❣বিবেকানন্দের অজানা তথ্য:১৭
❣লেখনী: ❣মাতা ঠাকুরাণীর ছেলে
সেই স্বনামধন্য সুন্দরী এমা কালভের জন্ম হয় 1864 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের এই গ্রামে। শৈশব থেকেই এমা জিরো চেতনায় ভরপুর এবং জীবন সংগ্রামে নিপুন সৈনিক ছিলেন । একটু বড় হলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুনে নিজেকে গায়িকা ও নর্তকী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন ।পরে ওই সকল বিষয় একাগ্রচিত্তে তালিম নিয়েছেন । হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা সুরঞ্জিতের ঊর্বশী।
যেহেতু তিনি সুন্দরী ও শ্রেষ্ঠ অপেরা গায়িকা ছিলেন , কাজেই তাঁর গুন মুগ্ধের অভাব ঘটে নি । বহু ব্যক্তিত্ব তার হৃদয়ের দরজা আঘাত করেছেন এবং ক্ষত গড়ে তুলেছেন।
এভাবে জীবন যখন সাফল্য, যন্ত্রণা, বেদনায় পসার বয়ে নিয়ে চলেছে গর্বিতা কালভে। এমন দিনে হঠাৎ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো স্বামী বিবেকানন্দের ।
সময়টা 1898 সাল । কালভে এসেছেন শিকাগো শহরে। এক নৃত্য-গীতের আসর এ। মানসিক আঘাতের তখন তার মন প্রাণ আড়ষ্ট অথচ গানের আসরে হাজির হতেই হবে ।মনের উদ্যম আনার জন্য শিকাগোয় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার একমাত্র কন্যাকে। সে তখন শিশু । তিনি তাকে রেখেছিলেন এক বন্ধুর নিকট।
অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে এমা সেখানে পরপর কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছেন। শেষ দিন শেষ অঙ্কের নৃত্যগীত সেরে যখন তিনি গ্রীন রুমে ঢুকলেন তখন তার কাছে খবর এলো, তার একমাত্র কন্যা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। অর্থাৎ তিনি যখন মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছিলেন তখন তার একমাত্র কন্যা অগ্নিদগ্ধ হচ্ছিল । হায় জীবন !
রূপে গুনে শ্রেষ্ঠ অপেরা সুন্দরী এমার দম্ভ যেন অলংকার। স্টেজে উঠলেই লক্ষ করতালিতে অভিনন্দন জানান হাজারো দর্শক। তা শুনে ভাল লাগে তার । তার গুনপনায় অমিত প্রশংসায় পত্রপত্রিকা মুখর ।
এহেন গায়িকার বুকে জমে থাকে পাহাড়প্রমাণ বিষাদ। আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন কিন্তু পারেননি। হয়ত মা কালী তা চান নি।
অবসাদ গ্রস্থ কালভে হোটেলে ফিরলেন ।হঠাৎ তার বন্ধু মিসেস এডমাস তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।এডামস বললেন “এক ভারতীয় সন্ন্যাসী এসেছে শিকাগো তে।যেন জ্যোতিরময় ঈশ্বর তিনি। তুমি যদি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ কর তাহলে তুমি নিশ্চিন্ত শান্তি লাভ করতে সমর্থ হবে । “
কালভের চোখের চাহনি হল বিদ্রূপ। এডামস পুনরায় তাকে অনুরোধ করলেন ।কারণ তিনিও চান যে এই বিশ্ব বিখ্যাত গায়িকা এই যন্ত্রণাময় অবসাদগ্রস্থ জীবন থেকে মুক্ত হন। অবশেষে কালভে রাজি হলেন।
অবশেষে একদিন, সেটি তাঁর এমত প্রয়াসের চতুর্থ বা পঞ্চম দিন, তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁর সেই বন্ধুর বাড়ির দরজায় – যেখানে স্বামীজী ছিলেন। সেই গৃহের বাট্লার বা খানসামা দরজা খুলে দিলেন এবং এমা বসার ঘরের একটি আরামদায়ক চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
এইভাবে ঘোরলাগা অবস্থায় সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তাঁর কানে এল কে যেন পাশের ঘর থেকে অতি মৃদু স্বরে তাঁকে ডাকছেন, ‘এস বাছা! ভয় পেয়ো না!’ প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরে ধীরে সেই ঘরটিতে গিয়ে পৌঁছলেন যেখানে একটি টেবিলের অপরদিকে স্বামীজী বসে রয়েছেন।
যেহেতু বাড়িটিতে ঢোকার সময়েই এমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে বিবেকানন্দ কথা না বললে কোন কথা না বলতে, তাই তিনি সেই ঘরে গিয়ে স্বামীজীর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্বামীজী ধ্যানরত স্তব্ধতায় অপরূপ ভঙ্গিতে বসেছিলেন, তাঁর গেরুয়া আলখাল্লার নিম্নাংশ লুটিয়ে ছিল মেঝেতে, উষ্ণীষবদ্ধ মাথাটি সামনে ঝুঁকে– দৃষ্টি ভূমিনিবদ্ধ। সামান্যক্ষণ পরেই চোখ না তুলেই তিনি বলে উঠলেন , “কন্যা মোর! তোমার চতুর্দিকে কি না যন্ত্রণা ও সংকটের আবর্ত। শান্ত হও ।তোমার প্রয়োজন শান্তি।”
অপার বিস্ময় তিনি ভাবলেন ,” যে ব্যক্তি আমার নাম পর্যন্ত জানেন না । তিনি আমার মনের গভীরতম বেদনাকে জানলেন কেমন করে ??? “
অভিভূত হয়ে কালভে স্বামীজিকে প্রশ্ন করলেন, “এসব কথা আপনি জানলেন কি করে ?এসব কে বলেছে আপনাকে ? “
স্বামীকে কমোল ভাবে বললেন , “কেউ এসব কথা আমাকে বলেনি ।বলার দরকার আছে কি??? আমি তো তোমার ভিতরটা বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়তে পারছি।”
শেষে বললেন,” কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ।।
কে তোমার স্ত্রী? কেই বা তোমার সন্তান? এই সংসার হল অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এই বিষয়ে চিন্তা করে দেখ।
যা ঘটে গেছে তাকে ভুলতে হবে । আবার উৎফুল্ল স্বাস্থ্য রক্ষা কর । নিজের দুঃখ নিয়ে একান্তে নাড়াচাড়া করো না । গহন বেদনাকে বাহ্য অভিব্যক্তিতে খুলে দাও। তা তোমার আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য প্রয়োজন , তা তোমার শিল্পের জন্য প্রোয়জন।”
এই স্বল্প আলাপচারিতায় কালভে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন ।
এমার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তিনি সেদিন যখন বিবেকানন্দ সান্নিধ্যমুগ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তখন তিনি স্বামীজীর বাণী ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা গভীরভাবে আচ্ছন্ন। তাঁর মাথা থেকে অসুস্থ ও জটিল চিন্তাদি অপসৃত হয়ে স্বামীজীর তীব্র ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে শান্ত-স্বচ্ছ ভাবে পরিপূর্ণ।
এমা একথাও বলেছেন যে স্বামীজী কোন সম্মোহন শক্তি কাজে লাগান নি, তিনি শুধু তাঁর চারিত্রিক শক্তি, পবিত্রতা এবং লক্ষ্যের প্রতি তীব্র মনঃসংযোগ দিয়ে তাঁর মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানসিক শক্তি আর স্থৈর্য ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ যে কথা এমাকে বলেছিলেন, সেটি এই অনন্যা নারীর আত্মজীবনীর পাতায় পরে স্থান করে নিয়েছিল।
পরবর্তী কালে এই দিনের অভিজ্ঞতাকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এইভাবে:
” বিবেকানন্দএর বাক্য ব্যক্তিত্বে গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়ে আমি চলে এলাম। যেন আমার মস্তিষ্ক থেকে সকল রুগ্ণ জটিলতাকে তুলে নিয়ে সেখানে ভরে দিলেন শান্ত শুদ্ধ ভাবনা।”
1900 সালে দ্বিতীয়বার প্রাশ্চাত্য সফরে বের হয়ে কালভের প্যারিসে স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। ম্যাকলাউড, কালভে, ফাদার হিয়াসান্ত প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে তিনি মিশর ভ্রমণে বের হয়েছিলেন।
স্বামীজির সঙ্গে এই ভ্রমণকে কালভে বলেছেন “,আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে ।। সেটি আমার জীবনের সর্বোত্তম কাল। স্বামীজির নিকট থাকার অর্থ অবিরাম প্রেরণার মধ্যে থাকা । ওই কালে আমারা গভীর তীব্র আধ্যাত্মিক আবহাওয়ার মধ্যে বাস করেছি। যে কোন ব্যাপারেই তার মুখে এনে দিত গল্পকথা , নীতি কাহিনী , নানা উদ্ধৃতি হিন্দু পুরাণ থেকে শুরু করে গভীর দার্শনিক শাস্ত্র পর্যন্ত। “
পরে আবার লিখেছেন, ” সেকি তীর্থযাত্রা বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসের কোন রহস্যই স্বামীজির কাছে অনালোকিত নয় । “
মিশরের কায়রো ভ্রমণকালে স্বামীজি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন সে কথা জানিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথায়:
” একদিন কায়রোয় আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি মনে হয় খুবই মগ্ন হয়ে আমারা কথাবার্তা বলছিলাম। যেভাবেই তা ঘটুক আমরা সচেতন হয়ে দেখলাম একটি নোংরা কটুগন্ধময় পথে হাজির হয়েছি যেখানে অর্ধ নগ্ন নারীদের কেউ জানলা থেকে উঁকি দিচ্ছে, কেউবা দরজার গোড়ায় পা হাত ছড়িয়ে এলিয়ে বসে আছে।………. স্বামীজি পরিবেশ বিশেষ লক্ষ্য করেননি ,যতক্ষণ না একটি জীর্ণ বাড়ির ছায়ায় বসে থাকা একদল অত্যন্ত প্রগলভা নারী খিলখিল করে হেসে তাকে ডাকাডাকি করছিল ।।
আমাদের দলের জনৈক মহিলা তাড়াতাড়ি ওখান থেকে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত হলেন।কিন্তু স্বামীজি মৃদুভাবে নিজেকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েগুলির দিকে এগিয়ে গেলেন।
‘হায় হতভাগিনী রা !হায় হতভাগ্য সন্তানেরা !এরা নিজেদের ঈশ্বরত্ব কে টেনে নামিয়েছে দেহের রূপে! দেখো একবার ওদের!’ এরপর তিনি কাঁদতে লাগলেন― যে কান্না প্রভু কাঁদতে পারেন ব্যভিচারিণী নারীদের সামনে।
মেয়েগুলি স্তব্ধ হয়ে গেল। অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে উঠল ।তাদের একজন নতজানু হয়ে তার বসনপ্রান্ত চুম্বন করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্প্যানিশে অস্ফুট বলতে লাগলো ,’ঈশ্বর পুত্র !ঈশ্বর পুত্র !’ অন্য একজন সহসা লজ্জায় আতঙ্কে অভিভুত হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল ।সে যেন ঐ পবিত্র আত্মা থেকে নিজের সংকুচিত আত্মাকে ঢেকে রাখতে চাইছিল।”
1902 সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে স্বামীজিকে পত্র দিয়েছিলেন উত্তরে স্বামীজী তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। 15 মে 1902 স্বামীজী এমা কালভেকে তাঁর পিতৃবিয়োগের জন্য সান্ত্বনা জানিয়ে এই চিঠি লিখেছিলেন।
প্রসঙ্গত, পিতার মৃত্যুসংবাদও এমার কাছে পৌঁছেছিল যখন তিনি মঞ্চে কারমেন-এর ভূমিকায় অভিনয়রত। স্বামীজী লিখছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি তোমার উপর নেমে আসা স্বজন হারানো ব্যথার কথা জেনেছি। এ আঘাত আমাদের সবার জীবনে আসবেই আসবে। প্রকৃতির এই নিয়ম, অথচ একে মেনে নেওয়া অতীব কঠিন।আমাদের মধ্যেকার এই সব সম্পর্কের এমনই শক্তি যে তার ফলে এই মায়াময় জগতকে সত্য বলে মনে হয়; এবং সান্নিধ্য যত দীর্ঘ হবে, ততই তা মায়াকে অধিকতর সত্য বলে প্রতিভাত করবে। কিন্তু দিন আসবেই, যখন এই মায়া আবার মায়াতেই বিলীন হয়ে যাবে, এবং তাকে মেনে নেওয়া বড় দুঃখের। অথচ সেইটি, যা সত্য বা মায়ার অতীত –অর্থাৎ আমাদের আত্মা, তা সর্বদাই আমাদের ঘিরে রয়েছে – সেটি সর্বত্র বিদ্যমান। তিনিই ধন্য যিনি এই অপস্রিয়মাণ ছায়াময় জগতের মধ্যে সত্যরূপটিকে চিনে নিতে পারেন। … বিবেকানন্দের সদাই এই প্রার্থনা যে, প্রভু তাঁর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষণ করুন।’
স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের 8 বছর পর 1910 সালে কালভে এসেছিলেন কলকাতায়। এসেছিলেন বেলুড় মঠে। সঙ্গী ছিলেন পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ও কুমুদবন্ধু সেন । তাকে অভ্যর্থনা জানান স্বামী সারদানন্দ ।বেলুড় মঠে তিনি দর্শন স্বামীজির সমাধি মন্দির (মন্দির তখনো নির্মীয়মান) দর্শন করে। দর্শন করেন শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মন্দির। কালভের অনুরোধে স্বামী সারদানন্দ জি তাঁকে আবৃত্তি করে শোনান:
ওঁ অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়। ( – বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৩।২৮)
পাশ্চাত্যের সংগীত রানীকে ভারতীয় সংগীত শোনাবার জন্য প্রসিদ্ধ বংশীবাদক স্বামীজীর খুড়তুতো ভাই হাবু দত্ত কে সদলবলে মঠে আনিয়েছিলেন সারদানন্দ। সারদানন্দএর অনুরোধে কালভে মঠে কয়েকটি ফরাসি সংগীত ঠাকুরকে শোনালেন । কালভের ইচ্ছা ছিল ভারতীয় সুর ও সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হতে।
যাতে পাশ্চাত্যের সুর ও সংগীতে সেই সুর আরোপ করা যায়। সেই উদ্যোগে হাবু দত্ত কালভকে থে শোনালেন এসরাজ ও ক্লেয়ারিঅনেট ।অতিথি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন হাবু দত্তের দলের এরপর তারা মঠ ত্যাগ করে কলকাতার অ হোটেলের অভিমুখে যাত্রা করেন।
এই সুর ও নৃত্যের ঊর্বশী দীর্ঘায়ু ছিলেন। 1942 সালের 6 জানুয়ারি 83 বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানিয়েছেন , “আমার সৌভাগ্য, আমার পরমানন্দ ,আমি এমন একজন মানুষকে জেনেছিলাম যিনি সত্যই “ঈশ্বরের সহযাত্রী” তিনি মহান, তিনি ঋষি, দার্শনিক এবং যথার্থ বন্ধু। আমার সামনে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন ।আমার আত্মা অনন্ত কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।”
বিবেকানন্দের পা ছুঁয়েছিলেন বলে, সেই হাত দিয়ে গান্ধীজিকে প্রনাম করেননি বিপ্লবী হেমচন্দ্র!!!
জীবনে আর দ্বিতীয় একজন মানুষকেও দেখিনি যাঁকে স্বামীজির পাশে দাঁড় করাতে পারি। গান্ধীজির সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয় তখন দেখলাম সবাই তাঁকে প্রনাম করছেন। কিন্তু আমি করিনি।একজন সেই বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।বললেন গান্ধীজিকে প্রনাম করার কথা।আমি বললাম আমার এই দক্ষিণ হস্ত দিয়ে আমি স্বামী বিবেকানন্দের চরণ স্পর্শ করেছি।আমার এই দক্ষিণ হস্ত দিয়ে আর কারও পা আমি স্পর্শ করতে পারবনা।যে মস্তক স্বামী বিবেকানন্দের চরণতলে নত হয়েছে , সে মস্তক আর কোথাও নত হবেনা।জীবনে আর কখনও কাউকে প্রনাম করিনি, আর কারও পায়ে মাথা নোয়াইনি। আমার মাথায় , পিঠে তাঁর অগ্নিস্পর্শ এখনও লেগে রয়েছে।
-বিপ্লবী নায়ক হেমচন্দ্র ঘোষ
(Amit Dutta র টাইমলাইন থেকে নেওয়া)
*এই বাস্তব সত্য আমাদের সকলকে জানা উচিত, উচিত প্রায়শ্চিত্ত করার...............*
**সেই সময় স্বামিজি প্রাপ্য
সন্মান পাননি---বাঙালিদের কাছে।**
স্বামীজির মহাপ্রয়াণ হয় ৩৯ বছর বয়েসে ১৯০২ সালে । বেলুড় মঠে তখন রাত ৯ টা ১০ মিনিট। তখন বেলুড় মঠে বা তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিদ্যূৎ ছিল না । কিন্তু টেলিফোন ছিল তবুও কোন সংবাদমাধ্যম আসেনি এবং পরের দিন বাঙ্গলাদেশের কোন কাগজেই বিবেকানন্দের মৃত্যূ সংবাদ প্রকাশিত হয়নি,এমন কি কোন রাষ্ট্রনেতা বা কোন বিখ্যাত বাঙ্গালী কোন শোকজ্ঞাপনও করেননি ।
ভাবতে পারেন ???
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর স্বল্প জীবনে অপমান, অবহেলা বহু পেয়েছেন,উপেক্ষিত হয়েছেন বার বার। পিতার মৃত্যূর পর স্বজ্ঞাতির সঙ্গে কোর্ট কাছারী করতে হয়েছে তাঁকে ।বহু বার হাজিরা দিয়েছেন কাঠগড়ায় l
নিদারুণ দরিদ্রের সংসারে সকালে উঠে অফিস পাড়া ঘুরে ঘুরে চাকরির খোঁজে বেরুতেন । দিনের পর দিন মা কে বলতেন মা আজ রাতে বন্ধুর বাড়িতে খেতে যাবো। প্রায় দিন দেখতেন সংসারে চাল,ডাল,নুন ,তেল কিছুই নেই কিন্তু ভাই ও বোন নিয়ে 5 টা পেটের খাবার কি ভাবে জুটবে ? মুদির দোকানে ধার করে মাকে এক- দুই দিনের চাল ডাল দিয়ে ... মা কে বলতেন আমার রান্না কোরো না... মা ! দিন দুই বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে কিন্তু..কোথায় নিমন্ত্রণ ? .. আনাহার আর অর্ধপেটে থাকতেন তৎ কালীন নরেন্দ্র .........
ভাবা যায় !!!!!!!
চরম দারিদ্রের মধ্যে সারা জীবনটাই টেনে নিয়ে গেছেন । ২৩ বছর বয়েসে শিক্ষকের চাকরি পেলেন মেট্রোপলিটন স্কূলে । যাঁর প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যাসাগর মশাই আর হেডমাস্টার বিদ্যাসাগরের জামাতা । জামাতা পছন্দ করতেন না নরেন্দ্রনাথ দত্তকে .. শ্বশুরকে বলে..." *খারাপ পড়ানোর অপরাধে"* বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিলেন বিবেকানন্দকে । অথছ, যাঁর জ্ঞান,বুদ্ধি,ব্যুৎপত্তি তর্কাতীত, অন্তত সেই সময়েও।
আবার বেকার বিবেকানন্দ। বিদেশেও তাঁর নামে এক বাঙ্গালি গুরু প্রচার করেন .. বিবেকানন্দ বেশ কয়েকটি বৌ ও দশ -বারো ছেলে পুলের পিতা ও এক আস্ত ভন্ড ও জুয়াখোর। ......
দেশে ও বিদেশে অর্ধপেটে বা অভুক্ত থেকেছেন দিন থেকে দিনান্তে....
চিঠিতে লিখেছিলেন :-
"-কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছি । মনে হয়েছে আজই হয়ত মরে যাবো ... জয় ব্রহ্ম বলে উঠে দাঁড়িয়েছি .... বলেছি . ..আমার ভয় নেই,নেই মৃত্যূ, নেই ক্ষুধা, আমি পিপাসা বিহীন । জগতের কি ক্ষমতা আমাকে ধ্বংস করে ?" ...
অসুস্থ বিবেকানন্দ বিশ্ব জয় করে কলকাতায় এলে তাঁর সংবর্ধনা দিতে বা সংবর্ধনা সভা তে আসতে রাজি হয় নি অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালী ( নাম গুলি অব্যক্ত রইল) শেষে প্যারিচাঁদ মিত্র রাজি হলেও ... তিনি বলেছিলেন .. ব্রাহ্মণ নয় বিবেকানন্দ । ও কায়েত... তাই সন্ন্যাসী হতে পারে না , আমি ওকে brother বিবেকানন্দ বলে মঞ্চে সম্বোধন করবো ।
১৮৯৮, বিদেশের কাগজে তাঁর বাণী ও ভাষণ পড়ে আমেরিকানরা অভিভূত আর বাঙ্গালীরা !
