আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিকে গুরু পূর্ণিমা বলে চিহ্নিত করা হয়। এদিন মহর্ষি বেদ ব্যাসের জন্মবার্ষিকীর দিন হিসেবেও পরিচিত। প্রাচীন ভারতের হিন্দু ঐতিহ্যে মহর্ষি বেদব্যাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এদিন বেদব্যাসকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্যই গুরু পূর্ণিমাকে এতো তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পালন করা হয়।হিন্দু বিশ্বাস মতে, এই তিথিতে মুণি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর ঘরে মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদা দিতেই ব্যাস পূর্ণিমাও বলা হয়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, মহাদেব হলেন আদি গুরু। তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন সপ্তর্ষির সাত ঋষি- অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা, পুলস্থ্য, মরীচি, কেতু। আদিযোগী শিব এই তিথিতে আদিগুরু রুপে রূপান্তরিত হন। তিনিই এই সাতঋষিকে মহাজ্ঞান প্রদান করেন । তাই এই তিথি হল গুরুপূর্ণিমা। শুধু হিন্দু ধর্মেই গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য রয়েছে তা নয়, বৌদ্ধ ধর্মেও গুরুপূর্ণিমার গুরুত্ব রয়েছে। জানা যায়, বোধিজ্ঞান লাভের পরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় সারনাথে প্রথম উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ। আর সেই সময় থেকেই গুরুর স্থানে বিরাজ করছেন বুদ্ধ। ভারতের অনেক জায়গায় গুরু পূর্ণিমার দিনে মহাঋষি বেদব্যাসের জন্মতিথি হিসেবে পালন করা হয়। ঋষি পরাশর ও মত্স্যগন্ধা সত্বতীর সন্তান ছিলেন বেদব্যাস। পরবর্তীকালে তিনিই মহাঋষিতে পরিণত হন। তিনি চতুর্বেদের সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করেন। ১৮টি পুরাণ ছাড়াও রচনা করেন মহাভারত ও শ্রীমদ্ভগবত।
ভারত হল ঋষি-মুনিদের দেশ, যেখানে তাঁদের ঈশ্বরতুল্য বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ভক্তদের প্রতি ভগবান রুষ্ট হলে গুরুই রক্ষার পথ দেখাতে পারেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই দেশে গুরুদের সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছে। গুরুর দেখানো পথে চললে, কোনও ব্যক্তি শান্তি, আনন্দ ও মোক্ষ প্রাপ্ত করতে পারেন। তাই গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকেই গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পূর্ণিমায় গুরুর পূজার্চনা করলে অক্ষয় আশীর্বাদ মেলে।
হিন্দু ও বৌদ্ধদের পাশাপাশি জৈনদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর প্রথম ও প্রদান শিষ্য হিসেবে গৌতম স্বামীকে বেছে নেন। শিক্ষা ও নির্দেশনার প্রকাশকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়।
গুরু (সংস্কৃত: गुरु) হলেন নির্দিষ্ট জ্ঞান বা ক্ষেত্রের জন্য "পরামর্শদাতা, প্রদর্শক, বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষক"। সর্ব-ভারতীয় ঐতিহ্যে, গুরু শিক্ষকের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধেয়: তিনি শিষ্য বা ছাত্রের "শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব, পরামর্শদাতা, জীবনের আদর্শ, অনুপ্রেরণার উৎস, এবং আধ্যাত্মিক বিবর্তনে সাহায্যকারী"।
