাগল। দেশনায়করা তাদের এদেশে " শরণার্থী " বলে নামকরণ করলেন। তথাকথিত হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে লাগলো যে তাদের পুনর্বাসন ______ এক বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করল। বিধানচন্দ্র রায় মহাকরণে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এক সভায় বললেন-------- পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের নিয়ে এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ন গ্রাম পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে তৈরি করতে হবে। সেই প্রস্তাব অবাস্তব মনে হয়েছিল তদনিন্তন মুর্শিদাবাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-এর। তাতে বিধানবাবু তাঁর উপর চটে যান। অবশ্য পুরো পরিকল্পনাও জেলাশাসক জানতেন না। পরে জানা যায়, সীমান্ত বরাবর দশ মাইল জায়গা খালি করে সেখানে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসিত করা হবে। এ বিষয়ে কোনও লিখিত আদেশ দেওয়া হয়েছিল না। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরনশঙ্কর রায় জানতে পারেন , জওহরলাল নেহেরু তখন বিদেশে। তিনি দেশে ফেরার আগে যা করার করে ফেলতে হবে। |
স্বাধীনতা পাওয়ায় আনন্দ না দু:খ ??? |
বাংলায় ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬০, ১৯৬৪, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ অবধি গৃহহারা মানুষদের সীমারেখার এপার ওপার হতে হয়েছে। গান্ধীজী তাঁর মৃত্যুর সাত দিন আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিনে বলেছিলেন-------- নেতাজী এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি সমস্ত ধর্মীয় বিভাজনের উর্ধে উঠে আসতে পেরেছিলেন। এবং এই উপমহাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের অতি নিকটে আসতে পেরেছিলেন। এই মহান দেশপ্রেমিকের স্মৃতিতে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন----- যেন সকল ভারতবাসী নিজেদের হৃদয় থেকে ধর্মীয় বিদ্বষভাব মুছে ফেলেন। গান্ধীজীর সেই উপদেশ আজ আমাদের গ্রহন করা উচিত। ১৯৪৭ সালে নেতৃবৃন্দের কিছু সিদ্ধান্ত দশকের পর দশক এই উপমহাদেশের কল্যাণের পরিপন্থী হয়ে রয়েছে।
১৯৪৭ এর এপ্রিলেও বোঝা যাইনি আগষ্ট দেশ ভাগ হবে। এ পারের মানুষ যাবে ও পারে, ও পারের মানুষ আসবে এ পারে। প্রাক্তন ইংরেজ ব্যারিস্টার সিরিল রেডক্লিফ আগে কখনও ভারতে আসেননি। মানচিত্র পড়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যেও তাঁর ছিল না। অভিঞ্জতা ছিল না এদেশের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ভাষা ও আবেগ সম্পর্কে। তাঁকে মাত্র সাত সপ্তাহ দেওয়া হয়েছিল দেশ ভাগ করে মাঝখানে সীমারেখা টেনে দিতে। তাঁর কলমের আঁচরের দাগ মাটিতে বা জমিতে পড়েনি, দাগটা পরেছে জন্মসূত্রে দুর্ভাগা কয়েক লক্ষ মানুষের বুকের পাঁজরে। সেই আঁচরে জন্মভূমি মায়ের বুকখানা এফোঁর ওফোঁর হয়ে গেছে। একবারও ভাবা হয়েনি যে এর পরিনামে এই লক্ষ লক্ষ লোকের জীবনে নেমে আসবে অনিশ্চয়তা ও গভীর বিপর্যয়। তাদের নতুন পরিচয় হয়ে যাবে " উদ্বাস্তু"। ছেড়ে যেতে হবে বহু সুখস্মৃতির জন্মভূমি, পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটে, আশৈশব হেঁটে যাওয়া চেনা পথ ও প্রান্তর। আর পিছনে পড়ে থাকবে শুধু স্বজনের শ্মশান।
সাধারণ ভাবে পূর্ববাংলার হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে আসার কথা ভাবিননি। অনেকেই বিশ্বাস ছিল এই ভাগাভাগি সাময়িক। তাই দেশভাগের পরেও কখনও ভাবিননি, ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। এমনকি অনেকে স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন।মোটামোটি তাঁরা স্থির করেছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে থাকবেন পিতৃপুরুষের ভিটার টানে। দেশভাগের পর যারা এ পার বাংলায় এসেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করতেন.....ও পার বাংলায় ফিরে যাওয়া কোনও সমস্যা হবে না।