সেই বছরই অক্টোবরে অসুস্থ স্বামীজি কলকাতার বিখ্যাত ডক্টর রসিকলাল দত্তকে দেখাতে যান,(চেম্বার- 2 সদর স্ট্রিট। কলকাতা যাদুঘরে পাশের রাস্তা )। রুগী বিবেকানন্দ কে দেখে সেই সময় 40 টাকা ও ঔষুধের জন্যে 10 টাকা মানে আজ ২০২০র হিসাবে প্রায় ১৬০০০ টাকা নিলেন
বিবিধ রোগে আক্রান্ত বিশ্বজয়ী দরিদ্র সন্ন্যাসীর কাছ থেকে . বেলুড় মঠের জন্যে তোলা অর্থ থেকে স্বামী ব্রহ্মনন্দ এই টাকা বিখ্যাত বাঙ্গালী(?) ডক্টর রসিকলাল কে দিয়েছিলেন। ..
আরও আছে .........!!!
বিবেকানন্দের মৃত্যূর কোন ফটো নেই । এমনকি বীরপুরুষের কোন ডেথ সার্টিফিকেটও নেই কিন্তু সে সময় বালি - বেলুড় মিউনিসিপালিটি ছিলো।
আর এই municipality বেলুড় মঠে প্রমোদ কর বা amusement tax ধার্য করেছিলো ।
বলা হয়েছিল ওটা ছেলে ছোকরাদের আড্ডার ঠেক আর সাধারণ মানুষ বিবেকানন্দকে ব্যঙ্গ করে মঠকে বলতো .. "বিচিত্র আনন্দ" বা "বিবি- কা আনন্দ" । ( মহিলা /বধূ / ... নিয়ে আনন্দ ধাম)। এই ছিলো তৎকালীন মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীদের মনোবৃত্তি l
সাধে কি শেষ সময় বলে গিয়েছিলেন- " *একমাত্র আর একজন বিবেকানন্দই বুঝেতে পারবে যে এই বিবেকানন্দ কি করে গেল।"*
ঋণস্বীকার---
শংকরের অচেনা অজানা বিবেকানন্দ।
স্বামীজি বলেন: কেন? আমি তো ব্রহ্মচারী।
মেয়েটি বলে: কারন আমি আপনার মতন একজন সন্তান চাই , যে সারা পৃথিবীতে আমার নাম উজ্জ্বল করবে। সেটা আপনাকে বিয়ে করলেই সম্ভব।
স্বামীজি বলেন: সেটার জন্য আরো একটি উপায় আছে।
মেয়ে জিজ্ঞেস করে: কি উপায়?
স্বামীজি মৃদু হেসে বলেন: আমাকে আপনার পুত্র বানিয়ে নেন। আর আমিও আপনাকে মা বলে ডাকব। এরফলে আপনার মনোবাসনাও পূর্ণ হবে আর আমার ব্রহ্মচর্যও অটুট থাকবে।
এমনটাই হলো মহাত্মাদের বিচারধারা।
পুরো সমুদ্রের জল একটি জাহাজকে ততক্ষন ডুবোতে পারেনা , যতক্ষন না সমুদ্রের জল জাহাজের ভেতর প্রবেশ করছে।
ঠিক তেমনি খারাপ কুবুদ্ধি ও অসামাজিক কাজ দ্বারা আপনি প্রভাবিত হবেন না, যতক্ষন না পর্যন্ত আপনি নিজে সেগুলি আপনার অন্তরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন।
এই জগৎ , সমাজ এই কারনে খারাপ নয় যে. খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশী। খারাপ কারন ভালো মানুষেরা চুপ থাকে...
😫 In 1881, a professor asked his student, whether it was God, who created EVERYTHING, that exists in the universe..?
🙄 Student replied : YES..
😫 He again asked : What about EVIL..? Has God created, EVIL ALSO.. ?
🙄 The student got silent. Somehow, the student requested that may he ask 2 questions..?
😫 Professor allowed him, to do so..
🙄 Student asked : Does COLD exists..?
😫 Professor said : Yes. Don't you feel the cold.. ?
🙄 Student said : I am sorry, but you are wrong sir. Cold is a complete ABSENCE OF HEAT. There is no cold. It is only, an absence of heat..
🙄 Student asked again : Does DARKNESS exists..?
😫 Professor said : YES..
🙄 Student replied : You are again wrong, sir. There is nothing like darkness. It is actually the ABSENCE OF LIGHT..
🙄 Sir, we always study LIGHT & HEAT, but not cold & darkness. Similarly, the evil does not exist. Actually it is the absence of LOVE, FAITH & BELIEF IN GOD ALMIGHTY. Name of this student was : VIVEKANANDA..
( ৬ )
স্বামীজী ষষ্ঠবার অর্থাৎ শেষবারের মতো দেওঘরে আসেন ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে । সেই সময়ের একটি বিশেষ ঘটনা জানা যায় হরিচরণ মিশ্রের অপ্রকাশিত রচনা থেকে ---------
" দেওঘরে থাকাকালীন স্বামীজী প্রায়ই পাশ্ববর্তী গ্রামের সাঁওতালপল্লী ভ্রমণ করতেন । তিনি বলেছিলেন, 'এই সাঁওতালরাই এদেশের আদি অধিবাসী । এরা সরল, সৎ ও উদার । মহাজন, জমিদার ও ফড়েদাররাই এদের ঠকায় । এরা এদের সততার মূল্য পায় না ।' সাঁওতালদের প্রতি স্বামীজীর গভীর ভালবাসা ছিল ।
" মুনিয়া মাঝির কথা মনে পড়ে । প্রিয়বাবুর আনন্দকুটিরে যেখানে স্বামীজী এসে থাকতেন, কাজ করত মুন্না সাঁওতাল ও তার স্ত্রী ঝরি সাঁওতাল । তাদের একমাত্র মেয়ে মুনিয়া মাঝি । মুনিয়ার যখন সাত বছর বয়স, তার বাবা মারা যায় কলেরায় । এরপর থেকে মা-মেয়ে প্রিয়বাবুর বাড়িতে ঘরমোছা, জলতোলা, বাসনমাজা, কাপড়কাচা প্রভৃতি কাজ করত ।
" মুনিয়া স্বামীজীর স্নানের জল তুলে দিত, কাপড় কেচে দিত, খড়ম ধুয়ে দিত । মুনিয়া স্বামীজীকে বলত 'সাধুবাবা' । স্বামীজী দেওঘরে এলে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত মাজতেন । এই নিমকাঠি জোগাড় করে আনত মুনিয়া । পেটের গোলমালে ভুগতেন বলে স্বামীজীর জন্য মুনিয়া হিঞ্চেশাক এনে তার রস করে কাঁচা দুধ দিয়ে খেতে দিত তাঁকে । স্বামীজী তা খেয়ে বলতেন, 'মুনিয়া আমার এখানকার গার্জেন !' একবার মুনিয়া অনেকগুলো ভুট্টা এনে স্বামীজীকে বলল, 'সাধুবাবা এগুলো পুড়িয়ে দেব খাবি ----- খুব ভাল খেতে ।' স্বামীজী মুনিয়ার কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলেন । বাপ-মরা এই মেয়েটির প্রতি স্বামীজীর অপরিসীম করুণা ছিল । তাই আমাকে বলেছিলেন, 'এই অনাথা আদিবাসী মেয়েটাকে একটু লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করুন ।'
" স্বামীজীর নির্দেশমত মুনিয়াকে প্রাথমিক লেখাপড়া শিখিয়ে কুষ্ঠাশ্রমে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম । কাজ করার সুবাদে সংসার একটু সচ্ছল হল । সে লেখাপড়া জানায় পরমহংসদেবের নাম জানতে পারল । স্বামীজীর কর্মকাণ্ডও কিছু জানল । এদিকে বয়স হওয়ায় তার মা তার বিয়ে দিতে চাইল । কিন্তু সে কোনমতেই রাজি হল না । সে বলেছিল, 'সাধুবাবা আমার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেছে ----- সেই-ই আমাকে রক্ষা করবে ।'
" মা-মেয়ের সংসার । থাকত ধারোয়া নদীর তীরে । স্বামীজীর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে মুনিয়া খুব কেঁদেছিল । তখন কুড়ি-বাইশ বছর বয়স তার, মারণ জ্বরে পড়ল সে । সংবাদ পেয়ে তাদের বাড়ি ছুটলাম । পাড়াতে পৌঁছেই কান্নার রোল শুনতে পেলাম, বুকটা ধড়াস করে উঠল । শুনলাম, আজই মুনিয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । বাড়িতে গিয়ে দেখি, দাওয়ায় চেটায়ের ওপর মুনিয়া চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছে । তার মাথার কাছে একজোড়া খড়ম । জিজ্ঞাসা করলাম, 'ওর মাথার কাছে খড়মজোড়া কেন ?' তার মা বলল, 'পাণ্ডাজী, ঐ খড়মজোড়া হল সাধুবাবার । পুজো করার লেগে মুনিয়া বাবুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল । অসুখের সময় বলেছিল, মা তুই সাধুবাবার খড়ম-দুটো মাথায় ঠেকিয়ে মাথার কাছে রাখ । সাধুবাবা এসে পড়বে ।' এ কথা বলে মুনিয়ার মা কান্নায় ভেঙে পড়ল ।
" স্বামীজী মুনিয়ার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন । মুনিয়া নিশ্চিত স্বামীজীর আশীর্বাদ পেয়েছিল । তা না হলে অশিক্ষিত সাঁওতাল গোষ্ঠীর মেয়ে হয়ে রোগীদের সেবায় নিজেকে বলি দেওয়ার সাহস পেল কোথা থেকে ? ধন্য মুনিয়া মাঝি ------- ধন্য তার সাধুবাবার প্রতি ভক্তি ! "
( উদ্বোধন : ৯ / ১৪১৯ )
🍂🍂🍂🍂🍂🍂 জয় স্বামীজী 🍂🍂🍂🍂🍂🍂
আজ সূর্যগ্রহণ -সর্বগ্রাসী গ্রহণ। জ্যোতির্বিদগণও গ্রহণ দেখতে নানাস্থানে গেছেন। ধর্মপিপাসু নরনারীগণ গঙ্গা স্নান করতে বহুদূর থেকে এসে উৎসুক হয়ে গ্রহণবেলার প্রতীক্ষা করছেন। স্বামীজীর কিন্তু গ্রহণ সম্বন্ধে বিশেষ কোন উৎসাহ নেই। কয়েকদিন হল তিঁনি বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে আছেন। সকালে ,দুপুরে বা সন্ধ্যায় তাঁর কিছুমাত্র বিরাম নেই।বহু উৎসাহী মানুষ ,কলেজের ছাত্র তাঁকে দর্শনের জন্য আসছেন।
স্বামীজী শিষ্যকে(শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী) বলেছেন নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে।সেইমত শিষ্যও মাছ ,তরকারি ও রান্নার সব জিনিস নিয়ে বলরাম বাবুর বাড়িতে সকাল ৮টার মধ্যে এসেছেন।তাকে দেখে স্বামীজী বললেন,"তোদের দেশের মতো রান্না হওয়া চাই আর গ্রহণের আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়া চাই।"
বলরামবাবুদের বাড়ির মেয়েছেলেরা কেউ কলকাতাতে নেই ।শিষ্য বাড়ির ভিতরে রন্ধনশালায় গিয়ে রান্না শুরু করলেন।আজ তার পরম আনন্দের দিন ,তার গুরুকে রান্না করে খাওয়াবেন।যোগীন মা সেদিন বলরাম বাবুর বাড়িতে ছিলেন।তিনি দাঁড়িয়ে শিষ্যকে নানারকম রান্না বিষয়ে সাহায্য করছিলেন।স্বামীজীও মাঝে মাঝে ভিতরে এসে শিষ্যকে উৎসাহিত করে যাচ্ছিলেন ;দেখিস মাছের "জুল" যেন ঠিক বাঙ্গালদিশি ধরনের হয় বলে রঙ্গ করছিলেন। ভাত ,মুগের ডাল ,কই মাছের ঝোল ,মাছের টক ও মাছের সুক্তনী রান্না প্রায় শেষ হয়েছে ,এমন সময় স্বামীজী স্নান করে এসে নিজেই পাতা নিয়ে খেতে বসে পড়লেন।এখনো কিছু রান্না বাকি আছে বলাতেও আবদেরে ছেলের মত বললেন ,"যা হয়েছে নিয়ে আয় ,আমি আর বসতে পারছি না ,পেট খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে।"শিষ্য তাড়াতাড়ি আগে মাছের সুক্তনী ও ভাত দিয়ে খেতে দিলেন।তারপর শিষ্য বাটিতে করে অন্য যা রান্না হয়েছিল সেগুলিও পরিবেশন করলেন।এবার তিনি ভিতরে গিয়ে প্রেমানন্দ ও যোগানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী মহারাজদের কেও ডেকে এনে খেতে দিলেন।
শিষ্য কোনকালেই রান্নায় পটু ছিলেন না।কিন্তু স্বামীজী আজ শিষ্যের রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন।কলকাতার লোক মাছের সুক্তনী নামে খুব ঠাট্টা তামাশা করে কিন্তু সেই সুক্তনী খেয়ে বললেন,"এমন কখনো খাই নি।" কিন্তু মাছের 'জুল'টা যেমন ঝাল হয়েছে ,এমন আর কোনটা ই হয় নি।মাছের টক খেয়ে বললেন ,"এটা ঠিক যেন বর্ধমানী ধরনের হয়েছে।অনন্তর দই ও সন্দেশ খেয়ে স্বামীজী ভোজন শেষ করে আচমনান্তে ঘরে এসে খাটে বসলেন।স্বামীজী তামাক টানিতে টানিতে বললেন ,"যে ভাল রাঁধতে পারে না ,সে ভাল সাধু হতে পারে না -মন শুদ্ধ না হলে ভাল সুস্বাদু রান্না হয় না।"
কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে শাঁক ঘন্টা বেজে উঠল এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শোনা যেতে লাগল। স্বামীজী বলে উঠলেন ,"ওরে গেরন লেগেছে - আমি ঘুমোই ,তুই আমার পা টিপে দে।" এই বলে একটু তন্দ্রা অনুভব করতে লাগলেন। শিষ্যও তাঁহার পদসেবা করতে করতে ভাবলেন ,"এই পূণ্যক্ষণে গুরুপদসেবাই আমার গঙ্গাস্নান ও জপ।" তিনি শান্তমনে গুরুর পদসেবা করতে লাগলেন। গ্রহণে সর্বগ্রাস হয়ে ক্রমে চারদিক সন্ধ্যাকালের মত তমসাছন্ন হয়ে গেল।
গ্রহণ ছেড়ে যাবার ১৫/২০ মিনিট বাকি থাকতে স্বামীজীর নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেল।নিদ্রা থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে চাইলেন। তামাক খেতে খেতে শিষ্যকে পরিহাস করে বললেন,"লোকে বলে ,গেরনের সময় যে যা করে ,সে নাকি তাই কোটিগুণে পায় ; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি,যদি এই সময়ে একটু ঘুমুতে পারি তো বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হলো না ; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে ।"
(১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি মধ্যাহ্নে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল)
স্বামীজীর তিরোধান দিবসে জানাই স্বশ্রদ্ধ প্রণাম !!
II আজ সেই চৌঠা জুলাই - এইদিনে স্বামী বিবেকানন্দ ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাদের কে ......
ঠিক কী ঘটেছিলো এই দিন.... ৪ঠা জুলাই, ১৯০২
========
❣লেখনী: ❣মাতা ঠাকুরাণীর ছেলে
এমা কালভের নাম শুনেছেন?
------------------------------------------------- বিখ্যাত অপেরা গায়িকা এমা কালভে। যার রূপে গুনে শত শত পুরুষ ছিল পাগল। যার শো দেখার জন্য দর্শক আসন উপচে পড়ত। যার নাম একসময় আমেরিকার খবরের কাগজের পাতার হেড লাইন হত। সেই এমা কালভে।সেই স্বনামধন্য সুন্দরী এমা কালভের জন্ম হয় 1864 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের এই গ্রামে। শৈশব থেকেই এমা জিরো চেতনায় ভরপুর এবং জীবন সংগ্রামে নিপুন সৈনিক ছিলেন । একটু বড় হলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুনে নিজেকে গায়িকা ও নর্তকী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন ।পরে ওই সকল বিষয় একাগ্রচিত্তে তালিম নিয়েছেন । হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেরা সুরঞ্জিতের ঊর্বশী।
যেহেতু তিনি সুন্দরী ও শ্রেষ্ঠ অপেরা গায়িকা ছিলেন , কাজেই তাঁর গুন মুগ্ধের অভাব ঘটে নি । বহু ব্যক্তিত্ব তার হৃদয়ের দরজা আঘাত করেছেন এবং ক্ষত গড়ে তুলেছেন।
এভাবে জীবন যখন সাফল্য, যন্ত্রণা, বেদনায় পসার বয়ে নিয়ে চলেছে গর্বিতা কালভে। এমন দিনে হঠাৎ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো স্বামী বিবেকানন্দের ।
সময়টা 1898 সাল । কালভে এসেছেন শিকাগো শহরে। এক নৃত্য-গীতের আসর এ। মানসিক আঘাতের তখন তার মন প্রাণ আড়ষ্ট অথচ গানের আসরে হাজির হতেই হবে ।মনের উদ্যম আনার জন্য শিকাগোয় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার একমাত্র কন্যাকে। সে তখন শিশু । তিনি তাকে রেখেছিলেন এক বন্ধুর নিকট।
অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে এমা সেখানে পরপর কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছেন। শেষ দিন শেষ অঙ্কের নৃত্যগীত সেরে যখন তিনি গ্রীন রুমে ঢুকলেন তখন তার কাছে খবর এলো, তার একমাত্র কন্যা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। অর্থাৎ তিনি যখন মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছিলেন তখন তার একমাত্র কন্যা অগ্নিদগ্ধ হচ্ছিল । হায় জীবন !