*শুভ গুরু পূর্ণিমার আদি কথা*
পরাশর মুনি এবং সত্যবতীর পুত্র যমুনা নদীর এক দ্বীপে জন্মগ্রহণ করলেন। দ্বীপে জন্ম, তাই সেই পুত্র দ্বৈপায়ন নামে পরিচিত হলেন।
তাঁর গায়ের রং কালো। তাই তাঁর পুরো নাম হলো কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর মার কাছ থেকে তপস্যা যাত্রার অনুমতি নিলেন।
বদরিকাশ্রমে তিনি কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন। তপস্যা বলে তিনি মহর্ষি বৈশিষ্ট্য লাভ করলেন। বদরিকাশ্রমে তপস্যার কারণে তিনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত হন।
মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মহাসমুদ্র সমান অসীম বেদকে চার ভাগে ভাগ করে সুশৃংখলভাবে লিপিবদ্ধ করলেন।
তাই তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বা বেদ ব্যাস নামে পরিচিত হলেন। 'ব্যাস' শব্দের অর্থ সংকলক বা ব্যবস্থাকারী। সমগ্র বেদকে চারভাগে বিভক্ত করে লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি এই নামে পরিচিত হলেন।
তিনি মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ, ব্রহ্মসূত্র রচনা করলেন।
মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মদিন সারা ভারতবর্ষে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে পালিত হয়।
গুরু শব্দটা 'গু' এবং 'রু'- এই দুটো শব্দাংশের যোগে তৈরি হয়। 'গু' মানে হল যে অজ্ঞানের অন্ধকারে জগৎ নিমজ্জিত থাকে। আর 'রু' মানে হল সেই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার জন্য যে আলোকের প্রয়োজন হয়। সুতরাং যিনি অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে মহান জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তির আলো দেখান তিনি হলেন গুরু।
বেদ ব্যাস তাঁর সব রচনার মাধ্যমে যা বলেছেন তা সমগ্র জগতকে জ্ঞানের আলো দেখিয়েছে। এবং সেটা চিরকালীন- আজকের দিনেও সমান ভাবে প্রযোজ্য।
এর কিছু উদাহরণ হলো-
বৃহৎ মানে জগতের মঙ্গলের জন্য যে কাজই করা হোক না কেন সেটা পুণ্য।
অন্যের প্রতি অত্যাচার,নিপীড়ন এগুলো হল পাপ।
কাউকে ভালো কর্মফল থেকে বঞ্চিত করার অধিকার স্বয়ং দেবতারও নেই।আবার কেউ যত শক্তিশালী বা জ্ঞানী হোক না কেন খারাপ কর্মের ফল তাকে ভোগ করতেই হবে।
সমগ্র জগতকে অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকে নিয়ে আসার জন্য মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বা বেদব্যাস হলেন আদি গুরু এবং তার জন্মদিন হল ভারতবর্ষে গুরু পূর্ণিমা।
"অখণ্ড মণ্ডলা কারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম।
তদপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মিলিত যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।
গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর।
গুরু রেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।"
গুরু কে?
— যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় আনয়ন করেন, তিনিই গুরু।
গুরুর কৃপায় জন্ম-জন্মান্তরের অন্ধকার বা অজ্ঞান দূর হয়ে হৃদয়কন্দর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়।
প্রাচীন ঋষিরা এই ভাবেই আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। যিনি এই ভাবে আত্মজ্ঞানের আলোক সম্পাত করতে পারেন তিনি কখনোই সাধারণ জীব হ'তে পারেন না, তিনি শিব। তাই এই জ্ঞানও মনুষ্যরচিত নয়, তা 'অপৌরুষেয়'।
