Tuesday, 28 December 2021

আশেপাশের স্বাধীনতার পাঠ

 

 " স্বাধীনতা " তোমার  আমার 


স্বাধীনতা একটা অনুভূতি। সমস্ত রকম দায়বদ্ধতা এবং কোলাহলের উর্দ্ধে এক অমোঘ প্রাপ্তি। "স্বাধীনতা" শব্দটা শুনলেই যেন মনে হয় মাথার উপরের আকাশটা আরও কয়েকগুন বেড়ে গেল। বুকের ভেতর "স্ব" অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে বাঁধ_ভাঙ্গা অক্সিজেন।  একটা বড় নদী, একটা নাক উচু পাহাড় বা আদিগন্ত বিস্মৃত বনানী যেখানে কোনো বেড়াজাল নেই।  নেই কোনো সীমান্ত।  

স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তর ২৪পরগনার নাম। ইতিহাসের অনেকগুলি পাতাই এই জেলা দখল করে রেখেছে। 


স্বাধীন শব্দের আক্ষরিক মানে নিজের অধীন। অন্যের শাসন না মানাই কি তাহলে প্রকৃত  স্বাধীনতা ?? না কখনোই  না। তাই যদি হতো তাহলে তন্ত্র ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা --- যেমন রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, বা গনতন্ত্রের তো সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে সামিল হবার কথা ছিল না। তাই  মাথার ওপর সবসময় মুরুব্বি গোছের কাউকে দরকার।  

তবে নি:সঙ্গতা বা একাকীত্বের সাথে স্বাধীনতার মানে গুলিয়ে ফেলার পরিসরও দিন দিন খুব কমে আসছে। স্বাধীনতার মানে কখনোই একচোরা হয়ে থাকা নয়। আমাদের দেশের মূল মন্ত্র যেমন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য তেমনি বাস্তব জীবনে স্বাধীনতার Jআক্ষরিক অর্থ হলো___ নানান কাজ,  অগুনিত লোক, বহু ভাষা, নাগরিক কোলাহল, গ্রামীন আন্তরিকতা আর প্রতিযোগিতার অন্তহীন দৌড়ঝাপের ফাঁকে ফাঁকে নিজের জন্য বাঁচার মতো টুকরো টুকরো সময় বের করে নেওয়া।

সময়েরই আসলে বড় অভাব আজকের ইন্টারনেটের যুগে। গতির পিছনে মানুষ ছুটছে, না মানুষ গতির পিছনে ধাওয়া করে সময়ের আগেই হাঁপিয়ে উঠছে বোঝা দায়। তাই বড় আকাশটা ধূলোয় আর হাই রাইজে ঢেকে গেছে। মরচে ধরা রেলিঙে আর নতুন নতুন পাখি আসে না। বুক ভরে অক্সিজেন আর নেওয়া হয় না। সেখানেও বিধিনিষেধর ঘেরাটোপ। সময় কই ? নিজের জন্য বাঁচার স্বাধীনতাই বা কতটুকু আছে আমাদের  ? শেষ কবে গলা ছেড়ে গান গিয়েছিলেন মনে পড়ে কি ???

ব্যারাকপুরের  গান্ধী ঘাট  


ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামের নানা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার  ব্যারাকপুর শহর। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই ব্যারাকপুর শহরেও ছিল  মহাত্মা গান্ধীর বিচরন। কম বেশি পাচঁ বার তিনি এখানে এসেছিলেন।  

রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে তাঁর বাড়ীতে দু'বার এসেছিলেন  মহাত্মা গান্ধী ব্যারাকপুরে । একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে গঙ্গাপাড়ের ফ্ল্যাগস্টাফ হাউস বর্তমানে যেটি গভর্নর হাউস বলে পরিচিত সেখানে এসেছিলেন গান্ধীজী। সেখানে দুজনের দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। 


যেহেতু গান্ধীজী বার বার ব্যারাকপুরে এসেছিলেন,  তাই তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভষ্ম ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।  তারপর থেকেই যা গান্ধীঘাট নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীকালে সেখানে স্মৃতিসৌধও তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি যার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু। গান্ধীজয়ন্তী, ২৬শে জানুয়ারি , ১৫ই আগষ্ট নিয়ম করে সেখানে রাজ্যপালের উপস্থিতিতে গান্ধীজীকে স্মরণ করা হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পাশে গান্ধী মিউজিয়ামও করা হয়েছে, যেখানে গান্ধীজীর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষিত করে রাখা আছে।


সেনানী  মঙ্গল পান্ডের স্মৃতিবাহক ব্যারাকপুর  ***


মঙ্গল পান্ডে, সামান্য একজন ভারতীয় সিপাহী, সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গর্জে উঠেছিলেন।  তাঁরই তৈরি স্ফুলিঙ্গে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে দেশ জুড়ে জমা হওয়া বারুদে। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যাবে , সিপাহি বিদ্রোহ হয়ত সফল হয়নি ঠিকই, কিন্ত  পরবর্তী সময় ভারতের সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয় সেইসময় থেকেই। 



তাই সেনানী মঙ্গল পান্ডের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে ব্যারাকপুরের নাম। এই ব্যারাকপুরের মাটিতেই তাঁকে ফাসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন ব্রিটিশ বাহিনী। যেখানে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল  সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর মূর্তি। তাঁর নামে রয়েছে উদ্যান,  রাস্তাও। স্বাধীনতা দিবসের 


প্রাক্কালে আরও বেশিকরে উচ্চারিত হয় মঙ্গল পান্ডের নাম। ব্যারাকপুরের গঙ্গা তীরবর্তী তাঁর নামাঙ্কিত  "মঙ্গল পান্ডে উদ্যান " -- এর নাম সর্বজনবিধিত।  নিয়ম করে তাঁর পরিচর্যা করা হয় স্থানীয় প্রশাসনের তরফে। পরিষ্কার করা হয় তার মূর্তিও  সরকারি স্তরে গঙ্গা তীরবর্তী ওই জায়গাকে ঘিরে আরও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনাও রয়েছে। 






ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নতুন রাইফেলের কার্তুজের ব্যবহার নিয়ে সিপাহিদের মধ্যে তৈরী হয় দ্বন্দ্ব।  ভারতীয় সিপাহীরা ওই নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। সেই


 ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূচনা হয় সিপাহি বিদ্রোহের।  তৎকালীন ব্যারাকপুরের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মঙ্গল পান্ডের হাত ধরেই সেই বিদ্রোহ সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। ইতিহাসবিদের একাংশ ১৮৫৭ সালের এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপেও দেখেন।



সে বছর  ২৯শে মার্চ মঙ্গল পান্ডের ডাকে ব্রিটিশ শাসনকে ভেঙে ফেলতে ব্যারাকপুরের প্যারেড গ্রাউন্ডে ভিড় জমিয়েছিল ভারতীয় সিপাহীরা। বিরোধিতা করায় তাঁর হাতে মৃত্যু হয়েছিল এক ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট ও এক সার্জেন্টের। 


ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মঙ্গল পান্ডে। অসুস্থ অবস্তায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেই সৈন্যদের সামনে ওই বছরের ৮ই এপ্রিল তাঁকে ফাসি দেওয়া হয়। বীর শহিদের মর্যাদায় ব্যারাকপুর আজও সশ্রদ্ধায় মনে রেখেছে মঙ্গল পান্ডেকে।





~°সোদপুরের গান্ধী আশ্রম °~ 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সোদপুরের এই খাদি প্রতিষ্ঠান। অনেক ঘটনার সাক্ষীও এই আশ্রম। সোদপুর ষ্টেশনের ধারেই। সবরমতী আশ্রমের মতোই  সোদপুর আশ্রম।  সেজন্য হয়ত  গান্ধীজী এটিকে তাঁর  দ্বিতীয় বাড়ী বলেছিলেন।  


ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে এই খাদি প্রতপ্রতিষ্ঠানের  গুরুত্ব অপরিসীম।  একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও জাতীয় নেতারা নিয়েছিলেন এই খাদি প্রতিষ্ঠানে বসেই। বিদেশী দ্রব্য বর্জন  বা আকাশবানীতে প্রথম ভাষণ এই খাদি প্রতিষ্ঠান থেকেই দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। 





বেঙ্গল কেমিক্যালসের চাকরি ছেড়ে ১৯২৪ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্নেহভাজন ও আচার্য প্রফুল্ল রায়ের সহযোগী শ্রী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত এই  খাদি প্রতিষ্ঠানটি তৈরী করেছিলেন।  মোট জমির পরিমাণ ছিল  ২৪ বিঘা। লক্ষ্য ছিল,  গান্ধীজীর আদর্শ মেনে দেশিয় বস্ত্রের উৎপাদন বাড়াতে হাতে কাটা চরকায় সুতি, খাদি কাপড়ের মতো বিভিন্ন জিনিস তৈরী করা হবে। এছাড়াও  ডাক্তারখানা , ছাপাখানা, গো পালন, পশুচিকিৎসা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সবই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের জমিতে। গান্ধীজী এই প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে জানার পর নিজেই আসেন এবং পরবর্তী কালে ১৯২৭ সালের ২রা জানুয়ারি তিনি এর উদ্বোধন করেন।  সেদিন উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্তরের অনেক নামজাদা ব্যক্তিত্ত্ব  যার মধ্যে মতিলাল নেহেরু উল্লেখযোগ্য। 