রূপে গুনে শ্রেষ্ঠ অপেরা সুন্দরী এমার দম্ভ যেন অলংকার। স্টেজে উঠলেই লক্ষ করতালিতে অভিনন্দন জানান হাজারো দর্শক। তা শুনে ভাল লাগে তার । তার গুনপনায় অমিত প্রশংসায় পত্রপত্রিকা মুখর ।
এহেন গায়িকার বুকে জমে থাকে পাহাড়প্রমাণ বিষাদ। আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন কিন্তু পারেননি। হয়ত মা কালী তা চান নি।
অবসাদ গ্রস্থ কালভে হোটেলে ফিরলেন ।হঠাৎ তার বন্ধু মিসেস এডমাস তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।এডামস বললেন “এক ভারতীয় সন্ন্যাসী এসেছে শিকাগো তে।যেন জ্যোতিরময় ঈশ্বর তিনি। তুমি যদি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ কর তাহলে তুমি নিশ্চিন্ত শান্তি লাভ করতে সমর্থ হবে । “
কালভের চোখের চাহনি হল বিদ্রূপ। এডামস পুনরায় তাকে অনুরোধ করলেন ।কারণ তিনিও চান যে এই বিশ্ব বিখ্যাত গায়িকা এই যন্ত্রণাময় অবসাদগ্রস্থ জীবন থেকে মুক্ত হন। অবশেষে কালভে রাজি হলেন।
অবশেষে একদিন, সেটি তাঁর এমত প্রয়াসের চতুর্থ বা পঞ্চম দিন, তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁর সেই বন্ধুর বাড়ির দরজায় – যেখানে স্বামীজী ছিলেন। সেই গৃহের বাট্লার বা খানসামা দরজা খুলে দিলেন এবং এমা বসার ঘরের একটি আরামদায়ক চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
এইভাবে ঘোরলাগা অবস্থায় সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তাঁর কানে এল কে যেন পাশের ঘর থেকে অতি মৃদু স্বরে তাঁকে ডাকছেন, ‘এস বাছা! ভয় পেয়ো না!’ প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরে ধীরে সেই ঘরটিতে গিয়ে পৌঁছলেন যেখানে একটি টেবিলের অপরদিকে স্বামীজী বসে রয়েছেন।
যেহেতু বাড়িটিতে ঢোকার সময়েই এমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে বিবেকানন্দ কথা না বললে কোন কথা না বলতে, তাই তিনি সেই ঘরে গিয়ে স্বামীজীর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্বামীজী ধ্যানরত স্তব্ধতায় অপরূপ ভঙ্গিতে বসেছিলেন, তাঁর গেরুয়া আলখাল্লার নিম্নাংশ লুটিয়ে ছিল মেঝেতে, উষ্ণীষবদ্ধ মাথাটি সামনে ঝুঁকে– দৃষ্টি ভূমিনিবদ্ধ। সামান্যক্ষণ পরেই চোখ না তুলেই তিনি বলে উঠলেন , “কন্যা মোর! তোমার চতুর্দিকে কি না যন্ত্রণা ও সংকটের আবর্ত। শান্ত হও ।তোমার প্রয়োজন শান্তি।”
অপার বিস্ময় তিনি ভাবলেন ,” যে ব্যক্তি আমার নাম পর্যন্ত জানেন না । তিনি আমার মনের গভীরতম বেদনাকে জানলেন কেমন করে ??? “
অভিভূত হয়ে কালভে স্বামীজিকে প্রশ্ন করলেন, “এসব কথা আপনি জানলেন কি করে ?এসব কে বলেছে আপনাকে ? “
স্বামীকে কমোল ভাবে বললেন , “কেউ এসব কথা আমাকে বলেনি ।বলার দরকার আছে কি??? আমি তো তোমার ভিতরটা বইয়ের খোলা পাতার মতো পড়তে পারছি।”
শেষে বললেন,” কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ।।
কে তোমার স্ত্রী? কেই বা তোমার সন্তান? এই সংসার হল অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এই বিষয়ে চিন্তা করে দেখ।
যা ঘটে গেছে তাকে ভুলতে হবে । আবার উৎফুল্ল স্বাস্থ্য রক্ষা কর । নিজের দুঃখ নিয়ে একান্তে নাড়াচাড়া করো না । গহন বেদনাকে বাহ্য অভিব্যক্তিতে খুলে দাও। তা তোমার আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য প্রয়োজন , তা তোমার শিল্পের জন্য প্রোয়জন।”
এই স্বল্প আলাপচারিতায় কালভে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন ।
এমার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তিনি সেদিন যখন বিবেকানন্দ সান্নিধ্যমুগ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তখন তিনি স্বামীজীর বাণী ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা গভীরভাবে আচ্ছন্ন। তাঁর মাথা থেকে অসুস্থ ও জটিল চিন্তাদি অপসৃত হয়ে স্বামীজীর তীব্র ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে শান্ত-স্বচ্ছ ভাবে পরিপূর্ণ।
এমা একথাও বলেছেন যে স্বামীজী কোন সম্মোহন শক্তি কাজে লাগান নি, তিনি শুধু তাঁর চারিত্রিক শক্তি, পবিত্রতা এবং লক্ষ্যের প্রতি তীব্র মনঃসংযোগ দিয়ে তাঁর মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানসিক শক্তি আর স্থৈর্য ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ যে কথা এমাকে বলেছিলেন, সেটি এই অনন্যা নারীর আত্মজীবনীর পাতায় পরে স্থান করে নিয়েছিল।
পরবর্তী কালে এই দিনের অভিজ্ঞতাকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এইভাবে:
” বিবেকানন্দএর বাক্য ব্যক্তিত্বে গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়ে আমি চলে এলাম। যেন আমার মস্তিষ্ক থেকে সকল রুগ্ণ জটিলতাকে তুলে নিয়ে সেখানে ভরে দিলেন শান্ত শুদ্ধ ভাবনা।”
1900 সালে দ্বিতীয়বার প্রাশ্চাত্য সফরে বের হয়ে কালভের প্যারিসে স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। ম্যাকলাউড, কালভে, ফাদার হিয়াসান্ত প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে তিনি মিশর ভ্রমণে বের হয়েছিলেন।
স্বামীজির সঙ্গে এই ভ্রমণকে কালভে বলেছেন “,আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে ।। সেটি আমার জীবনের সর্বোত্তম কাল। স্বামীজির নিকট থাকার অর্থ অবিরাম প্রেরণার মধ্যে থাকা । ওই কালে আমারা গভীর তীব্র আধ্যাত্মিক আবহাওয়ার মধ্যে বাস করেছি। যে কোন ব্যাপারেই তার মুখে এনে দিত গল্পকথা , নীতি কাহিনী , নানা উদ্ধৃতি হিন্দু পুরাণ থেকে শুরু করে গভীর দার্শনিক শাস্ত্র পর্যন্ত। “
পরে আবার লিখেছেন, ” সেকি তীর্থযাত্রা বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসের কোন রহস্যই স্বামীজির কাছে অনালোকিত নয় । “
মিশরের কায়রো ভ্রমণকালে স্বামীজি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন সে কথা জানিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথায়:
” একদিন কায়রোয় আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি মনে হয় খুবই মগ্ন হয়ে আমারা কথাবার্তা বলছিলাম। যেভাবেই তা ঘটুক আমরা সচেতন হয়ে দেখলাম একটি নোংরা কটুগন্ধময় পথে হাজির হয়েছি যেখানে অর্ধ নগ্ন নারীদের কেউ জানলা থেকে উঁকি দিচ্ছে, কেউবা দরজার গোড়ায় পা হাত ছড়িয়ে এলিয়ে বসে আছে।………. স্বামীজি পরিবেশ বিশেষ লক্ষ্য করেননি ,যতক্ষণ না একটি জীর্ণ বাড়ির ছায়ায় বসে থাকা একদল অত্যন্ত প্রগলভা নারী খিলখিল করে হেসে তাকে ডাকাডাকি করছিল ।।
আমাদের দলের জনৈক মহিলা তাড়াতাড়ি ওখান থেকে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত হলেন।কিন্তু স্বামীজি মৃদুভাবে নিজেকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েগুলির দিকে এগিয়ে গেলেন।
‘হায় হতভাগিনী রা !হায় হতভাগ্য সন্তানেরা !এরা নিজেদের ঈশ্বরত্ব কে টেনে নামিয়েছে দেহের রূপে! দেখো একবার ওদের!’ এরপর তিনি কাঁদতে লাগলেন― যে কান্না প্রভু কাঁদতে পারেন ব্যভিচারিণী নারীদের সামনে।
মেয়েগুলি স্তব্ধ হয়ে গেল। অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে উঠল ।তাদের একজন নতজানু হয়ে তার বসনপ্রান্ত চুম্বন করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্প্যানিশে অস্ফুট বলতে লাগলো ,’ঈশ্বর পুত্র !ঈশ্বর পুত্র !’ অন্য একজন সহসা লজ্জায় আতঙ্কে অভিভুত হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল ।সে যেন ঐ পবিত্র আত্মা থেকে নিজের সংকুচিত আত্মাকে ঢেকে রাখতে চাইছিল।”
1902 সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে স্বামীজিকে পত্র দিয়েছিলেন উত্তরে স্বামীজী তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। 15 মে 1902 স্বামীজী এমা কালভেকে তাঁর পিতৃবিয়োগের জন্য সান্ত্বনা জানিয়ে এই চিঠি লিখেছিলেন।
প্রসঙ্গত, পিতার মৃত্যুসংবাদও এমার কাছে পৌঁছেছিল যখন তিনি মঞ্চে কারমেন-এর ভূমিকায় অভিনয়রত। স্বামীজী লিখছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি তোমার উপর নেমে আসা স্বজন হারানো ব্যথার কথা জেনেছি। এ আঘাত আমাদের সবার জীবনে আসবেই আসবে। প্রকৃতির এই নিয়ম, অথচ একে মেনে নেওয়া অতীব কঠিন।আমাদের মধ্যেকার এই সব সম্পর্কের এমনই শক্তি যে তার ফলে এই মায়াময় জগতকে সত্য বলে মনে হয়; এবং সান্নিধ্য যত দীর্ঘ হবে, ততই তা মায়াকে অধিকতর সত্য বলে প্রতিভাত করবে। কিন্তু দিন আসবেই, যখন এই মায়া আবার মায়াতেই বিলীন হয়ে যাবে, এবং তাকে মেনে নেওয়া বড় দুঃখের। অথচ সেইটি, যা সত্য বা মায়ার অতীত –অর্থাৎ আমাদের আত্মা, তা সর্বদাই আমাদের ঘিরে রয়েছে – সেটি সর্বত্র বিদ্যমান। তিনিই ধন্য যিনি এই অপস্রিয়মাণ ছায়াময় জগতের মধ্যে সত্যরূপটিকে চিনে নিতে পারেন। … বিবেকানন্দের সদাই এই প্রার্থনা যে, প্রভু তাঁর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষণ করুন।’
স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের 8 বছর পর 1910 সালে কালভে এসেছিলেন কলকাতায়। এসেছিলেন বেলুড় মঠে। সঙ্গী ছিলেন পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ও কুমুদবন্ধু সেন । তাকে অভ্যর্থনা জানান স্বামী সারদানন্দ ।বেলুড় মঠে তিনি দর্শন স্বামীজির সমাধি মন্দির (মন্দির তখনো নির্মীয়মান) দর্শন করে। দর্শন করেন শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের মন্দির। কালভের অনুরোধে স্বামী সারদানন্দ জি তাঁকে আবৃত্তি করে শোনান:
ওঁ অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মামৃতং গময়। ( – বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৩।২৮)
পাশ্চাত্যের সংগীত রানীকে ভারতীয় সংগীত শোনাবার জন্য প্রসিদ্ধ বংশীবাদক স্বামীজীর খুড়তুতো ভাই হাবু দত্ত কে সদলবলে মঠে আনিয়েছিলেন সারদানন্দ। সারদানন্দএর অনুরোধে কালভে মঠে কয়েকটি ফরাসি সংগীত ঠাকুরকে শোনালেন । কালভের ইচ্ছা ছিল ভারতীয় সুর ও সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হতে।
যাতে পাশ্চাত্যের সুর ও সংগীতে সেই সুর আরোপ করা যায়। সেই উদ্যোগে হাবু দত্ত কালভকে থে শোনালেন এসরাজ ও ক্লেয়ারিঅনেট ।অতিথি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন হাবু দত্তের দলের এরপর তারা মঠ ত্যাগ করে কলকাতার অ হোটেলের অভিমুখে যাত্রা করেন।
এই সুর ও নৃত্যের ঊর্বশী দীর্ঘায়ু ছিলেন। 1942 সালের 6 জানুয়ারি 83 বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানিয়েছেন , “আমার সৌভাগ্য, আমার পরমানন্দ ,আমি এমন একজন মানুষকে জেনেছিলাম যিনি সত্যই “ঈশ্বরের সহযাত্রী” তিনি মহান, তিনি ঋষি, দার্শনিক এবং যথার্থ বন্ধু। আমার সামনে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন ।আমার আত্মা অনন্ত কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।”
বিপ্লবী নায়ক হেমচন্দ্র ঘোষ
বিবেকানন্দের পা ছুঁয়েছিলেন বলে, সেই হাত দিয়ে গান্ধীজিকে প্রনাম করেননি বিপ্লবী হেমচন্দ্র!!!
জীবনে আর দ্বিতীয় একজন মানুষকেও দেখিনি যাঁকে স্বামীজির পাশে দাঁড় করাতে পারি। গান্ধীজির সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয় তখন দেখলাম সবাই তাঁকে প্রনাম করছেন। কিন্তু আমি করিনি।একজন সেই বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।বললেন গান্ধীজিকে প্রনাম করার কথা।আমি বললাম আমার এই দক্ষিণ হস্ত দিয়ে আমি স্বামী বিবেকানন্দের চরণ স্পর্শ করেছি।আমার এই দক্ষিণ হস্ত দিয়ে আর কারও পা আমি স্পর্শ করতে পারবনা।যে মস্তক স্বামী বিবেকানন্দের চরণতলে নত হয়েছে , সে মস্তক আর কোথাও নত হবেনা।জীবনে আর কখনও কাউকে প্রনাম করিনি, আর কারও পায়ে মাথা নোয়াইনি। আমার মাথায় , পিঠে তাঁর অগ্নিস্পর্শ এখনও লেগে রয়েছে।
-বিপ্লবী নায়ক হেমচন্দ্র ঘোষ
(Amit Dutta র টাইমলাইন থেকে নেওয়া)
*এই বাস্তব সত্য আমাদের সকলকে জানা উচিত, উচিত প্রায়শ্চিত্ত করার...............*
**সেই সময় স্বামিজি প্রাপ্য
সন্মান পাননি---বাঙালিদের কাছে।**
স্বামীজির মহাপ্রয়াণ হয় ৩৯ বছর বয়েসে ১৯০২ সালে । বেলুড় মঠে তখন রাত ৯ টা ১০ মিনিট। তখন বেলুড় মঠে বা তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিদ্যূৎ ছিল না । কিন্তু টেলিফোন ছিল তবুও কোন সংবাদমাধ্যম আসেনি এবং পরের দিন বাঙ্গলাদেশের কোন কাগজেই বিবেকানন্দের মৃত্যূ সংবাদ প্রকাশিত হয়নি,এমন কি কোন রাষ্ট্রনেতা বা কোন বিখ্যাত বাঙ্গালী কোন শোকজ্ঞাপনও করেননি ।
ভাবতে পারেন ???
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর স্বল্প জীবনে অপমান, অবহেলা বহু পেয়েছেন,উপেক্ষিত হয়েছেন বার বার। পিতার মৃত্যূর পর স্বজ্ঞাতির সঙ্গে কোর্ট কাছারী করতে হয়েছে তাঁকে ।বহু বার হাজিরা দিয়েছেন কাঠগড়ায় l
নিদারুণ দরিদ্রের সংসারে সকালে উঠে অফিস পাড়া ঘুরে ঘুরে চাকরির খোঁজে বেরুতেন । দিনের পর দিন মা কে বলতেন মা আজ রাতে বন্ধুর বাড়িতে খেতে যাবো। প্রায় দিন দেখতেন সংসারে চাল,ডাল,নুন ,তেল কিছুই নেই কিন্তু ভাই ও বোন নিয়ে 5 টা পেটের খাবার কি ভাবে জুটবে ? মুদির দোকানে ধার করে মাকে এক- দুই দিনের চাল ডাল দিয়ে ... মা কে বলতেন আমার রান্না কোরো না... মা ! দিন দুই বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে কিন্তু..কোথায় নিমন্ত্রণ ? .. আনাহার আর অর্ধপেটে থাকতেন তৎ কালীন নরেন্দ্র .........
ভাবা যায় !!!!!!!
চরম দারিদ্রের মধ্যে সারা জীবনটাই টেনে নিয়ে গেছেন । ২৩ বছর বয়েসে শিক্ষকের চাকরি পেলেন মেট্রোপলিটন স্কূলে । যাঁর প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যাসাগর মশাই আর হেডমাস্টার বিদ্যাসাগরের জামাতা । জামাতা পছন্দ করতেন না নরেন্দ্রনাথ দত্তকে .. শ্বশুরকে বলে..." *খারাপ পড়ানোর অপরাধে"* বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিলেন বিবেকানন্দকে । অথছ, যাঁর জ্ঞান,বুদ্ধি,ব্যুৎপত্তি তর্কাতীত, অন্তত সেই সময়েও।
আবার বেকার বিবেকানন্দ। বিদেশেও তাঁর নামে এক বাঙ্গালি গুরু প্রচার করেন .. বিবেকানন্দ বেশ কয়েকটি বৌ ও দশ -বারো ছেলে পুলের পিতা ও এক আস্ত ভন্ড ও জুয়াখোর। ......
দেশে ও বিদেশে অর্ধপেটে বা অভুক্ত থেকেছেন দিন থেকে দিনান্তে....
চিঠিতে লিখেছিলেন :-
"-কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছি । মনে হয়েছে আজই হয়ত মরে যাবো ... জয় ব্রহ্ম বলে উঠে দাঁড়িয়েছি .... বলেছি . ..আমার ভয় নেই,নেই মৃত্যূ, নেই ক্ষুধা, আমি পিপাসা বিহীন । জগতের কি ক্ষমতা আমাকে ধ্বংস করে ?" ...
অসুস্থ বিবেকানন্দ বিশ্ব জয় করে কলকাতায় এলে তাঁর সংবর্ধনা দিতে বা সংবর্ধনা সভা তে আসতে রাজি হয় নি অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালী ( নাম গুলি অব্যক্ত রইল) শেষে প্যারিচাঁদ মিত্র রাজি হলেও ... তিনি বলেছিলেন .. ব্রাহ্মণ নয় বিবেকানন্দ । ও কায়েত... তাই সন্ন্যাসী হতে পারে না , আমি ওকে brother বিবেকানন্দ বলে মঞ্চে সম্বোধন করবো ।
১৮৯৮, বিদেশের কাগজে তাঁর বাণী ও ভাষণ পড়ে আমেরিকানরা অভিভূত আর বাঙ্গালীরা !
সেই বছরই অক্টোবরে অসুস্থ স্বামীজি কলকাতার বিখ্যাত ডক্টর রসিকলাল দত্তকে দেখাতে যান,(চেম্বার- 2 সদর স্ট্রিট। কলকাতা যাদুঘরে পাশের রাস্তা )। রুগী বিবেকানন্দ কে দেখে সেই সময় 40 টাকা ও ঔষুধের জন্যে 10 টাকা মানে আজ ২০২০র হিসাবে প্রায় ১৬০০০ টাকা নিলেন
বিবিধ রোগে আক্রান্ত বিশ্বজয়ী দরিদ্র সন্ন্যাসীর কাছ থেকে . বেলুড় মঠের জন্যে তোলা অর্থ থেকে স্বামী ব্রহ্মনন্দ এই টাকা বিখ্যাত বাঙ্গালী(?) ডক্টর রসিকলাল কে দিয়েছিলেন। ..
আরও আছে .........!!!
বিবেকানন্দের মৃত্যূর কোন ফটো নেই । এমনকি বীরপুরুষের কোন ডেথ সার্টিফিকেটও নেই কিন্তু সে সময় বালি - বেলুড় মিউনিসিপালিটি ছিলো।
আর এই municipality বেলুড় মঠে প্রমোদ কর বা amusement tax ধার্য করেছিলো ।
বলা হয়েছিল ওটা ছেলে ছোকরাদের আড্ডার ঠেক আর সাধারণ মানুষ বিবেকানন্দকে ব্যঙ্গ করে মঠকে বলতো .. "বিচিত্র আনন্দ" বা "বিবি- কা আনন্দ" । ( মহিলা /বধূ / ... নিয়ে আনন্দ ধাম)। এই ছিলো তৎকালীন মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীদের মনোবৃত্তি l
সাধে কি শেষ সময় বলে গিয়েছিলেন- " *একমাত্র আর একজন বিবেকানন্দই বুঝেতে পারবে যে এই বিবেকানন্দ কি করে গেল।"*
ঋণস্বীকার---
শংকরের অচেনা অজানা বিবেকানন্দ।
এক বিদেশী মেয়ের গল্প ::
একবার এক বিদেশী মেয়ে স্বামী বিবেকান্দকে এসে বলে "আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।"
স্বামীজি বলেন: কেন? আমি তো ব্রহ্মচারী।
মেয়েটি বলে: কারন আমি আপনার মতন একজন সন্তান চাই , যে সারা পৃথিবীতে আমার নাম উজ্জ্বল করবে। সেটা আপনাকে বিয়ে করলেই সম্ভব।
স্বামীজি বলেন: সেটার জন্য আরো একটি উপায় আছে।
মেয়ে জিজ্ঞেস করে: কি উপায়?
স্বামীজি মৃদু হেসে বলেন: আমাকে আপনার পুত্র বানিয়ে নেন। আর আমিও আপনাকে মা বলে ডাকব। এরফলে আপনার মনোবাসনাও পূর্ণ হবে আর আমার ব্রহ্মচর্যও অটুট থাকবে।
এমনটাই হলো মহাত্মাদের বিচারধারা।
পুরো সমুদ্রের জল একটি জাহাজকে ততক্ষন ডুবোতে পারেনা , যতক্ষন না সমুদ্রের জল জাহাজের ভেতর প্রবেশ করছে।
ঠিক তেমনি খারাপ কুবুদ্ধি ও অসামাজিক কাজ দ্বারা আপনি প্রভাবিত হবেন না, যতক্ষন না পর্যন্ত আপনি নিজে সেগুলি আপনার অন্তরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন।
এই জগৎ , সমাজ এই কারনে খারাপ নয় যে. খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশী। খারাপ কারন ভালো মানুষেরা চুপ থাকে...
A professor and Swami Vivekananda ::
😫 In 1881, a professor asked his student, whether it was God, who created EVERYTHING, that exists in the universe..?
🙄 Student replied : YES..
😫 He again asked : What about EVIL..? Has God created, EVIL ALSO.. ?
🙄 The student got silent. Somehow, the student requested that may he ask 2 questions..?
😫 Professor allowed him, to do so..
🙄 Student asked : Does COLD exists..?
😫 Professor said : Yes. Don't you feel the cold.. ?
🙄 Student said : I am sorry, but you are wrong sir. Cold is a complete ABSENCE OF HEAT. There is no cold. It is only, an absence of heat..
🙄 Student asked again : Does DARKNESS exists..?
😫 Professor said : YES..
🙄 Student replied : You are again wrong, sir. There is nothing like darkness. It is actually the ABSENCE OF LIGHT..
🙄 Sir, we always study LIGHT & HEAT, but not cold & darkness. Similarly, the evil does not exist. Actually it is the absence of LOVE, FAITH & BELIEF IN GOD ALMIGHTY. Name of this student was : VIVEKANANDA..