এই জ্ঞানই 'আত্মতত্ত্ব', এই জ্ঞানই প্রাচীন আর্য-ভারতের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।
🙏 **শ্রী গুরু প্রণাম**🙏
ওম অজ্ঞান-তিমিরন্ধস্য জ্ঞানানঞ্জনা-শলাকায়
চক্ষুর অমিলিতম্ য়েনা তসমই শ্রী-গুরাভে নমঃ
আমি আমার আধ্যাত্মিক গুরুকে আমার শ্রদ্ধার সাথে প্রণাম জানাই, যিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, যা অজ্ঞতার অন্ধকারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, জ্ঞানের মশালের আলোয আলোকিত হউক।
🪷 *গুরু বন্দনা*🪷
*ভব-সাগর-তারণ-কারণ হে, রবি-নন্দন-বন্ধন-খণ্ডন হে,*
*শরণাগত কিঙ্কর ভীত মনে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।*
হৃদিকন্দর-তামস-ভাস্কর হে, তুমি বিষ্ণু প্রজাপতি শঙ্কর হে,
পরব্রহ্ম পরাৎপর বেদ ভণে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
মন-বারণ-শাসন-অঙ্কুশ হে, নরত্রাণ তরে হরি চাক্ষুষ হে,
গুণগান-পরায়ণ দেবগণে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
কুলকুণ্ডলিনী-ঘুম-ভঞ্জক হে, হৃদি-গ্রন্থি-বিদারণ-কারক হে,
মম মানস চঞ্চল রাত্রদিনে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
রিপু-সূদন-মঙ্গল-নায়ক হে, সুখ-শান্তি-বরাভয়-দায়ক হে,
ত্রয়তাপ হরে তব নাম গুণে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
অভিমান-প্রভাব-বিমর্দ্দক হে, গতিহীন জনে তুমি রক্ষক হে,
চিত-শঙ্কিত-বঞ্চিত-ভক্তিধনে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
তব নাম সদা শুভ-সাধক হে, পতিতাধম-মানব-পাবক হে,
মহিমা তব গোচর শুদ্ধ মনে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
জয় সদ্গুরু ঈশ্বর-প্রাপক হে, ভব-রোগ-বিকার-বিনাশক হে,
মন যেন রহে তব শ্রীচরণে, গুরুদেব দয়া কর দীনজনে।।
রচনা - দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার
➖➖➖➖♠︎♠︎♠︎♠︎■■■■☆☆☆☆♥︎♥︎♥︎♥︎¤¿
গুরু কেমন হবেন ???
এ বিষয়ে স্বামীজি শিক্ষা দেন :
*"...গুরুর মন এরূপ প্রবল আধ্যাত্মিক স্পন্দনবিশিষ্ট হওয়া চাই যে, তাহা যেন সমবেদনাবশে শিষ্যে সঞ্চারিত হইয়া যায়।*
*গুরুর বাস্তবিক কার্যই এই : কিছু সঞ্চার করা, কেবল শিষ্যের বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করিয়া দেওয়া নয়।*
*বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, গুরু হইতে শিষ্যে যথার্থই একটি শক্তি আসিতেছে।..."*
ভগবান শঙ্করই আদিগুরু। আজকের পবিত্র তিথিতে তিনি তাঁর দক্ষিণামূর্তিতে পরম আধ্যাত্মিক সনাতন জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত করেন।
তাই তাঁর স্মরণেই আজ গুরুপূর্ণিমা।
এই মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে, ভগবান রুদ্র পদদলিত করেছেন অজ্ঞানকে এবং চারজন ঋষি লাভ করছেন পরম সত্য সনাতন জ্ঞান। এই শাশ্বত জ্ঞানই ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন, আমাদের জাতীয় পরম্পরা।
- সেই রুদ্র আমাদেরকে সনাতন জ্ঞান প্রদান করুন।
সেই আদিগুরু, যাঁর স্মরণে এই গুরুপূর্ণিমা, দক্ষিণামূর্তিধারী সেই শঙ্কর মহেশ্বর শিবের প্রতি আদি শঙ্করাচার্য স্তব করে সকলে।
*_গুরু প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা, কিছু উদ্ধৃতি :_*
🌼🌼🌼
প্রতিবেশী -- 'গুরুর উপদেশ বললেন। গুরু কেমন করে পাব?"
