নীরবতার ভাষা একটি গভীর এবং বহুমাত্রিক ধারনা। শুধুমাত্র "শব্দহীন" বলে বোঝালে হবে না কেননা এ এক অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং যোগাযোগের মাধ্যমে। এর প্রকাশ ..... একাকীত্বে, প্রত্যাখ্যান, প্রতিরোধে অথবা বলা যেতে পারে গভীর-অনুসন্ধানে। যার এক নিজস্ব ধরন বা ছন্দ রয়েছে। সাধারণত এটা ভালো বা খারাপ দুইজনের জন্য ব্যবহার করা হয়। খুব ছোট কথায় বলা যেতে পারে নীরবতা ভাষা যোগাযোগের এক বিশেষ রূপ। তবে এ ভাষার কোনো লিপি নেই। কিন্ত যে কোনো... সে দুঃখের বা সুখের বিষয় হোক না কেন , তা আলোকিত করে প্রদর্শন করবার এক সুদক্ষ যন্ত্র। নীরবতার ভাষার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হ'ল ' মায়া' যা শব্দ ছাড়া কথা বলে। আর নীরবতা তখনই কথা বলে যখন ভাষা মনের অবস্থা প্রকাশ করতে পারে না।
নীরবতার ভাষা অনুভূতির গভীরতম প্রকাশ। কোনো কথা বা শব্দ ছাড়া এটি অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারে। কখনো এটি শান্তি বা তৃপ্তির প্রতীক হয়। কখনো আবার বেদনা, বিষন্নতা বা অপ্রকাশিত অনুভুতির ইঙ্গিত দেয়। নীরবতা কখনো এমন কিছু প্রকাশ করে, শব্দের মাধ্যমে যা বলা সম্ভব নয়। তাই এটি শুধুমাত্র শব্দের অনুপস্থিত না, এটি একটি গভীর যোগাযোগের মাধ্যমে। এখানে শব্দ অপ্রয়োজনীয় হয়। তাই অনেক সময়ই দেখা যায় দুটি মানুষ একে অপরের প্রতি সহনাভুতি জানাতে "নীরব" থাকে।
বলা হয়ে থাকে নীরবতা একটি শিল্প। এটা আমাদের শব্দ ছাড়াই কথা বলতে শেখায়। কখনো কখনো এ এক শক্তিশালী আর্তনাদ বা খুব জোড়ে চিৎকারেরও সমান হতে পরে। আবার নীরবতা শক্তির এক রূপ। চিন্তাশীল এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা সব সময় কম কথা বলে । কিন্ত এর শক্তি এমন, দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে জানা যায় তাদের ব্যক্তব্য। অতীতে আমাদের মুনি ঋষিরা সমাজ থেকে দূরে থাকতেন এবং সময় ধরে নিরবে বনে প্রার্থনা ও ধ্যান করতেন। যার ফলে তাঁরা আত্মদর্শন বা সার্বজনীন গ্রহনযোগতার দর্শন, নীরবেই গড়ে তুলতে পারতেন। নীরবতা হ'ল ধৈর্যের , সহনশীলতার, তপস্যা, সত্যগ্রহের, ধ্যানের , প্রতিবাদের এক ভাষা। সেইজন্য গান্ধীজী মাঝে মাঝেই মৌন ব্রত পালন করতেন। কবিগুরু নীরবতার সমর্থনে বলেছেন..... এটাই হ'ল সবচেয়ে গভীর ভাষা, যা শব্দের চেয়েও স্পষ্ট করে হৃদয়ের কথা বলে। কাজী নজরুল নীরবতার ব্যাখ্যা এইভাবে করেছেন যে......... নীরবতা কখনো কখনো হ'ল সেই গান যা কেবল হৃদয়ের অন্তর্গত সুরে বাজে।
পশু-পাখিদের নীরবতার ভাষা ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে------- অন্য পশু-পাখিদের সাথে যোগাযোগের জন্য তারা সচরাচর কোনো শব্দ ব্যবহার না করে। তারা অঙ্গ ভঙ্গি, শারীরিক ভাষা বা অন্যান্য সংকেত ব্যবহার করে এই যোগাযোগ স্থাপন করে। পশুরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে। অনেক পশু তাদের শরীরের বিশেষ গ্রন্থি থেকে গন্ধ জড়িয়ে তাদের উপস্থিতি প্রকাশ করে। একে অপরের সাথে খেলা ও আলিঙ্গন করে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করে। আবার