শুধু উদ্বোধনে আসা নয়। পরবর্তীকালে প্রায়ই গান্ধীজী এই প্রতিষ্ঠানে এসেছেন।  তাঁর কথায় এই প্রতিষ্ঠানকে তাঁর দ্বিতীয় গৃহ বলে ধরতেন। এখানে বসেই স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন।  তাই দিনে দিনে জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই  খাদি প্রতিষ্ঠান। নেতাজীও এসেছিলেন এখানে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সাংগঠনিক কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান থেকেই।  ১৯৩৯ সালের মার্চে ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরে সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে তিন দিনের ঐতিহাসিক বৈঠকে বসেছিলেন গান্ধীজী এই প্রতিষ্ঠানেই। তারপরই কংগ্রেস ছাড়েন নেতাজী। শুধু তাই নয়, নেতাজী কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান চত্বর থেকেই শেষ সাংবাদিক বৈঠক করেন। 




সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো স্বাধীনতা আন্দোলনের বড় বড় সব নেতাই এখানে এসেছেন এবং রাত্রিবাস করেছেন।  ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি দাঙ্গার আগে সোদপুরের এই প্রতিষ্ঠানেই ছিলেন গান্ধীজী। দাঙ্গার খবর পেয়ে এই সোদপুর থেকেই নোয়খালির উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে ফের সোদপুরেই ওঠেন তিনি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে স্বাধীনতার ঠিক আগে বাংলা বিহারের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা নিয়েও গান্ধীজীর উপস্থিতিতে আলোচনা হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানে। ফলে এই খাদি প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস।  




ইতিহাস বুকে নিয়ে বিস্মৃত সোদপুরের এই গান্ধী আশ্রম।  যে আশ্রমের শুরুটা সেই ব্রিটিশ আমলে।আজ একা একা দাড়িয়ে। গোটা এলাকা অর্থাৎ গান্ধীজীর দ্বিতীয় গৃহেই এখন যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। একসময়ের সাজানো বাগানে আজ অবহেলার ঝোপঝাড়। ঘরের দেওয়াল বেয়ে উইয়ের সারি। বাড়ির  দালানে এখন কুকুরের বিশ্রাম।  এ বাড়ি এখন ব্রাত্য, পরিত্যক্ত। জীর্ন তার চেহারা। সংস্কারের অপেক্ষায়।  গান্ধীজী-নেতাজী-নেহেরু সহ বিভিন্ন নেতাদের ছবি বিভিন্ন ঘরে লাগানো রয়েছে। সেসব ছবিসহ  ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এত সব ইতিহাস বুকে নিয়েই একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে গান্ধীজীর দ্বিতীয় গৃহ। 


#$ থানায়  সংরক্ষিত  রয়েছে  নেতাজীর  সেল  #$

সালটা ছিল  ১৯৩১। দিনটা ছিল ১১ই অক্টোবর।  জগদ্দলের ঘোলঘরে বঙ্গীয় পাটকল শ্রমিক সংগঠনের সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভাষন দিতে যাচ্ছিলেন।  ব্রিটিশ পুলিশ ভেবেছিলো নেতাজী বক্তব্য রাখলে শ্রমিকেরা ইংরেজ শাসনের উপর আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। সেই আশংকা থেকেই ঐ দিন ভাষন দিতে যাওয়ার পথে বর্তমান শ্যামানগর চৌরঙ্গী কালীবাড়ীর সামনে নেতাজীর পথ আটকান নোয়াপাড়ার থানার তৎকালীন  ইন্সপেক্টর ম্যাকেঞ্জী। নেতাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। একটি ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়।



খবর মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে চারদিকে। নেতাজী না আসায় ভন্ডুল হয়ে যায় জগদ্দলের সভা। নেতাজীকে আটকানোর খবরে শয়ে শয়ে মানুষ নোয়াপাড়ার থানার সামনে ভিড় জমাতে থাকেন। থানার বাইরে ক্ষুব্ধ জনতা নেতাজীকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন বারবার।পুলিশ কিছুতেই রাজী হল না। ১০ ফুট বাই ৮ ফুটের সেলের মধ্যে নেতাজীকে আটকে রাখা হল। এসব দেখে সাধারণ মানুষ তো বটেই,  পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল  এদিকে নেতাজী থানায় ব্রিটিশ পুলিশের দেওয়া কোনো জিনিসই মুখে তুললেন না। বাইরে যারা নেতাজীর জন্য দাড়িয়ে ছিলেন   তাঁরই চা পাঠান।  সেদিন নোয়াপাড়ার থানার সেলেই সারা রাত কাটে নেতাজীর।  খবর পেয়ে পরদিন সকলে নেতাজীর দাদা শরৎচন্দ্র দেখা করতে আসেন।  কিন্ত তাঁকেও  ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। শেষে ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক ওয়ার্থ সাহেবের হস্তক্ষেপে ১২ই অক্টোবর মাঝ রাতে নেতাজী ছাড়া পান।  তবে মুক্তির একটাই শর্ত ছিল, দু মাস নেতাজী নোয়াপাড়ায় ঢুকতে পারবেন না।

যে সেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল সেই সেলের আজ অন্য কদর। সেলটিকে আজও সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে সেদিনের ব্যাবহৃত চায়ের কাপ  প্লেট। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে ভগ্নাবস্থায় পরে থাকা সেলটিকে সারানো হয়। সাদা টাইলস লাগানো হয়। রঙে সাজিয়ে তোলা হয় সেলটিকে। ২৩ জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিনে ওই সেলে নেতাজীর প্রতিকৃতিতে ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নোয়াপাড়ার থানার পুলিশ।  পাশাপাশি থানা চত্বরে নেতাজীর মূর্তিতে ফুল দেওয়া হয়। পুরোনো রীতি অনুযায়ি বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে নেতাজীর জন্মের মুহূর্তে দু মিনিট ধরে সাইরেনও বাজানো হয়। ১৫ই আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা দিবসেও নোয়াপাড়া থানার তরফে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়।


**  কেবল   স্মৃতিফলকের    বাহক  তিতুমিরের গ্রাম  **





সৈয়দ মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমির। বাবা হাসান আলি , মা আবিদা রোকেয়া খাতুন। অবিভক্ত ২৪ পরগনার বাদুরিয়ার চাঁদপুরের কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। জন্ম  ১৮৭২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি। গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে  আন্দোলনের  এক বিপ্লবী  যিনি ওয়াহাবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  ছোট বেলায় স্কুলের পাঠ শেষ করে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর জমিদারের লাঠিয়াল হয়ে কাজ শুরু করেন। একাধারে জমিদারের লাঠিয়াল , অন্যদিকে পালোয়ান হিসাবে এলাকায় তার বেশ নাম যশ ছিল।  জমিদারের খাজনা আদায় বা নীলচাষে ব্রিটিশরা কিভাবে গরীব চাষিদের বাধ্য করত ---- এগুলি সবকিছুই তিনি লখ্য করতেন। 




১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে আরবের স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাক আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এব পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। 



তিতুমির ছিলেন দূরদর্শী। বাঙ্গালিদের একত্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে নিজহস্তে বাঁশ তুলে নেন ও সবার হাতে বাঁশ তুলে দেন। যখন বাঙ্গালিরা হাতে বাঁশ ধারন করত তখন তাদের কাছে মনে হত যে তাদের হাতে আছে পারমানবিক বোমার রিমোট কন্ট্রোলার। যে কোনো সময় শুধু বাটন প্রেস করবে আর ইংরেজ জাতি হয় মাটির তিনহাত নিচে চলে যাবে, নয়তো সরাসরি ঊর্ধ্বগগণে। এই বাঁশের কারণেই তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছে। 

 এমনিতেই বাদুরিয়ার ইচ্ছামতী নদী সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর বাঁশ হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সেই বাঁশ ও কাদা দিয়ে কেল্লা তৈরী করেন নারকেলবেড়িয়া গ্রামে। বাঁশের তৈরী কেল্লার কাজ শেষ হয় ১৮৩১ সালের মাঝামাঝি। এরপর ২৪ পরগনা , নদিয়া ও ফরিদপুরের কৃষকদের একত্রিত করে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। স্থানীয় জমিদার ও বৃটিশ বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম।  এলাকার ৮৩ হাজার কৃষক তিতুমির পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন।  যাঁর মধ্যে ছিলেন তিতুমির তৈরি কয়েক  হাজার লাঠিয়াল।  


তিতুমির বাহিনীর সঙ্গে সন্মুখ সমরে কয়েকবার পিছু হঠে ইংরেজরা। শেষে ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে নারকেবেরিয়ার তিতুমির বাঁশের কেল্লা ঘিরে ধরে ব্রিটিশ বাহিনী। ১৯শে নভেম্বর কর্নেল হার্ডিংয়ের নেতৃত্বে ইংরেজরা ভারী অস্ত্র দিয়ে গুড়িয়ে দেয় বাঁশের কেল্লা। অনেকের সাথে শহিদ হন তিতুমির।  তাঁর বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুম ধরা পড়েন। পরে তাকে ফাসি দেওয়া হয়। 