শ্রীরামকৃষ্ণ -- *"যে-সে লোক গুরু হতে পারে না। বাহাদুরী কাঠ নিজেও ভেসে চলে যায়, অনেক জীবজন্তুও চড়ে যেতে পারে। হাবাতে কাঠের উপর চড়লে, কাঠও ডুবে যায়, যে চড়ে সেও ডুবে যায়। তাই ঈশ্বর যুগে যুগে লোকশিক্ষার জন্য নিজে গুরুরূপে অবতীর্ণ হন। সচ্চিদানন্দই গুরু।*
🌼🌼🌼
শ্রীরামকৃষ্ণ -- *"মানুষের কী সাধ্য অপরকে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত করে?*
*যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। সচ্চিদানন্দগুরু বই আর গতি নাই।*
*যারা ঈশ্বরলাভ করে নাই, তাঁর আদেশ পায় নাই, যারা ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয় নাই, তাদের কী সাধ্য জীবের ভববন্ধন মোচন করে?*
*আমি একদিন পঞ্চবটীর কাছ দিয়ে ঝাউতলায় বাহ্যে যাচ্ছিলাম। শুনতে পেলুম যে, একটা কোলা ব্যাঙ খুব ডাকছে। বোধ হল সাপে ধরেছে। অনেকক্ষণ পরে যখন ফিরে আসছি, তখনও দেখি, ব্যাঙটা খুব ডাকছে।*
*একবার উঁকি মেরে দেখলুম কী হয়েছে। দেখি, একটা ঢোঁড়ায় ব্যাঙটাকে ধরেছে -- ছাড়তেও পাচ্ছে না -- গিলতেও পাচ্ছে না -- ব্যাঙটার যন্ত্রণা ঘুচছে না।*
*তখন ভাবলাম, ওরে! যদি জাতসাপে ধরত, তিন ডাকের পর ব্যাঙটা চুপ হয়ে যেত। এ-একটা ঢোঁড়ায় ধরেছে কি না, তাই সাপটারও যন্ত্রণা, ব্যাঙটারও যন্ত্রণা!*
*যদি সদ্গুরু হয়, জীবের অহংকার তিন ডাকে ঘুচে। গুরু কাঁচা হলে গুরুরও যন্ত্রণা, শিষ্যেরও যন্ত্রণা! শিষ্যেরও অহংকার আর ঘুচে না, সংসারবন্ধন আর কাটে না।*
*কাঁচা গুরুর পাল্লায় পড়লে শিষ্য মুক্ত হয় না।”*
🌼🌼🌼
শ্রীরামকৃষ্ণ -- *"ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। গুরুর মুখে শুনে নিতে হয় -- কী করলে তাঁকে পাওয়া যায়।*
*গুরু নিজে পূর্ণজ্ঞানী হলে তবে পথ দেখিয়ে দিতে পারে।*
*পূর্ণজ্ঞান হলে বাসনা যায়, পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। দত্তাত্রেয় আর জড়ভরত -- এদের বালকের স্বভাব হয়েছিল।”*
*"মানুষ গুরু হ'তে পারে না। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে। মহাপাতক, অনেকদিনের পাতক, অনেকদিনের অজ্ঞান, তাঁর কৃপা হলে একক্ষণে পালিয়ে যায়।*
*হাজার বছরের অন্ধকার ঘরের ভিতর যদি হঠাৎ আলো আসে, তাহলে সেই হাজার বছরের অন্ধকার কি একটু একটু করে যায়, না একক্ষণে যায়? অবশ্য আলো দেখালেই সমস্ত অন্ধকার পালিয়ে যায়।*
*"যাদের একটু সিদ্ধাই থাকে তাদের প্রতিষ্ঠা, লোকমান্য এই সব হয়। অনেকের ইচ্ছা হয় গুরুগিরি করি -- পাঁচজনে গণে মানে -- শিষ্য-সেবক হয়; লোকে বলবে, গুরুচরণের ভাইয়ের আজকাল বেশ সময় -- কত লোক আসছে যাচ্ছে -- শিষ্য-সেবক অনেক হয়েছে -- ঘরে জিনিসপত্র থইথই করছে! -- কত জিনিস কত লোক এনে দিচ্ছে -- সে যদি মনে করে -- তার এমন শক্তি হয়েছে যে, কত লোককে খাওয়াতে পারে।*
