Saturday, 2 July 2022

ভগবান লাভের জন্য চেষ্টা / উপায়

 


একবার শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল  " সংসারী লোকের কি কোনো গতি নেই।  সংসারী মানে যারা বিবাহ করে গৃহস্থ হয়েছেন কেবল তারাই নন, যারাই সংসারে লিপ্ত হয়ে থাকেন তাদের কথাও বলতে হবে।" ঠাকুর বললেন  " উপায় তো অবশ্যই আছে। এগুলি হলো [১] ঈশ্বরের নামগান করা [২] সাধুসঙ্গ করা [৩] আর মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা।

এবিষয় প্রথমেই প্রশ্ন জাগে.....সাধারণ মানুষের জপ ধ্যানে মন বসে না, তবে তারা কি করবে ? উত্তরটা এইরকম.... মন এমন একটি যন্ত্র,  যে তাকে যে ভাবে ব্যবহার করবে সে সেভাবেই কাজ করবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জপধ্যানের চেষ্টা আমরা কতক্ষণ করি আর কতক্ষণ বা অন্য কাজে ব্যায় করি, এটা ভাবতে হবে। মন সর্বদা যে বিষয়ে চিন্তা করে , জপধ্যানে বললেও সেই বিষয় ফুটে উঠবে সেটাই  স্বাভাবিক।  তাই জপধ্যান করতে বসলে ভগবানের কথা মনে আসে না, মন তাতে স্থির হয় না।

কিন্ত এর প্রতিকার কি ? প্রতিকারের একটা সহজ উপায় হচ্ছে মনকে আরো বেশি সময় ভগব্বচিন্তায় নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করা। রামকৃষ্ণদেব বলতেন ----- মন কিরকম জান ? যেন ধোপাঘরের কাপড়। তাকে যে রঙে ফেলে রাখবেন, সে সেই রঙে রঞ্জিত হয়ে যাবে। মনকে যদি বেশি সময় সাংসারিক চিন্তায় ফেলে রাখি, জপধ্যানের সময় সেই চিন্তাই চলবে। তাই উপায় হল যত বেশি সম্ভব ঈশ্বর চিন্তার অভ্যাস করা। ঠাকুর আরও বলেছেন যে খানিকটা মন সবসময় তাঁর দিকে ফেলে রাখতে হয়। মনে যাতে স্থায়িভাবে ভগবানের চিন্তা চলতে থাকে তার চেষ্টা করতে হবে। তখন মনে হতে পারে তাহলে সংসারের কাজ চলবে কি করে ? ঠাকুর তখন বলছেন ____" যদি চদ্দো আনা মন ভগবানের কাছে রেখে যদি দু আনা দিয়ে সংসারের কাজ কর তো ভেসে যাবে। " কিন্ত  আমরা তার বিপরীত করি। চোদ্দ বা পনের আনা মন সংসারে ফেলে রাখি আর দু-এক আনা দিয়ে তাঁর চিন্তা করি। কোন মূল্যবান বস্তুত সহজে পাওয়া যায় না। আর পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুকে অত সহজে কি পাওয়া যায়? সুতরাং তাঁর চিন্তা করতে হলে মনকে তাঁর দিকে সর্বক্ষণ না পারি, সবচেয়ে বেশি সময় লাগিয়ে রাখতে হবে। তাতে সংসারের কাজ ব্যাহত হবে না, বরং আরো সুষ্ঠু হবে। তাঁর দিকে মন রাখলে মনে স্বার্থপরতা আসবে না। আর কাজ যখন নি:স্বার্থভাবে  করা হয়, তখন কাজটি যথোচিত হয়। এইজন্যই দরকার একটি আগ্রহী মন যা ভগবানের চিন্তা করতে চাইবে, তার জন্য চেষ্টা করবে এবং সেই চেষ্টার মধ্যে সংসারের কাজও চলতে থাকবে। এটি অভ্যাস করতে হয়। কোনও একসময় জপ করতে বসলাম, ভাল লাগল না উঠে পড়লাম।  এতে কাজ হবে না। আসল কথা, তাঁর নামে রুচি  হওয়া দরকার।