বাদুরিয়ার নারকেবেরিয়া গ্রামে আজ আর বাঁশের কেল্লার অবশিষ্ট কিছুই নেই।  কেবল তিতুমির একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তিতুমির বংশধরদের। তিতুমির বংশের বর্তমান প্রজন্ম মদত আলি বলেন  " বেশ কয়েক বছর আগে নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমির একটি স্মৃতিফলক তৈরি হয়েছিল।  তখন ঘটা করে বলা হয়েছিল তিতুমির বংশধরদের সন্মান দেওয়া হবে। বাগজোলা পঞ্চায়েতকে তিতুমির পঞ্চায়েত নাম দেওয়া হবে। শহিদের স্মৃতি বিজরিত চাঁদপুর ও নারকেলবেড়িয়া  আদর্শ  ও মডেল গ্রাম হিসাবে গড়ে তোলা হবে। কিন্ত কেউ কথা রাখেনি। তিতুমির বংশধরেরা এখন দিনমুজুরের কাজ করে। তাঁর বংশধরদের কোনও  সন্মান দেওয়া হয়নি।"


বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশদের সঙ্গে তিতুমির লড়াই ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সেই বাঁশের কেল্লা এখন তো আর নেই।  ইংরেজরা পুরোপুরিই ধ্বংস করে দিয়েছে। রয়েছে তিতুমির স্মৃতিফলক। সেটার  সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত।  কিন্ত  শুধু স্মৃতিফলকেই আটকে রইল কেন শ্রদ্ধাঞ্জাপন  ?? এ প্রশ্ন অনেকের। 


$$ বন্দেমাতরম্ স্তোত্র  :-:  জাতীয়তাবাদের  মহামন্ত্র  $$ 


বন্দে মাতরম্ (  অর্থাৎ  "বন্দনা করি মায়"বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান। সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত এই গানটি দেবী ভারত মাতা বন্দনাগীতি এবং বাংলা মা তথা বঙ্গদেশের একটি জাতীয় মূর্তিকল্প। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম্ গানটিকে "বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত" ("National Anthem of Bengal") বলে উল্লেখ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

কালচক্রের গতিতে একসময় এ পূণ্যভূমিতে পা পড়েছে একদল বিদেশী ইংরেজ বণিকের। যারা এদেশের মাটিতে ব্যাবসায়ী সেজে ব্যাবসা করতে এসে ছলনার সাহায্যে এদেশের বুকে বসিয়েছে ছুরি। ব্যাবসায়ী হয়েছে দেশের শাসক, লুঠ করেছে দেশের সম্পদ।” বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে পরিণত হয়েছে।” সোনার ভারতবর্ষ হয়েছে পরাধীনতার শিকল বদ্ধ। সর্বালঙ্কারভূষিতা জগদ্ধাত্রী পরিণত হয়েছেন শ্মশানচারিণী নগ্নিকা মা কালী।



ইংরেজ শাসনের চরম অত্যাচারে ভারতবর্ষের বিভিন্ন  প্রদেশে নেমে এসেছে হাহাকার। বঙ্গদেশে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ – যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসী বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেও ব্যর্থ হয়, সিপাহী বিদ্রোহ তার উদাহরণ। এক ভূখন্ডে বসবাসকারী মানুষকে এক সূত্রে আবদ্ধ না করতে না পারলে সে ভূখন্ড কখনই দেশ হয়ে ওঠে না। সেই দেশ যদি পরাধীন হয়, তাহলে তার স্বাধীনতা লাভের পথে এগোনোর জন্য জনগণকে এক বলে বলীয়ান হতে হবে। দীক্ষিত হতে হবে এক মন্ত্রে। বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই মন্ত্র দেন দেশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সাহিত্য সম্রাট ঋষি  বঙ্কিমচন্দ্র  চট্টোপাধ্যায়। আর সে মহামন্ত্রটি হলো ‘আনন্দমঠ’উপন্যাসের  ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ একাধারে স্বদেশমন্ত্র এবং স্বদেশসংগীত। বন্দেমাতরম্ মন্ত্র উচ্চারণ করেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর প্রভাত- লগ্নে বঙ্কিমচন্দ্রের সপ্তকোটি দেশের মানুষ প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্দে মাতরম্’-ই ছিল অখণ্ড ভারতের সমবেত স্বদেশ-সংগীত।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই বন্দেমাতরম্ স্তোত্রে যেন জাতীয়তার মহামন্ত্রে দীক্ষিত  হয়ে উঠেছিল আপামর ভারতবাসী। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে নৈহাটিতে সাহিত্য সম্রাটের জন্মভিটায় সেই  স্তোত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে স্মরণ করা হয় ভারতমাতার বীর যোদ্ধাদের।  



নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় জন্ম  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে এখানেই।  ১৮৮২ শে সালের বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আনন্দমঠ উপন্যাসে বন্দমাতরম্ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেস বন্দেমাতরমকে জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রকাশ কালে কাঁটালপাড়ার বৈঠকখানায় বসত সাহিত্যের আসর। যার পোশাকি নাম ছিল  " বঙ্গদর্শনের মজলিশ "। যেখানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নবীনচন্দ্র সেন, দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার , চন্দ্রনাথ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের মতো সাহিত্যিকেরা উপস্থিত থাকতেন।  বর্তমানে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বাড়ির শুধু সংরক্ষণই হয়নি, সংগ্রহশালার পাশাপাশি এখন তা বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।



কাঁটালপাড়ার বসতবাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত খাট, কাঠের আলমারি যত্নে রাখা আছে। সেই সময়কার বড় দেওয়াল ঘড়ি শোভা পাচ্ছে। রাখা রয়েছে যুবক বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছেন দেবীর দু'টি ছবি। বসতবাড়ির উত্তর পশ্চিম দিকে যেখানে বঙ্কিম পরিবারের সূতিকাগৃহের সন্ধান মিলেছিল,  সেখানে নির্মিত হয়েছে টেরাকোটা শোভিত চারচালা শৈলির দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। বসতবাড়ির দক্ষিনে যেখানে " বঙ্গদর্শনের মজলিশ "  এর আসর বসত, বৈঠকখানার সেই হলঘরটি এখন পুরোটাই বঙ্কিম সংগ্রহশালা। যেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত পাগড়ি,  শাল, সেজবাতি,  দাবার ঘুড়ি, তাঁর পরিবারের গানের স্বরলিপির খাতা, বংশ তালিকা, তাঁর পবিত্র অভিঞ্জান শকুন্তলমের  পুঁথি,  বঙ্গদর্শনের ক্যাশবাক্স সহ অসংখ্য নথি রাখা হয়েছে। 






বৈঠকখানার পাশেই বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার ঘর ও পরের একটি ঘর বিশ্রামকক্ষ। তাঁর লেখার ঘরে নানা নথির প্রতিরুপের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত কাঠের চেয়ার ও টেবিলের রেপ্লিকা রাখা রয়েছে। পাশাপাশি বঙ্কিমভবনের গ্রন্থাগারে বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর পরিজনদের পঠিত বঙ্গদর্শন, প্রচার, ভ্রমর, নবজীবন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, পঞ্চপুষ্প, মানবর মতো গ্রন্থ যেমন রয়েছে, তেমনই বঙ্কিমচন্দ্র ও বাংলার সমাজ, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার উপযোগী প্রায় ১৪ হাজারের বেশি বই সেখানে রয়েছে, যা এখনও অনেকের অজানা। এ বার একটি নতুন ভবন তৈরি করে সেখানে পাঠাগার স্থানান্তরের পাশাপাশি পৃথক গ্যালারি করে বঙ্কিমচন্দ্রের সময়কার তাঁর পরিবার-পরিজন এবং অন্যান্য মনীষীর ছবি ও তাদের ব্যবহৃত দুর্লভ জিনিস প্রদর্শিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।




বঙ্কিম গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ রতনকুমার নন্দী জানিয়েছেন " আলোকসজ্জা দিয়ে বাড়ির বাইরেটা সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।" তিনি আরও জানালেন বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বঙ্কিম ভবনে প্রতিবছর বন্দেমাতরম্ স্তোত্র পাঠের মাধ্যমেই স্বাধীনতা দিবসে পালন করা হয়।





#$# অনাদরে  হারিয়ে  যাচ্ছে  বিশ্বযুদ্ধের  সেই  ইতিহাস  ::**:: অশোকনগেরের  বিমানবন্দর  #$# 

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে ।  পরাধীন ভারতের অশোকনগরে বিমানবন্দর বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। অশোকনগর পুরসভার নিউ মার্কেট,  গোলবাজার, গণেশ ভান্ডার,  চৌরঙ্গি, ১/৩ মোড় নিয়ে ছিল  সেই বিমানবন্দর।সবমিলিয়ে কয়েক বর্গ কিলোমিটার গড়ে উঠেছিল বিমানবন্দর।  যুদ্ধ বিমান রাখার জন্য বানানো হয়েছিল চারটি হ্যাঙ্গার। স্থানীয় প্রবীণ লোকজন তাদের বাপ-ঠাকুরদার থেকে গল্প শুনেছেন, যে এখানে একসময় মিলিটারিদের বুটের শব্দে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকত। জওয়ানরা নিয়ম করে রুট-মার্চ করত।মিলিটারিদের জন্য ছিল বেস ক্যাম্প। রানওয়েতে যুদ্ধবিমানের উঠানামা লেগেই থাকত।  পুরসভার হরিপুর এলাকা থেকে গোলবাজার,  আবার ১/৩ মোড় থেকে কুয়াশার মোড় পর্যন্ত ছিল বিমানের উঠানামার রানওয়ে। কিন্ত কালের নিয়মে সে সবই অবহেলায়,  অনাদরে আজ অস্তমিত। ইতিহাসের সাথে লেপ্টে থাকা সেই সময়কার সবকিছুই আজ জবরদখল হয়ে গেছে। বর্তমান ঘোষপাড়ায় চারটি হ্যাঙ্গার এখন খাটাল হয়ে গিয়েছে। গরু মোষের আস্তানা। হ্যাঙ্গারের চারদিকে জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। যেখানে রানওয়ে ছিল সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। রানওয়ের  টিকি মেলাও ভার।



