#আবার_ট্রেন_কবে_আসবে?
- "বাবা, ঐ দেখো ট্রেন যাচ্ছে, ট্রেন!"
মেয়ের উত্তেজনা দেখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো! দু কামরা'র একটা ছোট্ট ট্রেন হুশ করে চলে গেল।
আমাদের ফ্ল্যাটের ছাদে উঠে একটা ঢিল ছুঁড়লে রেল লাইনে গিয়ে পড়ে। দিনরাত,এমনকী মধ্যরাতেও ট্রেনের শব্দ এই কয় বছরে সয়ে গেছে। ট্রেন গেলে মিঠি জানলায় দাঁড়িয়ে আগে প্যাসেঞ্জারদের টা টা দিতো। এখন খাঁ খাঁ রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়ে জিজ্ঞেস করে,"আবার কবে ট্রেন চলবে বাবা?"
ও অবশ্য জেনে গেছে, ওর বাবার কাছে এই উত্তর নেই। মাঝেমধ্যে যে ট্রেনগুলো ছুটে যায়, ওগুলো রেলের নিজস্ব কর্মীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আড়াল থেকে কেউ যেন জাদুকাঠি দিয়ে এই সভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এতোদিন একনাগাড়ে এইভাবে ট্রেন শাটডাউন হয়নি। প্রায় একমাস হতে চললো, কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলতে দেখিনি। ট্রেনেও চড়িনি। কোথায় গেল, সেই লোকাল ট্রেনের ভীড়, কোলাহল! কোথায় গেলো ট্রেনের সেইসব পরিচিত অপরিচিত হকাররা? কিম্বা জমিয়ে তাসখেলার মুখগুলো? শুধু কি ট্রেন? ভীষণ ব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম গুলোয় এখন শ্মশানের নীরবতা। এখনো ভেবে চলেছি, চোখের সামনে যা দেখছি, এসব স্বপ্ন নয় তো!
এই ভারতীয় রেল কতকিছুরই তো সাক্ষী! ট্রেন চলাচল শুরু হতেই এদেশের উচ্চবর্ণের বহুমানুষ প্রতিবাদ করে বলেছিল, ট্রেন চালানো ঘোরতর অন্যায়। এতে জাত যাবে। হিঁদু,মোসলমান,মুচি,মেথর সব গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাবে! ভারতীয় রেল সাক্ষী, বড় বড় স্টেশনে একসময় 'হিন্দু পানি' আর 'মুসলমান পানি' আলাদা ভাবে বিক্রি হত। দুই পানি'র স্বাদ কি আলাদা হত? কী জানি! সেসব অবশ্য ব্রিটিশ আমল। ভারতীয় রেল সাক্ষী আছে, যেদিন প্রথম এদেশে ট্রেন চলেছিল, দেশের মানুষ গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করেছিল। ভক্তিভরে ইঞ্জিনের গায়ে এঁকে দিয়েছিল লাল তিলক। পাদানিতে দেবতার উদ্দেশ্যে ফল,মিষ্টিও অর্পণ করেছিলো। এই ট্রেনে চেপে, ট্রেনচলার শব্দ ও ছন্দ শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন মনে বলে উঠেছিলেন, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত ;দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত ; সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত ;দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত.....চলন্ত ট্রেন নাকি এই কথাগুলোই বলেচলেছিলো।
কোটি কোটি মানুষের রুজিরোজগারের ট্রেন, সমাজ,সংস্কৃতি, অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ট্রেন আজ অদ্ভুত এক ভাইরাসের ভয়ে স্তব্ধ। রেলের ইতিহাসে লেখা হল নতুন এক অধ্যায়।
কবে আবার স্বাভাবিক হবে ট্রেন চলাচল?
আমরা জানিনা। হয়তো কেউ-ই জানেনা।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৮৬৮ সালের কথা। সস্ত্রীক মথুরবাবু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাগ্নে হৃদয় কে নিয়ে ট্রেনে চড়ে তীর্থে চলেছেন। ট্রেন ছুটেছে কাশীর উদ্দেশ্যে। একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। ঠাকুরের এতোক্ষণ কি আর ট্রেনের মধ্যে ভালো লাগে! তিনি তাই নেমে পড়েছেন স্টেশনে। সঙ্গে হৃদয়ও। ঠাকুর কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের ট্রেনে তুলতে। উদ্বিগ্ন মথুর বাবু। জনমানবহীন অপরিচিত স্টেশন। ঠাকুর তো আপন মনে প্ল্যাটফর্মের এক গায়ের নিচে গিয়ে বসেছেন। এদিকে গাড়ির হুইসিল দিয়েছে। ঠাকুর নির্বিকার। ভাগ্নে হৃদয় চিলচিৎকার জুড়ে দিয়েছে। মথুরবাবু কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেন ছেড়ে দিলো। সত্যিই ছেড়ে দিলো। ঠাকুর পড়ে রইলেন প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে ঠাকুরের আচরণে প্রচন্ড ভেঙে পড়া ভাগ্নে হৃদয়। এবার কী হবে?
স্টেশন মাস্টারের কাছে ছুটলো হৃদয়। পরের ট্রেন কখন? মাস্টারমশাই জানালেন, আজ আর ট্রেন নেই। পরের ট্রেন আসবে আগামীকাল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো হৃদয়ের। এদিকে একথা শুনে তো ঠাকুর নাচতে শুরু করেছেন.... "ওরে হৃদয়, এবারেই তো খেলা জমবে। ওরে দেখ এবার মা কী করে!" হৃদয় তো ঠাকুরের কথা শুনে রেগে আগুন.... " হ্যাঁ, তোমার মা রেল কোম্পানি খুলবে!"
