" স্বাধীনতা " তোমার আমার
স্বাধীনতা একটা অনুভূতি। সমস্ত রকম দায়বদ্ধতা এবং কোলাহলের উর্দ্ধে এক অমোঘ প্রাপ্তি। "স্বাধীনতা" শব্দটা শুনলেই যেন মনে হয় মাথার উপরের আকাশটা আরও কয়েকগুন বেড়ে গেল। বুকের ভেতর "স্ব" অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে বাঁধ_ভাঙ্গা অক্সিজেন। একটা বড় নদী, একটা নাক উচু পাহাড় বা আদিগন্ত বিস্মৃত বনানী যেখানে কোনো বেড়াজাল নেই। নেই কোনো সীমান্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তর ২৪পরগনার নাম। ইতিহাসের অনেকগুলি পাতাই এই জেলা দখল করে রেখেছে।
স্বাধীন শব্দের আক্ষরিক মানে নিজের অধীন। অন্যের শাসন না মানাই কি তাহলে প্রকৃত স্বাধীনতা ?? না কখনোই না। তাই যদি হতো তাহলে তন্ত্র ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা --- যেমন রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, বা গনতন্ত্রের তো সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে সামিল হবার কথা ছিল না। তাই মাথার ওপর সবসময় মুরুব্বি গোছের কাউকে দরকার।
তবে নি:সঙ্গতা বা একাকীত্বের সাথে স্বাধীনতার মানে গুলিয়ে ফেলার পরিসরও দিন দিন খুব কমে আসছে। স্বাধীনতার মানে কখনোই একচোরা হয়ে থাকা নয়। আমাদের দেশের মূল মন্ত্র যেমন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য তেমনি বাস্তব জীবনে স্বাধীনতার Jআক্ষরিক অর্থ হলো___ নানান কাজ, অগুনিত লোক, বহু ভাষা, নাগরিক কোলাহল, গ্রামীন আন্তরিকতা আর প্রতিযোগিতার অন্তহীন দৌড়ঝাপের ফাঁকে ফাঁকে নিজের জন্য বাঁচার মতো টুকরো টুকরো সময় বের করে নেওয়া।
সময়েরই আসলে বড় অভাব আজকের ইন্টারনেটের যুগে। গতির পিছনে মানুষ ছুটছে, না মানুষ গতির পিছনে ধাওয়া করে সময়ের আগেই হাঁপিয়ে উঠছে বোঝা দায়। তাই বড় আকাশটা ধূলোয় আর হাই রাইজে ঢেকে গেছে। মরচে ধরা রেলিঙে আর নতুন নতুন পাখি আসে না। বুক ভরে অক্সিজেন আর নেওয়া হয় না। সেখানেও বিধিনিষেধর ঘেরাটোপ। সময় কই ? নিজের জন্য বাঁচার স্বাধীনতাই বা কতটুকু আছে আমাদের ? শেষ কবে গলা ছেড়ে গান গিয়েছিলেন মনে পড়ে কি ???
ব্যারাকপুরের গান্ধী ঘাট
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামের নানা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর শহর। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই ব্যারাকপুর শহরেও ছিল মহাত্মা গান্ধীর বিচরন। কম বেশি পাচঁ বার তিনি এখানে এসেছিলেন।
রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে তাঁর বাড়ীতে দু'বার এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী ব্যারাকপুরে । একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে গঙ্গাপাড়ের ফ্ল্যাগস্টাফ হাউস বর্তমানে যেটি গভর্নর হাউস বলে পরিচিত সেখানে এসেছিলেন গান্ধীজী। সেখানে দুজনের দীর্ঘক্ষণ কথা হয়।
যেহেতু গান্ধীজী বার বার ব্যারাকপুরে এসেছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভষ্ম ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই যা গান্ধীঘাট নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীকালে সেখানে স্মৃতিসৌধও তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি যার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু। গান্ধীজয়ন্তী, ২৬শে জানুয়ারি , ১৫ই আগষ্ট নিয়ম করে সেখানে রাজ্যপালের উপস্থিতিতে গান্ধীজীকে স্মরণ করা হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পাশে গান্ধী মিউজিয়ামও করা হয়েছে, যেখানে গান্ধীজীর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষিত করে রাখা আছে।
সেনানী মঙ্গল পান্ডের স্মৃতিবাহক ব্যারাকপুর ***