আসলে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সইতে হয়েছিল দেশভাগের যন্ত্রনা। দেশভাগের পর বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগেই গড়ে উঠে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত আজকের অশোকনগর।  পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের একটা বড় অংশ মাথা গোজার ঠাই করেছিলেন এখানে। এরপর ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকে। ইতিহাসকে  বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনটুকু সেই সময় কারো মাথায় সেভাবে আসেনি। ফলে ইতিহাসে অশোকনগেরের নাম এভাবে জড়িয়ে থাকলেও, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কিছুই দেখানোর থাকছে না। স্মৃতিরক্ষার কোনও নিতে দেখা যায়নি অশোকনগর-কল্যানগড় পুরসভাকে। চেষ্টাও হয়নি জবরদখল মুক্ত করার।  ফলে অনাদরে, অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই  ইতিহাস।  অথচ সংরক্ষণের একটু উদ্যোগ নিলে সংহতি পার্ক, মিলেনিয়াম পার্কের সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অশোকনগরে বৃটিশ সরকারের তৈরি যুদ্ধবিমান রাখার হ্যাঙ্গারগুলিও অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারত বলে মনে হয়। এ বিষয়ে পুর প্রশাসক জানালেন " বৃটিশ আমলের সম্পত্তি এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্ত কোনো কাজেও লাগছে না। ঘোষপাড়ার কিছু মানুষ ওখানে গরু মোষের খাটাল করেছেন। ফলে সমস্যা একটা হয়েছে। আমরা কথা বলার চেষ্টাও করছি। সমাধানের খোঁজ চলছে, যদি এই হ্যাঙ্গারগুলি সংরক্ষন করা যায়। আমরা ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই চায়।"


দমদম থেকে ৫০ কি মি দূরে অশোকনগরে বিমানবন্দর বানাতে হয়েছিল।  তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। কিন্ত পরাধীন ভারতের সেই বিমানবন্দরের কোনও অস্তিত্বই আর টিকে নেই।  রানওয়ে বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই।  গোটাটাই পাড়া। এলাকার প্রবীণ মানুষজনের প্রশ্ন,  ইতিহাসকে আগামীর কাছে তুলে ধরার কোনও উদ্যোগ কি আমরা নেব না ??




Friday, 19 November 2021

পঞ্চমুন্ডীর আসনের সম্বন্ধে

 



পঞ্চমুন্ডীর আসন।

🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺

পঞ্চমুন্ডীর আসন কি?

#পঞ্চমুন্ডীর আসন কি ভাবে তৈরি করা হয়?

#পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে ধ্যানের উপকারিতা কি? 

স্বীকারোক্তি:-

                    গোড়াতেই স্বীকারোক্তি করি যে, পঞ্চমুন্ডীর আসন তৈরী করা অতোটা সহজ কাজ নয়। অনেক অনেক সাধ্য সাধনা করে, অনেক কষ্ট করে একটা পঞ্চমুন্ডীর আসন তৈরী করতে হয়।

             পঞ্চমুন্ডীর আসন সাধারণত তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই তন্ত্র সাধনায় নারী ও পুরুষ কিন্তু বসে সাধনা করতে পারেন। কেবলমাত্র গুরুদেবের আদেশ ছাড়া এই পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসা উচিত নয়। আর কেউ যদি শখ করে গুরুদেবের আদেশ ছাড়া এই আসনে বসে ধ্যান করেন তবে তিনি হয় উন্মাদ না হয় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আমি বেশ কয়েকটি পঞ্চমুন্ডীর আসন দেখেছি সেগুলি কিন্তু নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।

উপাদান:- 

(১) একটি অপঘাতে মৃত্যুু চন্ডালের মাথা,

##########################

কারন, চন্ডালের কাজ হলো হিন্দুদের মৃতদেহ দাহ করে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেওয়া। এমন একটা চন্ডাল বা চাঁড়ালের মাথা, যার মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে অর্থাৎ সাপের কামড়ে, বিষ খেয়ে, গলায় দঁড়ি দিয়ে, এ্যাক্সিডেন্টে অথবা আগুনে পুড়ে।

(২) একটা সাপের মাথা।

#################

সাপ হলেই হবে না, বিষধর সাপ অর্থাৎ কেউটে বা গোখরো এমন সাপ চাই, যে সাপ ফনা ধরতে পারে এবং খুব বিষধর। কারন, সাপ হলো হিংস্রতার প্রতীক, তাই এমন সাপের মাথা নেওয়া হয়।

(৩) একটা বেজী বা নেউলের মাথা।

######################

কারন, বেজী বা নেউল হলো ক্ষিপ্রতার প্রতীক। তাই ক্ষিপ্রতার প্রতীক হিসেবে বেজীর মাথা নেওয়া হয়।

(৪) একটা শৃগাল বা শেয়ালের মাথা।

#######################

কারন, সমস্ত পশুদের মধ্যে শেয়াল সবচেয়ে ধূর্ত বা চালাক। সাধনা তে শীঘ্র সিদ্ধিলাভ করার জন্য শেয়াল বা শৃগালের মাথা নেওয়া হয়।


(৫) একটা হনুমানের মাথা  অথবা বানরের মাথা।

#################

কারন, হনুমান হলেন ব্রহ্মজ্ঞানী, ধীর,স্থির তাই সাধকের চিন্তাধারনাকে স্থির রাখার জন্য হনুমানের মাথা নেওয়া হয়।

স্থান নির্বাচন:-

#########

       শহর বা জনবসতি পূর্ণ এলাকায় পঞ্চমুন্ডীর আসন তৈরী করা যাবে না। পঞ্চমুন্ডীর আসন তৈরী করতে গেলে কোন নির্জন শ্মশানস্থান, বা গভীর জঙ্গলের মধ্যে স্থান নির্বাচন করতে হবে।

বৃক্ষ বা গাছ নির্বাচন:-

##############

         পঞ্চমুন্ডীর আসন তৈরী করতে গেলে কোন নির্জন স্থানে অর্থাৎ যেখানে মানুষের আনাগোনা খুব কম সেইখানে নির্দিষ্ট পাঁচটি গাছ যথা,,,,,,,

(১) শিমুল, (২) বেল, (৩) নিম, (৪) বট,(৫) পিপুল।

এই পাঁচটি গাছের মধ্যে যে কোন একটি গাছের নীচে আসন তৈরী করতে হবে।


তিথি 

#######

            কেবলমাত্র অমাবস্যা তিথিতে রাত ১২টার পর এই পঞ্চমুন্ডীর আসন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। তবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে ও প্রতিষ্ঠান করা যায়, তবে গুরুদেবের আদেশে।

নিয়ম

#######

           প্রথমেই বলি সাধারণ মানুষের জন্য কিন্তু পঞ্চমুন্ডীর আসন নয়। এই পঞ্চমুন্ডীর আসনে সাধনা হলো গুরুমুখী, গুরুদেবের আদেশ ছাড়া এইসব ক্রিয়া করলে সাধক হয় উন্মাদ নাহলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

            উক্ত পাঁচটি মাথা সংগ্ৰহ করে প্রথমে ভালো করে পঞ্চগব্য দিয়ে ভালো করে শোধন করতে হবে। প্রথমে মনে রাখতে হবে ঐ মৃত প্রানীর মধ্যে সাধককে প্রান সঞ্চার করতে হবে।

           এক একটি মাথার উপর বসে, প্রথমে সাধককে টানা ৪৫ দিন ব্রহ্মচর্য ও হবিষ্যান্ন পালন করে, অর্থাৎ ব্রাহ্ম মুহূর্তে স্নান করে উদয় অস্ত গুরুদেবের আদেশ নিয়ে তাঁর দেওয়া মন্ত্র জপ করতে হবে। এই একই ভাবে পাঁচটি মাথার উপর আলাদা আলাদা করে ৪৫ দিন ধরে চলবে কঠোর ভাবে সাধনা, ব্রহ্মচর্য পালন ও হবিষ্যান্ন গ্ৰহন।


       এই ভাবে ৪৫ দিন করে পাঁচটি মাথার উপর সাধনার পর ঐ মাথাগুলির প্রানসঞ্চার হবে। তখন নির্ধারিত গাছের নীচে অর্থাৎ শিমুল, বেল, নিম, বট বা পিপুল গাছের তলায় তিন ফুট লম্বা ও তিন ফুট চওড়া গর্ত খুঁড়তে হবে। ঐ মাপের একটা পাথর অভাবে মার্বেল ও সংগ্ৰহ করে রাখতে হবে।

       ঐ গর্তের মধ্যে চারকোনে চারটি অর্থাৎ ঈশান, বায়ু, অগ্নি ও নৈঋত কোনে চারটি প্রানীর মাথা এবং ঠিক মাঝখানে চন্ডালের মাথা প্রতিস্থাপন করতে হবে। এর মধ্যে কয়েকটি গাছের শিকড় যথা, 

(১) শ্বেত মাকাল গাছের শিকড়।

(২) শ্বেত লজ্জাবতী গাছের শিকড়।

(৩) ডুমুর গাছের শিকড়।

(৪) সিংহ পুচ্ছ গাছের শিকড়।

            উপরোক্ত চারটি গাছের শিকড় দিতে হবে। তাছাড়া ও দিতে হবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পত্র যেমন, আতর, অগুরু, চন্দন, কুমকুম, তেল, লালবস্ত্র ও কারণ। 