হৃদয় যত রাগে, ঠাকুর ততই আনন্দ পান। তাঁর মধ্যে উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা তো দূরের কথা, তিনি আনন্দে টগবগ করে ফুটছেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকার পর হঠাৎ সেই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে এসে বললেন, " আপনাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। রেলের একজন খুব বড় অফিসার একটি সেলুন কার নিয়ে কাশি চলেছেন। তিনি কিছুক্ষণ এই প্ল্যাটফর্মে থামবেন। আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ওনাকে অনুরোধ করতে পারি। কিছুক্ষণ পর একটা অত্যন্ত সাজানো গোছানো ট্রেন এসে হাজির হল সেখানে। ট্রেন থেকে যিনি নামলেন, তিনি রাজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলের মস্ত অফিসার।
বাড়ি বাগবাজার। ঠাকুর কে এই অবস্থায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলেন তিনি। ঠাকুর তাঁকে না চিনলেও তিনি চেনেন। রাজেনবাবু বলেন, "এ কী অবস্থা আপনার! কোথায় যাবেন?" ঠাকুরও তো কাশিই যাবেন! রাজেনবাবু তো প্রণাম করে ঠাকুর কে তাঁর ট্রেনে তুলেছেন। এ ট্রেন একদম অন্যরকম। পুরু গদিওলা সোফা, সামনে টেবিল, জানলায় পর্দা। যেন বাড়ির বিলাশবহুল বৈঠকখানা। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। রাজেন্দ্রলাল বাবু অস্ফুটে বলে উঠলেন, দক্ষিণেশ্বরের দেবতাকে নিয়ে চলেছি কাশির দেবতার কাছে। আর এদিকে ঠাকুর তো মিটিমিটি হাসছেন আর ভাগ্নে হৃদয়ের দিকে চেয়ে বলছেন,.... "হ্যাঁ গা, কী বুঝলি...?"
হঠাৎ এই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল কেন? কেনই বা উল্লেখ করলাম?
মনে হল, আমরা সবাই, এই সভ্যতা যেন একটা অদৃশ্য প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। চারপাশে সব স্তব্ধ। কবে ট্রেন আসবে কেউ জানেনা। কিন্তু হঠাৎ যদি সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে সেই রাজেনবাবুর ট্রেনটার মতন কোনো ট্রেন ছুটে আসে?
আবার যদি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়!
আমরা তো আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নই, পাপীতাপি কীটপতঙ্গ। তবু আশায় বুক বেঁধেছি।
ঠাকুর, কবে আসবে 'সেই ট্রেন'?
(সংকলিত)
#ডাকাতের_কবলে_ঠাকুর ?
না
#ঠাকুরের_কবলে_ডাকাত ?
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●
শ্রী রামকৃষ্ণ একবার ডাকাতের কবলে পড়েছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজের উৎসবশেষে দক্ষিণেশ্বরে ফিরছেন শ্রী রামকৃষ্ণ, সঙ্গে হৃদয়।
রাত বেশ গভীর। চানকের রাস্তায় (বি. টি.রোড) তখন আশপাশে জঙ্গল, ডাকাতদল আটকাল গাড়ি।
তারা তিনজন -- সঙ্গে বল্লম, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্র।
গাড়ি যখন, তখন যথেষ্ট বিত্তবান সন্দেহ নেই।
কিন্তু হায়, এরা তো অতি সাধারণ, কিছুই সঙ্গে নেই। তারা হতাশ ও ক্রুদ্ধ।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের বুঝিয়ে বললেন, দক্ষিণেশ্বরে এসো, তোমাদের পাওনা মিটিয়ে দেব। কোনও চালাকি নয়তো! তবে মানুষটিকে যেন কেমন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। সর্দার 'তারা কাঁড়ার' বললে , ঠিক আছে তবে কোনও চালাকি যেন না করা হয়, তাহলে পার পাবে না। তারপর কদিন বাদে 'তারা কাঁড়ার' দক্ষিণেশ্বরে এসে হাজির।
শ্রী রামকৃষ্ণ কে বলল, কই আমাদের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দাও।
ঠাকুর বললেন , বসো, মায়ের প্রসাদ পাও, দেব বৈকি।
রাতের কারবারি সে, ঘরে নানা লোকের আনাগোনা -- হৃদয় হাজির -- ভাল ঠেকল না। সে একটু থেকেই চম্পট দিল। কিন্তু ছাড়তে রাজি নয়, কদিন বাদে আবার হাজির। সেদিন রামকৃষ্ণ মায়ের নাম গান করছেন।
সে গানে সর্দার মুগ্ধ!
প্রসাদ ধারণ করে, জল খেয়ে নীরবে প্রস্থান।
কী জানি কোন পাওনায় আজ তার মন ভরপুর! তারপর একদিন তিনজনেই এসে হাজির।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের দেখে মায়ের নাম করছেন আর বলেছেন, লাগ্ ভেলকি, লাগ্ ।
তা ভেলকিই লাগল, তারা সটান পড়ল শ্রী রামকৃষ্ণের চরণে ---- আমাদের কী হবে, আমরা পাপী, খুনি, ডাকাতি করি।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের সদ্ ভাবে জীবন যাপন করতে বলে অনেক সান্তনা দিয়ে ফেরত পাঠালেন। এবারে তাদের পাওনা পূর্ণ হল।
'তারা কাড়ার' এক কাঠ গোলায় চাকরি পেল, তার এক সাগরেদ হল রানী রাসমণির বাড়ির পাইক, অপরটি হল এক আস্তাবলে ঘোড়ার সহিস।
'তারা কাড়ার' আসত ঠাকুরের কাছে। একটা পিঁড়ি তৈরি করে ঠাকুরকে উপহার দিয়েছিল সে।
তিনি অপ্রকট হলে সে দক্ষিণেশ্বরে এসে তাঁর ঘরে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা আর চোখের জলে ভাসত।"
আমার মন তুমি ,নাথ, লবে হ'রে/ আমি আছি বসে সেই আশা ধরে।।"
সূত্র: নিবোধত, মে-জুন ২০১৮
সংগৃহীত।
https://m.facebook.com/groups/333556606679773?view=permalink&id=2841268785908530
" খণ্ডন-ভব-বন্ধন " ভজন- সঙ্গীতে স্বামীজী ঠাকুরের যে জীবন্ত ভাবরূপ আমাদের জন্য ধরে দিয়েছেন, তা চিরকাল প্রাণবন্ত ধ্যানের বস্তু হয়ে থাকবে ৷
রামকৃষ্ণের গোঠ-গোত্রের, জন্মধামের সাধন-আরাধনার এমনকি তাঁর অনবদ্য অবয়বের পর্যন্ত বর্ণনা করলেন না— ভাবমুখের রামকৃষ্ণকে ভাব-মুখেই প্রকাশ করলেন ৷
বললেন ঃ " বন্দি তোমায় ৷"
কিন্তু কে তিনি ?