কিছু বিপদ বা সতর্ক বার্তা, সেই অঞ্চলের পশুদের জানানোর জন্য বিশেষ শব্দ ব্যবহার করতে থাকে। এছাড়া সাধারণ সংকেত হিসেবে আমরা দেখি___ লেজ নাড়ানো, শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করা, লোম খাঁড়া করা বা কান ঝাকানো ইত্যাদি। এসবের সাহায্যই তারা নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদান করে আর একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। তবে দেখা গিয়েছে যে বেশিরভাগ মানুষ পশুদের নীরব ভাষা বুঝতে পারে। এর ফলে পশুদের সাথে মানুষের যোগাযোগ সহজেই স্থাপিত হয়।
প্রকৃতির নীরবতার ভাষাতেও কোনো শব্দ নেই। এখানেও শব্দহীনতা...... সম্পূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ। এক গভীর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় এই অনুভূতির মাধ্যমে। তাইতো আমরা বাতাসের প্রবাহ উপলব্ধি করে, গাছের পাতার নড়াচড়া বা শুকনো ঝড়া পাতার মুচমুচ শব্দ, সমুদ্রের গভীরে ঢেউ অথবা সীমাহীন নীল আকাশের দিকে, আবার কখনো সে আকাশে ছোটাছুটি করা মেঘের দলগুলি দেখে , বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুভুতি করি। নীল উপরে বা কালো মেঘলা আকাশ আর নীচে সবুজ প্রকৃতি। মনে হয় এ বিধাতার সবচেয়ে সুন্দর রূপ। প্রকৃতির গভীরে তাকালে আমরা আরও কিছু ভাল মতন জানতে পারি। সবুজ প্রকৃতি আমাদের মনে করিয়ে যে আমরা প্রকৃতির সন্তান। বর্ষার পর প্রকৃতির সবুজ তার নতুন প্রান ফিরে পায় আর মনে হয় পৃথিবী স্নানের পর পরিস্কার হয়েছে। পাখির ডাকে মুখরিত প্রকৃতির এই আঙিনায় নতুন এক দিন শুরু করার সাথে জীবন পূর্ণতা উপলব্ধি করতে পারি। এই সব অনুভুতি সাহায্যই আমরা প্রকৃতির সাথে এক যোগসূত্র স্থাপন করি। আর্থাৎ প্রকৃতির সাথে আমাদের এক বন্ধন হয়। মনে আসে শান্তি ও স্থিরতা। যেগুলি কিনা দৈনন্দিন জীবনের চাপ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে সাহায্য করে। এই সংযোগ প্রায় সময়ই প্রকৃতির চিরন্তন সুন্দরের প্রতি আমাদের কৌতুহল বাড়িয়ে তোলে। আর স্বাভাবিক ভাবেই প্রকৃতির প্রতি আমাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। তাই বাইরের শব্দ থেকে আমাদের পালিয়ে যেতে হবে বা শব্দকে শান্ত করে প্রকৃতির গানের সুর আমাদের কাছে আসতে দিতে হবে। ধরিত্রি মাতাকে বাধাহীনভাবে তার নিজের গান গাইতে হবে। আর এই নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই শক্তি যার সাহায্যে আমরা শুনতে পারবো সেই গান আর তার সাথে নিজেদের ভিতরের গুনাগুনানি স্বরের সাথে তাল মেলানোর এক কঠোর প্রচেষ্টা করে আনন্দের স্বাদ পাবো।
মনে রাখতে হবে একজন "নীরব " বলে সে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে ভাবাটা ঠিক নয়। কেননা ঝড়ের আগে এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। বিক্ষোভে ভরা এই পৃথিবীতে , নীরবতা কেবল বিলাসিতা নয়। এরও এক বিরাট প্রয়োজন আছে। নীরব মুহুর্তগুলি আলিঙ্গন করলে, আরও ভালভাবে মনোযোগ দিয়ে বিশৃঙ্খলা নিরাময় করতে পারি বা বিশৃঙ্খলতার মাঝে ষ্পটতা খুজে পেতে পারি। শব্দে ভরা এই পৃথিবীতে , নীরবতা আমাদের মনোযোগকে তীক্ষ্ণ করে, মনের চাপ কমায়, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে ........ এগুলি সব প্রমানিত। প্রকৃতির নীরবতা আমাদের শেখায় কিভাবে শান্ত থাকতে হয়। পাখির গান থেমে গেলেও বাতাসের হাল্কা শব্দ শোনা যায়। এ শব্দেও এক শান্তি লুকিয়ে রয়েছে। বেশি কথা বললে সাধারণত মিথ্যা বলার সম্ভবনা থেকে যায়। কিন্ত নীরব থাকলে অপ্রত্যাশিতভাবে সত্যটা যেন ফুটে উঠে। এই নীরবতা গভীর চিন্তাভাবনা, ধ্যান এবং আত্মউপলব্ধির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে থাকে। সেজন্যই কিছু কিছু সংস্কৃতিতে নীরবতাকে সন্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
শেষে এখন একটাই প্রশ্ন জাগে ...... মানুষ কি মানুষের নীরবতার ভাষা বোঝে ??? এককথায় উত্তর দেওয়া যেতে পারে " না "। কিছু মানুষ হয়তো এর ব্যাতিক্রম। তবে তাদের সংখ্যা নগন্য। বলা হয়ে থাকে যে মানুষ যদি কথা না বলার মতো নীরব থাকার ক্ষমতা পেতো বা মানুষ যদি মানুষের নীরবতার ভাষা বুঝতে পারতো, তবে পৃথিবী আরও সুখি হতো। মানুষ অনেকেই পশু-পাখিদের নীরবতার ভাষা বুঝতে পারে বা প্রকৃতির নীরবতার ভাষা বুঝতে পারে । তাই তাদের সাথে এক সুখের সম্পর্ক, এক আনন্দের সম্পর্ক গড়ে উঠে সহজেই। পৃথিবীর কথা ছেড়েই দিয়ে যদি আমাদের এই ছোট মধ্যবিত্ত সমাজের দিকে তাকাই , তবে লক্ষ্য করা যায় যে নীরবতার ভাষা না বোঝার কারনেই আমাদের এতো অস্থিরতা, এতো অশান্তি, এতো উত্তেজনা, এতো ভুল বোঝাবুঝি। তাই আমরা এতো অসুখি। বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে আমাদের নীরবতা বাড়তে থাকে। অবসর জীবনে সেই নীরবতা এক বিরাট রূপ নিয়ে থাকে। কিন্ত আমরা সেই নীরবতার ভাষা পাঠ করতে পারি না। আর তারই ফলে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। অসুখি হয়ে বাকি জীবন কাটায় । এ সংসারের সুখ সাচ্ছন্দ তখন জ্বালা হয়ে উঠে। পৃথিবী ত্যাগের ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠে।







শ্রী শচীবিলাস রায় মন্তব্য করেছেন এই রকম :*:*:*:
ReplyDeleteনীরবতার ভাষা অবশ্যই "শব্দহীন", তবে কেবলমাত্র শব্দহীন নয়। ঠিকই বলেছিস নীরবতার ভাষার প্রকৃষ্ট উদাহরণ "মায়া", এছাড়াও আবেগ, সহানুভূতি ইত্যাদিকেও উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
নীরবতা যেমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়, তেমনই আবার অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে।
মৌনতা এবং নীরবতা কি এক জিনিষ? বলতে পারব না। আমার মনে হয় এই দুয়ের মধ্যে এক সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, কি তা বোঝাতে বা প্রকাশ করতে পারব না ..... হয়তো আমার ধারণা ভুল ও হতে পারে।
"মানুষ মানুষের নীরবতার ভাষা বোঝে না বা সেই কারণেই সমাজে এতো উত্তেজনা, অশান্তি, অস্হিরতা"..... ব্যাপারটাকে এতো সরলিকরণ করা কি ঠিক? কেউ যদি অন্যের নীরবতার কারণ উপলব্ধি করতে অক্ষম হয় তবে কি সে নিষ্ঠুর, অসামাজিক, অসংবেদনশীল?
সবশেষে বলি এ এক ভিন্ন স্বাদের, অন্য আঙ্গিকের লেখা। বেশ, বেশ ভালো লাগলো।