দাঙ্গা, হিংসা, বীভৎসতার ভয়ঙ্কর স্মৃতির পাশাপাশি অনেকের মনে বার বার উঁকি দিয়ে ফেলে ফেলা আসা জন্মভিটার স্মৃতি। যা কিনা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার উৎস। আসলে পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলি এমন নৈসর্গিক শোভায় শোভিত যে এক বার সেই নান্দনিক দৃশ্য যার মনকে মথিত করছে সে চিরকাল আবিষ্ট থেকেছে সেই স্মৃতিতে।
তাহলেও এই স্মৃতি উস্কে দেয়া ঠিক হবে কি? কেননা মাপের বিচার করতে গেলে দেখা যাবে আনন্দের চাইতে বেদনার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। তার সাথে নেমে আসে এক প্রবল ক্ষোভ। কেননা ধারনা ছিল এই নিজের দেশের বাড়ীতে থাকার মত সুখ হয়তো স্বর্গ গিয়েও পাওয়া যাবেনা। দেশভাগের পর আজ তা চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তখন সার্বিক অবিশ্বাসের মরুভূমিতেও অনেক গ্রামে ছিল হিন্দু - মুসলমান সুসম্পর্কের মরুদ্যান। বহু মুসলমান চাননি যে হিন্দুরা দেশত্যাগ করুক। হিন্দুদের দেশত্যাগে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান কষ্ট পেয়েছিলেন প্রানে। বস্তুত , দেশভাগের আগে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে পৌচ্ছে গিয়েছিল আত্মীয়তার পর্যায়ে। সেই মানবিক সম্পর্কের স্মৃতি বার বার নাড়া দিয়েছিল গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষের হৃদয়কে। এ পাড় বাংলায় আসা মানুষগুলোর প্রান যেমন কেঁদেছিল ও পার বাংলার "দেশ" এর জন্য, ঠিক তেমনই ঘটেছিল এ পাড় বাংলা ছেড়ে যাওয়ার মানুষগুলোর জীবনে। নানা মানুষের স্মৃতি কথা, সমকালীন পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্য থেকে উঠে আসে দেশভাগের আগের এক নিশ্চিত জীবনযাত্রা, অন্য দিকে এক ভিন্ন সামাজিক বিন্যাসের ছবি, যা ঐতিহ্যগত ভাবে শিকড় চালিয়ে দিয়েছিল পূর্ববঙ্গের গ্রাম জীবনে। ফলে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক সাহায্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্বাস। উভয়ে বাঁধা পরেছিল আত্মীয়তার বন্ধনে।
 |
আলোচনায় মহাত্মা গান্ধী ও রাজা গোপালাচারী |
কিন্ত বহু কাল ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই সুসম্পর্কের ছবিটা ঝলসে গিয়েছিল রাজনীতির আঁচে। রাজনীতিবিদরা শুধু দেশকে ভাগ করেননি, করেছিলেন মানুষকে, মানুষের হৃদয়কে, ভাবনাকে। বাঙালি জাতিকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করে সেদিনের তথাকথিত দেশহিতৈষীরা পূর্ববাংলা থেকে উদ্বাস্তুস্রোতের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁদের জীবনে অকল্পনীয় যন্ত্রনা ও বেদনার সৃষ্টি করেছিলেন, তা ভুলতে চেয়েছিলেন অনেকেই। কারণ বিস্মৃতি দিয়েই হৃদয়ের ক্ষতের উপশম করা যায়। কিন্ত সকলের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। দেশের স্মৃতি, বিচ্ছেদের বেদনা অনেক মানুষকে তাড়া করে বেড়িয়েছে আমৃত্যু।
 |
১৯৪৭ এ স্বাধীনতার দেশভাগের ফল। |
সেইজন্যই অনেকের কাছে সময়টা থমকে গিয়েছিল ১৯৪৭ এ ......... যে বছরের এক পিঠে ছিল স্বাধীনতা , আর অন্য পিঠে ছিল দেশ ভাগ। নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয়ের অভিঞ্জতা তাদের বাধ্য করেছিল বুঝিয়ে দিতে যে বাস্তবকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই, তা সেই বাস্তব যতই বেদনার হোক না কেন। কিন্ত কয়েকটা প্রশ্ন আজও তাদের তাড়া করে বেড়ায় সদুত্তরের আশায় -------- সাতচল্লিশের দেশভাগ সত্যিই কি ঠিক?? এটা কি অনিবার্য ছিল?? আর কি কোনো বিকল্প ছিল না ?? বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ এবং ভয়ঙ্কর গননির্বাসন ঘটেছিল কোন ও কার স্বার্থে ??? এই প্রশ্নগুলো কোনও দিন মুছে যাবে না দেশভাগের পরিণতির শিকার হওয়া মানুষের মন থেকে,,, ইতিহাস থেকে। আর হয়তো কখনোই প্রশ্নগুলোর সঠিক যথাযথ উত্তর কেউই দিতে পারবে ভবিষ্যতে!!