🍂🍂🍂🍂🍂 দেওঘরে স্বামীজী 🍂🍂🍂🍂🍂
( ৬ )
স্বামীজী ষষ্ঠবার অর্থাৎ শেষবারের মতো দেওঘরে আসেন ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে । সেই সময়ের একটি বিশেষ ঘটনা জানা যায় হরিচরণ মিশ্রের অপ্রকাশিত রচনা থেকে ---------
" দেওঘরে থাকাকালীন স্বামীজী প্রায়ই পাশ্ববর্তী গ্রামের সাঁওতালপল্লী ভ্রমণ করতেন । তিনি বলেছিলেন, 'এই সাঁওতালরাই এদেশের আদি অধিবাসী । এরা সরল, সৎ ও উদার । মহাজন, জমিদার ও ফড়েদাররাই এদের ঠকায় । এরা এদের সততার মূল্য পায় না ।' সাঁওতালদের প্রতি স্বামীজীর গভীর ভালবাসা ছিল ।
" মুনিয়া মাঝির কথা মনে পড়ে । প্রিয়বাবুর আনন্দকুটিরে যেখানে স্বামীজী এসে থাকতেন, কাজ করত মুন্না সাঁওতাল ও তার স্ত্রী ঝরি সাঁওতাল । তাদের একমাত্র মেয়ে মুনিয়া মাঝি । মুনিয়ার যখন সাত বছর বয়স, তার বাবা মারা যায় কলেরায় । এরপর থেকে মা-মেয়ে প্রিয়বাবুর বাড়িতে ঘরমোছা, জলতোলা, বাসনমাজা, কাপড়কাচা প্রভৃতি কাজ করত ।
" মুনিয়া স্বামীজীর স্নানের জল তুলে দিত, কাপড় কেচে দিত, খড়ম ধুয়ে দিত । মুনিয়া স্বামীজীকে বলত 'সাধুবাবা' । স্বামীজী দেওঘরে এলে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত মাজতেন । এই নিমকাঠি জোগাড় করে আনত মুনিয়া । পেটের গোলমালে ভুগতেন বলে স্বামীজীর জন্য মুনিয়া হিঞ্চেশাক এনে তার রস করে কাঁচা দুধ দিয়ে খেতে দিত তাঁকে । স্বামীজী তা খেয়ে বলতেন, 'মুনিয়া আমার এখানকার গার্জেন !' একবার মুনিয়া অনেকগুলো ভুট্টা এনে স্বামীজীকে বলল, 'সাধুবাবা এগুলো পুড়িয়ে দেব খাবি ----- খুব ভাল খেতে ।' স্বামীজী মুনিয়ার কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলেন । বাপ-মরা এই মেয়েটির প্রতি স্বামীজীর অপরিসীম করুণা ছিল । তাই আমাকে বলেছিলেন, 'এই অনাথা আদিবাসী মেয়েটাকে একটু লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করুন ।'
" স্বামীজীর নির্দেশমত মুনিয়াকে প্রাথমিক লেখাপড়া শিখিয়ে কুষ্ঠাশ্রমে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম । কাজ করার সুবাদে সংসার একটু সচ্ছল হল । সে লেখাপড়া জানায় পরমহংসদেবের নাম জানতে পারল । স্বামীজীর কর্মকাণ্ডও কিছু জানল । এদিকে বয়স হওয়ায় তার মা তার বিয়ে দিতে চাইল । কিন্তু সে কোনমতেই রাজি হল না । সে বলেছিল, 'সাধুবাবা আমার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেছে ----- সেই-ই আমাকে রক্ষা করবে ।'
" মা-মেয়ের সংসার । থাকত ধারোয়া নদীর তীরে । স্বামীজীর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে মুনিয়া খুব কেঁদেছিল । তখন কুড়ি-বাইশ বছর বয়স তার, মারণ জ্বরে পড়ল সে । সংবাদ পেয়ে তাদের বাড়ি ছুটলাম । পাড়াতে পৌঁছেই কান্নার রোল শুনতে পেলাম, বুকটা ধড়াস করে উঠল । শুনলাম, আজই মুনিয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । বাড়িতে গিয়ে দেখি, দাওয়ায় চেটায়ের ওপর মুনিয়া চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছে । তার মাথার কাছে একজোড়া খড়ম । জিজ্ঞাসা করলাম, 'ওর মাথার কাছে খড়মজোড়া কেন ?' তার মা বলল, 'পাণ্ডাজী, ঐ খড়মজোড়া হল সাধুবাবার । পুজো করার লেগে মুনিয়া বাবুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল । অসুখের সময় বলেছিল, মা তুই সাধুবাবার খড়ম-দুটো মাথায় ঠেকিয়ে মাথার কাছে রাখ । সাধুবাবা এসে পড়বে ।' এ কথা বলে মুনিয়ার মা কান্নায় ভেঙে পড়ল ।
" স্বামীজী মুনিয়ার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন । মুনিয়া নিশ্চিত স্বামীজীর আশীর্বাদ পেয়েছিল । তা না হলে অশিক্ষিত সাঁওতাল গোষ্ঠীর মেয়ে হয়ে রোগীদের সেবায় নিজেকে বলি দেওয়ার সাহস পেল কোথা থেকে ? ধন্য মুনিয়া মাঝি ------- ধন্য তার সাধুবাবার প্রতি ভক্তি ! "
( উদ্বোধন : ৯ / ১৪১৯ )
🍂🍂🍂🍂🍂🍂 জয় স্বামীজী 🍂🍂🍂🍂🍂🍂
স্বামী বিবেকানন্দ ও সূর্যগ্রহণ
আজ সূর্যগ্রহণ -সর্বগ্রাসী গ্রহণ। জ্যোতির্বিদগণও গ্রহণ দেখতে নানাস্থানে গেছেন। ধর্মপিপাসু নরনারীগণ গঙ্গা স্নান করতে বহুদূর থেকে এসে উৎসুক হয়ে গ্রহণবেলার প্রতীক্ষা করছেন। স্বামীজীর কিন্তু গ্রহণ সম্বন্ধে বিশেষ কোন উৎসাহ নেই। কয়েকদিন হল তিঁনি বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে আছেন। সকালে ,দুপুরে বা সন্ধ্যায় তাঁর কিছুমাত্র বিরাম নেই।বহু উৎসাহী মানুষ ,কলেজের ছাত্র তাঁকে দর্শনের জন্য আসছেন।
স্বামীজী শিষ্যকে(শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী) বলেছেন নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে।সেইমত শিষ্যও মাছ ,তরকারি ও রান্নার সব জিনিস নিয়ে বলরাম বাবুর বাড়িতে সকাল ৮টার মধ্যে এসেছেন।তাকে দেখে স্বামীজী বললেন,"তোদের দেশের মতো রান্না হওয়া চাই আর গ্রহণের আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়া চাই।"
বলরামবাবুদের বাড়ির মেয়েছেলেরা কেউ কলকাতাতে নেই ।শিষ্য বাড়ির ভিতরে রন্ধনশালায় গিয়ে রান্না শুরু করলেন।আজ তার পরম আনন্দের দিন ,তার গুরুকে রান্না করে খাওয়াবেন।যোগীন মা সেদিন বলরাম বাবুর বাড়িতে ছিলেন।তিনি দাঁড়িয়ে শিষ্যকে নানারকম রান্না বিষয়ে সাহায্য করছিলেন।স্বামীজীও মাঝে মাঝে ভিতরে এসে শিষ্যকে উৎসাহিত করে যাচ্ছিলেন ;দেখিস মাছের "জুল" যেন ঠিক বাঙ্গালদিশি ধরনের হয় বলে রঙ্গ করছিলেন। ভাত ,মুগের ডাল ,কই মাছের ঝোল ,মাছের টক ও মাছের সুক্তনী রান্না প্রায় শেষ হয়েছে ,এমন সময় স্বামীজী স্নান করে এসে নিজেই পাতা নিয়ে খেতে বসে পড়লেন।এখনো কিছু রান্না বাকি আছে বলাতেও আবদেরে ছেলের মত বললেন ,"যা হয়েছে নিয়ে আয় ,আমি আর বসতে পারছি না ,পেট খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে।"শিষ্য তাড়াতাড়ি আগে মাছের সুক্তনী ও ভাত দিয়ে খেতে দিলেন।তারপর শিষ্য বাটিতে করে অন্য যা রান্না হয়েছিল সেগুলিও পরিবেশন করলেন।এবার তিনি ভিতরে গিয়ে প্রেমানন্দ ও যোগানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী মহারাজদের কেও ডেকে এনে খেতে দিলেন।
শিষ্য কোনকালেই রান্নায় পটু ছিলেন না।কিন্তু স্বামীজী আজ শিষ্যের রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন।কলকাতার লোক মাছের সুক্তনী নামে খুব ঠাট্টা তামাশা করে কিন্তু সেই সুক্তনী খেয়ে বললেন,"এমন কখনো খাই নি।" কিন্তু মাছের 'জুল'টা যেমন ঝাল হয়েছে ,এমন আর কোনটা ই হয় নি।মাছের টক খেয়ে বললেন ,"এটা ঠিক যেন বর্ধমানী ধরনের হয়েছে।অনন্তর দই ও সন্দেশ খেয়ে স্বামীজী ভোজন শেষ করে আচমনান্তে ঘরে এসে খাটে বসলেন।স্বামীজী তামাক টানিতে টানিতে বললেন ,"যে ভাল রাঁধতে পারে না ,সে ভাল সাধু হতে পারে না -মন শুদ্ধ না হলে ভাল সুস্বাদু রান্না হয় না।"
কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে শাঁক ঘন্টা বেজে উঠল এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শোনা যেতে লাগল। স্বামীজী বলে উঠলেন ,"ওরে গেরন লেগেছে - আমি ঘুমোই ,তুই আমার পা টিপে দে।" এই বলে একটু তন্দ্রা অনুভব করতে লাগলেন। শিষ্যও তাঁহার পদসেবা করতে করতে ভাবলেন ,"এই পূণ্যক্ষণে গুরুপদসেবাই আমার গঙ্গাস্নান ও জপ।" তিনি শান্তমনে গুরুর পদসেবা করতে লাগলেন। গ্রহণে সর্বগ্রাস হয়ে ক্রমে চারদিক সন্ধ্যাকালের মত তমসাছন্ন হয়ে গেল।
গ্রহণ ছেড়ে যাবার ১৫/২০ মিনিট বাকি থাকতে স্বামীজীর নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেল।নিদ্রা থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে চাইলেন। তামাক খেতে খেতে শিষ্যকে পরিহাস করে বললেন,"লোকে বলে ,গেরনের সময় যে যা করে ,সে নাকি তাই কোটিগুণে পায় ; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি,যদি এই সময়ে একটু ঘুমুতে পারি তো বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হলো না ; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে ।"
(১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি মধ্যাহ্নে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল)
ঠিক কি ঘটেছিল ৪ঠা জুলাই ১৯০২ সালে...........
স্বামীজীর তিরোধান দিবসে জানাই স্বশ্রদ্ধ প্রণাম !!
II আজ সেই চৌঠা জুলাই - এইদিনে স্বামী বিবেকানন্দ ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাদের কে ......
ঠিক কী ঘটেছিলো এই দিন.... ৪ঠা জুলাই, ১৯০২
========
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিবেকানন্দের । তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে । আজই তো সেই দিন । আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আর আমার দেহত্যাগের দিন। মা ভুবনেশ্বরী দেবীর মুখটি মনে পড়ল তাঁর। ধ্যান করলেন সেই দয়াময় প্রসন্ন মুখটি। বুকের মধ্যে অনুভব করলেন নিবিড় বেদনা ।তারপর সেই বিচ্ছেদবেদনার সব ছায়া সরে গেল ।ভারী উৎফুল্ল বোধ করলেন বিবেকানন্দ। মনে নতুন আনন্দ, শরীরে নতুন শক্তি । তিনি অনুভব করলেন, তাঁর সব অসুখ সেরে গিয়েছে । শরীর ঝরঝর করছে । শরীরে আর কোনো কষ্ট নেই।
মন্দিরে গেলেন স্বামীজি । ধ্যানমগ্ন উপাসনায় কাটালেন অনেকক্ষন । আজ সকাল থেকেই তাঁর মনের মধ্যে গুন গুন করছে গান । অসুস্থতার লক্ষন নেই বলেই ফিরে এসেছে গান, সুর, আনন্দ । তাঁর মনে আর কোনও অশান্তি নেই । শান্ত , স্নিগ্ধ হয়ে আছে তাঁর অন্তর।উপাসনার পরে গুরুভাইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন ।
বেলা বাড়ল। সাড়ে আটটা নাগাদ প্রেমানন্দকে ডাকলেন তিনি। বললেন, আমার পুজোর আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে । সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে ।
বিবেকানন্দ একা হতে চান ।
প্রেমানন্দকে বললেন‚ আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে ।
এখন আমি সেখানে বসেই ধ্যান করব ।
অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন । আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন ।চারদিকের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতে বললেন স্বামীজি ।
বেলা এগারোটা পর্যন্ত ধ্যানে মগ্ন রইলেন স্বামীজি । ধ্যান ভাঙলে ঠাকুরের বিছানা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন তিনি --
মন্দিরে গেলেন স্বামীজি । ধ্যানমগ্ন উপাসনায় কাটালেন অনেকক্ষন । আজ সকাল থেকেই তাঁর মনের মধ্যে গুন গুন করছে গান । অসুস্থতার লক্ষন নেই বলেই ফিরে এসেছে গান, সুর, আনন্দ । তাঁর মনে আর কোনও অশান্তি নেই । শান্ত , স্নিগ্ধ হয়ে আছে তাঁর অন্তর।উপাসনার পরে গুরুভাইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন ।
বেলা বাড়ল। সাড়ে আটটা নাগাদ প্রেমানন্দকে ডাকলেন তিনি। বললেন, আমার পুজোর আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে । সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে ।
বিবেকানন্দ একা হতে চান ।
প্রেমানন্দকে বললেন‚ আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে ।
এখন আমি সেখানে বসেই ধ্যান করব ।
অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন । আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন ।চারদিকের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতে বললেন স্বামীজি ।
বেলা এগারোটা পর্যন্ত ধ্যানে মগ্ন রইলেন স্বামীজি । ধ্যান ভাঙলে ঠাকুরের বিছানা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন তিনি --
মা কি আমার কালো,
কালোরূপা এলোকেশী
হৃদিপদ্ম করে আলো ।
তরুন সন্ন্যাসীর রূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গুরুভাইরা ।
বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই দুপুরের খাওয়া সারতে বললেন বিবেকানন্দ । আজ নিজে একলা খাচ্ছেন না । খেতে বসলেন সবার সঙ্গে ।
সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলেদের নৌকো ভিড়েছিল । নৌকোভর্তি গঙ্গার ইলিশ । স্বামীজির কানে খবর আসতেই তিনি মহাউত্সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন । তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে ইলিশের অনেকরকম পদ ।
গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশভক্ষনে বসলেন বিবেকানন্দ । তিনি জানেন, আর মাত্র কয়েকঘন্টার পথ তাঁকে পেরোতে হবে । ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলার আর প্রয়োজন নেই । জীবনের শেষ দিনটা তো আনন্দেই কাটানো উচিত।
'একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে। ঘটিবাটিগুলোও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ।' বললেন স্বামীজি ।
পেট ভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল. ইলিশ ভাজা ।
দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল, একটু লেখাপড়া করা যাক ।
বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন‚ লাইব্রেরি থেকে শুক্লযজুর্বেদটি নিয়ে আয় ।
তারপর হঠাৎ বললেন‚ এই বেদের মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না |
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ শিরাগুচ্ছে‚ ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি রয়েছে‚ তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে । আর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে । মহীধর সেটি ধরতে পারেননি ।
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন ।
এরপর দুপুর একটা থেকে চারটে পর্যন্ত তিনঘন্টা স্বামীজী লাইব্রেরী ঘরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে ।
তিনি পাণিনির ব্যাকরণের সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলেন ।
ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসির হুল্লোড়ে পরিণত হল ।
ব্যাকরনের ক্লাস শেষ হতেই এক কাপ গরম দুধ খেয়ে প্রেমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত প্রায় দু মাইল পথ হাঁটলেন ।
এতটা হাঁটা তাঁর শরীর ইদানিং নিতে পারছে না ।
কিন্তু ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাইয়ের গল্প অন্যরকম । কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না।
বুকে এতটুকু হাঁফ ধরল না । আজ তিনি অক্লেশে হাঁটলেন ।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ মঠে ফিরলেন বিবেকানন্দ । সেখানে আমগাছের তলায় একটা বেঞ্চি পাতা । গঙ্গার ধারে মনোরম আড্ডার জায়গা । স্বামীজির শরীর ভাল থাকে না বলে এখানে বসেন না । আজ শরীর -মন একেবারে সুস্থ । তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন বিবেকানন্দ ।
আড্ডা দিতে দিতে ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল ।
সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা হবে । সন্ন্যাসীরা কজন মিলে চা খাচ্ছেন । স্বামীজি এক কাপ চা চাইলেন ।
সন্ধ্যে ঠিক সাতটা। শুরু হলো সন্ধ্যারতি । স্বামীজি জানেন আর দেরি করা চলবে না । শরীরটাকে জীর্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করার পরমলগ্ন এগিয়ে আসছে ।
তিনি বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন । ব্রজেন্দ্রকে বললেন , 'আমাকে দুছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর ।
আমি না ডাকলে আসবি না ।'
স্বামীজি হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটাই তাঁর শেষ ধ্যান ।
তখন ঠিক সন্ধ্যে সাতটা পঁয়তাল্লিশ । স্বামীজি যা চেয়েছিলেন তা ঘটিয়ে দিয়েছেন ।
ব্রজেন্দ্রকে ডাকলেন তিনি । বললেন , জানলা খুলে দে । গরম লাগছে ।মেঝেতে বিছানা পাতা । সেখানে শুয়ে পড়লেন স্বামীজি । হাতে তাঁর জপের মালা ।
ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন স্বামীজিকে । স্বামীজি ঘামছেন । বললেন , আর বাতাস করিসনে । একটু পা টিপে দে ।
রাত ন'টা নাগাদ স্বামীজি বাঁপাশে ফিরলেন । তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল । কুন্ডলিনীর শেষ ছোবল । বুঝতে পারলেন বিবেকানন্দ । শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন তিনি ।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । গভীর সেই শ্বাস । মাথাটা নড়ে উঠেই বালিশ থেকে পড়ে গেল ।
ঠোঁট আর নাকের কোনে রক্তের ফোঁটা । দিব্যজ্যোতিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ । ঠোঁটা হাসি ।
ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন , 'তুই যেদিন নিজেকে চিনতে পারবি সেদিন তোর এই দেহ আর থাকবে না ।'
স্বামীজি বলেছিলেন , 'তাঁর চল্লিশ পেরোবে না ।'
বয়েস ঠিক উনচল্লিশ বছর পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন ।
পরের দিন ভোরবেলা ।
একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত‚ বিভূতি-বিভূষিত‚ বিবেকানন্দ ।
তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট ।
তাঁর পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন ।
তাঁর প্রসারিত ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি ।
তাঁর চোখদুটি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ‚ অর্ধনিমীলিত‚ অন্তর্মুখী‚ অক্ষিতারা ।
নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন ।
স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস করছেন ।তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা ।
স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে ।
পা-দুখানি পুবে‚ গঙ্গার দিকে ।
শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা‚ ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে । আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে বিশুদ্ধ বেদনা ।অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন‚ পুড়ছেন তিনি ।
এ বেদনার সমুদ্রে তিনি একা ।নির্জনবাসিনী নিবেদিতা ।বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায় ।
আর তখুনি সেখানে এসে পৌঁছলেন জননী ভুবনেশ্বরী ।চিৎকার করে কাঁদতে- কাঁদতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে ।
কী হল আমার নরেনের ?
হঠাৎ চলে গেল কেন ?
ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয় ।
আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা ।
আমি কী নিয়ে থাকব নরেন ?
ফিরে আয় । ফিরে আয় ।
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন ।
তারপর তাঁকে তুলে দিলেন নৌকায় ।
জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা ।
মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না ।
ফিরে আয় নরেন ফিরে আয় ।
ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ।
তাঁর কান্না‚ ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়‚ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে ।
নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন‚ প্রভুর ওই জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম !
সন্ধে ছটা ।
দাহকার্য সম্পন্ন হল । আর নিবেদিতা অনুভব করলেন‚ কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল । তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন‚ অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে‚ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি‚ সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন ।
নিবেদিতার মনে হল‚ মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে-আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর‚ তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি ।
*সেই 4ঠা জুলাই ১৯০২ এর স্বামীজীর শেষ দিনটা কেমন ছিল জানুন*
**************************
*৪ঠা জুলাই ১৯০২ ভোর*
====≠= ============
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিবেকানন্দের। তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে। আজই তো সেই দিন। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আর আমার দেহত্যাগের দিন। মা ভুবনেশ্বরী দেবীর মুখটি মনে পড়ল তাঁর। ধ্যান করলেন সেই দয়াময় প্রসন্ন মুখটি। বুকের মধ্যে অনুভব করলেন নিবিড় বেদনা।
তারপর সেই বিচ্ছেদবেদনার সব ছায়া সরে গেল।
ভারী উৎফুল্ল বোধ করলেন বিবেকানন্দ। মনে নতুন আনন্দ, শরীরে নতুন শক্তি। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর সব অসুখ সেরে গিয়েছে। শরীর ঝরঝর করছে। শরীরে আর কোনো কষ্ট নেই।
মন্দিরে গেলেন স্বামীজি। ধ্যানমগ্ন উপাসনায় কাটালেন অনেকক্ষন। আজ সকাল থেকেই তাঁর মনের মধ্যে গুন গুন করছে গান। অসুস্থতার লক্ষন নেই বলেই ফিরে এসেছে গান, সুর, আনন্দ। তাঁর মনে আর কোনও অশান্তি নেই। শান্ত , স্নিগ্ধ হয়ে আছে তাঁর অন্তর।
উপাসনার পরে গুরুভাইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন।
*৪ঠা জুলাই সকাল সাড়ে আটটা*
===============
প্রেমানন্দকে ডাকলেন তিনি। বললেন, আমার পুজোর আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে। সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে। বিবেকানন্দ একা হতে চান।
প্রেমানন্দকে বললেন‚ আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে।
এখন আমি সেখানে বসেই ধ্যান করব।
অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন।
আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন ।চারদিকের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতে বললেন স্বামীজি।
*৪ঠা জুলাই বেলা এগারোটা*
=============
ধ্যান ভাঙলে ঠাকুরের বিছানা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন তিনি --
মা কি আমার কালো,
কালোরূপা এলোকেশী
হৃদিপদ্ম করে আলো।
তরুন সন্ন্যাসীর রূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গুরুভাইরা।
বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই দুপুরের খাওয়া সারতে বললেন বিবেকানন্দ। আজ নিজে একলা খাচ্ছেন না। খেতে বসলেন সবার সঙ্গে।
*সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলেদের নৌকো ভিড়েছিল। নৌকোভর্তি গঙ্গার ইলিশ। স্বামীজির কানে খবর আসতেই তিনি মহাউত্সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন। তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে ইলিশের অনেকরকম পদ।*
গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশ ভক্ষনে বসলেন বিবেকানন্দ।
*তিনি জানেন, আর মাত্র কয়েকঘন্টার পথ তাঁকে পেরোতে হবে। ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলার আর প্রয়োজন নেই। জীবনের শেষ দিনটা তো আনন্দেই কাটানো উচিত।*
'একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে। ঘটিবাটিগুলোও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।' বললেন স্বামীজি । *পেট ভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল, ইলিশ ভাজা।*
দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল, একটু লেখাপড়া করা যাক। বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন‚ লাইব্রেরি থেকে শুক্ল যজুর্বেদটি নিয়ে আয়।
তারপর হঠাৎ বললেন‚ এই বেদের মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না।
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ শিরাগুচ্ছে‚ ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি রয়েছে‚ তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে। আর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে। মহীধর সেটি ধরতে পারেননি।
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন।
*৪ঠা জুলাই দুপুর একটা থেকে চারটে*
==================
এই তিনঘন্টা স্বামীজী লাইব্রেরী ঘরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে।
তিনি পাণিনির ব্যাকরণের সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলেন।
ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসির হুল্লোড়ে পরিণত হল।
ব্যাকরনের ক্লাস শেষ হতেই এক কাপ গরম দুধ খেয়ে প্রেমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত প্রায় দু মাইল পথ হাঁটলেন।
এতটা হাঁটা তাঁর শরীর ইদানিং নিতে পারছে না। কিন্তু ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাইয়ের গল্প অন্যরকম। কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না।
বুকে এতটুকু হাঁফ ধরল না। আজ তিনি অক্লেশে হাঁটলেন।
*৪ঠা জুলাই বিকেল পাঁচটা*
==============
মঠে ফিরলেন বিবেকানন্দ। সেখানে আমগাছের তলায় একটা বেঞ্চি পাতা। গঙ্গার ধারে মনোরম আড্ডার জায়গা। স্বামীজির শরীর ভাল থাকে না বলে এখানে বসেন না।আজ শরীর -মন একেবারে সুস্থ। তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন বিবেকানন্দ।
*৪ঠা জুলাই সন্ধে ছটা*
=================
আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা হলো । সন্ন্যাসীরা কজন মিলে চা খাচ্ছেন। স্বামীজি এক কাপ চা চাইলেন।
*৪ঠা জুলাই সন্ধ্যে ঠিক সাতটা।*
===============
শুরু হলো সন্ধ্যারতি। স্বামীজি জানেন আর দেরি করা চলবে না। শরীরটাকে জীর্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করার পরমলগ্ন এগিয়ে আসছে।
তিনি বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ব্রজেন্দ্রকে বললেন , 'আমাকে দুছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর। আমি না ডাকলে আসবি না।'
স্বামীজি হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটাই তাঁর শেষ ধ্যান।
*৪ঠা জুলাই ঠিক সন্ধ্যে সাতটা পঁয়তাল্লিশ।*
=================
স্বামীজি যা চেয়েছিলেন তা ঘটিয়ে দিয়েছেন। ব্রজেন্দ্রকে ডাকলেন তিনি। বললেন , জানলা খুলে দে। গরম লাগছে।
মেঝেতে বিছানা পাতা। সেখানে শুয়ে পড়লেন স্বামীজি। হাতে তাঁর জপের মালা।
ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন স্বামীজিকে। স্বামীজি ঘামছেন। বললেন , আর বাতাস করিসনে। একটু পা টিপে দে।
*৪ঠা জুলাই রাত ন'টা দশ মিনিট*
================
স্বামীজি বাঁপাশে ফিরলেন। তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কুন্ডলিনীর শেষ ছোবল। বুঝতে পারলেন বিবেকানন্দ। শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গভীর সেই শ্বাস। মাথাটা নড়ে উঠেই বালিশ থেকে পড়ে গেল। ঠোঁট আর নাকের কোনে রক্তের ফোঁটা। দিব্যজ্যোতিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ। ঠোঁটে হাসি,
*চলে গেলেন ঠিক রাত নটা দশ মিনিট এ*
ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন , 'তুই যেদিন নিজেকে চিনতে পারবি সেদিন তোর এই দেহ আর থাকবে না।'
*স্বামীজি বলেছিলেন , 'তাঁর চল্লিশ পেরোবে না।' বয়েস ঠিক উনচল্লিশ বছর পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন।**
*পরের দিন 5ই জুলাই ভোরবেলা।*
একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত‚ বিভূতি-বিভূষিত‚ বিবেকানন্দ।
তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট।
তাঁর পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন।
তাঁর প্রসারিত ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি।
তাঁর চোখদুটি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ‚ অর্ধনিমীলিত‚ অন্তর্মুখী‚ অক্ষিতারা।
নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন।
স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস করছেন।
তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা।
স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে।
পা-দুখানি পুবে‚ গঙ্গার দিকে।
শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা‚ ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে।আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে বিশুদ্ধ বেদনা।
অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন‚ পুড়ছেন তিনি।
এই বেদনার সমুদ্রে তিনি একা।
নির্জনবাসিনী নিবেদিতা।
বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায়।
*আর তখুনি সেখানে এসে পৌঁছলেন জননী ভুবনেশ্বরী।*
চিৎকার করে কাঁদতে- কাঁদতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।*
কী হল আমার নরেনের ?
হঠাৎ চলে গেল কেন ?
ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়।
আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা।
আমি কী নিয়ে থাকব নরেন ?
ফিরে আয়। ফিরে আয়।
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন।
তারপর তাঁকে তুলে দিলেন নৌকায়। জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা।
মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না। ফিরে আয় নরেন ফিরে আয়। ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
তাঁর কান্না‚ ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়‚ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে।
নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন‚ প্রভুর ওই জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম!
*৫ই জুলাই সন্ধে ছটা।*
দাহকার্য সম্পন্ন হল। আর নিবেদিতা অনুভব করলেন‚ কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল। তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন‚ অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে‚ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি‚ সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন।
নিবেদিতার মনে হল‚ মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর‚ তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি।
🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼
(সংগৃহীত)
৪ জুলাই ১৯০২ ----- রাত ৯ টার পরে নব্যভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানযোগে মহাসমাধির আনন্দে চিরমগ্ন হয়েছেন | আষাঢ়ের ঘন-অন্ধকারে ধর্ম জগতের উজ্জ্বল আলোক স্তম্ভের জীবন প্রদীপটি হঠাৎ নিভে গেল | এই দুঃসংবাদ পর দিন সকালে কলকাতা সহ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল | আমাদের আহিরিটোলার বাড়ীতে স্বামীজীর শিষ্য কানাই মহারাজ ( স্বামী নির্ভয়ানন্দ ) এসে শোক-সংবাদটি জানিয়ে গেছেন | আমি তখন পাশে কোন ঠাকুর মন্দিরে পূজা করতে গিয়েছিলাম | ৯টায় বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার মা শোকবিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি করছেন | কারণ জিজ্ঞাসা করায়
মা বললেন , "" বাবা ! তোদের সর্বনাশ হয়ে
গেছে ----- মঠের স্বামীজী আর নেই ,
দেহ রেখেছেন , আমাকে একবার
তাঁকে দেখালি না ! ""
আমি বললাম , "" মঠের সকল সাধুই "স্বামী" ,
তুমি কোন স্বামীজীর কথা
বলছো ? তুমি বোধ হয়
ভুল শুনেছো | ""
মা বলেন , "" ওরে না , কানাই ভোরে এসে
খবর দিয়ে গেছে ------ বড় স্বামীজী
গতকাল রাত ৯টায় শরীর ছেড়ে
চলে গেছেন | কানাই তোদের
মঠে যেতে বলেছে | ""
ক্রন্দনরত মাকে আশ্বস্ত করে বললাম , "" সাধুর
দেহত্যাগে শোক করতে নেই | ""
সেই সময় বন্ধু নিবারণচন্দ্র ( শ্রীশ্রীমায়ের শিষ্য ) আসাতে তাকে ও আমর ভাই দুলালশশীকে নিয়ে অফিসে না গিয়ে স্বামীজীকে শেষ দর্শন করার জন্য আহিরিটোলা ঘাট থেকে নৌকায় বেলুড় মঠে পৌঁছলাম বেলা দশটায় | তখন সামান্য বৃষ্টি হয়েছে | দেখলাম পুজনীয় রাখাল মহারাজ ( স্বামী ব্রহ্মানন্দজী ) প্রমুখ কয়েকজন মহারাজ পশ্চিম দিকের নীচের বারান্দায় খাটে ফুল সাজাচ্ছেন |
আমাদের দেখে শ্রীরাখাল মহারাজ কেঁদে ফেললেন , তাঁর বাক্য বের হলো না ----- হাত ইশারা করে উপরে যেতে ইঙ্গিত করলেন |
উপরে স্বামীজীর ঘরে পৌঁছে দেখলাম ------ একটি সুন্দর গালিচার উপর শয়ান স্বামীজীর মুখমণ্ডল দিব্যভাবদীপ্ত , সমস্ত শরীর নতুন রং করা গেরুয়া বস্ত্রে ঢাকা রয়েছে | ডানহাতে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি জড়িয়ে আছে | ঠিক ধ্যানমগ্ন মহাদেবের মতো তাঁর চোখ দুটি অন্তর্মুখী ও অর্ধনিমীলিত | স্বামীজীর বাঁ দিকে ভগিনী নিবেদিতা অশ্রুপূর্ণচোখে স্বামীজীর মাথায় একভাবে পাখার বাতাস করছেন | স্বামীজীর মাথাটি পশ্চিমদিকে ও পা দুখানি পূর্বদিকে গঙ্গারদিকে শয়ন করা | তাঁর পায়ের কাছে নন্দলাল ব্রহ্মচারী বিষাদ মৌনমুখে নীরবে বসে আছেন | আমরা তিনজনে মাথা নিচু করে স্বামীজীর পাদপদ্ম স্পর্শ ও প্রণাম করে সেখানে বসলাম | স্পর্শ করে অনুভব করলাম স্বামীজীর দেহ বরফের মতোন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে |
স্বামীজীর ডানহাতের আঙুলে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করে নিলাম | ইতিমধ্যে অনেক ভক্ত স্বামীজীকে শেষ দর্শন করতে উপরে এসেছেন ও প্রণাম করে একে একে চলে যাচ্ছেন | আমার জপ শেষ হলে নিবেদিতা আমাকে ডেকে চুপি চুপি বললেনঃ ------ "" Can you sing , my friend ? Would you mind singing those which our Thakur used to sing ? ""
ঐ বিষয়ে আমার অক্ষমতা জানালে ,
নিবেদিতা আবার অনুরোধ করলেন ,
"" Will you please request your
friend on my behalf ? ""
তখন বন্ধু নিবারণ প্রাণ খুলে কয়েকটি গান গাইলেন , "" ১) যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী .শ্যামা মাকে , ২) গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চি কেবা চায় | ৩) কে বলে শ্যামা আমার কালো , মা যদি কালো তবে কেন আমার হৃদয় করে আলো , ৪) মজলো আমার মন ভ্রমরা , শ্যামাপদ নীলকমলে , ৫ ) মন আমার কালী কালী বলনা , কালী কালী বললে পরে , কালের ভয় আর রবে না ইত্যাদি
আকুল আগ্রহভরে সুমধুর গান শুনতে শুনতে বিষণ্ণ ভগিনী নিবেদিতার অন্তর থেকে বেদনার স্রোত বুক ফেটে বেরিয়ে এসে চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু নির্গত হতে লাগল | এই দৃশ্যটি বড় করুণ , অবিস্মরণীয় ------ এই স্মৃতিটুকু তো ভুলবার নয় | যদিও স্রোতের মতো ৪৫টা বছর চলে গিয়েছে | তবুও সেই স্মৃতি আজও আমাদের মনে সোনার অক্ষরে লিখিত আছে
※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※
বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশরৎ মহারাজ ( স্বামী সীরদানন্দজী ) দোতলায় স্বামীজীর ঘরে এসে আমাদের তিনজন ও ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন , "" বাবা ! স্বামীজী চলে যাওয়াতে
আমরা ভেঙে পড়েছি |
------ আমাদের বল টুটে গেছে |
তোরা সকলে ধরাধরি করে
স্বামীজীর দেহটি নিচে নামিয়ে
আনতে পারবি ? ""
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহিভক্ত ও নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজীর দেহটি বহন করে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে বারান্দায় রাখা পুষ্পসজ্জিত খাটটিতে শুইয়ে দিলাম | সেইসময় কয়েকটি বেদানা , আপেল , ন্যাসপাতি , আঙুর স্বামীজীর বুকের উপর সাজিয়ে দেওয়া হলো |
তখন বুড়োগোপালদাদা ( স্বামী অদ্বৈতানন্দজী ) ব্রহ্মচারীকে বললেন , "" ওরে নন্দলাল !
আমাদের চেয়ে স্বামীজী তোকেই
বেশি ভালোবাসতেন | আজ তাঁর
শেষ পুজো তোর হাতেই হোক্ | ""
এই প্রস্তাব শ্রীরাখাল মহারাজ ও অন্যান্য মহারাজও অনুমোদন করায় , নন্দলাল স্বামীজীকে ফুল-মালা এবং নানা ফলাদি মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করে স্তোত্রপাঠ করলেন | এই সময় স্বামীজীর শেষ ফটো তোলার প্রস্তাব হলে ,
শ্রীরাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দজী )
বলেন , "" স্বামীজীর কত রকমের ভাল
ফটো রয়েছে , এই বিষাদ মাখা
ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে | ""
তারপর শ্রীরাখাল মহারাজ প্রমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ ও ব্রহ্মচারীরা একে একে স্বামীজীর শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করলেন | পরে স্বামীজীর বন্ধু হরমোহন ও অন্যান্য গৃহিভক্তরাও পুষ্পাঞ্জলি দিলেন | পরে স্বামীজী চরণতলে আলতা মাখিয়ে পায়ের ছাপ রাখা হলো | ভগিনী নিবেদিতাও একটি রুমালে স্বামীজীর চরণের ছাপ তুলে নিলেন | একটি ফুটন্ত " মার্শাল নীল " জাতীয় গোলাপ ফুলে চন্দন মাখিয়ে স্বামীজীর চরণতলে বুলিয়ে আমার বুকপকেট রাখলাম |
স্বামীজীর পূজাদি কার্য শেষ হলে শ্রীশরৎ মবারাজ আমাদের চারজনকেই পালঙ্কটি বহন করে যেখানে অগ্নিসংস্কার করা হবে সেখানে নিয়ে যেতে অনুমতি দিলেন | আমরা তাই করলাম , বাকি সকলে পিছে পিছে আসতে লাগলেন | সেইদিন পূর্বেই বৃষ্টি হওয়াতে মঠ প্রাঙ্গন পিচ্ছিল হওয়ায় অতি সাবধানে বহন করে পূর্বে সজ্জিত চন্দন কাঠের চিতার উপরে স্থাপন করা হলো |
তারপর শ্রীশরৎ মহারাজ
উপস্থিৎ সকলকে বললেন , "" তোমরা বাণ্ডিল পাঁকাঠি আগুন ধরিয়ে এই বেদিকে
সাতবার প্রদক্ষিণ করে
শেষে খাটের নিচে
স্বামীজীর পায়ের তলায় জ্বলন্ত
আগুন রেখে প্রণাম করে চলে এস | ""
তাঁর আদেশ মতো স্বামীজীর শরীরকে চন্দন কাঠে অগ্নি সংযোগ করে জ্বলন্ত চিতাকে বেষ্টন করে ভক্তেরা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল | চিতার আগুন ক্রমশ লেলিহমান হয়ে উর্ধমুখী অনেকগুলি জিহ্বা বের করে ধূ ধূ করে জ্বলতে লাগল | সেসময় মহাকবি গিরিশ ঘোষ , মাস্টার মহাশয় মহেন্দ্র গুপ্ত , শাঁখচুন্নী ( অক্ষয় কুমার সেন ) , জলধর সেন , বসুমতীর উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ভক্তেরা বেলতলার কাছে রকে বসে এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে লাগলেন |
গিরিশবাবু তো ভগ্নহৃদয়ে
চিৎকার করে বলতে লাগলেন ,
"" নরেন ! কোথায় তুমি বেঁচে থেকে
আমার কথা লোকের কাছে বলে
ঠাকুরের মহিমা প্রচার করবে -------
কিন্তু সে সাধে পোড়া বিধি হলো
বাদী , আমি বুড়ো বেঁচে রইলুম
তোমার এই দৃশ্য দেখবার জন্য ?
তুমি তো ঠাকুরের ছেলে ,
ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে ,
বল দেখি এখানে আমাদের কি
দশায় ফেলে অকালে চলে
গেলে ? নিশ্চয়ই আমাদের
কপাল ভেঙ্গেছে | ""
এই কথা শুনে নিবেদিতা শোকচ্ছাস চেপে রাখতে পারলেন না | তিনি জ্বলন্ত চিতার কাছে গিয়ে চারদিক ঘুরতে লাগলেন | পাথে তাঁর গাউনে আগুন লাগে , তাই মহারাজজীর নির্দেশে কানাই মহারাজ নিবেদিতার হাত ধরে দূরে গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে বসালেন ও সাহস দিতে লাগলেন | স্বামীজীর নারায়ণী শরীরটির নিম্নাংশ অনুকুল বায়ুর প্রভাবে অল্প সময়েই ভস্মিভুত হলো | কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় , তাঁর বুকে , মুখে মাথায় আগুন স্পর্শ না করায় সেই মুখভঙ্গি , আয়ত চোখ দুটির দৃষ্টি কী সুন্দর দেখাতে লাগল | স্বামীজীর সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ নিকটের একটি গাছে উঠে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে জ্বলন্ত চিতার উপর সাজিয়ে দিতে লাগলেন |
এই সময় শ্রীরাখাল মহারাজ আমাকে একটু তফাতে নিয়ে একটি দশটাকার নোট দিয়ে
বললেন , "" তুমি নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে
গিরিশবাবুর নৌকায় ওপারে
বরানগর বাজার থেকে কিছু
সন্দেশ ও খাবার কিনে আনো |
কাল রাত্তির থেকে সাধুরা কেউজল মুখে দেয় নি ------ আরউপস্থিৎ অনেক ভক্তদেরওখাওয়া হয় নি | ""
মহারাজের কথা মতো কাজ করতে যেতে দেখে বরানগরের এক ভক্ত বিপিন সাহা আরও পাঁচ টাকা দিয়ে আমাদের সঙ্গে ওপারে গিয়ে গরম লুচি , কচুরী ও সন্দেশ নিয়ে ঝুড়ি নিজের মাথায় বহন করে আমাদের সঙ্গে মঠে ফিরলেন | এসে দেখলাম চিতা নিভিয়ে স্বামীজীর দেহাবশেষ সংগ্রহ করে সন্ন্যাসী ও ভক্তরা স্নান করে গঙ্গায় তর্পণ করছেন |
মাস্টার মহাশয় ( শ্রীম )আমাকে বললেন , "" তুমি শব ছঁয়েছো , স্নান তর্পণ কর | ""
একথায় আমি বললাম , "" সাধু নারায়ণ -------
সেই নারায়ণী দেহ স্পর্শ
করাতে আমি অপবিত্র হয়েছি ?