অরুচিকরকে রুচিকর করতে গেলে মনকে সেদিকে চালনা চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করতে করতে ক্রমে রুচি আসে। তাঁর নামগান করা মানে ধ্যানজপ, পূজার্চনা করা, দেবস্থানে যাওয়া দেবসেবার কাজ করা। সাধুসঙ্গ মানে যাঁরা ভগবানের চিন্তা করেন , তাঁকে ভালোবাসেন, তাঁদের সঙ্গ করা। সঙ্গ করা মানে তাঁদের কাছে গিয়ে বসে থাকা নয়, তাঁদের ভাব গ্রহন করা, তাঁদের জীবনচর্যা অনুসরন করা। না হলে সাধুসঙ্গ হয় না। তৃতীয় উপায়, মাঝে মাঝে নির্জনবাস।সংসারে বাস করে অন্য কিছু চিন্তা করার অবকাশ থাকে না। নির্জনে ভগবানের কথা চিন্তা করতে হয়। 

প্রথমে........ তাঁর নামগান মানে তাঁর চিন্তা, তাঁর পূজা---- এগুলি ভক্তিলাভের উপায়। ঠাকুর একে বলছেন বৈধী ভক্তি। এই বৈধী ভক্তির অনুষ্ঠান করতে করতে ক্রমশঃ তাঁর উপর অনুরাগ আসে। ভাবতে একজায়গায় বলা হয়েছে ---- ভক্তির দ্বারা ভক্তি উৎপন্ন হয়। বৈধী ভক্তির দ্বারা রাসায়নিক ভক্তি -- অর্থাৎ ঈশ্বরে অনুরাগ আসে এবং তার ফলে শরীরে ভক্তির চিহ্ন--- পুলক রোমাঞ্চকর প্রকাশ পায়। এ যেন ঠিক পুতুল খেলার মতন। ছোট্ট মেয়েরা পুতুল নিয়ে খেলা করে, কেউ ছেলে হয় কেউ মেয়ে হয়, নানা সম্বন্ধ।  তাদের খাওয়ার, পরায়,  শোয়ায়,  আবার পুতুল যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। খেলতে খেলতে তাদের পুতুলের উপর ভালবাসা আসে। আমাদের পূজা-অর্চনাও ভগবানকে নিয়ে পুতুল খেলা। তাঁকে জীবন্ত বলে আপনার বোধ তখনো হয়নি, কিন্ত এইভাবে চেষ্টা করতে করতে ক্রমশ: সেই বোধ আসে। এইভাবে বৈধী  ভক্তি থেকে রাগাত্মিকা ভক্তি আসে।