তাঁর কি রূপ ?
কি আশ্চর্য জবাব— " খণ্ডন-ভব-বন্ধন! " ভব-বন্ধন খণ্ডন করে কে ?
যিনি অখণ্ড তিনিই খণ্ডন-ভব-বন্ধন ৷
খণ্ড দিয়ে খণ্ডন হয় না ৷
সব খণ্ডিত বস্তুই মায়াধীন ৷
তবু ব্যক্ত হয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রাণের বস্তু হয়ে হৃদয়ে এসেছেন কেন ?
হৃতস্মৃতি মানুষকে পুনরায় অখণ্ডে ফিরিয়ে নেবেন বলে ৷
তিনি অঞ্জনহীন নররূপধর ৷
তার সেইরূপ মানুষকে আত্মশ্রদ্ধ করেছে, ভগবানকে আত্মীয় করেছে, ধারণার বস্তু করেছে ৷ নেই তার গুণ, তবু গুণময় ৷
ধরাছোঁয়ার বাইরে, তবু তিনি ধরা দিয়েছেন—কৃপায় ৷
তাঁকে আঁকড়ে ধরে এই ধরার সকল আসক্তি ছোঁয়ার বাইরে যাওয়া চলে৷
পঙ্কিল এই কলিকালে তিনি হচ্ছেন " মোচন-অঘদূষণ " ৷
অনেক কর্মের গেরো জড়ানো নাড়িতে-অষ্টপাশে বাঁধা ৷
তবু ভরসাহীন নই ৷
নিজেই চুম্বক নিজেই কাদা সরিয়ে নেন ছুঁচের উপর চেপে ৷
তবেই না ভগবানে একটু আধটু মন ৷
কী করুণার ব্যাথামাখা কথা—" কখনো ভগবান চুম্বক, ভক্ত ছুঁচ; কখনো ভক্ত চুম্বক, ভগবান ছুঁচ হন ৷" তা নাহলে ভরসা ছিল কি ?
কালাতীত বলেই কালের করে কালস্বরূপ তিনি ৷
দেখতে আমাদের মতো, কত আপনজনের মতো কথা ! অথচ ব্রহ্মবস্তু ৷
দেহের মাংস-মজ্জা কাশীপুরে দগ্ধ হয়েছিল—তবু রামকৃষ্ণতনু, সেই " চিদঘনকায় ", জ্বল-জ্বল করছে কোটি ভক্তহৃদয়ে ৷
একটি তো ছিলেন ৷ এত হলেন কি করে? একটি বলেই ৷
অস্তি-বস্তুর নির্যাসকেই বলা চলে 'ভাব' ৷
তারই সমুজ্জ্বল-সাগর শ্রীরামকৃষ্ণ ৷
এ দার্শনিকের নির্বিকার ব্রহ্মসাগর নয় ৷
এ " চির-উন্মাদ প্রেমপাথার " ৷
যিনি জগদীশ্বর, তিনি যোগেশ্বর ৷
তিনিই আসেন যুগে যুগে ৷
এসেছেন বহু বহু করুণা-ভক্তির টানে—ভক্ত তরাতে ৷ বিযুক্তকে যুক্ত করতে ৷
সবাই যে ভুলে আছে সেই নাড়ির সম্বন্ধ ৷ লোকের ভিড়ে, কথা বলতে, পথ চলতে, রহস্য করতে করতে, হাসি- অশ্রুর শান্ত নানা অবস্থায় আচম্বিতে সমাহিত হয়ে হাতে-কলমে দেখালেন ৷
মানুষের সত্য-সনাতন অবস্থা সত্য সুন্দর হয়ে জীবনে এলেন জীবকে আবার শিব করবেন বলে ৷ অজ্ঞানের ঘরে জ্বালালেন প্রজ্ঞানের মণি-দীপ ৷
~ স্বামী বুধানন্দ।
মানুষের যতরকম সদগুণ আছে, দয়া তার মধ্যে অন্যতম । যে সংসারে দয়া, হৃদ্যতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা নেই, সেটি তৃণহীন মরুভূমির মতো শুষ্ক, নিষ্প্রাণ । দয়া ও হৃদ্যতা সংসারকে করে সরস, সজীব, প্রাণরসে উদ্বেলিত । দয়া থেকে জন্ম নেয় ক্ষমা ও ভালবাসা । অন্তরে অন্তরে ফুটে ওঠে প্রীতির মুকুল ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, " দেখ, দয়া আর মায়া এ-দুটি আলাদা জিনিস । মায়া মানে আত্মীয়ে মমতা ; যেমন বাপ-মা, ভাই-ভগ্নী, স্ত্রী-পুত্র এদের উপর ভালবাসা । দয়া সর্বভূতে ভালবাসা ; সমদৃষ্টি । কারু ভিতর যদি দয়া দেখ যেমন বিদ্যাসাগরের, সে জানবে ঈশ্বরের দয়া । দয়া থেকে সর্বভূতের সেবা হয় । মায়াও ঈশ্বরের । মায়া দ্বারা তিনি আত্মীয়দের সেবা করিয়ে লন । তবে একটি কথা আছে ------ মায়াতে অজ্ঞান করে রাখে, আর বদ্ধ করে । কিন্তু দয়াতে চিত্তশুদ্ধি হয় । ক্রমে বন্ধন মুক্তি হয় । "
শ্রীশ্রীমা বলতেন, " আমার দয়া যার উপর নেই সে নেহাত হতভাগ্য । আমার দয়া যে কার উপর নেই তা বুঝি না ------ প্রাণীটা পর্যন্ত । "
আমেরিকা থেকে এক পত্রে স্বামীজী লিখছেন, " এদেশের তুষার যেমন ধবল তেমনি হাজার হাজার মেয়ে দেখেছি । আর এরা কেমন স্বাধীন । সকল কাজ এরাই করে ।....... আর এদের কত দয়া ! যতদিন এখানে এসেছি, এদের মেয়েরা বাড়িতে স্থান দিয়েছে, খেতে দিচ্ছে ----- লেকচার দেবার সব বন্দোবস্ত করে, সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে যায় ------ কি না করে বলতে পারি না । শত শত জন্ম এদের সেবা করলেও এদের ঋণমুক্ত হব না । "
সর্বজীবে ভালবাসার নাম প্রেম, দয়া, করুণা । তখন কর্ম ফলাকাঙ্ক্ষারহিত হয়ে সর্বজীবের সুখ ও কল্যাণ সাধনে অনুষ্ঠিত হয় ।