এই কাপড়েই মহারাজের আদেশে
ঠাকুরের ভোগের জিনিস বহন
করে এনেছি | ""
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে স্বামী প্রেমানন্দজী বললেন , "" তোমার স্নান
করবার দরকার নেই ,
তোমার মাথায় গঙ্গাজল
দিলুম , ঠাকুরঘরে খাবার
রেখে এসে তুমি গঙ্গায়
স্বামীজীকে তর্পণ অঞ্জলি দাও | ""
সমস্ত দিনের পর ঠাকুরের এই প্রথম সান্ধ্য-জলপানি ভোগ ও. আরতি হয়ে গেলে নিচের তলায় সংবেত সাধু ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে চা , সরবৎ এবং প্রসাদ বিতরিত হল |
স্বামীজীর অন্তিম ইচ্ছাপূরণেরজন্য ৪ জুলাইয়ের পরদিনের অমাবস্যাতে রাতে বেলুড়মঠে শ্রীশ্রীকালীপূজা অনুষ্ঠান | বাইরের কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি |কেবল স্বামীজীর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ মহাশয় এসেছিলেন | মাখন মহারাজ নিবারণ ও আমাকে হোমের জন্য পনের সের বেল কাঠ আনার আদেশ দিলেন | সেই নির্দিষ্ট তিথিতে শনিবার বিকালে আমরা দুজন ঐ বেলকাঠ বহন করে আনলে মহারাজজী খুশী হয়ে উচ্চারণ করেন ,
"" চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর পাহি মাম্ |
চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর রক্ষ মাম্ ||
বাঁচালে বাবা ! আজ এমন ঝড় বৃষ্টি দূর্যোগে শুকনো বেলকাঠ এনেছো ----- মা তোমাদের মঙ্গল করুন | ""
রাত দশটার পরে দোতলায় ঠাকুরঘরে শ্রীশ্রীকালী পূজা আরম্ভ হলো | রামকৃষ্ণানন্দজীর পিতা প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক ঁঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় পূজকের আসন গ্রহন করেন | সাধূ ব্রহ্মচারীরা ঠাকুর প্রণাম করে স্বামীজীর ঘরে গিয়ে বসলেন | সেদিন রাতে প্রসাদ পাবার পর আমরা তিনজন মঠেই থাকলাম | রাত্রে মধ্যে মধ্যেই স্বামীজীর বৃদ্ধ শিষ্য নিত্যানন্দ স্বামীর সকরুণ ক্রন্দন ধ্বনিতে বেলুড় মঠ যেন মুখরিত হয়ে উঠল | রাত তিনটার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ আমাদের জাগিয়ে উপরের ঠাকুর ঘরে যেতে বললেন | উপরে ঠাকুর ঘরে গেলে মহারাজজী আমাকে আচমন করে কিছুক্ষণ জপ করতে বললেন | কিছু পরে মহারাজজীর আদেশে সকলে নিচে বিরাট হোমকুণ্ডের চারদিকে বসে জপ করতে লাগলাম | হোমক্রিয়া শেষ হলে যেখানে স্বামীজীর দেহ দাহ হয়েছে , সেখানে এসে সাতবার প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করলাম এবং বেলতলায় বসে জপ করে ফিরে এসে ঠাকুর ঘরে প্রণামের পরে প্রসাদ গ্রহণ করলাম |
※※※ জয় স্বামীজী মহারাজজী কী জয় |
প্রণাম নাও হে অমর-আত্মা,ভারত-আত্মা স্বামীজী***
※※※※※
※※※※※※※
※※※প্রণাম※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※ভালবাসা※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※জানাই※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※ বুদ্ধদেব ※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※
※※※※※※※※
※※※※※※※
※※※※※※
※※※※※
※※※※
※※※
※※
শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী দাসী। জগতবিখ্যাত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর জননী।
১৮৪১ সালে অভিজাত পরিবারে জন্ম। ছেলেবলায় মেমের কাছে ইংরাজি শিখেছিলেন। শিশু নরেন জননীর কাছেই প্রথম ইংরাজির পাঠ নেন। পরবর্তী কালে বিবেকানন্দর বিদেশি ভক্তদের সঙ্গে ইংরাজি তে কথাও বলেছেন। চরিত্রগুণে ছিলেন মহীয়সী। আর আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্বংসহা। এত সহ্যশক্তির পরীক্ষা ঈশ্বর আর কারোর কাছে নিয়েছেন কিনা জানিনা।
আদরে ও ঐশ্বর্যে লালিত বাবা মার একমাত্র সন্তান ভুবনেশ্বরীর সারা জীবন শুধু দুঃখের কাহিনী। দশ বছর বয়সে বিয়ে। ছটি কন্যা ও চার পুত্রের জননী। অতি অল্প বয়সে বৈধব্য। অপরিসীম অভাব। তারপর কখনো আদরের কন্যাদের আত্মহনন, প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। শরিকি মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে স্বামীর ভিটে থেকে বিতাড়ন এবং প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়া।
দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়। মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ নিখোঁজ, কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ ইংরেজের বিরুদ্ধাচার করে জেলে এবং শেষ অব্দি মায়ের শেষ সম্বল গয়নাগুলো বেচে মার্কিন দেশে যাত্রা। এতকিছু নীরবে সহ্য করে নিঃসহায় অবস্থায় বিধবা মায়ের আশ্রয়ে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটান।
১৯১১ সালের ২৫ শে জুলাই মেনিনজাইটিস রোগে মৃত্যু। শেষকৃত্যে শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন মেজছেলে মহেন্দ্রনাথ ও সিস্টার নিবেদিতা। কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ তখন আমেরিকায় নির্বাসিতের জীবন যাপন করছেন। আর বিশ্ববন্দিত সন্ন্যাসীপুত্র বিবেকানন্দ ন'বছর আগেই মহাসমাধিতে মগ্ন।
নীচে একটি ছবি দিলাম। নির্মম দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ, আত্মীয়দের অপমান ও পুত্রকন্যা র অকালমৃত্যুতে শোকজর্জরিত বিবেকানন্দজননীর এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ছেপেছিলেন ব্রহ্মানন্দ উপাধ্যায়, সন ১৩১৪ র বৈশাখ সংখ্যায়, স্বরাজ পত্রিকায়।
ক্যাপশনে লেখা ছিল নিম্নরুপে...
"নরেন্দ্রর মাতার চিত্রও দিলাম। নরেন্দ্রর মাতা রত্নগর্ভা।.... আহা- মায়ের ছবিখানি দেখ-দেখিলে বুঝিতে পারিবে যে নরেন্দ্র মায়ের ছেলে বটে---আর মাতা ছেলের মা বটে "
আজকের দিনে ২৫ জুলাই,১৯১১ স্বামীজীর মা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অমৃতলোকে যাত্রা করেন |প্রণাম গ্রহণ করুন বীরেশ্বর বিবেকানন্দের মা ভূবনেশ্বরী দেবী।
এই প্রসঙ্গে খেতড়ি মহারাজকে লেখা স্বামীজীর একটি চিঠি মায়ের জন্য----
১ ডিসেম্বর,১৮৯৮, মঠ, বেলুড়, হাওড়া
মহারাজা,
আপনার তারবার্তা আমায় যে আনন্দ দিয়াছে তাহা বর্ণনাতীত| এমন বার্তা আপনার মত মহান ব্যক্তিরই যোগ্য |আমি কি চাই তাহা বিশদভাবে লিখিলাম |
কলকাতায় একটি ছোটখাটো বাড়ী নির্মাণের নুন্যতম খরচ আনুমানিক দশ হাজার টাকা |সংসার খরচের জন্য মাসিক একশত টাকা আপনি যে আমার মাকে পাঠাইয়া থাকেন তাহা তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট | যদি আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত আমার ব্যায় নির্বাহের জন্য আরও একশত টাকা পাঠাইতে পারেন তবে আমি বড়ই খুশী হইব ;কিন্তু এই বাড়তি একশত টাকা আপনাকে খুব বেশী দিন বহন করিতে হইবে না কেননা আমি বড়জোর আর দু-এক বৎসর বাঁচিব |আমি আর একটি ভিক্ষা এখানে চাহিব |মায়ের জন্য একশত টাকার সাহায্যটি সম্ভব হইলে আপনি স্হায়ী রাখিবেন | মহারাজা যেন সাধুর দুঃখী বৃদ্ধা মাতার প্রতি এই করুণা বর্ষণ করেন|••••••••••••••
যে -জগন্মাতার লীলা-খেলা এই বিশ্বচরাচর,যাঁহার হাতে আমরা যন্ত্রমাত্র----তিনি যেন আপনাকে সকল অমঙ্গল হইতে রক্ষা করেন |
ভগবানের নামে চিরদিন আপনার ----
বিবেকানন্দ
বর্তমান বেলুড়মঠ নির্মাণের জন্য একটা বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন, এই মহিলা। বিবাহের দশ বছর পরেই তার স্বামীর মৃত্যু হয় ।
এর ১৪ বছর পর স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় |স্বামীজী বলেছেন Most Spiritual Women.
জন্মসূত্রে অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হয়েও জাগতিক সুখ বিমুখ ছিলেন ।এঁর একমাত্র কন্যার নাম ওলিয়া | ইনি মৃত্যুর আগে উইল করে যান যার একটা বড় অংশই শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের উদ্দেশ্যে দান করেছিলেন ।
মামলা করেছিলেন,মেয়ে ওলিয়া মৃতা মায়ের উইলের যথার্থতা নিয়ে।
কিন্তু মামলায় তার পরাজয় হয় আর ওলিয়ার মৃত্যুও হয় মামলার রায় যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিনই আকস্মিকভাবে ।
শ্রীরামক়ষ্ণ মিশনে তিনি Saint Sara নামে পরিচিত |
বাইরের ঘটনা সবসময় কোন মানুষের সঠিক পরিচয় দেয় না।জীবনের উচ্চতম আদর্শকে সামনে রেখে তিলে তিলে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন যে রমণী, তিনিই স্বামীজীর ধীরামাতা --- শ্রীমতী সারা চ্যাপম্যান বুল |
🔴🔴🔴🔴🔴 মহাপ্রাণ স্বামীজী 🔴🔴🔴🔴🔴
বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে বেদ বেদান্তের গভীর আলোচনায় মেতে রয়েছেন স্বামীজী তাঁর শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে । এমন সময় সেখানে হাজির হলেন ভক্তভৈরব গিরিশচন্দ্র ঘোষ । গিরিশবাবুর দিকে তাকিয়ে স্বামীজী বললেন, " কি জি. সি., এ-সব তো কিছু পড়লে না, কেবল কেষ্টু-বিষ্টু নিয়েই দিন কাটালে । " গিরিশবাবু বললেন, " কি আর পড়ব ভাই ? অত অবসরও নেই, বুদ্ধিও নেই যে, ওতে সেঁধুব । তবে ঠাকুরের কৃপায় ও-সব বেদবেদান্ত মাথায় রেখে এবার পাড়ি মারব । তোমাদের দিয়ে তাঁর ঢের কাজ করাবেন বলে ও-সব পড়িয়ে নিয়েছেন, আমার ও-সব দরকার নেই । " এ কথা বলে গিরিশবাবু প্রকাণ্ড ঋগ্বেদ গ্রন্থখানিকে বারবার প্রণাম করে বলতে লাগলেন ------ " জয় বেদরূপী শ্রীরামকৃষ্ণের জয় । "
এবার স্বামীজীর দিকে তাকিয়ে গিরিশবাবু বলে উঠলেন, " হাঁ, হে নরেন, একটা কথা বলি । বেদবেদান্ত তো ঢের পড়লে, কিন্তু এই যে দেশে ঘোর হাহাকার, অন্নাভাব, ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা, মহাপাতকাদি চোখের সামনে দিনরাত ঘুরছে, এর উপায় তোমার বেদে কিছু বলেছে ? ঐ অমুকের বাড়ির গিন্নি, এককালে যার বাড়িতে রোজ পঞ্চাশখানি পাতা পড়ত, সে আজ তিন দিন হাঁড়ি চাপায়নি ; ঐ অমুকের বাড়ির কুলস্ত্রীকে গুণ্ডাগুলো অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে ; ঐ অমুকের বাড়িতে ভ্রূণহত্যা হয়েছে, অমুক জোচ্চুরি করে বিধবার সর্বস্ব হরণ করেছে ------- এ-সকল রহিত করবার কোন উপায় তোমার বেদে আছে কি ? " গিরিশবাবু এভাবে সমাজের বিভীষিকাময় ছবিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরাতে স্বামীজী নির্বাক হয়ে রইলেন । জগতের দুঃখকষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে স্বামীজীর চোখে জল এল । মনের ভাব কাউকে জানতে দেবেন না বলে তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে চলে গেলেন ।
গিরিশবাবু শিষ্যকে লক্ষ্য করে বললেন, " দেখলি বাঙাল, কত বড় প্রাণ ! তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না ; কিন্তু ঐ যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি । চোখের সামনে দেখলি তো মানুষের দুঃখকষ্টের কথাগুলো শুনে করুণায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে স্বামীজীর বেদবেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল ! "
🔴🔴🔴🔴জয় স্বামীজী 🔴🔴🔴🔴
১৮৬৩ সালের পৌষ সংক্রান্তি কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে কলকাতায় সিমুলিয়ায় দত্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, জননীর নাম ভুবনেশ্বরী দেবী।
১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারী পৌষ সংক্রান্তির পুণ্যপ্রভাতে সূর্যোদয়ের ৬ মিনিট পূর্বে, ৬ টা ৩৩ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দেবী ভুবনেশ্বরী বিশ্ববিজয়ী পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন।
বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর মোট দশটি সন্তান--
১) পুত্র শৈশবে মৃত।
২) কন্যা শৈশবে মৃত।
৩) হারামণি ২২ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৪) স্বর্ণময়ী ৭২ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৫) কন্যা শৈশবে মৃত।
৬) নরেন্দ্রনাথ ৩৯ বৎসর ৫ মাস ২৪ দিন জীবিত ছিলেন।
৭) কিরণবালা ১৬ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৮) যোগীন্দ্রবালা ২২ বৎসর জীবিতছিলেন।
৯) মহেন্দ্রনাথ ৮৭ বৎসর জীবিত ছিলেন।
১০) ভূপেন্দ্রনাথ ৮১ বৎসর জীবিত ছিলেন।
বিরজাহোম করে সন্ন্যাসগ্রহণ কালে নরেন্দ্রনাথের নতুন নাম হয় বিবিদিষানন্দ। পরিব্রাজক জীবনে তিনি সচ্চিদানন্দ ও বিবেকানন্দ নামও ব্যবহার করেছেন। শেষোক্ত নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন।
ॐ নমঃ শ্রীযতিরাজায় বিবেকানন্দসূরয়ে ।
সচ্চিৎ সুখস্বরূপায় স্বামিনে তাপহারিণে ।।
শ্রীমান্, সন্ন্যাসিরাজ, সচ্চিদানন্দস্বরূপ, ত্রিতাপহারী, সর্বজ্ঞ স্বামী বিবেকানন্দকে প্রণাম করি।
#আমি_কচুরি_সম্প্রদায়ভুক্ত_সন্ন্যাসী !
স্বামী বিবেকানন্দ।
বাঙালি মানেই ভোজনরসিক। সেই তালিকায় মধ্যে রয়েছেন বহু মনিষীও। নেতাজীর যেমন লক্ষ্মীনারায়ণের চপ না হলে রাজনৈতিক মিটিং জমত না। রবীন্দ্রনাথ আবার তিনি খান আর নাই খান তাঁর পাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার সাজানো রয়েছে এটা দেখতে পছন্দ করতেন। রামকৃষ্ণদেব আবার সারদামণির হাতের ভাত আর ঝোলেই তৃপ্তি পেতেন। তাঁরই শিষ্য বিবেকানন্দ, তিনি আবার কচুরি খেতে খুব পছন্দ করতেন।
কলকাতার বিভিন্ন দোকান থেকে তিনি কচুরি আনিয়ে তো খেতেন। লন্ডনে তাঁকে কে বানিয়ে দেবে কচুরি তরকারি ? তোয়াক্কা করতেন না। বিদেশে বাড়ির বেসমেন্টে বসেই বানিয়ে ফেলতেন। তারপর তৃপ্তি করে তা উদরস্থ করতেন। ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন স্বামীজি। পথে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বসে, “আচ্ছা, আপনি কোন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী? পুরী না গিরি?” বিবেকানন্দ বরাবরই কথার প্যাঁচে পটু ছিলেন। তাঁর অসাধারন উত্তরে কাবু প্রশ্নকর্তা। তিনি বলেন, ” পুরী গিরি দুটোর কোনোটাই না, আমি কচুরি সম্প্রদায়ভুক্ত।” এমনই ছিল তাঁর কচুরি প্রেম।
মৃত্যুর দিনেও স্বামী বিবেকানন্দ দুপুরে ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন যে “একাদশীতে না খেয়ে পেটটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। স্বস্তি পেলাম।” কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে তাঁর খাদ্য তালিকায় সবার উপরে থাকত কচুরি আর তরকারি। এটা না খেলে তাঁর দিন যেত না। সমস্ত মায়া ত্যাগ করা মানুষটির কচুরি দেখলে লোভ সংবরন করতে মুশকিলে পড়তেন। কচুরি-আলু ছেঁচকি বানানোর কেউ না থাকলে নিজেই বানিয়ে খেয়ে নিতেন। এর প্রতি স্বামীজির দুর্বলতা মারাত্মক ছিল।
শুধু খাওয়া নয় রান্না করতেও ভালোবাসতেন। মাংসের নানা পদ তাঁর প্রিয় ছিল। ফাউল ছিল তার মধ্যে অন্যতম। শিকাগো যাত্রার আগে তৎকালীন বোম্বাইতে স্বামীজি ১৪ টাকা খরচ করে এক হাঁড়ি পোলাও রান্না করে শিষ্যদের খাইয়েছিলেন। কই মাছের তরকারি তাঁর প্রিয় খাবারের আরও একটি।
তখন তিনি শুধুই নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পড়াশোনা করছেন। পেটুক এবং খাদ্যরসিক বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘পেটুক সংঘ’। তাদের কাছে ঘোষণা করেন, “দেখবি কলকাতা শহরে গলির মোড়ে মোড়ে পানের দোকানের মতো চপ-কাটলেটের দোকান হবে।” এখন সত্যি শহরের প্রত্যেক মোড়ে একটি অন্তত চপ বা তেলেভাজার দোকান থাকেই। কিছু না হোক মিষ্টির দোকানের শিঙারা তো পাওয়াই যায়। খেতে পছন্দ করতেন রসগোল্লা এবং আইসক্রিমও।
স্বামীজির আমেরিকায় থাকাকালীন প্রাতঃরাশের তালিকাও ছিল বেশ লম্বা। প্রথমেই খেতেন কমলালেবু এবং আঙুর। এরপরেই খেয়ে নিতেন ডবল ডিমের পোচ। এরপরে দুই পিস টোস্ট এবং ক্রিম ও চিনি সহকারে দুই কাপ কফি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে স্যুপ এবং মাংস বা মাছের সঙ্গে রাতের আহার সেরে নিতেন। এরপর কোনও একটি মিষ্টির পদ থাকতই। আর প্রত্যেকবার খাবার শেষে ধূমপান ছিল অতি আবশ্যক।
স্বামী বিবেকানন্দের বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) ভ্রমনের একাংশ:
১৯০১ সালের ১৮ মার্চ জলপথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন তাঁর মা ও কয়েকজন বন্ধু। পরবর্তীতে কিছু আত্মীয় স্বজনও এসে যুক্ত হন তাদের সাথে । পূর্ববঙ্গে তিনি ১৫ দিনের বেশি অবস্থান করেছিলেন এবং ঢাকায় দুটি ভাষনও প্রদান করেন৷
জগন্নাথ কলেজে প্রদত্ত প্রথম ভাষণের শুরুতে বলেন, "আমি নানা দেশ ভ্রমণ করেছি-কিন্তু আমি কখনো নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশ বিশেষভাবে দর্শন করিনি। জানতাম না, এ দেশের জলে স্থলে সর্বত্র এত সৌন্দর্য ;কিন্তু নানা দেশ ভ্রমণ করে আমার এই লাভ হয়েছে যে, আমি বাংলার সৌন্দর্য বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।"
ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা জানিয়ে লন্তনে অবস্থানরত মিসেস ওলি বুলকে স্বামীজি দুটি চিঠি পাঠান (২০ মার্চ ও ২৯ মার্চ)। আমার প্রিয় মা সম্বোধন করে তিনি লেখেন,
" শেষ পর্যন্ত আমি পূর্ব বাংলায় এসেছি। এখানে আমি এবারই প্রথম এবং কখনো জানতাম না বাংলা এত সুন্দর। এখানকার নদীগুলো আপনার দেখা উচিৎ - নিয়মিত পরিষ্কার জলের প্রবাহ এবং সবকিছু এত সবুজ। গ্রামগুলো সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার ও সুন্দর।"
ঢাকার জীবন সম্পর্কে লিখেছেন, " I am peaceful and calm. I'm finding every day the old begging and trudging life is the best for me after all."