ঠাকুর বলেছেন ___ অনুরাগ এলে আর চিন্তা নেই।  অনুরাগ রুপ বাঘ কামক্রোধাদি খেয়ে ফেলে। অনুরাগের ফলে ভগবানের পথে যাবার অন্তরায়গুলি অপসারিত হবে। সাধারণত আমরা বলে থাকি সংসারে প্রবল বাধা। প্রবল বাধা সংসারে নয়। বাধা মনে। তাই মনে অনুরাগের সঞ্চার হলে কোনো বাধাই আর প্রতিরোধ করতে পারে না।অনুরাগ নেই বলেই বাধা। ভগবতে আছে --- গোপীরা গৃহকাজে ব্যাস্ত, এমন সময় বনের মধ্যে থেকে বাঁশীর শব্দ শোনা গেল। গোপীরা যে যা কাজ করছিলেন সব ফেলে রেখে চললেন। একেই বলে অনুরাগ।  কিন্ত এই অনুরাগ আসবে কি করে? ভগবানের নাম, তাঁকে চিন্তা করতে করতে , জীবনটা সেই ভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা করতে করতে, অনুরাগ আসে। অনুরাগ এলে তখন সংসারের কোনও বাধা আর আটকাতে পারে না। ঠাকুর বলেছেন.... অনুরাগ এলে, অরুণোদয় হয়। পূবের আকাশ লাল হলে বোঝা যায় সূর্য উঠতে আর বেশি দেরী নেই।  তাই ভগবানের জন্য ব্যাকুল হলে কোনো প্রতিবন্ধী আর ভক্তদের আটকাতে পারে না। এবার ঠাকুরকে জিঞ্জাসা করা হল ___ পরিবার যদি ভগবানের দিকে যাবার পথে বাধা হয়, তাহলে কি করব ? ঠাকুর উত্তর দিলেন -- তাকে বোঝাবে,  বুঝিয়ে তোমার ভাবে ভাবিত করার চেষ্টা করবে। ..... যদি কিছুতেই না মানে তবে তাহলে কি করব ? গম্ভীরভাবে  এর উত্তরে বললেন :: তাহলে তাকে ত্যাগ করবে।  একটু পরে ঠাকুর আবার  বললেন____ দেখ যে ভগবানের জন্য  ব্যাকুল হয় তিনি তার সব অনুকূল করে দেন। তাঁকে কাতর হয়ে প্রার্থনা করলে তিনি সব প্রতিকূলতা দূর করে দেন, বাধাবিঘ্ন সব অনুকূল হয়ে যায়।কাজেই আমরা যখন সংসারকে দোষারোপ করি তখন আত্মসমীক্ষা করি না। দোষটা সংসারের নয়, নিজেদের। জগৎটা তো বদলাবে না, যেমন আছে তেমনই থাকবে, দৃষ্টিকে বদলাতে হবে। ভগবানে অনুরাগ হলে দৃষ্টির পরিবর্তন হয়। এই হলো উপায়।

উপনিষদের একটি কাহিনী আছে, যাতে বলা হয়েছে মাটির নীচে অমূল্য সম্পদ পোঁতা রয়েছে। একজন সেই মাটির উপর দিয়েই যাতায়াত করে, কিন্ত সে সম্পদ কাজে লাগে না। কারন সেই সম্পদ সম্বন্ধে সে জানে না। জানলে তা তাঁর কাজে লাগতো। আমাদের ভিতরেও ভগবানের জন্য ব্যাকুলতা রয়েছে, কিন্ত সংসারের দিকে মন ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে সব চাপা পরে গিয়েছে। ছড়িয়ে যাওয়ার মনকে গুটিয়ে নেওয়া খুব মুশকিল।  সে চেষ্টা করার নামই হল সাধনা। এ হঠাৎ হয় না, ধৈর্য ধরে করতে হয়। এর দ্বারা মন ক্রমশ: ভগবানের দিকে যাবে। আর সেই সঙ্গে সেই পথে যাওয়ার প্রেরণা আসবে ও যাওয়ার উপায় সম্বন্ধে ধারণা হবে। 

দ্বিতীয়ত::::: সাধুসঙ্গ করা। সাধুসঙ্গ করা মানে কেবল সাধুর কাছে থাকা বা তাঁর কাছে যাওয়া নয়। তাঁকে আদর্শ বলে গ্রহন করে তাঁর জীবনকে অনুসরণ করার চেষ্টা করা।উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে  কর্মচারীরা বছরের পর বছর থেকেছে। অথচ তাদের জীবনে বিশেষ কিছুই  পরিবর্তন হয়নি।

যাঁর কাছে গেলে ভগবদ্ভাবের স্ফুরণ হয় তিনিই সাধু। যিনি যেভাবে ভাবিত, তাঁর সংস্পর্শে যারা আসে তাদের ভিতরেও সেই ভাব সংক্রামিত হয়। সেইজন্য সাধুসঙ্গ ফলপ্রসু। সাধুর সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত। তাদের দৃষ্টান্ত না থাকলে ভগবানের অস্তিত্ব মানুষের বিশ্বাসই হবে না। ভগবানকে আমরা দেখিনি, শুনিনি। সাধুর জীবনে সাধুর ভাব সজীব ও স্পষ্ট।  এই জন্য ঠাকুর সাধুসঙ্গ করতে বলেছেন।  