সন্ত তুলসীদাস এজন্যই বলেছেন --------
" দয়া ধরমকা মূল, নরকমূল অভিমান ।
তুলসি কহে দয়া না ছোড়িয়ে, যবলগ্ ঘটমে প্রাণ ।। "
( উদ্বোধন : ১১৭ / ১২ )
💮💮 জয় ঠাকুর 💮 জয় মা 💮 জয় স্বামীজী 💮💮
ভালো থেকো সবাই।
বয়েস হয়েছে; ছোট দোকান, কষ্টে দিন গুজরায় কিন্তু গদাধর যখনই দোকানে এসে বসে, মনে হয় কোথাও যেন আর কষ্ট নেই। রাত যতই অন্ধকার হোক, গদাধর যেন চিরন্তন সুপ্রভাত।যাই একটু বাড়তি রোজগার হয় তাই দিয়ে মিষ্টি কিনে গদাধরকে খাওয়ায়। গদাধর খায় আর চিনু দেখে। ওদিকে খদ্দের এসেছে দোকানে, সেদিকে খেয়াল নেই। গদাধরকে যেন চিনতে পেরেছে চিনু। তার নাম যখন চিনু তখন সেই তো প্রথমে চিনতে পারবে।
একদিন হলো কি, চিনু ফুল তুলে পরিপাটি করে মালা গাঁথলে। কোঁচড়ে করে লুকিয়ে মিষ্টি কিনে আনলে বাজার থেকে। গদাধরকে বললে, ‘চলো!’
‘কোথায়?’
‘মাঠে । যেখানে কেউ কোথাও নেই। যেখানে কেবল তুমি আর আমি।‘
চিনিবাস গদাধরকে নিয়ে মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টির গোচরে নেই কোথাও জনমানুষ। উপরে আকাশ-ভরা শান্তির নীলিমা। মালা-মিষ্টি পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বসে রইল চিনিবাস। সামনে গদাধর। কৃষ্ণকিশোর।
‘এ কি চিনিবাসদা, এ কি করছ? তার চেয়ে মিষ্টির ঠোঙাটা হাতে দাও।‘
‘দিচ্ছি গো দিচ্ছি-‘
আগে মালা দিলে গলায়। কৃষ্ণের গলায় অতসী ফুলের মালা। পরে হাতে করে খাওয়াতে লাগল গদাধরকে। ব্রজের ননীগোপালকে।
জলে চোখ ভেসে যাচ্ছে চিনিবাসের। মিষ্টিভরা হাত কখনো পড়ছে গিয়ে গদাধরের নাকে, কখনো চোখে, কখনো কপালে। গদাধর হাসছে আর খাচ্ছে।
খাওয়ানোর পর আবার স্তব করতে বসল চিনিবাস। বললে, ‘বুড়ো হয়েছি, বাঁচব না বেশি দিন। মর্ত্যধামে তোমার কত লীলা –খেলা হবে, কিছুই দেখতে পাব না। তবু আজ যে আমাকে একটু চিনতে দিলে দয়া করে, তাই আমার পারের কড়ি হয়ে রইল।‘
মত্ত অসুরের মত স্বাস্থ্য ছিল চিনিবাসের। দু’হাতে তুলে গদাধরকে কাঁধে বীরবিক্রমে নৃত্য করত। বলত, ‘তুমি আমাকে দাদা বলো- চিনিবাস দাদা। আমি যদি তোমার দাদা হই, তবে আমি তো বলরাম।‘ বলে আবার নৃত্য।
তুমি সমুদ্র আর আমি সামান্য শঙ্খকার।-– পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ –অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।।
🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺
- "বাবা, ঐ দেখো ট্রেন যাচ্ছে, ট্রেন!"
মেয়ের উত্তেজনা দেখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো! দু কামরা'র একটা ছোট্ট ট্রেন হুশ করে চলে গেল।
আমাদের ফ্ল্যাটের ছাদে উঠে একটা ঢিল ছুঁড়লে রেল লাইনে গিয়ে পড়ে। দিনরাত,এমনকী মধ্যরাতেও ট্রেনের শব্দ এই কয় বছরে সয়ে গেছে। ট্রেন গেলে মিঠি জানলায় দাঁড়িয়ে আগে প্যাসেঞ্জারদের টা টা দিতো। এখন খাঁ খাঁ রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে । মেয়ে জিজ্ঞেস করে,"আবার কবে ট্রেন চলবে বাবা?"
ও অবশ্য জেনে গেছে, ওর বাবার কাছে এই উত্তর নেই। মাঝেমধ্যে যে ট্রেনগুলো ছুটে যায়, ওগুলো রেলের নিজস্ব কর্মীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আড়াল থেকে কেউ যেন জাদুকাঠি দিয়ে এই সভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এতোদিন একনাগাড়ে এইভাবে ট্রেন শাটডাউন হয়নি। প্রায় একমাস হতে চললো, কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলতে দেখিনি। ট্রেনেও চড়িনি। কোথায় গেল, সেই লোকাল ট্রেনের ভীড়, কোলাহল! কোথায় গেলো ট্রেনের সেইসব পরিচিত অপরিচিত হকাররা? কিম্বা জমিয়ে তাসখেলার মুখগুলো? শুধু কি ট্রেন? ভীষণ ব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম গুলোয় এখন শ্মশানের নীরবতা। এখনো ভেবে চলেছি, চোখের সামনে যা দেখছি, এসব স্বপ্ন নয় তো!