            তারপর লাল বস্ত্রের উপর চারটি কোনে ঐ পাঁচটি মাথা প্রতিস্থাপন করে, অগুরু, কুমকুম, অষ্টগন্ধ্যা, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন, হলুদ চন্দন চামেলী তেল, জবাকুসুম তেল, সিঁদুর ও কস্তুরী দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে অভিষেক করতে হবে। অভিষেকের পর পাথর বা মার্বেল পাথর চাপা দেওয়ার পর ঐ পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে টানা নয়দিন নয় রাত্রি পূজা অর্চনা করতে হবে। নয়দিন পর পাথর চাপা দেওয়ার পর গুরুদেবের আদেশ নিয়ে ঐ আসনে বসতে হবে।

         এই পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে সাধনা করলে খুব শীঘ্রই ঈষ্ট দর্শন হয়। তবে গুরুদেবের আদেশ ব্যতীত সমস্ত সাধনাই বিফল

*****" মনে রাখবেন এই পঞ্চমুন্ডীর আসন সাধনা সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এগুলো হলো গুরুমুখী বিদ্যা। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা নিয়ম আছে, আছে আলাদা আলাদা মন্ত্র। কেউ কোনদিন কোন ভাবেই কৌতুহল বশত ভুলেও এই ধরনের ক্রিয়া করতে যাবেন না। এখানে নিজের আত্মরক্ষার মন্ত্র আগে প্রয়োগ করতে হয়, আমি কিন্তু কোন জ্যায়গায় কোন মন্ত্র প্রকাশ করিনি। 


সংগৃহীত

Tuesday, 14 September 2021

মহানাদ ব্রহ্মময়ী মন্দির

 


卐 মহানাদ  ব্রহ্মময়ী  কালী  মন্দির  卐


মন্দিরটি মহানাদ কালীবাড়ী নামে পরিচিত।  আবার অনেকেই একে ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ী নামে ডাকে। মা এখানে ব্রহ্মময়ী নামে পরিচিত।  মন্দিরটিতে ন'টি চূড়া আছে। তাই একে নবরত্ন মন্দিরও বলে। মহানাদ গ্রামটি হল হুগলী জেলার  চুচূড়া সাবডিভিশনের পোলবা-দাদপুর ব্লকে। হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনের পান্ডুয়া স্টেশন থেকে এর দূরত্ব  মাত্র সাত কিলোমিটার।  আর চুচূড়া থেকে প্রায় ১৯ কিমি। 



তেত্রিশ কোটি দেবতার  দেশ এই ভারতবর্ষ।  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোরা এক এক অপূর্ব পরিবেশে এই  সব দেবতাদের অবস্থান। আর আমরা সাধারণ মানুষ , ধর্ম শাস্ত্র  অনুসরন করে,  পুন্য    লাভের আশায় ঘুরে বেড়ায় এইসব তীর্থস্থানে। পশ্চিমবঙ্গেও অবস্থান করছে এরকম নানান পীঠস্থান ও আদিমন্দির। হুগলীর  মহানাদ মন্দির এদের মধ্যে একটি। ১৮২২ সালে গভীর জঙ্গল পরিষ্কার করে এই মন্দিরের ভিত খোরা শুরু হয়। ভিত খোরার সময় কুশান সভ্যতার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কিছু মুদ্রা পাওয়া যায় যেগুলি কুশান ও গুপ্ত যুগের।  আর টেরাকোটা কাজের যে নিদর্শন পাওয়া যায় সেগুলি বেশিরভাগ গুপ্ত যুগের বলে ঐতিহাসিকরা চিহ্নিত করেন। মন্দির শেষ হতে সময় লাগে ৮ বছর। ১৮৩০ সলে মন্দিরের কাজ শেষ হয়। ৮৫ ফুট উচু তিন তলা এই মন্দির।  



জমিদার কৃষ্ণ চন্দ্র নিয়োগী কাঠ ও চিনির বড় ব্যাবসায়ী ছিলেন।  তিনি বাড়িতেই জাঁকজমক করে দূর্গা, লক্ষ্মী ও জগদ্ধাত্রী করতেন। পূজো শেষ হতেই বিগ্রহের বিসর্জন হয়ে যেত। তাই নিত্য প্রতিমা দর্শনের কোনও উপায় ছিল না। এই সব ভাবনা থেকেই জমিদার দক্ষিণা কালীর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। আবার কেউ কেউ বলেন  তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বলে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চান। তখনি মহানাদ দক্ষিণ পাড়ার দু বিঘে জমির  জঙ্গল পরিষ্কার করতে লোকজন লাগান। মন্দিরের কাজ ১৮২২ সালে আরম্ভ হয়ে ১৮৩০ সালে শেষ হলে ৮ই মাঘ কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালী পুজোর দিন  পঞ্চমুন্ডি আসনের উপর তন্ত্র মতে দক্ষিণা কালী প্রতিষ্ঠা করেন।  তারপর থেকে একই ভাবে মায়ের পূজো হয়ে আসছে। কষ্টি পাথরের তৈরী এই মূর্তি। শোনা যায় যে মূর্তিকার এই মূর্তি তৈরী করেন, পরবর্তীকালে তারই হাতে তৈরী হয় দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মূর্তি। এও শোনা যায় পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে মন্দির প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে জমিদার বাড়িতে আসেন রানী রাসমণি। মন্দিরের গঠনশৈলী ও দক্ষিণা কালীর মূর্তি দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তার কিছুদিন পর তাঁর লোকজনদের এনে মন্দিরের উচ্চতা, প্রতিমার খুটিনাটি লিখে নিয়ে যান।  রানী শেষে মহানাদ কালী বাড়ির আদলেই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির তৈরিতে উদ্যোগী হন। মহানাদ কালীবাড়ীর বর্তমান বংশধর শ্রী স্বপন কুমার নিয়োগী। তাঁর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন " রানী রাসমণি মহানাদ কালী বাড়িতে এসেছিলেন বলে পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনেছি। কিন্ত তার কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।"



মায়ের আসনের পাশাপাশি মাকে শয়ন দেওয়ান জন্য  সেগুন কাঠের একটি খাট আছে। নিয়োগী মশাই তাঁর ব্যবসার কাঠ দিয়ে এই  খাট বানিয়েছিলেন। এই খাটের বয়স এখন ১৯০ বছর।মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে আসা হয়েছিল  তান্ত্রিকদের। সেই থেকে  এখনো এখানে তান্ত্রিক মতে পূজো হয়। আলাদা আলাদা দিনে আলাদা রকম ভোগ ও হোম করে পূজো করেন। প্রচুর মানুষের ভীর হয় রোজদিন।  এছাড়াও  বিশেষ বিশেষ আমাবস্যায় বিশেষ হোম যঙ্গোর আয়োজন করা হয় নিয়ম মেনে। মায়ের মূর্তির দু দিকে শিবের মূর্তি রয়েছে। আগে শিবের পূজো হয় এবং পরে মায়ের পূজো হয়। মায়ের কাছে পুজো দিতে হলে ধূপ, মোমবাতি, ফলমূল বা মিষ্টি সব কিছুই নিজেকে নিয়ে আসতে হয়। কেননা এখানে কোনো দোকান নেই। কালীপুজোর দিন কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়। আবার শিবরাত্রীতে প্রতি বছর এখানে বিরাট মেলা বসে। তাতেও  হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান  ও দুই ২৪  পরগনা থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় জমান।  মন্দির চালানোর জন্য সেই সময়ই নিয়োগী বংশের লোকদের নিয়ে জমিদার কৃষ্ণ চন্দ্র একটি বোর্ড গঠন করেছিলেন।  তাদের সপ্তম পুরুষ শ্রী স্বপন কুমার নিয়োগী বর্তমানে মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব বহন করছেন।  জমিদার মশাই-এর আদেশ মেনে এখনও বংশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে মন্দির পরিচালনা থেকে বঞ্চিত হন। মন্দিরের পূজো পরিচালনার জন্য বর্তমানে সতরো জন সেবাইত আছে।কালী পুজোর আগে এখানে সাজো সাজো রব দেখা যায়। প্রচুর ভক্তের সমাগমে দীপাবলীর অমাবস্যা তিথিতে মা পূজিত হন মহা সমারোহে। 


পর্যটনের তালিকায় এখন এসেছে এই মহানাদ মন্দির।  মন্দিরের ভক্তরা ও সেবাইতরা সরকারের পর্যটন দপ্তরের কাছে এই মন্দির নতুন রূপে সংস্কার করবার আবেদন জানান।  সেই মত  সরকারের পর্যটন দপ্তরের পক্ষ থেকে মহানাদ মন্দির পরিদর্শন করেন এবং মন্দিরটিকে নতুন করে সংস্কার করবার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এর সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। এখন রাতে মন্দিরের সব আলো জ্বলে উঠলে মন্দিরের রূপ অন্য রকম হয়।


কলকাতা থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৬৪ কিমি মত। গাড়ী নিয়ে যেতে চইলে জি টি রোড বা দিল্লী রোড ধরে সহজেই চলে আসতে পারেন।  এছাড়া রেলে পান্ডুয়া বা চুচূড়া বা ব্যান্ডেল ষ্টেশনে নেমে বাস বা অটো বা টোটোতে করে মন্দিরে পৌচ্ছাতে পারেন।  এটুকু দৃঢ়ভাবে বলছি যে একবার মন্দিরটি দর্শন করতে এলে বার বার ছুটে আসতে হবে এই জায়গায়।একবার এসেই দেখুন যে এখনকার সবুজ ঠান্ডা কোলাহলহীন পরিবেশ  আপনার  মনকে কেমন শান্ত করে দেয় !!!