মঙ্গল পান্ডে, সামান্য একজন ভারতীয় সিপাহী, সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গর্জে উঠেছিলেন। তাঁরই তৈরি স্ফুলিঙ্গে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে দেশ জুড়ে জমা হওয়া বারুদে। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যাবে , সিপাহি বিদ্রোহ হয়ত সফল হয়নি ঠিকই, কিন্ত পরবর্তী সময় ভারতের সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয় সেইসময় থেকেই।
তাই সেনানী মঙ্গল পান্ডের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে ব্যারাকপুরের নাম। এই ব্যারাকপুরের মাটিতেই তাঁকে ফাসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন ব্রিটিশ বাহিনী। যেখানে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর মূর্তি। তাঁর নামে রয়েছে উদ্যান, রাস্তাও। স্বাধীনতা দিবসের
প্রাক্কালে আরও বেশিকরে উচ্চারিত হয় মঙ্গল পান্ডের নাম। ব্যারাকপুরের গঙ্গা তীরবর্তী তাঁর নামাঙ্কিত "মঙ্গল পান্ডে উদ্যান " -- এর নাম সর্বজনবিধিত। নিয়ম করে তাঁর পরিচর্যা করা হয় স্থানীয় প্রশাসনের তরফে। পরিষ্কার করা হয় তার মূর্তিও সরকারি স্তরে গঙ্গা তীরবর্তী ওই জায়গাকে ঘিরে আরও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনাও রয়েছে।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নতুন রাইফেলের কার্তুজের ব্যবহার নিয়ে সিপাহিদের মধ্যে তৈরী হয় দ্বন্দ্ব। ভারতীয় সিপাহীরা ওই নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। সেই
ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূচনা হয় সিপাহি বিদ্রোহের। তৎকালীন ব্যারাকপুরের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মঙ্গল পান্ডের হাত ধরেই সেই বিদ্রোহ সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। ইতিহাসবিদের একাংশ ১৮৫৭ সালের এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপেও দেখেন।
সে বছর ২৯শে মার্চ মঙ্গল পান্ডের ডাকে ব্রিটিশ শাসনকে ভেঙে ফেলতে ব্যারাকপুরের প্যারেড গ্রাউন্ডে ভিড় জমিয়েছিল ভারতীয় সিপাহীরা। বিরোধিতা করায় তাঁর হাতে মৃত্যু হয়েছিল এক ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট ও এক সার্জেন্টের।
ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মঙ্গল পান্ডে। অসুস্থ অবস্তায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেই সৈন্যদের সামনে ওই বছরের ৮ই এপ্রিল তাঁকে ফাসি দেওয়া হয়। বীর শহিদের মর্যাদায় ব্যারাকপুর আজও সশ্রদ্ধায় মনে রেখেছে মঙ্গল পান্ডেকে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে এই খাদি প্রতপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও জাতীয় নেতারা নিয়েছিলেন এই খাদি প্রতিষ্ঠানে বসেই। বিদেশী দ্রব্য বর্জন বা আকাশবানীতে প্রথম ভাষণ এই খাদি প্রতিষ্ঠান থেকেই দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে আরবের স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাক আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এব পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।
তিতুমির ছিলেন দূরদর্শী। বাঙ্গালিদের একত্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে নিজহস্তে বাঁশ তুলে নেন ও সবার হাতে বাঁশ তুলে দেন। যখন বাঙ্গালিরা হাতে বাঁশ ধারন করত তখন তাদের কাছে মনে হত যে তাদের হাতে আছে পারমানবিক বোমার রিমোট কন্ট্রোলার। যে কোনো সময় শুধু বাটন প্রেস করবে আর ইংরেজ জাতি হয় মাটির তিনহাত নিচে চলে যাবে, নয়তো সরাসরি ঊর্ধ্বগগণে। এই বাঁশের কারণেই তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছে।
এমনিতেই বাদুরিয়ার ইচ্ছামতী নদী সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর বাঁশ হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সেই বাঁশ ও কাদা দিয়ে কেল্লা তৈরী করেন নারকেলবেড়িয়া গ্রামে। বাঁশের তৈরী কেল্লার কাজ শেষ হয় ১৮৩১ সালের মাঝামাঝি। এরপর ২৪ পরগনা , নদিয়া ও ফরিদপুরের কৃষকদের একত্রিত করে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। স্থানীয় জমিদার ও বৃটিশ বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। এলাকার ৮৩ হাজার কৃষক তিতুমির পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। যাঁর মধ্যে ছিলেন তিতুমির তৈরি কয়েক হাজার লাঠিয়াল।