*গুরুগিরি বেশ্যাগিরির মতো। -- ছার টাকা-কড়ি, লোকমান্য হওয়া, শরীরের সেবা, এই সবের জন্য আপনাকে বিক্রি করা। যে শরীর মন আত্মার দ্বারা ঈশ্বরকে লাভ করা যায়, সেই শরীর মন আত্মাকে সামান্য জিনিসের জন্য এরূপ করে রাখা ভাল নয়।”*
🌼🌼🌼
*"গুরুগিরি করা ভাল নয়। ঈশ্বরের আদেশ না পেলে আচার্য হওয়া যায় না। যে নিজে বলে, ‘আমি গুরু’ সে হীনবুদ্ধি। দাঁড়িপাল্লা দেখ নাই? হালকা দিকটা উঁচু হয়, যে ব্যক্তি নিজে উঁচু হয়, সে হালকা। সকলেই গুরু হতে যায়! -- শিষ্য পাওয়া যায় না!”*
_গুরু কে?_
*দীক্ষা প্রদান করেন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি।*
*একটি প্রদীপ থেকে আরেকটি প্রদীপ জ্বালানোর মতো একটি উন্নত আত্মা (গুরু) থেকে অপর এক অপেক্ষাকৃত অনুন্নত আত্মায় (শিষ্য) আধ্যাত্মিক শক্তির সঞ্চারই দীক্ষা।*
*বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি দীক্ষা প্রদান করতে পারেন। কোনও প্রতিষ্ঠান কখনও দীক্ষা দিতে পারে না। এমনকি যে কোনও সাধক কিন্তু গুরু হ'তে পারেন না।*
*ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দুইরকম কাঠের উপমা দিতেন :* *একরকম কাঠ হ'ল 'হাভাতে কাঠ'। এরা নিজেরা জলে ভাসতে পারে কিন্তু উপরে একটা পাখী এসে বসলে টুপ করে ডুবে যায়। অর্থাৎ এরা অপরের ভার নিতে অক্ষম।*
*আবার আর একরকমের কাঠকে ঠাকুর বলতেন 'বাহাদুরী কাঠ'। এরা নিজেরাও জলে ভেসে থাকতে পারে আবার এদের উপরে হাতি এসে বসলেও ডোবে না।*
*সাধারণ আধ্যাত্মিক সাধক যেন এই 'হাভাতে কাঠ'। এঁরা নিজের নিজের সাধন পথে অগ্রসর হ'তে সক্ষম হ'লেও অন্যকে নিয়ে যেতে পারেন না।*
*আর 'বাহাদুরী কাঠ' হ'ল সেই বিশেষ শক্তিসম্পন্ন সাধক, যাঁরা অন্যের ভার বহন করতে সক্ষম। এঁরাই গুরু।*
*'গুরু' কোনও বিশেষ 'পদমর্যাদা' নয়। 'গুরু' একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তিস্তর। তাই গুরুর যোগ্যতা কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক পদমর্যাদা দ্বারা নির্ধারিত হ'তে পারে না।* *আবার কোনও সাধক কোনও শিষ্যের গুরু হওয়ার যোগ্য হ'লেও অন্য কারও ক্ষেত্রে হয়তো তিনি গুরু হবার যোগ্য নন এমনও হ'তে পারে।*
*আধ্যাত্মিক সাধকদের অনেকের জীবনকথায় পাওয়া যায় যে কোনও গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি হয়তো বলছেন যে, 'আমি তোমার গুরু নই, তোমার গুরু অন্য কেউ।'*
*প্রকৃত দীক্ষার জন্য তাই গুরুকরণের আগে গুরুকে যাচাই করে নেওয়া উচিৎ।* *ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,*
*'সাধুকে দিনে দেখবি রাতে দেখবি।'* *দেখে-শুনে যাচাই করে তবে গ্রহণ করার কথা বলতেন তিনি।*
*এই 'দেখা শোনা'-টি ঠিক কেমন তার কিছুটা পরিচয় স্বামী বিবেকানন্দজীর জীবনীতেও পাওয়া যায়।*