Friday, 10 September 2021

সিদ্ধিদাতা গণেশায় নম:

 

'ওঁ গাং গণেশায় নমঃ ওঁ শ্রী গণেশায় নমঃ'


গণেশ হলেন হিন্দুদের সর্বাধিক  পরিচিত ও সর্বাধিক পূজিত দেবতাদের অন্যতম।  তিনি গনপতি, পিল্লাইয়ার , বঘ্নিশ্বর, যানইমুগবতন, গজপতি, একদন্ত নামেও পরিচিত।  ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে গণেশর মন্দির ও মূর্তি দেখা যায়। জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে গনেশ ভক্তিবাদ মিশে গিয়ে গণেশ পূজার প্রথা বিস্তার লাভ করেছে। সাধারণত সকল হিন্দু সম্প্রদায়েই গণেশের পূজা প্রচলিত  রয়েছে।

সিদ্ধেশ্বর

হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে গনেশের পূজা বিধেয়। পুরাণ মতে ভাদ্রপদ মাসের এই চতুর্থী তিথিতে জন্মগ্রহণ হয়েছিল সিদ্ধিদাতার। এই উৎসব গনেশ চতুর্থী বা বিনায়ক চতুর্থী বা বিনায়ক চবিথি নামে পরিচিত।  সাধারণত এই দিনটি ২০শে আগস্ট থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কোনোও এক দিন পড়ে। দশ দিন ধরে এই উৎসব চলে। চতুর্থী দুই দিনে পড়লে পূর্বদিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্নের সম্পূর্ণ সময়ে চতুর্থী বিদ্যমান হলেও পূর্বদিন মধ্যাহ্নে এক ঘটিকার (২৪ মিনিট) জন্যও যদি চতুর্থী বিদ্যমান থাকে তবে পূর্বদিনেই গণেশ পূজা হয়।


ব্যাবসায়ে গণেশ পুজো কেন করা হয় ??

আমাদের দেশে শুভ নববর্ষে , অক্ষয় তৃতীয়ায় কিংবা কোনও ব্যবসার শুরুতে ঘটা করে গণেশ পূজা করা হয়। এই গণেশ দেবতার আগমন সুপ্রাচীন। ঋগ্বেদে 'গনপতি'  নামে একজনের উল্লেখ আছে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বয়ং ইন্দ্রকেই গনপতিরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে কালক্রমে তন্ত্র ভাবনার বিস্তারের ফলে গণপতি বলে একজন পৃথক দেবতার আবির্ভাব ঘটে।  ইনি শিব পার্বতীর পুত্র গণেশ। ইনি যে কোনও পূজোর আগে পূজো পান এবং যে কোনও শুভকর্ম সুষঠভাবে সম্পন্ন করতে পারদর্শী। এই গণেশ হলেন---- গণ + ঈশ। অর্থাৎ গণদের বা জনগনের ঈশ্বর। ইনি যে কোনও কর্মের বিঘ্ননাশকরূপে পরিচিত এবং সিদ্ধি আনতে অপরিহার্য। এ কারণে ব্যাবসার শুরুতে লাভবান হতে ভারতে সর্বত্র গণেশ পূজার প্রচলন দেখা যায়। শুভ নববর্ষ ছাড়াও ভাদ্র মাসে এবং মাঘ মাসের শুক্লা চতুর্থীতে গণেশের বিশেষ পূজার ব্যবস্থা আছে। এদেশে জন্মাষ্ঠমীর পরে যে শুক্লা চতুর্থী সেই  চতুর্থী গণেশ চতুর্থী নামে পরিচিত। এই দিনে ভারতের নানা জায়গায় গণেশের আনুষ্ঠানিকভাবে পূজো করা হয়।




গণেশের পূজা সর্বাগ্রে হয় কেন   ???

বরাহ পুরাণে লেখা আছে যে একদিন ব্রহ্মার হস্তক্ষেপে মহাদেব তাঁর রুদ্ররূপ সংবরন করে কুমারকে বর দিয়েছিলেন  ------ " সকলের আগে তাঁরাই  পূজা হবে।" এই পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি গণেশের জন্ম হয়েছিল মহাদেবের শ্রীমুখ থেকে। চিন্তামগ্ন মহাদেব দেখলেন পৃথিবী, জল,অগ্ণি ও বায়ুর মূর্তি রয়েছে। কিন্ত আকাশের কোনও মূর্তি নেই।  এরূপ চিন্তা করামাত্রই ফল। মহাদেবের অট্টহাসি থেকে আবির্ভূত হলেন সেদিন এক সর্বাঙ্গসুন্দর তেজোদীপ্ত কুমার।  কিন্ত বিপদ ডেকে আনলেন পার্বতী। কুমারের সুন্দর মিষ্টি কচি মুখখানি দেখে পার্বতী হৃদয়াবেগ রুদ্ধ করতে না পেরে আপ্লুত হয়ে পরলেন।  অপলক নয়নে স্নহসিক্ত দৃষ্টিতে নিরক্ষণ করতে লাগলেন তাঁর প্রিয় কুমারকে। এই আসক্তিলিপ্ত দৃশ্য 


দেখা মাত্র মহাদেব রুদ্ররূপ ধারন করে  শাপ দিয়ে বসলেন  সেই নিরপরাধ কুমারকেই। কুমারের গ্রীবায় বসল হস্তীমুন্ড, লম্বিত উদরে রক্তিম কায়ে যুক্ত হল নাগ-উপবীত। এ দৃশ্য দেখে সকলেই ব্রহ্মার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন।  অত:পর ব্রহ্মার কৃপায় রুদ্রের ক্রোধ প্রশমিত হলে করুণার্দ্র নয়নে মহাদেব গণেশকে করে দেন আকাশের অধিপতি ও বর দেন " সকল দেবতার সর্বাগ্রে তাঁর পূজা হবে।"


গণেশ মূর্তির ভাসানের দিনকে কী বলা হয়?

মূলত যে দিন থেকে গণেশের পুজো শুরু হয়, সেই দিন থেকে ১০ দিনের পর এগারোতম দিনে ভাসান দেওয়া হয় গণেশের মূর্তির। এই দিনটিতে 'অনন্ত চতুর্দশী' বলা হয়। 'আসছে বছর আবার হবে'র বার্তা দিয়ে এমন শুভ দিনে ভাসন দেওয়া হয় সমৃদ্ধির দেবতাকে।








গণেশ কি ফুল  ভালবাসেন  ??

পরিজাত, মালতী, চাঁপা সহ নানারকম সুগন্ধী ফুল।  এছাড়া চন্দন,  অগরু, কস্তুরী,প্রদীপ ও ধূপ তাঁর খুবই প্রিয় জিনিস। 

তিনি খেতে পছন্দ করেন...........

বড় বড় তিলের নাড়ু, চিনির তৈরি মিষ্টি , মুড়কি, পিঠে, পায়েস এবং অন্যান্য সুস্বাদু ব্যঞ্জন। তাঁর প্রিয় ফলগুলি হল বেল, দাড়িম, খেজুর, আম, জাম, কলা এবং নারকেল। খাবারের সঙ্গে কর্পূর মিশানো ঠান্ডা গঙ্গাজলও তাঁর বিশেষ পানীয়। এসব পেলেই গণেশ ঠাকুর খুবই খুশি হন। 




গণেশের  বাহন  *$*

গণেশ গজমুন্ডধারী এবং স্থূলকায়। হাতে ভারী গদা। রজোগুনের প্রতীক স্বরূপ এই  কর্মবীর ঈষৎ রক্তবর্ন।  কিন্ত  প্রশ্নটা তাঁর বাহন ক্ষুদ্র ইঁদুর হল কি করে। পুরানে লেখা আছে, গণেশ কে দেখতে এসে পৃথিবী তাঁকে ইঁদুরটা দিয়েছিলেন।  আসলে ইঁদুর বা মূষিক হল সমাজের পতিত বা দলিত শ্রেনীর প্রতীক। গণেশ তাঁকে বাহন করে শোষিত,  অবহেলিত ও খেটে খাওয়া মানুষকে সন্মান দিয়েছিলেন।  তিনি যেমন একদিকে গজদন্ত ধারণ করে উচ্চ জাতিদের বরণ করেছেন,  তেমনি মূষিক বাহন করে উপেক্ষিত সম্প্রদায়কে কাছে টেনে নিয়েছেন। আর এটাও তিনি ভাবতেন যে, এই উভয়ের সমন্বয় হলেই প্রকৃত দেশ ও জাতির কল্যাণ হতে পারে। হয়তো তাঁর এই মহান জীবনদর্শনের জন্যই মহারাষ্ট্রে গণপতি উৎসব এত ব্যাপ্তি লাভ করেছে বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন।  আবার অনেকে এ কথাও বলেন যে , গণেশের বাহন মূষিক জীবের কর্মফল কর্তন করে সিদ্ধির পথ উন্মুক্ত কর দেন।