তবে সেই প্রেরণা গ্রহন করবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক চাই। সাধুকে অনুসরন করবার উদ্দেশ্য নিয়ে সাধুসঙ্গ না করলে সাধুসঙ্গ ফলপ্রদ হয় না। সাধুর কাছে গিয়ে বিনীত থেকে তাঁর জীবনের মধ্যে যে শিক্ষা সেই শিক্ষাকে গ্রহন করবার চেষ্টার নাম সাধুসঙ্গ। সাধুর মধ্যে ভগবানের ভাবটি মূর্ত।  তাই তাঁর সঙ্গ পেলে সেই ভাব সম্বন্ধে বিশ্বাস জন্মায়, মনে প্রেরনা জাগে এবং তাঁকে অনুসরণ করবার ইচ্ছা হয়। তবে আবার মনে প্রশ্ন হতে পারে..... সাধু ভগবানকে নিয়ে আছেন তাতে আমার লাভ কি?? আমাদের লাভ এই, তাকে দেখে আমাদের বিশ্বাস হবে যে, ভগবান আছেন, ভগবানকে ভাবলে আমাদের জীবনটা এঁর মতো পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। সাধুসঙ্গ না হলে ভগবানে বিশ্বাস আসে না। বিশ্বাস আসা বড় কঠিন।  যে বস্তুকে কখনো দেখিনি, জানি না, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ থাকবেই। কিন্ত কোনোও একজনের জীবনে তার ষ্পষ্ট প্রকাশ দেখি, ভগবানকে চিন্তা করলে জীবন কিভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় লক্ষ্য করি, তখন মনে হয় এই আদর্শ।

তৃতীয়ত::: ঠাকুর তৃতীয় উপায় বলেছেন,  মাঝে মাঝে নির্জনবাস। তাঁকে ভুলে থাকতে থাকতে আমাদের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, সংসারের স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের অনুভূতি নেই।  ঠাকুর বলেছেন  ..... কোনো  কোনো মাছ জালে পড়ে মুখ গুঁজে ভাবে বেশ আছি। জানে না জেলে এক্ষুনি তাকে হিড়হিড় করে ডাঙ্গায় তুলে আনবে, আর তার প্রান যাবে। এই হলো বদ্ধ জীব। তাই নির্জনে গিয়ে আমাদের ভাবতে হবে জীবনের উদ্দেশ্য কি? কিভাবে জীবন কাটাচ্ছি ? প্রত্যহ তো দেখছি সব চলে যাচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে, কত লোক তাদের আত্মীয় স্বজন হারিয়ে দু:খে হাহাকার করছে , আর আমরা ভাবছি ওদের হয়েছে, আমাদের হবে না। অনিত্য বোধ হচ্ছে না। সুখেও বোধ হচ্ছে না, দু:খেও না। কাজেই নির্জনে গিয়ে জীবনের পাতা গুলি উল্টে উল্টে দেখে যদি তার অসারত্ব ভাবতে শিখি তখনই ঠিক ঠিক বুঝতে পারবো জগৎ অনিত্য।  তীব্র আসক্তি সংসারের ভয়াবহ রূপ বুঝতে দিচ্ছে না----- যেন গলিত শব ফুল দিয়ে ঢাকা রয়েছে। এটি বুঝলে সংসারের প্রতি মনের টান আসবে না। সংসারের সর্বস্তরের যিনি তাঁর দিকে যখন মন যাবে তখনই আমাদের পথ হয়ে যাবে। ব্যাকুলতা যখন আসবে, তখন আর কেউ আমাদের সংসারের সুযোগে আটকে রাখতে পারবে না। ব্যাকুলতা এলেই ঈশ্বরকে সত্য বস্তু বলে মনে হয়। জাগতিক বিষয়কে তুচ্ছ বোধ করে ভগবানকে সারবস্তুবলে বোধ না হওয়া পর্যন্ত কোনও কাজ হবে না, গৃহস্থেরও নয়, সন্ন্যাসীর নয়।

No comments:

Post a Comment