এই ভারতীয় রেল কতকিছুরই তো সাক্ষী! ট্রেন চলাচল শুরু হতেই এদেশের উচ্চবর্ণের বহুমানুষ প্রতিবাদ করে বলেছিল, ট্রেন চালানো ঘোরতর অন্যায়। এতে জাত যাবে। হিঁদু,মোসলমান,মুচি,মেথর সব গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাবে! ভারতীয় রেল সাক্ষী, বড় বড় স্টেশনে একসময় 'হিন্দু পানি' আর 'মুসলমান পানি' আলাদা ভাবে বিক্রি হত। দুই পানি'র স্বাদ কি আলাদা হত? কী জানি! সেসব অবশ্য ব্রিটিশ আমল। ভারতীয় রেল সাক্ষী আছে, যেদিন প্রথম এদেশে ট্রেন চলেছিল, দেশের মানুষ গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করেছিল। ভক্তিভরে ইঞ্জিনের গায়ে এঁকে দিয়েছিল লাল তিলক। পাদানিতে দেবতার উদ্দেশ্যে ফল,মিষ্টিও অর্পণ করেছিলো। এই ট্রেনে চেপে, ট্রেনচলার শব্দ ও ছন্দ শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন মনে বলে উঠেছিলেন, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত ;দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত ; সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত ;দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত.....চলন্ত ট্রেন নাকি এই কথাগুলোই বলেচলেছিলো।
কোটি কোটি মানুষের রুজিরোজগারের ট্রেন, সমাজ,সংস্কৃতি, অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ট্রেন আজ অদ্ভুত এক ভাইরাসের ভয়ে স্তব্ধ। রেলের ইতিহাসে লেখা হল নতুন এক অধ্যায়।
কবে আবার স্বাভাবিক হবে ট্রেন চলাচল?
আমরা জানিনা। হয়তো কেউ-ই জানেনা।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৮৬৮ সালের কথা। সস্ত্রীক মথুরবাবু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাগ্নে হৃদয় কে নিয়ে ট্রেনে চড়ে তীর্থে চলেছেন। ট্রেন ছুটেছে কাশীর উদ্দেশ্যে। একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। ঠাকুরের এতোক্ষণ কি আর ট্রেনের মধ্যে ভালো লাগে! তিনি তাই নেমে পড়েছেন স্টেশনে। সঙ্গে হৃদয়ও। ঠাকুর কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের ট্রেনে তুলতে। উদ্বিগ্ন মথুর বাবু। জনমানবহীন অপরিচিত স্টেশন। ঠাকুর তো আপন মনে প্ল্যাটফর্মের এক গায়ের নিচে গিয়ে বসেছেন। এদিকে গাড়ির হুইসিল দিয়েছে। ঠাকুর নির্বিকার। ভাগ্নে হৃদয় চিলচিৎকার জুড়ে দিয়েছে। মথুরবাবু কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেন ছেড়ে দিলো। সত্যিই ছেড়ে দিলো। ঠাকুর পড়ে রইলেন প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে ঠাকুরের আচরণে প্রচন্ড ভেঙে পড়া ভাগ্নে হৃদয়। এবার কী হবে?
স্টেশন মাস্টারের কাছে ছুটলো হৃদয়। পরের ট্রেন কখন? মাস্টারমশাই জানালেন, আজ আর ট্রেন নেই। পরের ট্রেন আসবে আগামীকাল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো হৃদয়ের। এদিকে একথা শুনে তো ঠাকুর নাচতে শুরু করেছেন.... "ওরে হৃদয়, এবারেই তো খেলা জমবে। ওরে দেখ এবার মা কী করে!" হৃদয় তো ঠাকুরের কথা শুনে রেগে আগুন.... " হ্যাঁ, তোমার মা রেল কোম্পানি খুলবে!"
হৃদয় যত রাগে, ঠাকুর ততই আনন্দ পান। তাঁর মধ্যে উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা তো দূরের কথা, তিনি আনন্দে টগবগ করে ফুটছেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকার পর হঠাৎ সেই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে এসে বললেন, " আপনাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। রেলের একজন খুব বড় অফিসার একটি সেলুন কার নিয়ে কাশি চলেছেন। তিনি কিছুক্ষণ এই প্ল্যাটফর্মে থামবেন। আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ওনাকে অনুরোধ করতে পারি। কিছুক্ষণ পর একটা অত্যন্ত সাজানো গোছানো ট্রেন এসে হাজির হল সেখানে। ট্রেন থেকে যিনি নামলেন, তিনি রাজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলের মস্ত অফিসার।
বাড়ি বাগবাজার। ঠাকুর কে এই অবস্থায় স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলেন তিনি। ঠাকুর তাঁকে না চিনলেও তিনি চেনেন। রাজেনবাবু বলেন, "এ কী অবস্থা আপনার! কোথায় যাবেন?" ঠাকুরও তো কাশিই যাবেন! রাজেনবাবু তো প্রণাম করে ঠাকুর কে তাঁর ট্রেনে তুলেছেন। এ ট্রেন একদম অন্যরকম। পুরু গদিওলা সোফা, সামনে টেবিল, জানলায় পর্দা। যেন বাড়ির বিলাশবহুল বৈঠকখানা। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। রাজেন্দ্রলাল বাবু অস্ফুটে বলে উঠলেন, দক্ষিণেশ্বরের দেবতাকে নিয়ে চলেছি কাশির দেবতার কাছে। আর এদিকে ঠাকুর তো মিটিমিটি হাসছেন আর ভাগ্নে হৃদয়ের দিকে চেয়ে বলছেন,.... "হ্যাঁ গা, কী বুঝলি...?"
হঠাৎ এই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল কেন? কেনই বা উল্লেখ করলাম?
মনে হল, আমরা সবাই, এই সভ্যতা যেন একটা অদৃশ্য প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। চারপাশে সব স্তব্ধ। কবে ট্রেন আসবে কেউ জানেনা। কিন্তু হঠাৎ যদি সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে সেই রাজেনবাবুর ট্রেনটার মতন কোনো ট্রেন ছুটে আসে?
আবার যদি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়!
আমরা তো আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নই, পাপীতাপি কীটপতঙ্গ। তবু আশায় বুক বেঁধেছি।
ঠাকুর, কবে আসবে 'সেই ট্রেন'?
(সংকলিত)
#ডাকাতের_কবলে_ঠাকুর ?
না
#ঠাকুরের_কবলে_ডাকাত ?