গণেশের হাতের চার অস্ত্রের বর্ননা  ৹৹৹ 

গণেশের চার হাতে রয়েছে যথাক্রমে শঙ্খ-চক্র-গদা ও পদ্ম। এই চারটি অস্ত্রই হল ভগবান বিষ্নুর।  তাই গণেশের হাতের শঙ্খের অর্থ হল জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে মঙ্গলের ও উৎসাহ উদ্দীপনা দেবার বস্তুবিশেষ। শঙ্খ ধ্বনিতে শুভ ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং অশুভ শক্তি দূরে পলায়ন করে। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের শুভ সূচনায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও শঙ্খ ধ্বনি করেছিলেন।  সুদর্শনচক্র শৌর্য-বীর্য ও সাহসের প্রতীক স্বরূপ এক অস্ত্র বিশেষ। কালধর্ম ছেদনকারী এই অস্ত্রধারন করে গণেশ ভক্তদের বিঘ্ননাশ করেন এবং কর্মের বাধাবিপত্তি দূর করে সিদ্ধি এনে দেন। তখন ভক্তরা কর্মসিদ্ধি বা মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। গদা হল শৌর্য ও শক্তিমত্তার প্রতীক।  যাঁদের হাতে গদা থাকে তাঁরা খুবই পরাক্রমী ও শক্তিশালী। গদা হাতে গণেশ ভক্তদের সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে থাকেন। অপরদিকে পদ্ম হল জীবনকে সৌন্দর্যে রূপায়িত করার ও নিরাসক্ততার প্রতীক।  পদ্ম পাঁকে জন্মায় কিন্ত গায়ে কোনও পঙ্ক গন্ধ নেই। পদ্মপাতা জলে থাকে কিন্ত জলবিন্দু ধারন করে না। অর্থাৎ পদ্ম বলতে চাইছে এই সংসারে ভগবানের জন্য কর্তব্যবোধে অনাসক্ত হয়ে কর্ম কর। বিষয়ে মনকে জড়িয়ো না। তাহলে মন পরমেশ্বরীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে উন্নত আনন্দ ও প্রেমে পরিপূর্ণ হবে। তখন মানবজীবন সুন্দর হয়ে সকলকে আমোদিত করবে।






গণেশ পূজোয় তুলসী পাতা লাগে না।

গণেশ পুজোয় তুলসী পাতার প্রচলন নেই। এক পৌরণিক কাহিনি মতে , তুলসী দেবীর সঙ্গে গণেশের সম্পর্ক ঘিরে রয়েছে কাহিনি, বলা হয়, তুলসী দেবী কেবলই বিষ্ণুর উপাসনা করতেন। বিষ্ণুদেব বাদে কারোর আরাধনা তিনি করতেন না। তবে তুলসী দেবীর সঙ্গে গণেশের বিবাহের কথা এগোতেই তাঁরা একে অপরকে অভিশাপ দেন বলে শোনা যায়। সেই থেকে গণেশ পুজোয় ব্যবহার করা হয়না তুলসী।

গণেশের  পরিবারে কে কে আছেন 

সিদ্ধিদাতা গণেশের বউ কে? কলা বৌ তার বৌ নন। তাহলে!

 সিদ্ধিদাতা গণেশের বউ হিসাবের আমরা যাকে জানি তিনি হলেন কলাবউ।এই কলাবউ কিন্তু গনেশের বউ নন আসলে কলাবউ হলেন গনেশের মাতা অর্থাত্‍ দেবী দুর্গার রূপ।তাহলে জানেন কি গনেশে বউ কে এবং সন্তান কে? জেনে নিন সিদ্ধিদাতা গনেশের বউ এবং সন্তান সম্পর্কে।

শিবপুরাণ অনুসারে, প্রজাপতি ব্রহ্মার দুই কন্যা ছিলেন সিদ্ধি ও বুদ্ধির।ব্রহ্মাদেবের এই দুই কন্যার সাথে বিয়ে হয়েছিল গণেশের।এরপর গনেশের দুই সন্তানের জন্ম হয়। সিদ্ধির গর্ভে 'ক্ষেম'এবং বুদ্ধির গর্ভে 'লাভ'।এই দুই পুত্র ছাড়াও গনেশের একটি কন্যা ছিল।এই কন্যার নাম হল 'সন্তোষী মা।




অন্য এক  পুরাণের  কাহিনী পড়লে জানতে পারি যে বিবাহের ব্যাপারে গণেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি দার পরিগ্রহ করবেন না। চিরকুমার থেকে তপস্যাতেই জীবনযাপন করবেন।  আর সেইমত ধ্যানধারনা নিয়েই রত থাকতেন।  কিন্ত ধর্মধ্বজের কন্যা তুলসির গণেশকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে যায় এবং মনে মনে তিনি পার্বতী পুত্রকে দারুন ভালবেসে ফেলেন। শুধু তাই নয়, প্রণায়াবেগে তিনি সুন্দর ভাবে সেজেগুজে একদিন গণেশের কাছে গিয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন।  এতে ধৈর্যশীল গণেশের আত্মসংযমের বাঁধ ভেঙে গেল এবং তিনি তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বললেন  " ওরে তুলসী, তুমি যেমন কামতুরা, তাতে তুমি দেবভোগ্যা না হয়ে অচিরেই অসুরভোগ্যা হবে।"  প্রণয় প্রতিহত হয়ে তুলসীও ক্রোধে জ্বলে উঠলেন।  তিনিও গণেশের মুখের ওপর বলে দিলেন  " তোমার ব্রহ্মচর্যব্রত ভঙ্গ হবেই। তুমি বিবাহ করতে বাধ্য হবে।"কালের বিধানে পরস্পর প্রদত্ত অভিশাপই সত্য হল। তুলসী শঙ্খচূড় নামে এক অসুরের ভার্যা হলেন  এবং গণেশ পুষ্টি নাম্নী এক দেববালার পাণিগ্রহন করলেন। এই দেববালার অপর নাম মহাষষ্ঠী। অপরদিকে কলাবউ গণেশের স্ত্রী নয়। কলাবউ হল দুর্গারই অন্য এক রূপ যা নবপত্রিকা নামে পরিচিত।  যাহোক,  তুলসী অভিশাপ দিয়েছিল বলে গণেশ পূজায় তুলসীপাতা আর লাগে না।

পুরান  ঘাটলে আমরা জানতে পারি গণেশের  সর্বসিদ্ধপ্রদ বারোটি নাম। এগুলি হল যথাক্রমে___ খর্বাকৃতি, একদন্ত,  রক্তবর্ন কলেবর, গজবদন, লম্বোদর,  স্থূলদেহ, বিঘ্ননাশক, ধূম্রবর্ন, চন্দ্রবদন, বিনায়ক,  গণপতি এবং গজানন। পতীর      কোলে বিষ্নুর বরে ও তারই অংশে গণেশের জন্ম হয় । বিষ্নুর অংশ স্বরূপ বলে গণেশেরও চার হাত এবং বিষ্নুর মতো তিনিও শঙ্খ-চক্র-গদা ও পদ্মধারী। মা পার্বতী স্বয়ং তপ:শক্তি বলে তাঁর  গনেশকে লাভ করেন। সাধারণ ভাবে তাঁর জন্ম হয়নি। কাজেই কোনও নায়ক বা পতি ছাড়াই গণেশের জন্ম হয়েছিল বলে তিনি বিনায়ক নামে পরিচিত।  আর ত্রিভুবনের সমস্ত  দেবতার ঈশ্বর বলে গণেশ । সমস্ত জনগনের পতি বলে গণপতি। তাকেঁ স্মরণ করে কর্ম শুরু করলে তিনি কর্মের বিঘ্ননাশ করেন বলে বিঘ্ননাশক । সর্বকর্মে সত্বর সিদ্ধি প্রদানের জন্য নাম হল তাঁর  সিদ্ধিদাতা। এছাড়া তাকেঁ নানারকম খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হয় এফং তা ভক্ষন করলেই ভুঁড়ি প্রসারিত হয় বলে গণেশ হলেন লম্বোদর। শণির অশুভ দৃষ্টিতে তাঁর জন্মের পর মাথা খসে পড়েছিল এবং দেবরাজ ইন্দ্রের হাতির মাথাটি কেটে এনে স্বয়ং বিষ্নু লাগিয়েছিলেন _____ এ কারণে তিনি হস্তীবদন বা গজানন । দীনজনের সদা সেবক বলে গণেশের আরেক নাম হল হেরম্বদেব । অপরদিকে পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করে একটি দাঁতকে ভেঙে তিনি একদন্ত নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।  গণেশের রং রক্তবর্ন । দেহের গঠন অনুপম সৌন্দর্যে ভরপুর।  সমস্ত দেবদেবীর আশীর্বাদে অত্যন্ত মার্জিত,  সংস্কৃতিবান এবং ঞ্জানী দেবতা হিসেবে গণেশ খ্যাতিলাভ করেছেন।  



গণেশের দেহে হাতির মাথা কেন ??


সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি সম্ভবত শিব পুরাণ থেকে গৃহীত হয়েছে। এক দিন দেবী পার্বতী কৈলাসে স্নান করছিলেন। স্নানাগারের বাইরে তিনি নন্দীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, যাতে তাঁর স্নানের সময় কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে। এই সময় শিব এসে ভিতরে প্রবেশ করতে চান। নন্দী শিবের বাহন। তাই প্রভুকে তিনি বাধা দিতে পারলেন না। পার্বতী রেগে গেলেন। তিনি ভাবলেন, নন্দী যেমন শিবের অনুগত, তেমনই তাঁর অনুগত কোনো গণ নেই। তাই তিনি তাঁর প্রসাধনের হলুদমাখা কিছুটা নিয়ে গণেশকে সৃষ্টি করলেন এবং গণেশকে নিজের অনুগত পুত্র রূপে ঘোষণা করলেন।

এরপর থেকে পার্বতী স্নানাগারের বাইরে গণেশকে দাঁড় করাতেন। একবার শিব এলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু গণেশ তাঁকে বাধা দিলেন। শিব রেগে গিয়ে তাঁর বাহিনীকে আদেশ দিলেন গণেশকে হত্যা করার। কিন্তু তারা গণেশের সামান্য ক্ষতি করতেও সক্ষম হল না।

এতে শিব অবাক হলেন। তিনি বুঝলেন, গণেশ সামান্য ছেলে নয়। তাই তিনি নিজে গণেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন। শিব গণেশের মুণ্ডটি কেটে তাকে হত্যা করলেন। একথা জানতে পেরে পার্বতীও রেগে সমগ্র সৃষ্টি ধ্বংস করে ফেলতে উদ্যোগী হলেন। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। পার্বতী দুটি শর্ত দিলেন। প্রথমত, গণেশের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সকল দেবতার পূজার আগে তাঁর পূজার বিধি প্রবর্তন করতে হবে।

এই সময় শিবেরও রাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি পার্বতীর শর্ত মেনে নিলেন। তিনি ব্রহ্মাকে উত্তর দিকে পাঠিয়ে বললেন, যে প্রাণীটিকে প্রথমে দেখতে পাওয়া যাবে, তারই মাথাটি কেটে আনবে। কিছুক্ষণ পরে ব্রহ্মা এক শক্তিশালী হাতির মাথা নিয়ে ফিরে এলেন। শিব সেই মাথাটি গণেশের দেহে স্থাপন করলেন। তারপর তাঁর মধ্যে প্রাণের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হল। শিব গণেশকে নিজ পুত্র ঘোষণা করলেন এবং সকল দেবতার পূজার আগে তাঁর পূজার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই সঙ্গে তাঁকে সকল গণের অধিপতি নিযুক্ত করা হল।

গণেশের হাতির মাথা

বৌদ্ধধর্মে  গণেশ  ::



বৌদ্ধধর্মেও গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ধর্মে শুধুমাত্র বৌদ্ধ দেবতা বিনায়ক রূপেই গণেশের উল্লেখ নেই, বরং হিন্দু দেবতা রূপেও বিনায়কের উল্লেখ আছে। গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ের বৌদ্ধ ভাস্কর্যে গণেশের মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধ দেবতা রূপে বিনায়কের মূর্তিটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নৃত্যরত। এই রূপটির নাম ‘নৃত্য গণপতি’। উত্তর ভারতে এই রূপটি জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীকালে তা নেপালে গৃহীত হয় এবং তারও পরে তিব্বতে গৃহীত হয়। মালয় দ্বীপমালার চণ্ডী সুকুহ মন্দিরে নৃত্যরত গণেশের একটি মূর্তি দেখা যায়।

মঞ্জনগন (গণেশ) মন্দির,  বালি, ইন্দোনেশিয়া


নৃত্যরত গণেশের মূর্তি


জৈন ধর্মাবলম্বীদের গণেশ  卐卐

অধিকাংশ জৈন ধর্মাবলম্বী গণেশের পূজা করেন। তাঁদের বিশ্বাস, গণেশ কুবেরের কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করেন।[৫] জৈন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বাণিজ্যের বিশেষ যোগ থাকায় তাঁদের কাছে গণেশ পূজার ধারণাটি বেশ গ্রহণযোগ্য হয়।

গণেশ গুম্ফা, উদয়গিরি 

বর্ধমানসূরি রচিত শ্বেতাম্বর জৈন গ্রন্থ আচারদিনকর (১৪১২ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে, দেবতারাও কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য অর্জনের জন্য গণপতিকে প্রসন্ন রাখেন। এই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, যে কোনো শুভ অনুষ্ঠান ও নতুন কাজ শুরু করার আগে তাঁকে পূজা করা হয়। এই প্রথা এখনও শ্বেতাম্বর জৈন সম্প্রদায়ে বেশ জনপ্রিয়। এই গ্রন্থ থেকে গণপতি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বিধিও পাওয়া যায়।

যদিও দিগম্বর ধর্মগ্রন্থগুলিতে গণেশের এই জনপ্রিয়তা দেখা যায় না। অধুনা ওড়িশার উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি গুহাসমূহে খোদিত দুটি মধ্যযুগীয় মূর্তি এবং মথুরায় প্রাপ্ত একটি প্রাচীন মূর্তি ছাড়া কোনো দিগম্বর তীর্থস্থানে গণেশের মূর্তি নেই।


$*$* গণেশ পূজার ফলে ভক্তরা কি লাভ করেন  $*$*  



শাস্ত্রমতে গণেশের স্তবস্তুতি ও পুজোয় অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। কর্মের বিঘ্ননাশ হয়। গণেশ পুজো করলে গ্রহপীড়ার মধ্যে পড়তে হয় না। আর এই  কারণেই ব্যবসায়ীরা ব্যাবসায় ক্ষতির হাত  থেকে বাঁচতে,  ব্যাবসার সমৃদ্ধি কামনায় সেই  আদিকাল থেকে গণেশ পুজো করে আসছেন।  

গণেশ যেহেতু গণশক্তি বা সমষ্টিশক্তির প্রতীক,  সেহেতু, সকলের শক্তি তাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে। ফলে, সেই শক্তির জোরেই যে কোনও বিঘ্ন খুব সহজেই অপসারিত হয়। তাই গণেশের পূজা ঠিক ঠিক সম্পাদিত হলে অন্য সকল দেবতার পূজা সার্থক হয়। এছাড়াও গণেশের অর্চনায় অষ্টপাশ অর্থাৎ ঘৃণা, অপমান,  লজ্জা, মাহ, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ ও বৈগুণ্য প্রভৃতি বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ হয়। বিদ্যার্থীর বিদ্যা, ধনার্থীর ধন, পুত্রার্থীর পুত্র এবং মোক্ষার্থীর মোক্ষ লাভ হয়।

কোথায় স্থাপন করতে হবে গনেশ মূর্তি: অনেকে গৃহের মঙ্গল ও ব্যবসার উন্নতি লাভের জন্য সিদ্ধিদাতার পুজো করেন। কিন্তু কোন স্থানে তাঁর মূর্তি স্থাপন করতে হবে, সে সম্পর্কে বেশিরভাগই জানেন না। তাই দিনের পর দিন আরাধনার পরেও তেমন কোনও ফল মেলে না। বাস্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়ির পূর্বদিকে যদি গণেশ ঠাকুরের মূর্তি রাখা যায়, তাহলে সবথেকে বেশি সুফল মেলে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে উত্তরদিকে রেখেও পুজো করতে পারেন।

শ্বেত গণেশ: অনেকে বিশ্বাস করেন, বাড়ির ঠাকুরঘরে সাদা গণেশের মূর্তি স্থাপন করলে পরিবারে অশান্তির আশঙ্কা কমে। সেইসঙ্গে পরিবারে সমৃদ্ধি ছোঁয়া লাগে। তাই এবার থেকে গণেশ মূর্তি বাড়ি আনলে সাদা মার্বেলের মূর্তি আনুন!

গণেশের শুঁড়: সিদ্ধিদাতার মূর্তি আনার সময় খেয়াল রাখতে হবে, তার শুঁড় যেন ঠাকুরের বাঁ-হাতের দিকে বেঁকে থাকে। কারণ, বিশেষজ্ঞদের মতে এমন মূর্তি বাড়িতে রাখলে গৃহের উন্নতি হয়। সেইসঙ্গে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

মোদক এবং বাহন: গণেশের হাতে মোদক এবং পায়ের কাছে বাহন, এমন মূর্তি বাড়িতে রাখলে গৃহের সুখ-শান্তি বজায় থাকে, তেমনি মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।

তাই পরিশেষে ভগবান বিষ্নুর সাথে গলা মিলিয়ে পরমভক্তি  সহকারে সর্ববিঘ্ন বিনাশক গণপতির স্তব করতে ইচ্ছা করে    "  হে সিদ্ধেশ্বর গণেশ,  তুমি সকল দেব ও সিদ্ধগণের শ্রেষ্ঠ,  যোগীদের গুরু , তুমি সর্বস্বরূপ, সকলের ঈশ্বর এবং ঞ্জানরাশিস্বরূপ। তুমি অব্যক্ত,  অক্ষর, নিত্য,  সত্য  এবং আত্মস্বরূপ, তুমি বায়ুতুল্য নির্লিপ্ত,  অক্ষত এবং সর্বসাক্ষী। সংসার সাগরের পারবিষয়ে তুমি মায়ারূপ পোতারোহী জীবগনের দুর্লভ কর্ণধার স্বরূপ  এবং ভক্তগনের প্রতি অনুগ্রহকারী।  তুমি ধার্মিক,  ধর্মস্বরূপ, ধর্মঞ্জ এবং ধর্ম  ও অধর্মের ফলদাতা। তুমি সংসার বৃক্ষের বীজ এবং তদাশ্রিত অঙ্কুর। তুমি স্ত্রী, পুরুষ ও নপুংসকের স্বরূপ এবং অতীন্দ্রিয়। তুমি সকলের আদিতে অবস্থিত,  অগ্রে পূজনীয়, সকলের পূজনীয় এবং গুনের সাগর। তুমি আপনার ইচ্ছানুসারে কখন সগুন এবং কখন নির্গুন ব্রহ্মারূপে অবস্থান কর। তোমাকে ভক্তিপূর্ন নমস্কার জানাই।"