 |
হরিদাসপুর, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম। |
মৃত্যুর সাত দিন আগে , নেতাজীর জন্মদিন ২৩ শে জানুয়ারি ১৯৪৮ এ , গান্ধীজী বলেছিলেন কি ভাবে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ সকল ভেদাভেদের উর্দ্ধে উঠে সারা ভারত থেকে পুরুষ মহিলা হয়েছিলেন এবং সকলের অকুন্ঠ ভালবাসা ও আনুগত্য নেতাজী জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। "সেই মহান দেশপ্রেমিকের স্মরনে" তাঁর দেশবাসীকে তাদের অন্তর থেকে সব সাম্প্রদায়িক তিক্ততা ধুয়ে ফেলতে বলেন। মহাত্মার কাছে ২৬ শে জানুয়ারিই ছিল স্বাধীনতা দিবস, আর ১৫ ই আগস্ট সংগঠিত হয়েছিল " TRANSFER OF POWER". ১৯৪৮ র ২৬শে জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, "আসুন , আমরা আশা করি, ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দু টুকরো হয়ে গেলেও , অন্তরে অন্তরে আমরা চিরকালই ভাই আর বন্ধু হয়েই থাকব, পরস্পরকে সাহায্য ও শ্রদ্ধা করব, বাইরের দুনিয়ার কাছে একই থাকব।"
 |
মুক্তির আশায় আশ্রয়ের সন্ধানে দেশত্যাগ। ৬৩ বছরের ছেলের কোলে ৯৯ বছরের মা।
|
আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। (১) ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য। (২) বিভিন্ন ভাষাভাষি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যের প্রতি মর্যাদা জানিয়ে গড়ে তোলা একটি স্বাধীন ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। (৩) ঔপনিবেশিক শাসনে দ্রারিদ্র নিক্ষেপ জনসাধারণের মুক্তি, সাম্যবাদী সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে। এই তিনটি স্তম্ভ একে অপরের উপরে নির্ভরশীল। ১৯৪৭ সালের ধর্মীয় বিভাজন যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ভাবনাকে পঙ্গু করে , কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রক্ষমতা আস্ফালনের পথ সুগম করেছিল।
তাই আজ অতীতের মহা আদর্শ সামনে রেখে ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন ভাবের রাজ্য জাগিয়ে তুলে প্রেমের ভারতবর্ষ রচনা করা খুবই জরুরী। "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের বারো বছর আগেই "পূর্ন স্বরাজ" সঙ্কল্প গৃহীত হয়েছিল। ১৯৩০ এর ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ার শপথ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ এর ১৫ই আগষ্ট নীতি ও ন্যায়ের সাথে আপস করে পূর্ণ স্বরাজ বদলে তদানীন্তন নেতৃত্ব ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়েছিল এবং বাস্তবে ঘটলো ঐক্যের পরিবর্তে পার্টিশন।
 |
অস্তিত্ব রক্ষার সন্ধানে...... |
স্বাধীনতা দিবসে উৎসবের চেয়ে আত্মসমীক্ষা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পরেছে। স্বাধীনতা স্বপ্নের যে তিনটি স্তম্ভের কথা আলোচনা করা হল , সেগুলিকে ইংরেজীতে .... secularism, federalism আর socialism শব্দ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। আর বাংলায় এর মর্ম বোঝানো যায় " মহামিলন " এই শব্দ দিয়ে। কিন্ত এই মহামিলন ঘটতে পারে একমাত্র সাম্যের ভিত্তিতে। স্বাধীনতার স্বপ্ন ভঙ্গের অন্ধকার থেকে মুক্তির আলো দেখার এটাই একমাত্র পথ।
ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করার উস্কানি বহু যুগ ধরেই দিয়েছিল ব্রিটিশরা, আর স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিতে সেই আগুনে ঘৃতাহুতি পরেছিল। আজকের সুসভ্য পরিবেশনায় গান্ধী ও নেতাজী সুভাষকে একই ফুলদানির একই রকম ফুল দিয়ে সুবাসিত করতে দেখা যায়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু , গান্ধীজী সহ অন্য প্রাক্তন রাজনীতিকদের প্রতি কোনও প্রকাশ্য বিরোধিতা দেখেননি, বরং ওদের নামে বাহিনীর নামকরন করেছিলেন আই এন এ তে। তবে গান্ধীজীর থেকে তার অবস্থান ছিল বিপরীত। ব্রিটিশদের সাথে দরদস্তুর না করে , সুভাষচন্দ্র কট্টর বিরোধিতা করেছিলেন।
জাপান, জার্মান বিশ্বযুদ্ধের চরম দুর্বিপাক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশকে উন্নত করে তুলেছে। কিন্ত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও "উন্নয়নশীল" হয়ে থাকতে চাওয়া আমাদের দেশের অনুন্নত বঞ্চিত দেশবাসীর সাক্ষ্য দেয় যে নেতাজী সুভাষ, সর্দার ভগৎ প্রমুখ কতটা দূরদর্শী, উন্নতশীর, বাস্তববাদী, প্রঞ্জাবান, প্রকৃত দেশপ্রেমিক মহামানব ছিলেন।
আজ ২০২২ সালে দাড়িয়ে স্বাধীনতা ও দেশভাগের ৭৫ বছর পর আমাদের সকলেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভারতবর্ষের জনসাধারণের মঙ্গল সাধন করা। গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্রের আদর্শের সোপান বেয়ে ধর্ম ও গোষ্ঠীগত বিসংবাদ ভুলে কদম কদম এগিয়ে যাওয়াই যেন জীবনের ধ্রুবতারা হয় দেশবাসীর, সেই স্বপ্নই ভারত দেখুক স্বাধীনতার ৭৫ বছরে।
( সংগৃহীত )
No comments:
Post a Comment