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●
শ্রী রামকৃষ্ণ একবার ডাকাতের কবলে পড়েছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজের উৎসবশেষে দক্ষিণেশ্বরে ফিরছেন শ্রী রামকৃষ্ণ, সঙ্গে হৃদয়।
রাত বেশ গভীর। চানকের রাস্তায় (বি. টি.রোড) তখন আশপাশে জঙ্গল, ডাকাতদল আটকাল গাড়ি।
তারা তিনজন -- সঙ্গে বল্লম, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্র।
গাড়ি যখন, তখন যথেষ্ট বিত্তবান সন্দেহ নেই।
কিন্তু হায়, এরা তো অতি সাধারণ, কিছুই সঙ্গে নেই। তারা হতাশ ও ক্রুদ্ধ।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের বুঝিয়ে বললেন, দক্ষিণেশ্বরে এসো, তোমাদের পাওনা মিটিয়ে দেব। কোনও চালাকি নয়তো! তবে মানুষটিকে যেন কেমন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। সর্দার 'তারা কাঁড়ার' বললে , ঠিক আছে তবে কোনও চালাকি যেন না করা হয়, তাহলে পার পাবে না। তারপর কদিন বাদে 'তারা কাঁড়ার' দক্ষিণেশ্বরে এসে হাজির।
শ্রী রামকৃষ্ণ কে বলল, কই আমাদের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দাও।
ঠাকুর বললেন , বসো, মায়ের প্রসাদ পাও, দেব বৈকি।
রাতের কারবারি সে, ঘরে নানা লোকের আনাগোনা -- হৃদয় হাজির -- ভাল ঠেকল না। সে একটু থেকেই চম্পট দিল। কিন্তু ছাড়তে রাজি নয়, কদিন বাদে আবার হাজির। সেদিন রামকৃষ্ণ মায়ের নাম গান করছেন।
সে গানে সর্দার মুগ্ধ!
প্রসাদ ধারণ করে, জল খেয়ে নীরবে প্রস্থান।
কী জানি কোন পাওনায় আজ তার মন ভরপুর! তারপর একদিন তিনজনেই এসে হাজির।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের দেখে মায়ের নাম করছেন আর বলেছেন, লাগ্ ভেলকি, লাগ্ ।
তা ভেলকিই লাগল, তারা সটান পড়ল শ্রী রামকৃষ্ণের চরণে ---- আমাদের কী হবে, আমরা পাপী, খুনি, ডাকাতি করি।
শ্রী রামকৃষ্ণ তাদের সদ্ ভাবে জীবন যাপন করতে বলে অনেক সান্তনা দিয়ে ফেরত পাঠালেন। এবারে তাদের পাওনা পূর্ণ হল।
'তারা কাড়ার' এক কাঠ গোলায় চাকরি পেল, তার এক সাগরেদ হল রানী রাসমণির বাড়ির পাইক, অপরটি হল এক আস্তাবলে ঘোড়ার সহিস।
'তারা কাড়ার' আসত ঠাকুরের কাছে। একটা পিঁড়ি তৈরি করে ঠাকুরকে উপহার দিয়েছিল সে।
তিনি অপ্রকট হলে সে দক্ষিণেশ্বরে এসে তাঁর ঘরে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা আর চোখের জলে ভাসত।"
আমার মন তুমি ,নাথ, লবে হ'রে/ আমি আছি বসে সেই আশা ধরে।।"
সূত্র: নিবোধত, মে-জুন ২০১৮
সংগৃহীত।
https://m.facebook.com/groups/333556606679773?view=permalink&id=2841268785908530
" খণ্ডন-ভব-বন্ধন " ভজন- সঙ্গীতে স্বামীজী ঠাকুরের যে জীবন্ত ভাবরূপ আমাদের জন্য ধরে দিয়েছেন, তা চিরকাল প্রাণবন্ত ধ্যানের বস্তু হয়ে থাকবে ৷
রামকৃষ্ণের গোঠ-গোত্রের, জন্মধামের সাধন-আরাধনার এমনকি তাঁর অনবদ্য অবয়বের পর্যন্ত বর্ণনা করলেন না— ভাবমুখের রামকৃষ্ণকে ভাব-মুখেই প্রকাশ করলেন ৷
বললেন ঃ " বন্দি তোমায় ৷"
কিন্তু কে তিনি ?
তাঁর কি রূপ ?
কি আশ্চর্য জবাব— " খণ্ডন-ভব-বন্ধন! " ভব-বন্ধন খণ্ডন করে কে ?
যিনি অখণ্ড তিনিই খণ্ডন-ভব-বন্ধন ৷
খণ্ড দিয়ে খণ্ডন হয় না ৷
সব খণ্ডিত বস্তুই মায়াধীন ৷
তবু ব্যক্ত হয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রাণের বস্তু হয়ে হৃদয়ে এসেছেন কেন ?
হৃতস্মৃতি মানুষকে পুনরায় অখণ্ডে ফিরিয়ে নেবেন বলে ৷
তিনি অঞ্জনহীন নররূপধর ৷
তার সেইরূপ মানুষকে আত্মশ্রদ্ধ করেছে, ভগবানকে আত্মীয় করেছে, ধারণার বস্তু করেছে ৷ নেই তার গুণ, তবু গুণময় ৷
ধরাছোঁয়ার বাইরে, তবু তিনি ধরা দিয়েছেন—কৃপায় ৷
তাঁকে আঁকড়ে ধরে এই ধরার সকল আসক্তি ছোঁয়ার বাইরে যাওয়া চলে৷
পঙ্কিল এই কলিকালে তিনি হচ্ছেন " মোচন-অঘদূষণ " ৷
অনেক কর্মের গেরো জড়ানো নাড়িতে-অষ্টপাশে বাঁধা ৷
তবু ভরসাহীন নই ৷
নিজেই চুম্বক নিজেই কাদা সরিয়ে নেন ছুঁচের উপর চেপে ৷
তবেই না ভগবানে একটু আধটু মন ৷
কী করুণার ব্যাথামাখা কথা—" কখনো ভগবান চুম্বক, ভক্ত ছুঁচ; কখনো ভক্ত চুম্বক, ভগবান ছুঁচ হন ৷" তা নাহলে ভরসা ছিল কি ?