দ্বিতীয় চিঠিতে লেখেন," এখানে ব্রহ্মপুত্র নদে বিরাট একটি পবিত্র স্নান আছে। যখনই গ্রহ-নক্ষত্রের সংযোগ হয়, যা খুবই কদাচিৎ হয়ে থাকে,তখনই নদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশাল লোকের সমারোহ হয়ে থাকে। এবছর এখানে হাজার হাজার লোকের সমারোহ হয়েছিল; মাইলব্যাপী নদটি নৌকাদ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছিল।.... নদটি যদিও স্নানের স্থানে প্রায় একমাইল প্রশস্ত, তবে স্থানটি কর্দমাক্ত। "
৫ জুলাই, মেরি হলকে চিঠিতে স্বামীজি লেখেন," তুমি জানো, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু এর তাৎপর্য পূর্বে কখনো উপলব্ধি করিনি৷ পূর্ববঙ্গের নদীগুলো যেন তরঙ্গসঙ্কুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয় - সেগুলি এত দীর্ঘ যে, স্টীমার সপ্তাহের পর সপ্তাহ এদের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। "
কালোরূপা এলোকেশী
হৃদিপদ্ম করে আলো ।
তরুন সন্ন্যাসীর রূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গুরুভাইরা ।
বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই দুপুরের খাওয়া সারতে বললেন বিবেকানন্দ । আজ নিজে একলা খাচ্ছেন না । খেতে বসলেন সবার সঙ্গে ।
সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলেদের নৌকো ভিড়েছিল । নৌকোভর্তি গঙ্গার ইলিশ । স্বামীজির কানে খবর আসতেই তিনি মহাউত্সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন । তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে ইলিশের অনেকরকম পদ ।
গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশভক্ষনে বসলেন বিবেকানন্দ । তিনি জানেন, আর মাত্র কয়েকঘন্টার পথ তাঁকে পেরোতে হবে । ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলার আর প্রয়োজন নেই । জীবনের শেষ দিনটা তো আনন্দেই কাটানো উচিত।
'একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে। ঘটিবাটিগুলোও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ।' বললেন স্বামীজি ।
পেট ভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল. ইলিশ ভাজা ।
দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল, একটু লেখাপড়া করা যাক ।
বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন‚ লাইব্রেরি থেকে শুক্লযজুর্বেদটি নিয়ে আয় ।
তারপর হঠাৎ বললেন‚ এই বেদের মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না |
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ শিরাগুচ্ছে‚ ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি রয়েছে‚ তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে । আর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে । মহীধর সেটি ধরতে পারেননি ।
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন ।
এরপর দুপুর একটা থেকে চারটে পর্যন্ত তিনঘন্টা স্বামীজী লাইব্রেরী ঘরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে ।
তিনি পাণিনির ব্যাকরণের সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলেন ।
ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসির হুল্লোড়ে পরিণত হল ।
ব্যাকরনের ক্লাস শেষ হতেই এক কাপ গরম দুধ খেয়ে প্রেমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত প্রায় দু মাইল পথ হাঁটলেন ।
এতটা হাঁটা তাঁর শরীর ইদানিং নিতে পারছে না ।
কিন্তু ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাইয়ের গল্প অন্যরকম । কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না।
বুকে এতটুকু হাঁফ ধরল না । আজ তিনি অক্লেশে হাঁটলেন ।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ মঠে ফিরলেন বিবেকানন্দ । সেখানে আমগাছের তলায় একটা বেঞ্চি পাতা । গঙ্গার ধারে মনোরম আড্ডার জায়গা । স্বামীজির শরীর ভাল থাকে না বলে এখানে বসেন না । আজ শরীর -মন একেবারে সুস্থ । তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন বিবেকানন্দ ।
আড্ডা দিতে দিতে ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল ।
সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা হবে । সন্ন্যাসীরা কজন মিলে চা খাচ্ছেন । স্বামীজি এক কাপ চা চাইলেন ।
সন্ধ্যে ঠিক সাতটা। শুরু হলো সন্ধ্যারতি । স্বামীজি জানেন আর দেরি করা চলবে না । শরীরটাকে জীর্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করার পরমলগ্ন এগিয়ে আসছে ।
তিনি বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন । ব্রজেন্দ্রকে বললেন , 'আমাকে দুছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর ।
আমি না ডাকলে আসবি না ।'
স্বামীজি হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটাই তাঁর শেষ ধ্যান ।
তখন ঠিক সন্ধ্যে সাতটা পঁয়তাল্লিশ । স্বামীজি যা চেয়েছিলেন তা ঘটিয়ে দিয়েছেন ।
ব্রজেন্দ্রকে ডাকলেন তিনি । বললেন , জানলা খুলে দে । গরম লাগছে ।মেঝেতে বিছানা পাতা । সেখানে শুয়ে পড়লেন স্বামীজি । হাতে তাঁর জপের মালা ।
ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন স্বামীজিকে । স্বামীজি ঘামছেন । বললেন , আর বাতাস করিসনে । একটু পা টিপে দে ।
রাত ন'টা নাগাদ স্বামীজি বাঁপাশে ফিরলেন । তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল । কুন্ডলিনীর শেষ ছোবল । বুঝতে পারলেন বিবেকানন্দ । শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন তিনি ।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । গভীর সেই শ্বাস । মাথাটা নড়ে উঠেই বালিশ থেকে পড়ে গেল ।
ঠোঁট আর নাকের কোনে রক্তের ফোঁটা । দিব্যজ্যোতিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ । ঠোঁটা হাসি ।
ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন , 'তুই যেদিন নিজেকে চিনতে পারবি সেদিন তোর এই দেহ আর থাকবে না ।'
স্বামীজি বলেছিলেন , 'তাঁর চল্লিশ পেরোবে না ।'
বয়েস ঠিক উনচল্লিশ বছর পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন ।
পরের দিন ভোরবেলা ।
একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত‚ বিভূতি-বিভূষিত‚ বিবেকানন্দ ।
তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট ।
তাঁর পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন ।
তাঁর প্রসারিত ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি ।
তাঁর চোখদুটি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ‚ অর্ধনিমীলিত‚ অন্তর্মুখী‚ অক্ষিতারা ।
নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন ।
স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস করছেন ।তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা ।
স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে ।
পা-দুখানি পুবে‚ গঙ্গার দিকে ।
শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা‚ ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে । আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে বিশুদ্ধ বেদনা ।অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন‚ পুড়ছেন তিনি ।
এ বেদনার সমুদ্রে তিনি একা ।নির্জনবাসিনী নিবেদিতা ।বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায় ।
আর তখুনি সেখানে এসে পৌঁছলেন জননী ভুবনেশ্বরী ।চিৎকার করে কাঁদতে- কাঁদতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে ।
কী হল আমার নরেনের ?
হঠাৎ চলে গেল কেন ?
ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয় ।
আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা ।
আমি কী নিয়ে থাকব নরেন ?
ফিরে আয় । ফিরে আয় ।
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন ।
তারপর তাঁকে তুলে দিলেন নৌকায় ।
জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা ।
মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না ।
ফিরে আয় নরেন ফিরে আয় ।
ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ।
তাঁর কান্না‚ ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়‚ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে ।
নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন‚ প্রভুর ওই জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম !
সন্ধে ছটা ।
দাহকার্য সম্পন্ন হল । আর নিবেদিতা অনুভব করলেন‚ কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল । তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন‚ অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে‚ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি‚ সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন ।
নিবেদিতার মনে হল‚ মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে-আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর‚ তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি ।
আ বা র জানুন ::
*সেই 4ঠা জুলাই ১৯০২ এর স্বামীজীর শেষ দিনটা কেমন ছিল জানুন*
**************************
*৪ঠা জুলাই ১৯০২ ভোর*
====≠= ============
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিবেকানন্দের। তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে। আজই তো সেই দিন। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আর আমার দেহত্যাগের দিন। মা ভুবনেশ্বরী দেবীর মুখটি মনে পড়ল তাঁর। ধ্যান করলেন সেই দয়াময় প্রসন্ন মুখটি। বুকের মধ্যে অনুভব করলেন নিবিড় বেদনা।
তারপর সেই বিচ্ছেদবেদনার সব ছায়া সরে গেল।
ভারী উৎফুল্ল বোধ করলেন বিবেকানন্দ। মনে নতুন আনন্দ, শরীরে নতুন শক্তি। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর সব অসুখ সেরে গিয়েছে। শরীর ঝরঝর করছে। শরীরে আর কোনো কষ্ট নেই।
মন্দিরে গেলেন স্বামীজি। ধ্যানমগ্ন উপাসনায় কাটালেন অনেকক্ষন। আজ সকাল থেকেই তাঁর মনের মধ্যে গুন গুন করছে গান। অসুস্থতার লক্ষন নেই বলেই ফিরে এসেছে গান, সুর, আনন্দ। তাঁর মনে আর কোনও অশান্তি নেই। শান্ত , স্নিগ্ধ হয়ে আছে তাঁর অন্তর।
উপাসনার পরে গুরুভাইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন।
*৪ঠা জুলাই সকাল সাড়ে আটটা*
===============
প্রেমানন্দকে ডাকলেন তিনি। বললেন, আমার পুজোর আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে। সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে। বিবেকানন্দ একা হতে চান।
প্রেমানন্দকে বললেন‚ আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে।
এখন আমি সেখানে বসেই ধ্যান করব।
অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন।
আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন ।চারদিকের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতে বললেন স্বামীজি।
*৪ঠা জুলাই বেলা এগারোটা*
=============
ধ্যান ভাঙলে ঠাকুরের বিছানা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন তিনি --
মা কি আমার কালো,
কালোরূপা এলোকেশী
হৃদিপদ্ম করে আলো।
তরুন সন্ন্যাসীর রূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গুরুভাইরা।
বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই দুপুরের খাওয়া সারতে বললেন বিবেকানন্দ। আজ নিজে একলা খাচ্ছেন না। খেতে বসলেন সবার সঙ্গে।
*সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলেদের নৌকো ভিড়েছিল। নৌকোভর্তি গঙ্গার ইলিশ। স্বামীজির কানে খবর আসতেই তিনি মহাউত্সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন। তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে ইলিশের অনেকরকম পদ।*
গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশ ভক্ষনে বসলেন বিবেকানন্দ।
*তিনি জানেন, আর মাত্র কয়েকঘন্টার পথ তাঁকে পেরোতে হবে। ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলার আর প্রয়োজন নেই। জীবনের শেষ দিনটা তো আনন্দেই কাটানো উচিত।*
'একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে। ঘটিবাটিগুলোও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।' বললেন স্বামীজি । *পেট ভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল, ইলিশ ভাজা।*
দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল, একটু লেখাপড়া করা যাক। বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন‚ লাইব্রেরি থেকে শুক্ল যজুর্বেদটি নিয়ে আয়।
তারপর হঠাৎ বললেন‚ এই বেদের মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না।
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ শিরাগুচ্ছে‚ ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি রয়েছে‚ তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে। আর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে। মহীধর সেটি ধরতে পারেননি।
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন।
*৪ঠা জুলাই দুপুর একটা থেকে চারটে*
==================
এই তিনঘন্টা স্বামীজী লাইব্রেরী ঘরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে।
তিনি পাণিনির ব্যাকরণের সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলেন।
ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসির হুল্লোড়ে পরিণত হল।
ব্যাকরনের ক্লাস শেষ হতেই এক কাপ গরম দুধ খেয়ে প্রেমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত প্রায় দু মাইল পথ হাঁটলেন।
এতটা হাঁটা তাঁর শরীর ইদানিং নিতে পারছে না। কিন্তু ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাইয়ের গল্প অন্যরকম। কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না।
বুকে এতটুকু হাঁফ ধরল না। আজ তিনি অক্লেশে হাঁটলেন।
*৪ঠা জুলাই বিকেল পাঁচটা*
==============
মঠে ফিরলেন বিবেকানন্দ। সেখানে আমগাছের তলায় একটা বেঞ্চি পাতা। গঙ্গার ধারে মনোরম আড্ডার জায়গা। স্বামীজির শরীর ভাল থাকে না বলে এখানে বসেন না।আজ শরীর -মন একেবারে সুস্থ। তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন বিবেকানন্দ।
*৪ঠা জুলাই সন্ধে ছটা*
=================
আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা হলো । সন্ন্যাসীরা কজন মিলে চা খাচ্ছেন। স্বামীজি এক কাপ চা চাইলেন।
*৪ঠা জুলাই সন্ধ্যে ঠিক সাতটা।*
===============
শুরু হলো সন্ধ্যারতি। স্বামীজি জানেন আর দেরি করা চলবে না। শরীরটাকে জীর্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করার পরমলগ্ন এগিয়ে আসছে।
তিনি বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ব্রজেন্দ্রকে বললেন , 'আমাকে দুছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর। আমি না ডাকলে আসবি না।'
স্বামীজি হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটাই তাঁর শেষ ধ্যান।
*৪ঠা জুলাই ঠিক সন্ধ্যে সাতটা পঁয়তাল্লিশ।*
=================
স্বামীজি যা চেয়েছিলেন তা ঘটিয়ে দিয়েছেন। ব্রজেন্দ্রকে ডাকলেন তিনি। বললেন , জানলা খুলে দে। গরম লাগছে।
মেঝেতে বিছানা পাতা। সেখানে শুয়ে পড়লেন স্বামীজি। হাতে তাঁর জপের মালা।
ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন স্বামীজিকে। স্বামীজি ঘামছেন। বললেন , আর বাতাস করিসনে। একটু পা টিপে দে।
*৪ঠা জুলাই রাত ন'টা দশ মিনিট*
================
স্বামীজি বাঁপাশে ফিরলেন। তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কুন্ডলিনীর শেষ ছোবল। বুঝতে পারলেন বিবেকানন্দ। শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গভীর সেই শ্বাস। মাথাটা নড়ে উঠেই বালিশ থেকে পড়ে গেল। ঠোঁট আর নাকের কোনে রক্তের ফোঁটা। দিব্যজ্যোতিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ। ঠোঁটে হাসি,
*চলে গেলেন ঠিক রাত নটা দশ মিনিট এ*
ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন , 'তুই যেদিন নিজেকে চিনতে পারবি সেদিন তোর এই দেহ আর থাকবে না।'
*স্বামীজি বলেছিলেন , 'তাঁর চল্লিশ পেরোবে না।' বয়েস ঠিক উনচল্লিশ বছর পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন।**
*পরের দিন 5ই জুলাই ভোরবেলা।*
================
একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত‚ বিভূতি-বিভূষিত‚ বিবেকানন্দ।তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট।
তাঁর পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন।
তাঁর প্রসারিত ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি।
তাঁর চোখদুটি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ‚ অর্ধনিমীলিত‚ অন্তর্মুখী‚ অক্ষিতারা।
নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন।
স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস করছেন।
তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা।
স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে।
পা-দুখানি পুবে‚ গঙ্গার দিকে।
শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা‚ ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে।আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে বিশুদ্ধ বেদনা।
অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন‚ পুড়ছেন তিনি।
এই বেদনার সমুদ্রে তিনি একা।
নির্জনবাসিনী নিবেদিতা।
বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায়।
*আর তখুনি সেখানে এসে পৌঁছলেন জননী ভুবনেশ্বরী।*
চিৎকার করে কাঁদতে- কাঁদতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।*
কী হল আমার নরেনের ?
হঠাৎ চলে গেল কেন ?
ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়।
আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা।
আমি কী নিয়ে থাকব নরেন ?
ফিরে আয়। ফিরে আয়।
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন।
তারপর তাঁকে তুলে দিলেন নৌকায়। জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা।
মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না। ফিরে আয় নরেন ফিরে আয়। ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
তাঁর কান্না‚ ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়‚ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে।
নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন‚ প্রভুর ওই জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম!
*৫ই জুলাই সন্ধে ছটা।*
================
দাহকার্য সম্পন্ন হল। আর নিবেদিতা অনুভব করলেন‚ কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল। তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন‚ অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে‚ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি‚ সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন।নিবেদিতার মনে হল‚ মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর‚ তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি।
🙏🏼🙏🏼🙏🏼🙏🏼
(সংগৃহীত)
আ র ও জানুন...... ৪ঠার পর ________
※※ আজ স্বামীজীর শেষ পূজা তোর হাতেই হোক ********************************
( স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের পর ৫ জুলাই১৯০২ )
৪ জুলাই ১৯০২ ----- রাত ৯ টার পরে নব্যভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানযোগে মহাসমাধির আনন্দে চিরমগ্ন হয়েছেন | আষাঢ়ের ঘন-অন্ধকারে ধর্ম জগতের উজ্জ্বল আলোক স্তম্ভের জীবন প্রদীপটি হঠাৎ নিভে গেল | এই দুঃসংবাদ পর দিন সকালে কলকাতা সহ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল | আমাদের আহিরিটোলার বাড়ীতে স্বামীজীর শিষ্য কানাই মহারাজ ( স্বামী নির্ভয়ানন্দ ) এসে শোক-সংবাদটি জানিয়ে গেছেন | আমি তখন পাশে কোন ঠাকুর মন্দিরে পূজা করতে গিয়েছিলাম | ৯টায় বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার মা শোকবিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি করছেন | কারণ জিজ্ঞাসা করায়
মা বললেন , "" বাবা ! তোদের সর্বনাশ হয়ে
গেছে ----- মঠের স্বামীজী আর নেই ,
দেহ রেখেছেন , আমাকে একবার
তাঁকে দেখালি না ! ""
আমি বললাম , "" মঠের সকল সাধুই "স্বামী" ,
তুমি কোন স্বামীজীর কথা
বলছো ? তুমি বোধ হয়
ভুল শুনেছো | ""
মা বলেন , "" ওরে না , কানাই ভোরে এসে
খবর দিয়ে গেছে ------ বড় স্বামীজী
গতকাল রাত ৯টায় শরীর ছেড়ে
চলে গেছেন | কানাই তোদের
মঠে যেতে বলেছে | ""
ক্রন্দনরত মাকে আশ্বস্ত করে বললাম , "" সাধুর
দেহত্যাগে শোক করতে নেই | ""
সেই সময় বন্ধু নিবারণচন্দ্র ( শ্রীশ্রীমায়ের শিষ্য ) আসাতে তাকে ও আমর ভাই দুলালশশীকে নিয়ে অফিসে না গিয়ে স্বামীজীকে শেষ দর্শন করার জন্য আহিরিটোলা ঘাট থেকে নৌকায় বেলুড় মঠে পৌঁছলাম বেলা দশটায় | তখন সামান্য বৃষ্টি হয়েছে | দেখলাম পুজনীয় রাখাল মহারাজ ( স্বামী ব্রহ্মানন্দজী ) প্রমুখ কয়েকজন মহারাজ পশ্চিম দিকের নীচের বারান্দায় খাটে ফুল সাজাচ্ছেন |
আমাদের দেখে শ্রীরাখাল মহারাজ কেঁদে ফেললেন , তাঁর বাক্য বের হলো না ----- হাত ইশারা করে উপরে যেতে ইঙ্গিত করলেন |
উপরে স্বামীজীর ঘরে পৌঁছে দেখলাম ------ একটি সুন্দর গালিচার উপর শয়ান স্বামীজীর মুখমণ্ডল দিব্যভাবদীপ্ত , সমস্ত শরীর নতুন রং করা গেরুয়া বস্ত্রে ঢাকা রয়েছে | ডানহাতে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি জড়িয়ে আছে | ঠিক ধ্যানমগ্ন মহাদেবের মতো তাঁর চোখ দুটি অন্তর্মুখী ও অর্ধনিমীলিত | স্বামীজীর বাঁ দিকে ভগিনী নিবেদিতা অশ্রুপূর্ণচোখে স্বামীজীর মাথায় একভাবে পাখার বাতাস করছেন | স্বামীজীর মাথাটি পশ্চিমদিকে ও পা দুখানি পূর্বদিকে গঙ্গারদিকে শয়ন করা | তাঁর পায়ের কাছে নন্দলাল ব্রহ্মচারী বিষাদ মৌনমুখে নীরবে বসে আছেন | আমরা তিনজনে মাথা নিচু করে স্বামীজীর পাদপদ্ম স্পর্শ ও প্রণাম করে সেখানে বসলাম | স্পর্শ করে অনুভব করলাম স্বামীজীর দেহ বরফের মতোন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে |
স্বামীজীর ডানহাতের আঙুলে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করে নিলাম | ইতিমধ্যে অনেক ভক্ত স্বামীজীকে শেষ দর্শন করতে উপরে এসেছেন ও প্রণাম করে একে একে চলে যাচ্ছেন | আমার জপ শেষ হলে নিবেদিতা আমাকে ডেকে চুপি চুপি বললেনঃ ------ "" Can you sing , my friend ? Would you mind singing those which our Thakur used to sing ? ""
ঐ বিষয়ে আমার অক্ষমতা জানালে ,
নিবেদিতা আবার অনুরোধ করলেন ,
"" Will you please request your
friend on my behalf ? ""
তখন বন্ধু নিবারণ প্রাণ খুলে কয়েকটি গান গাইলেন , "" ১) যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী .শ্যামা মাকে , ২) গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চি কেবা চায় | ৩) কে বলে শ্যামা আমার কালো , মা যদি কালো তবে কেন আমার হৃদয় করে আলো , ৪) মজলো আমার মন ভ্রমরা , শ্যামাপদ নীলকমলে , ৫ ) মন আমার কালী কালী বলনা , কালী কালী বললে পরে , কালের ভয় আর রবে না ইত্যাদি
আকুল আগ্রহভরে সুমধুর গান শুনতে শুনতে বিষণ্ণ ভগিনী নিবেদিতার অন্তর থেকে বেদনার স্রোত বুক ফেটে বেরিয়ে এসে চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু নির্গত হতে লাগল | এই দৃশ্যটি বড় করুণ , অবিস্মরণীয় ------ এই স্মৃতিটুকু তো ভুলবার নয় | যদিও স্রোতের মতো ৪৫টা বছর চলে গিয়েছে | তবুও সেই স্মৃতি আজও আমাদের মনে সোনার অক্ষরে লিখিত আছে
※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※※
বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশরৎ মহারাজ ( স্বামী সীরদানন্দজী ) দোতলায় স্বামীজীর ঘরে এসে আমাদের তিনজন ও ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন , "" বাবা ! স্বামীজী চলে যাওয়াতে
আমরা ভেঙে পড়েছি |
------ আমাদের বল টুটে গেছে |
তোরা সকলে ধরাধরি করে
স্বামীজীর দেহটি নিচে নামিয়ে
আনতে পারবি ? ""
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহিভক্ত ও নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজীর দেহটি বহন করে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে বারান্দায় রাখা পুষ্পসজ্জিত খাটটিতে শুইয়ে দিলাম | সেইসময় কয়েকটি বেদানা , আপেল , ন্যাসপাতি , আঙুর স্বামীজীর বুকের উপর সাজিয়ে দেওয়া হলো |
তখন বুড়োগোপালদাদা ( স্বামী অদ্বৈতানন্দজী ) ব্রহ্মচারীকে বললেন , "" ওরে নন্দলাল !