তিতুমির বাহিনীর সঙ্গে সন্মুখ সমরে কয়েকবার পিছু হঠে ইংরেজরা। শেষে ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে নারকেবেরিয়ার তিতুমির বাঁশের কেল্লা ঘিরে ধরে ব্রিটিশ বাহিনী। ১৯শে নভেম্বর কর্নেল হার্ডিংয়ের নেতৃত্বে ইংরেজরা ভারী অস্ত্র দিয়ে গুড়িয়ে দেয় বাঁশের কেল্লা। অনেকের সাথে শহিদ হন তিতুমির। তাঁর বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুম ধরা পড়েন। পরে তাকে ফাসি দেওয়া হয়।
বাদুরিয়ার নারকেবেরিয়া গ্রামে আজ আর বাঁশের কেল্লার অবশিষ্ট কিছুই নেই। কেবল তিতুমির একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তিতুমির বংশধরদের। তিতুমির বংশের বর্তমান প্রজন্ম মদত আলি বলেন " বেশ কয়েক বছর আগে নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমির একটি স্মৃতিফলক তৈরি হয়েছিল। তখন ঘটা করে বলা হয়েছিল তিতুমির বংশধরদের সন্মান দেওয়া হবে। বাগজোলা পঞ্চায়েতকে তিতুমির পঞ্চায়েত নাম দেওয়া হবে। শহিদের স্মৃতি বিজরিত চাঁদপুর ও নারকেলবেড়িয়া আদর্শ ও মডেল গ্রাম হিসাবে গড়ে তোলা হবে। কিন্ত কেউ কথা রাখেনি। তিতুমির বংশধরেরা এখন দিনমুজুরের কাজ করে। তাঁর বংশধরদের কোনও সন্মান দেওয়া হয়নি।"
বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশদের সঙ্গে তিতুমির লড়াই ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সেই বাঁশের কেল্লা এখন তো আর নেই। ইংরেজরা পুরোপুরিই ধ্বংস করে দিয়েছে। রয়েছে তিতুমির স্মৃতিফলক। সেটার সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত। কিন্ত শুধু স্মৃতিফলকেই আটকে রইল কেন শ্রদ্ধাঞ্জাপন ?? এ প্রশ্ন অনেকের।
$$ বন্দেমাতরম্ স্তোত্র :-: জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্র $$
বন্দে মাতরম্ ( অর্থাৎ "বন্দনা করি মায়") বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান। সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত এই গানটি দেবী ভারত মাতা বন্দনাগীতি এবং বাংলা মা তথা বঙ্গদেশের একটি জাতীয় মূর্তিকল্প। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম্ গানটিকে "বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত" ("National Anthem of Bengal") বলে উল্লেখ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
কালচক্রের গতিতে একসময় এ পূণ্যভূমিতে পা পড়েছে একদল বিদেশী ইংরেজ বণিকের। যারা এদেশের মাটিতে ব্যাবসায়ী সেজে ব্যাবসা করতে এসে ছলনার সাহায্যে এদেশের বুকে বসিয়েছে ছুরি। ব্যাবসায়ী হয়েছে দেশের শাসক, লুঠ করেছে দেশের সম্পদ।” বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে পরিণত হয়েছে।” সোনার ভারতবর্ষ হয়েছে পরাধীনতার শিকল বদ্ধ। সর্বালঙ্কারভূষিতা জগদ্ধাত্রী পরিণত হয়েছেন শ্মশানচারিণী নগ্নিকা মা কালী।
ইংরেজ শাসনের চরম অত্যাচারে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে নেমে এসেছে হাহাকার। বঙ্গদেশে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ – যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসী বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেও ব্যর্থ হয়, সিপাহী বিদ্রোহ তার উদাহরণ। এক ভূখন্ডে বসবাসকারী মানুষকে এক সূত্রে আবদ্ধ না করতে না পারলে সে ভূখন্ড কখনই দেশ হয়ে ওঠে না। সেই দেশ যদি পরাধীন হয়, তাহলে তার স্বাধীনতা লাভের পথে এগোনোর জন্য জনগণকে এক বলে বলীয়ান হতে হবে। দীক্ষিত হতে হবে এক মন্ত্রে। বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই মন্ত্র দেন দেশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর সে মহামন্ত্রটি হলো ‘আনন্দমঠ’উপন্যাসের ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ একাধারে স্বদেশমন্ত্র এবং স্বদেশসংগীত। বন্দেমাতরম্ মন্ত্র উচ্চারণ করেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর প্রভাত- লগ্নে বঙ্কিমচন্দ্রের সপ্তকোটি দেশের মানুষ প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্দে মাতরম্’-ই ছিল অখণ্ড ভারতের সমবেত স্বদেশ-সংগীত।