কালাতীত বলেই কালের করে কালস্বরূপ তিনি ৷
দেখতে আমাদের মতো, কত আপনজনের মতো কথা ! অথচ ব্রহ্মবস্তু ৷
দেহের মাংস-মজ্জা কাশীপুরে দগ্ধ হয়েছিল—তবু রামকৃষ্ণতনু, সেই " চিদঘনকায় ", জ্বল-জ্বল করছে কোটি ভক্তহৃদয়ে ৷
একটি তো ছিলেন ৷ এত হলেন কি করে? একটি বলেই ৷
অস্তি-বস্তুর নির্যাসকেই বলা চলে 'ভাব' ৷
তারই সমুজ্জ্বল-সাগর শ্রীরামকৃষ্ণ ৷
এ দার্শনিকের নির্বিকার ব্রহ্মসাগর নয় ৷
এ " চির-উন্মাদ প্রেমপাথার " ৷
যিনি জগদীশ্বর, তিনি যোগেশ্বর ৷
তিনিই আসেন যুগে যুগে ৷
এসেছেন বহু বহু করুণা-ভক্তির টানে—ভক্ত তরাতে ৷ বিযুক্তকে যুক্ত করতে ৷
সবাই যে ভুলে আছে সেই নাড়ির সম্বন্ধ ৷ লোকের ভিড়ে, কথা বলতে, পথ চলতে, রহস্য করতে করতে, হাসি- অশ্রুর শান্ত নানা অবস্থায় আচম্বিতে সমাহিত হয়ে হাতে-কলমে দেখালেন ৷
মানুষের সত্য-সনাতন অবস্থা সত্য সুন্দর হয়ে জীবনে এলেন জীবকে আবার শিব করবেন বলে ৷ অজ্ঞানের ঘরে জ্বালালেন প্রজ্ঞানের মণি-দীপ ৷
~ স্বামী বুধানন্দ।
💮💮💮💮💮💮 দয়া পরম ধর্ম 💮💮💮💮💮💮
মানুষের যতরকম সদগুণ আছে, দয়া তার মধ্যে অন্যতম । যে সংসারে দয়া, হৃদ্যতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা নেই, সেটি তৃণহীন মরুভূমির মতো শুষ্ক, নিষ্প্রাণ । দয়া ও হৃদ্যতা সংসারকে করে সরস, সজীব, প্রাণরসে উদ্বেলিত । দয়া থেকে জন্ম নেয় ক্ষমা ও ভালবাসা । অন্তরে অন্তরে ফুটে ওঠে প্রীতির মুকুল ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, " দেখ, দয়া আর মায়া এ-দুটি আলাদা জিনিস । মায়া মানে আত্মীয়ে মমতা ; যেমন বাপ-মা, ভাই-ভগ্নী, স্ত্রী-পুত্র এদের উপর ভালবাসা । দয়া সর্বভূতে ভালবাসা ; সমদৃষ্টি । কারু ভিতর যদি দয়া দেখ যেমন বিদ্যাসাগরের, সে জানবে ঈশ্বরের দয়া । দয়া থেকে সর্বভূতের সেবা হয় । মায়াও ঈশ্বরের । মায়া দ্বারা তিনি আত্মীয়দের সেবা করিয়ে লন । তবে একটি কথা আছে ------ মায়াতে অজ্ঞান করে রাখে, আর বদ্ধ করে । কিন্তু দয়াতে চিত্তশুদ্ধি হয় । ক্রমে বন্ধন মুক্তি হয় । "
শ্রীশ্রীমা বলতেন, " আমার দয়া যার উপর নেই সে নেহাত হতভাগ্য । আমার দয়া যে কার উপর নেই তা বুঝি না ------ প্রাণীটা পর্যন্ত । "
আমেরিকা থেকে এক পত্রে স্বামীজী লিখছেন, " এদেশের তুষার যেমন ধবল তেমনি হাজার হাজার মেয়ে দেখেছি । আর এরা কেমন স্বাধীন । সকল কাজ এরাই করে ।....... আর এদের কত দয়া ! যতদিন এখানে এসেছি, এদের মেয়েরা বাড়িতে স্থান দিয়েছে, খেতে দিচ্ছে ----- লেকচার দেবার সব বন্দোবস্ত করে, সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে যায় ------ কি না করে বলতে পারি না । শত শত জন্ম এদের সেবা করলেও এদের ঋণমুক্ত হব না । "
সর্বজীবে ভালবাসার নাম প্রেম, দয়া, করুণা । তখন কর্ম ফলাকাঙ্ক্ষারহিত হয়ে সর্বজীবের সুখ ও কল্যাণ সাধনে অনুষ্ঠিত হয় ।
সন্ত তুলসীদাস এজন্যই বলেছেন --------
" দয়া ধরমকা মূল, নরকমূল অভিমান ।
তুলসি কহে দয়া না ছোড়িয়ে, যবলগ্ ঘটমে প্রাণ ।। "
( উদ্বোধন : ১১৭ / ১২ )
💮💮 জয় ঠাকুর 💮 জয় মা 💮 জয় স্বামীজী 💮💮
ভালো থেকো সবাই।
বয়েস হয়েছে; ছোট দোকান, কষ্টে দিন গুজরায় কিন্তু গদাধর যখনই দোকানে এসে বসে, মনে হয় কোথাও যেন আর কষ্ট নেই। রাত যতই অন্ধকার হোক, গদাধর যেন চিরন্তন সুপ্রভাত।যাই একটু বাড়তি রোজগার হয় তাই দিয়ে মিষ্টি কিনে গদাধরকে খাওয়ায়। গদাধর খায় আর চিনু দেখে। ওদিকে খদ্দের এসেছে দোকানে, সেদিকে খেয়াল নেই। গদাধরকে যেন চিনতে পেরেছে চিনু। তার নাম যখন চিনু তখন সেই তো প্রথমে চিনতে পারবে।
একদিন হলো কি, চিনু ফুল তুলে পরিপাটি করে মালা গাঁথলে। কোঁচড়ে করে লুকিয়ে মিষ্টি কিনে আনলে বাজার থেকে। গদাধরকে বললে, ‘চলো!’
‘কোথায়?’