*তিনি ঠাকুরকে গুরুরূপে গ্রহণের আগে যথাসাধ্য পরীক্ষা করেছিলেন।*
*তাই কাউকে গুরু রূপে গ্রহণের আগে তাঁর সঙ্গ করা উচিত, তাঁকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। দেখতে হয় তাঁর 'মন-মুখ' এক কিনা। অর্থাৎ যে আদর্শের কথা তিনি মুখে বলছেন সেটা তাঁর জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা।*
*দ্বিতীয়তঃ দেখতে হয় তিনি তত্ত্বের আক্ষরিক ব্যাখ্যার গভীরে মর্মার্থ গ্রহণে সমর্থ কিনা। স্বামীজি বলতেন, 'গুরু হবেন তত্ত্বসমূহের মর্মদর্শী।'*
*আবার উপরের দুটি শর্ত ঠিকঠাক থাকলেও তিনি আমার পক্ষে উপযুক্ত হবেন এমন নাও হতে পারে।*
*তাই তৃতীয়তঃ দেখতে হবে তিনি আমার অন্তর পড়তে পারছেন কিনা।*
*স্বামী বিবেকানন্দজিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'গুরু কাকে করতে পারা যায়?'*
*স্বামীজি উত্তর দিলেন, 'যিনি তোমার ভূত ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন তিনিই গুরু।* *দেখনা, আমার গুরু (শ্রীরামকৃষ্ণ) আমার ভূত ভবিষ্যৎ বলে দিয়েছিলেন।*
*স্বামীজি একজনকে দীক্ষা দেবার কালে প্রশ্ন করছেন, 'কোন দেবতা তোর ভাল লাগে?*
*শিষ্য একটি উত্তর দিলে স্বামীজি বললেন,*
*'তা নয়, গুরু জানতে পারেন কার কী পথ।'*
*বলে স্বামীজি ওই শিষ্যের হস্তস্পর্শ করে গভীর ভাবে ধ্যানস্থ হলেন।* *তারপর ধ্যানোত্থিত হয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, 'তুই কি কখনও ঘট-স্থাপন করে পুজো করেছিস?'*
*শিষ্যের তখন মনে পড়ল ছেলেবেলায় তিনি একবার ঘট-স্থাপন করে পূজা করেছিলেন। তিনি নিজেই বোধহয় ভুলে গেছিলেন সে কথা।*
অঁ*তখন স্বামীজি বললেন, 'এই দেবতার মন্ত্র তোর উপযুক্ত।'*
*বলে মহাবীজমন্ত্র শিষ্যের কানে উচ্চারণ করলেন।*
*আর শিষ্যটিও দেখলেন স্বামীজি ঠিকই বলেছেন৷ এই দেবতাই তাঁর আশৈশব প্রিয়।*
*এই হ'ল গুরুর ক্ষমতা। তিনি শিষ্যের অন্তর দেখতে পান, সেখানে দেখতে পান তার অতীত সংস্কাররাশি। আর সেই সংস্কার অনুযায়ী শিষ্যকে ভবিষ্যতের পথে পরিচালিত করেন।*
*সুতরাং যে গুরু শিষ্যকে চেনেন না, শিষ্যের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত কিছুই জানেন না; তিনি আর যাই হোন ওই শিষ্যের গুরু হ'তে পারেন না।*
*শিষ্য এগুলো দেখে নিতেই পারে। তার জন্য তাকে গুরুর সমান ক্ষমতাবিশিষ্ট হ'তে হয়না।*
*তার হৃদয়ই বলে দেয়, 'ইনিই আমার গুরু।'*
*আরও একটি সহজ পন্থা আছে সঠিক গুরু নির্বাচনের। সেটা হ'ল সম্পূর্ণরূপে ইষ্টের শরণাগত হয়ে ইষ্টের কাছেই সঠিক গুরুলাভের জন্য প্রার্থনা।*
*প্রার্থনা আন্তরিক হ'লে ও দীক্ষালাভের তৃষ্ণা প্রবল হ'লে ইষ্টই গুরু জুটিয়ে দেন, গুরুর মধ্যে দিয়ে তিনিই কৃপা করেন ; কারণ সেই শরণাগত ভক্তের ভার স্বয়ং ভগবান বহন করেন।* *'যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।'*