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই বন্দেমাতরম্ স্তোত্রে যেন জাতীয়তার মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠেছিল আপামর ভারতবাসী। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে নৈহাটিতে সাহিত্য সম্রাটের জন্মভিটায় সেই স্তোত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে স্মরণ করা হয় ভারতমাতার বীর যোদ্ধাদের।
নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় জন্ম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে এখানেই। ১৮৮২ শে সালের বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আনন্দমঠ উপন্যাসে বন্দমাতরম্ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেস বন্দেমাতরমকে জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রকাশ কালে কাঁটালপাড়ার বৈঠকখানায় বসত সাহিত্যের আসর। যার পোশাকি নাম ছিল " বঙ্গদর্শনের মজলিশ "। যেখানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নবীনচন্দ্র সেন, দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার , চন্দ্রনাথ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের মতো সাহিত্যিকেরা উপস্থিত থাকতেন। বর্তমানে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বাড়ির শুধু সংরক্ষণই হয়নি, সংগ্রহশালার পাশাপাশি এখন তা বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
কাঁটালপাড়ার বসতবাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত খাট, কাঠের আলমারি যত্নে রাখা আছে। সেই সময়কার বড় দেওয়াল ঘড়ি শোভা পাচ্ছে। রাখা রয়েছে যুবক বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছেন দেবীর দু'টি ছবি। বসতবাড়ির উত্তর পশ্চিম দিকে যেখানে বঙ্কিম পরিবারের সূতিকাগৃহের সন্ধান মিলেছিল, সেখানে নির্মিত হয়েছে টেরাকোটা শোভিত চারচালা শৈলির দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। বসতবাড়ির দক্ষিনে যেখানে " বঙ্গদর্শনের মজলিশ " এর আসর বসত, বৈঠকখানার সেই হলঘরটি এখন পুরোটাই বঙ্কিম সংগ্রহশালা। যেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত পাগড়ি, শাল, সেজবাতি, দাবার ঘুড়ি, তাঁর পরিবারের গানের স্বরলিপির খাতা, বংশ তালিকা, তাঁর পবিত্র অভিঞ্জান শকুন্তলমের পুঁথি, বঙ্গদর্শনের ক্যাশবাক্স সহ অসংখ্য নথি রাখা হয়েছে।
বৈঠকখানার পাশেই বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার ঘর ও পরের একটি ঘর বিশ্রামকক্ষ। তাঁর লেখার ঘরে নানা নথির প্রতিরুপের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত কাঠের চেয়ার ও টেবিলের রেপ্লিকা রাখা রয়েছে। পাশাপাশি বঙ্কিমভবনের গ্রন্থাগারে বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর পরিজনদের পঠিত বঙ্গদর্শন, প্রচার, ভ্রমর, নবজীবন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, পঞ্চপুষ্প, মানবর মতো গ্রন্থ যেমন রয়েছে, তেমনই বঙ্কিমচন্দ্র ও বাংলার সমাজ, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার উপযোগী প্রায় ১৪ হাজারের বেশি বই সেখানে রয়েছে, যা এখনও অনেকের অজানা। এ বার একটি নতুন ভবন তৈরি করে সেখানে পাঠাগার স্থানান্তরের পাশাপাশি পৃথক গ্যালারি করে বঙ্কিমচন্দ্রের সময়কার তাঁর পরিবার-পরিজন এবং অন্যান্য মনীষীর ছবি ও তাদের ব্যবহৃত দুর্লভ জিনিস প্রদর্শিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বঙ্কিম গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ রতনকুমার নন্দী জানিয়েছেন " আলোকসজ্জা দিয়ে বাড়ির বাইরেটা সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।" তিনি আরও জানালেন বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বঙ্কিম ভবনে প্রতিবছর বন্দেমাতরম্ স্তোত্র পাঠের মাধ্যমেই স্বাধীনতা দিবসে পালন করা হয়।