‘মাঠে । যেখানে কেউ কোথাও নেই। যেখানে কেবল তুমি আর আমি।‘
চিনিবাস গদাধরকে নিয়ে মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টির গোচরে নেই কোথাও জনমানুষ। উপরে আকাশ-ভরা শান্তির নীলিমা। মালা-মিষ্টি পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বসে রইল চিনিবাস। সামনে গদাধর। কৃষ্ণকিশোর।
‘এ কি চিনিবাসদা, এ কি করছ? তার চেয়ে মিষ্টির ঠোঙাটা হাতে দাও।‘
‘দিচ্ছি গো দিচ্ছি-‘
আগে মালা দিলে গলায়। কৃষ্ণের গলায় অতসী ফুলের মালা। পরে হাতে করে খাওয়াতে লাগল গদাধরকে। ব্রজের ননীগোপালকে।
জলে চোখ ভেসে যাচ্ছে চিনিবাসের। মিষ্টিভরা হাত কখনো পড়ছে গিয়ে গদাধরের নাকে, কখনো চোখে, কখনো কপালে। গদাধর হাসছে আর খাচ্ছে।
খাওয়ানোর পর আবার স্তব করতে বসল চিনিবাস। বললে, ‘বুড়ো হয়েছি, বাঁচব না বেশি দিন। মর্ত্যধামে তোমার কত লীলা –খেলা হবে, কিছুই দেখতে পাব না। তবু আজ যে আমাকে একটু চিনতে দিলে দয়া করে, তাই আমার পারের কড়ি হয়ে রইল।‘
মত্ত অসুরের মত স্বাস্থ্য ছিল চিনিবাসের। দু’হাতে তুলে গদাধরকে কাঁধে বীরবিক্রমে নৃত্য করত। বলত, ‘তুমি আমাকে দাদা বলো- চিনিবাস দাদা। আমি যদি তোমার দাদা হই, তবে আমি তো বলরাম।‘ বলে আবার নৃত্য।
তুমি সমুদ্র আর আমি সামান্য শঙ্খকার।-– পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ –অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।।
🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺🙏🏻🌼🌺
ঠাকুর তখন কাশীপুরে ক্যান্সারে ভুগছেন। রাম দত্ত বাবু কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার কৈলাস চন্দ্র বসুর কাছে গিয়ে ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করেন। কৈলাস বসু রামবাবুর কাছে ঠাকুরের মহত্ত্বের কথা শুনে বললেন: "এদিকে বলছ,'পরমহংসদেব', 'অবতার ', আবার বলছ---তাঁর গলদেশে বিষাক্ত ক্ষত হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে।পরমহংস অবতারও হবেন, আবার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারও হবে। এ কেমন কথা ? আমি হলে ভাই , ওরকম অবতারের কান মুচড়ে দিতুম।"
শুনে রামবাবু দুঃখিত হয়ে বললেন, "ওরূপ মহাপুরুষদের উদ্দেশে কটূক্তি করতে নাই। তাতে বক্তা ও শ্রোতা উভয়েরই অকল্যাণ হয়।" যা হোক তাঁরা গাড়ি করে কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে এসে পৌঁছালেন। ঠাকুর ডাক্তারকে নমস্কার করে জিজ্ঞাসা করেন, "হ্যাঁগো ডাক্তার, তুমি আগে আমার চিকিৎসার করবে, না আমার কান মুচড়ে দেবে?কোনটি আগে করবে?" শোনামাত্র কৈলাস ডাক্তারের অন্তরাত্মা শিউরে উঠল। ইনি কি করে জানলেন? বুঝলেন --এ পরমহংস নিশ্চয়ই অন্তর্যামী ভগবান। হাত জোর করে ঠাকুরের কাছে বললেন: "দীনের অপরাধ মার্জনা করবেন। না বুঝে যে অন্যায় করেছি তার জন্য আমি লজ্জিত।"
এরপর তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে ঠাকুরের চিকিৎসা করেন ও পরম ভক্ত হয়ে ওঠেন। পরবর্তী কালে তিনি ঠাকুরের ছবি প্রণাম না করে বাড়ি থেকে বের হতেন না। অন্তর্যামী ঠাকুর এইভাবে কৃপা করে ভক্তের অহংকার চূর্ণ করে দিতেন।
প্রণাম ঠাকুর🙏
শ্রীরামকৃষ্ণের মধুর স্মৃতি~
শ্রীশ্রীঠাকুর বরফ খেতে খুব ভালবাসতেন। একদিন খুব গরম ছিল, আমি কলকাতা থেকে দক্ষিণেশ্বর (ছয় মাইল) হেঁটে কাগজে মোড়া এক টুকরো বরফ নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ঠিক দুপুরবেলা ছিল আর সূর্যের তেজ এত প্রখর ছিল যে আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। ঠাকুর আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, "উঃ উঃ!" যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? তিনি বললেন যে আমার শরীরের দিকে তাকাতেই তার শরীর জ্বলতে আরম্ভ করলো। আশ্চর্যের কথা, বরফ সারা রাস্তা এতটুকু গলেনি।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন কাশীপুরে উদ্যান বাটীতে এলেন তখন শীতকাল এবং প্রায়ই ঠাণ্ডা পড়ত। একবার ঠাকুরের সেবা করার সময়, মাঝরাতে আমি তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম শুধুমাত্র একটি পাতলা কাপড় গায়ে দিয়ে। ফিরে এসে দেখি, অসুস্থ অবস্থায় তিনি খাট থেকে উঠে কোন প্রকারে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের অপর প্রান্তে গিয়ে হুকে ঝুলানো একটা শালের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি তিরস্কারের কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কি করছেন? এখন কনকনে ঠাণ্ডা, আপনার বিছানা ছেড়ে ওঠা উচিত হয়নি।" ঠাকুর তার নিজের শালখানি হাতে করে উদ্বেগ ও স্নেহপূর্ণ দুর্বল কন্ঠে বললেন, "আমি চাই না তোর ঠাণ্ডা লাগুক। এটা নে।"
ঠাকুরের ব্যবহৃত শাল কাছে রাখার যোগ্যতা আমার নেই মনে করে ঐটি পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে দিয়েছিলাম।
----------স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ




No comments:
Post a Comment