#$# অনাদরে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের সেই ইতিহাস ::**:: অশোকনগেরের বিমানবন্দর #$#
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে । পরাধীন ভারতের অশোকনগরে বিমানবন্দর বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। অশোকনগর পুরসভার নিউ মার্কেট, গোলবাজার, গণেশ ভান্ডার, চৌরঙ্গি, ১/৩ মোড় নিয়ে ছিল সেই বিমানবন্দর।সবমিলিয়ে কয়েক বর্গ কিলোমিটার গড়ে উঠেছিল বিমানবন্দর। যুদ্ধ বিমান রাখার জন্য বানানো হয়েছিল চারটি হ্যাঙ্গার। স্থানীয় প্রবীণ লোকজন তাদের বাপ-ঠাকুরদার থেকে গল্প শুনেছেন, যে এখানে একসময় মিলিটারিদের বুটের শব্দে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকত। জওয়ানরা নিয়ম করে রুট-মার্চ করত।মিলিটারিদের জন্য ছিল বেস ক্যাম্প। রানওয়েতে যুদ্ধবিমানের উঠানামা লেগেই থাকত। পুরসভার হরিপুর এলাকা থেকে গোলবাজার, আবার ১/৩ মোড় থেকে কুয়াশার মোড় পর্যন্ত ছিল বিমানের উঠানামার রানওয়ে। কিন্ত কালের নিয়মে সে সবই অবহেলায়, অনাদরে আজ অস্তমিত। ইতিহাসের সাথে লেপ্টে থাকা সেই সময়কার সবকিছুই আজ জবরদখল হয়ে গেছে। বর্তমান ঘোষপাড়ায় চারটি হ্যাঙ্গার এখন খাটাল হয়ে গিয়েছে। গরু মোষের আস্তানা। হ্যাঙ্গারের চারদিকে জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। যেখানে রানওয়ে ছিল সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। রানওয়ের টিকি মেলাও ভার।
আসলে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সইতে হয়েছিল দেশভাগের যন্ত্রনা। দেশভাগের পর বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগেই গড়ে উঠে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত আজকের অশোকনগর। পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের একটা বড় অংশ মাথা গোজার ঠাই করেছিলেন এখানে। এরপর ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকে। ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনটুকু সেই সময় কারো মাথায় সেভাবে আসেনি। ফলে ইতিহাসে অশোকনগেরের নাম এভাবে জড়িয়ে থাকলেও, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কিছুই দেখানোর থাকছে না। স্মৃতিরক্ষার কোনও নিতে দেখা যায়নি অশোকনগর-কল্যানগড় পুরসভাকে। চেষ্টাও হয়নি জবরদখল মুক্ত করার। ফলে অনাদরে, অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই ইতিহাস। অথচ সংরক্ষণের একটু উদ্যোগ নিলে সংহতি পার্ক, মিলেনিয়াম পার্কের সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অশোকনগরে বৃটিশ সরকারের তৈরি যুদ্ধবিমান রাখার হ্যাঙ্গারগুলিও অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারত বলে মনে হয়। এ বিষয়ে পুর প্রশাসক জানালেন " বৃটিশ আমলের সম্পত্তি এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্ত কোনো কাজেও লাগছে না। ঘোষপাড়ার কিছু মানুষ ওখানে গরু মোষের খাটাল করেছেন। ফলে সমস্যা একটা হয়েছে। আমরা কথা বলার চেষ্টাও করছি। সমাধানের খোঁজ চলছে, যদি এই হ্যাঙ্গারগুলি সংরক্ষন করা যায়। আমরা ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই চায়।"
দমদম থেকে ৫০ কি মি দূরে অশোকনগরে বিমানবন্দর বানাতে হয়েছিল। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। কিন্ত পরাধীন ভারতের সেই বিমানবন্দরের কোনও অস্তিত্বই আর টিকে নেই। রানওয়ে বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। গোটাটাই পাড়া। এলাকার প্রবীণ মানুষজনের প্রশ্ন, ইতিহাসকে আগামীর কাছে তুলে ধরার কোনও উদ্যোগ কি আমরা নেব না ??



