আমাদের চেয়ে স্বামীজী তোকেই
বেশি ভালোবাসতেন | আজ তাঁর
শেষ পুজো তোর হাতেই হোক্ | ""
এই প্রস্তাব শ্রীরাখাল মহারাজ ও অন্যান্য মহারাজও অনুমোদন করায় , নন্দলাল স্বামীজীকে ফুল-মালা এবং নানা ফলাদি মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করে স্তোত্রপাঠ করলেন | এই সময় স্বামীজীর শেষ ফটো তোলার প্রস্তাব হলে ,
শ্রীরাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দজী )
বলেন , "" স্বামীজীর কত রকমের ভাল
ফটো রয়েছে , এই বিষাদ মাখা
ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে | ""
তারপর শ্রীরাখাল মহারাজ প্রমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ ও ব্রহ্মচারীরা একে একে স্বামীজীর শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করলেন | পরে স্বামীজীর বন্ধু হরমোহন ও অন্যান্য গৃহিভক্তরাও পুষ্পাঞ্জলি দিলেন | পরে স্বামীজী চরণতলে আলতা মাখিয়ে পায়ের ছাপ রাখা হলো | ভগিনী নিবেদিতাও একটি রুমালে স্বামীজীর চরণের ছাপ তুলে নিলেন | একটি ফুটন্ত " মার্শাল নীল " জাতীয় গোলাপ ফুলে চন্দন মাখিয়ে স্বামীজীর চরণতলে বুলিয়ে আমার বুকপকেট রাখলাম |
স্বামীজীর পূজাদি কার্য শেষ হলে শ্রীশরৎ মবারাজ আমাদের চারজনকেই পালঙ্কটি বহন করে যেখানে অগ্নিসংস্কার করা হবে সেখানে নিয়ে যেতে অনুমতি দিলেন | আমরা তাই করলাম , বাকি সকলে পিছে পিছে আসতে লাগলেন | সেইদিন পূর্বেই বৃষ্টি হওয়াতে মঠ প্রাঙ্গন পিচ্ছিল হওয়ায় অতি সাবধানে বহন করে পূর্বে সজ্জিত চন্দন কাঠের চিতার উপরে স্থাপন করা হলো |
তারপর শ্রীশরৎ মহারাজ
উপস্থিৎ সকলকে বললেন , "" তোমরা বাণ্ডিল পাঁকাঠি আগুন ধরিয়ে এই বেদিকে
সাতবার প্রদক্ষিণ করে
শেষে খাটের নিচে
স্বামীজীর পায়ের তলায় জ্বলন্ত
আগুন রেখে প্রণাম করে চলে এস | ""
তাঁর আদেশ মতো স্বামীজীর শরীরকে চন্দন কাঠে অগ্নি সংযোগ করে জ্বলন্ত চিতাকে বেষ্টন করে ভক্তেরা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল | চিতার আগুন ক্রমশ লেলিহমান হয়ে উর্ধমুখী অনেকগুলি জিহ্বা বের করে ধূ ধূ করে জ্বলতে লাগল | সেসময় মহাকবি গিরিশ ঘোষ , মাস্টার মহাশয় মহেন্দ্র গুপ্ত , শাঁখচুন্নী ( অক্ষয় কুমার সেন ) , জলধর সেন , বসুমতীর উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ভক্তেরা বেলতলার কাছে রকে বসে এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে লাগলেন |
গিরিশবাবু তো ভগ্নহৃদয়ে
চিৎকার করে বলতে লাগলেন ,
"" নরেন ! কোথায় তুমি বেঁচে থেকে
আমার কথা লোকের কাছে বলে
ঠাকুরের মহিমা প্রচার করবে -------
কিন্তু সে সাধে পোড়া বিধি হলো
বাদী , আমি বুড়ো বেঁচে রইলুম
তোমার এই দৃশ্য দেখবার জন্য ?
তুমি তো ঠাকুরের ছেলে ,
ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে ,
বল দেখি এখানে আমাদের কি
দশায় ফেলে অকালে চলে
গেলে ? নিশ্চয়ই আমাদের
কপাল ভেঙ্গেছে | ""
এই কথা শুনে নিবেদিতা শোকচ্ছাস চেপে রাখতে পারলেন না | তিনি জ্বলন্ত চিতার কাছে গিয়ে চারদিক ঘুরতে লাগলেন | পাথে তাঁর গাউনে আগুন লাগে , তাই মহারাজজীর নির্দেশে কানাই মহারাজ নিবেদিতার হাত ধরে দূরে গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে বসালেন ও সাহস দিতে লাগলেন | স্বামীজীর নারায়ণী শরীরটির নিম্নাংশ অনুকুল বায়ুর প্রভাবে অল্প সময়েই ভস্মিভুত হলো | কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় , তাঁর বুকে , মুখে মাথায় আগুন স্পর্শ না করায় সেই মুখভঙ্গি , আয়ত চোখ দুটির দৃষ্টি কী সুন্দর দেখাতে লাগল | স্বামীজীর সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ নিকটের একটি গাছে উঠে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে জ্বলন্ত চিতার উপর সাজিয়ে দিতে লাগলেন |
এই সময় শ্রীরাখাল মহারাজ আমাকে একটু তফাতে নিয়ে একটি দশটাকার নোট দিয়ে
বললেন , "" তুমি নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে
গিরিশবাবুর নৌকায় ওপারে
বরানগর বাজার থেকে কিছু
সন্দেশ ও খাবার কিনে আনো |
কাল রাত্তির থেকে সাধুরা কেউজল মুখে দেয় নি ------ আরউপস্থিৎ অনেক ভক্তদেরওখাওয়া হয় নি | ""
মহারাজের কথা মতো কাজ করতে যেতে দেখে বরানগরের এক ভক্ত বিপিন সাহা আরও পাঁচ টাকা দিয়ে আমাদের সঙ্গে ওপারে গিয়ে গরম লুচি , কচুরী ও সন্দেশ নিয়ে ঝুড়ি নিজের মাথায় বহন করে আমাদের সঙ্গে মঠে ফিরলেন | এসে দেখলাম চিতা নিভিয়ে স্বামীজীর দেহাবশেষ সংগ্রহ করে সন্ন্যাসী ও ভক্তরা স্নান করে গঙ্গায় তর্পণ করছেন |
মাস্টার মহাশয় ( শ্রীম )আমাকে বললেন , "" তুমি শব ছঁয়েছো , স্নান তর্পণ কর | ""
একথায় আমি বললাম , "" সাধু নারায়ণ -------
সেই নারায়ণী দেহ স্পর্শ
করাতে আমি অপবিত্র হয়েছি ?
এই কাপড়েই মহারাজের আদেশে
ঠাকুরের ভোগের জিনিস বহন
করে এনেছি | ""
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে স্বামী প্রেমানন্দজী বললেন , "" তোমার স্নান
করবার দরকার নেই ,
তোমার মাথায় গঙ্গাজল
দিলুম , ঠাকুরঘরে খাবার
রেখে এসে তুমি গঙ্গায়
স্বামীজীকে তর্পণ অঞ্জলি দাও | ""
সমস্ত দিনের পর ঠাকুরের এই প্রথম সান্ধ্য-জলপানি ভোগ ও. আরতি হয়ে গেলে নিচের তলায় সংবেত সাধু ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে চা , সরবৎ এবং প্রসাদ বিতরিত হল |
স্বামীজীর অন্তিম ইচ্ছাপূরণেরজন্য ৪ জুলাইয়ের পরদিনের অমাবস্যাতে রাতে বেলুড়মঠে শ্রীশ্রীকালীপূজা অনুষ্ঠান | বাইরের কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি |কেবল স্বামীজীর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ মহাশয় এসেছিলেন | মাখন মহারাজ নিবারণ ও আমাকে হোমের জন্য পনের সের বেল কাঠ আনার আদেশ দিলেন | সেই নির্দিষ্ট তিথিতে শনিবার বিকালে আমরা দুজন ঐ বেলকাঠ বহন করে আনলে মহারাজজী খুশী হয়ে উচ্চারণ করেন ,
"" চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর পাহি মাম্ |
চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর চন্দ্রশেখর রক্ষ মাম্ ||
বাঁচালে বাবা ! আজ এমন ঝড় বৃষ্টি দূর্যোগে শুকনো বেলকাঠ এনেছো ----- মা তোমাদের মঙ্গল করুন | ""
রাত দশটার পরে দোতলায় ঠাকুরঘরে শ্রীশ্রীকালী পূজা আরম্ভ হলো | রামকৃষ্ণানন্দজীর পিতা প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক ঁঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় পূজকের আসন গ্রহন করেন | সাধূ ব্রহ্মচারীরা ঠাকুর প্রণাম করে স্বামীজীর ঘরে গিয়ে বসলেন | সেদিন রাতে প্রসাদ পাবার পর আমরা তিনজন মঠেই থাকলাম | রাত্রে মধ্যে মধ্যেই স্বামীজীর বৃদ্ধ শিষ্য নিত্যানন্দ স্বামীর সকরুণ ক্রন্দন ধ্বনিতে বেলুড় মঠ যেন মুখরিত হয়ে উঠল | রাত তিনটার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ আমাদের জাগিয়ে উপরের ঠাকুর ঘরে যেতে বললেন | উপরে ঠাকুর ঘরে গেলে মহারাজজী আমাকে আচমন করে কিছুক্ষণ জপ করতে বললেন | কিছু পরে মহারাজজীর আদেশে সকলে নিচে বিরাট হোমকুণ্ডের চারদিকে বসে জপ করতে লাগলাম | হোমক্রিয়া শেষ হলে যেখানে স্বামীজীর দেহ দাহ হয়েছে , সেখানে এসে সাতবার প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করলাম এবং বেলতলায় বসে জপ করে ফিরে এসে ঠাকুর ঘরে প্রণামের পরে প্রসাদ গ্রহণ করলাম |
※※※ জয় স্বামীজী মহারাজজী কী জয় |
প্রণাম নাও হে অমর-আত্মা,ভারত-আত্মা স্বামীজী***
※※※※※
※※※※※※※
※※※প্রণাম※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※ভালবাসা※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※জানাই※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※ বুদ্ধদেব ※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※※
※※※※※※※※※
※※※※※※※※
※※※※※※※
※※※※※※
※※※※※
※※※※
※※※
※※
বিবেকানন্দর মায়ের দুঃখের জীবনি.....
শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী দাসী। জগতবিখ্যাত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর জননী।
১৮৪১ সালে অভিজাত পরিবারে জন্ম। ছেলেবলায় মেমের কাছে ইংরাজি শিখেছিলেন। শিশু নরেন জননীর কাছেই প্রথম ইংরাজির পাঠ নেন। পরবর্তী কালে বিবেকানন্দর বিদেশি ভক্তদের সঙ্গে ইংরাজি তে কথাও বলেছেন। চরিত্রগুণে ছিলেন মহীয়সী। আর আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্বংসহা। এত সহ্যশক্তির পরীক্ষা ঈশ্বর আর কারোর কাছে নিয়েছেন কিনা জানিনা।
আদরে ও ঐশ্বর্যে লালিত বাবা মার একমাত্র সন্তান ভুবনেশ্বরীর সারা জীবন শুধু দুঃখের কাহিনী। দশ বছর বয়সে বিয়ে। ছটি কন্যা ও চার পুত্রের জননী। অতি অল্প বয়সে বৈধব্য। অপরিসীম অভাব। তারপর কখনো আদরের কন্যাদের আত্মহনন, প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। শরিকি মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে স্বামীর ভিটে থেকে বিতাড়ন এবং প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়া।
দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়। মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ নিখোঁজ, কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ ইংরেজের বিরুদ্ধাচার করে জেলে এবং শেষ অব্দি মায়ের শেষ সম্বল গয়নাগুলো বেচে মার্কিন দেশে যাত্রা। এতকিছু নীরবে সহ্য করে নিঃসহায় অবস্থায় বিধবা মায়ের আশ্রয়ে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটান।
১৯১১ সালের ২৫ শে জুলাই মেনিনজাইটিস রোগে মৃত্যু। শেষকৃত্যে শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন মেজছেলে মহেন্দ্রনাথ ও সিস্টার নিবেদিতা। কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ তখন আমেরিকায় নির্বাসিতের জীবন যাপন করছেন। আর বিশ্ববন্দিত সন্ন্যাসীপুত্র বিবেকানন্দ ন'বছর আগেই মহাসমাধিতে মগ্ন।
নীচে একটি ছবি দিলাম। নির্মম দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ, আত্মীয়দের অপমান ও পুত্রকন্যা র অকালমৃত্যুতে শোকজর্জরিত বিবেকানন্দজননীর এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ছেপেছিলেন ব্রহ্মানন্দ উপাধ্যায়, সন ১৩১৪ র বৈশাখ সংখ্যায়, স্বরাজ পত্রিকায়।
ক্যাপশনে লেখা ছিল নিম্নরুপে...
"নরেন্দ্রর মাতার চিত্রও দিলাম। নরেন্দ্রর মাতা রত্নগর্ভা।.... আহা- মায়ের ছবিখানি দেখ-দেখিলে বুঝিতে পারিবে যে নরেন্দ্র মায়ের ছেলে বটে---আর মাতা ছেলের মা বটে "
আজকের দিনে ২৫ জুলাই,১৯১১ স্বামীজীর মা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অমৃতলোকে যাত্রা করেন |প্রণাম গ্রহণ করুন বীরেশ্বর বিবেকানন্দের মা ভূবনেশ্বরী দেবী।
এই প্রসঙ্গে খেতড়ি মহারাজকে লেখা স্বামীজীর একটি চিঠি মায়ের জন্য----
১ ডিসেম্বর,১৮৯৮, মঠ, বেলুড়, হাওড়া
মহারাজা,
আপনার তারবার্তা আমায় যে আনন্দ দিয়াছে তাহা বর্ণনাতীত| এমন বার্তা আপনার মত মহান ব্যক্তিরই যোগ্য |আমি কি চাই তাহা বিশদভাবে লিখিলাম |
কলকাতায় একটি ছোটখাটো বাড়ী নির্মাণের নুন্যতম খরচ আনুমানিক দশ হাজার টাকা |সংসার খরচের জন্য মাসিক একশত টাকা আপনি যে আমার মাকে পাঠাইয়া থাকেন তাহা তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট | যদি আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত আমার ব্যায় নির্বাহের জন্য আরও একশত টাকা পাঠাইতে পারেন তবে আমি বড়ই খুশী হইব ;কিন্তু এই বাড়তি একশত টাকা আপনাকে খুব বেশী দিন বহন করিতে হইবে না কেননা আমি বড়জোর আর দু-এক বৎসর বাঁচিব |আমি আর একটি ভিক্ষা এখানে চাহিব |মায়ের জন্য একশত টাকার সাহায্যটি সম্ভব হইলে আপনি স্হায়ী রাখিবেন | মহারাজা যেন সাধুর দুঃখী বৃদ্ধা মাতার প্রতি এই করুণা বর্ষণ করেন|••••••••••••••
যে -জগন্মাতার লীলা-খেলা এই বিশ্বচরাচর,যাঁহার হাতে আমরা যন্ত্রমাত্র----তিনি যেন আপনাকে সকল অমঙ্গল হইতে রক্ষা করেন |
ভগবানের নামে চিরদিন আপনার ----
বিবেকানন্দ
স্বামীজীর ধীরা মাতা ---Mrs.Ole Bull
বর্তমান বেলুড়মঠ নির্মাণের জন্য একটা বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন, এই মহিলা। বিবাহের দশ বছর পরেই তার স্বামীর মৃত্যু হয় ।
এর ১৪ বছর পর স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় |স্বামীজী বলেছেন Most Spiritual Women.
জন্মসূত্রে অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হয়েও জাগতিক সুখ বিমুখ ছিলেন ।এঁর একমাত্র কন্যার নাম ওলিয়া | ইনি মৃত্যুর আগে উইল করে যান যার একটা বড় অংশই শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের উদ্দেশ্যে দান করেছিলেন ।
মামলা করেছিলেন,মেয়ে ওলিয়া মৃতা মায়ের উইলের যথার্থতা নিয়ে।
কিন্তু মামলায় তার পরাজয় হয় আর ওলিয়ার মৃত্যুও হয় মামলার রায় যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিনই আকস্মিকভাবে ।
শ্রীরামক়ষ্ণ মিশনে তিনি Saint Sara নামে পরিচিত |
বাইরের ঘটনা সবসময় কোন মানুষের সঠিক পরিচয় দেয় না।জীবনের উচ্চতম আদর্শকে সামনে রেখে তিলে তিলে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন যে রমণী, তিনিই স্বামীজীর ধীরামাতা --- শ্রীমতী সারা চ্যাপম্যান বুল |
🔴🔴🔴🔴🔴 মহাপ্রাণ স্বামীজী 🔴🔴🔴🔴🔴
বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে বেদ বেদান্তের গভীর আলোচনায় মেতে রয়েছেন স্বামীজী তাঁর শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে । এমন সময় সেখানে হাজির হলেন ভক্তভৈরব গিরিশচন্দ্র ঘোষ । গিরিশবাবুর দিকে তাকিয়ে স্বামীজী বললেন, " কি জি. সি., এ-সব তো কিছু পড়লে না, কেবল কেষ্টু-বিষ্টু নিয়েই দিন কাটালে । " গিরিশবাবু বললেন, " কি আর পড়ব ভাই ? অত অবসরও নেই, বুদ্ধিও নেই যে, ওতে সেঁধুব । তবে ঠাকুরের কৃপায় ও-সব বেদবেদান্ত মাথায় রেখে এবার পাড়ি মারব । তোমাদের দিয়ে তাঁর ঢের কাজ করাবেন বলে ও-সব পড়িয়ে নিয়েছেন, আমার ও-সব দরকার নেই । " এ কথা বলে গিরিশবাবু প্রকাণ্ড ঋগ্বেদ গ্রন্থখানিকে বারবার প্রণাম করে বলতে লাগলেন ------ " জয় বেদরূপী শ্রীরামকৃষ্ণের জয় । "
এবার স্বামীজীর দিকে তাকিয়ে গিরিশবাবু বলে উঠলেন, " হাঁ, হে নরেন, একটা কথা বলি । বেদবেদান্ত তো ঢের পড়লে, কিন্তু এই যে দেশে ঘোর হাহাকার, অন্নাভাব, ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা, মহাপাতকাদি চোখের সামনে দিনরাত ঘুরছে, এর উপায় তোমার বেদে কিছু বলেছে ? ঐ অমুকের বাড়ির গিন্নি, এককালে যার বাড়িতে রোজ পঞ্চাশখানি পাতা পড়ত, সে আজ তিন দিন হাঁড়ি চাপায়নি ; ঐ অমুকের বাড়ির কুলস্ত্রীকে গুণ্ডাগুলো অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে ; ঐ অমুকের বাড়িতে ভ্রূণহত্যা হয়েছে, অমুক জোচ্চুরি করে বিধবার সর্বস্ব হরণ করেছে ------- এ-সকল রহিত করবার কোন উপায় তোমার বেদে আছে কি ? " গিরিশবাবু এভাবে সমাজের বিভীষিকাময় ছবিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরাতে স্বামীজী নির্বাক হয়ে রইলেন । জগতের দুঃখকষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে স্বামীজীর চোখে জল এল । মনের ভাব কাউকে জানতে দেবেন না বলে তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে চলে গেলেন ।
গিরিশবাবু শিষ্যকে লক্ষ্য করে বললেন, " দেখলি বাঙাল, কত বড় প্রাণ ! তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না ; কিন্তু ঐ যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি । চোখের সামনে দেখলি তো মানুষের দুঃখকষ্টের কথাগুলো শুনে করুণায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে স্বামীজীর বেদবেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল ! "
🔴🔴🔴🔴জয় স্বামীজী 🔴🔴🔴🔴
১৮৬৩ সালের পৌষ সংক্রান্তি কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে কলকাতায় সিমুলিয়ায় দত্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, জননীর নাম ভুবনেশ্বরী দেবী।
১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারী পৌষ সংক্রান্তির পুণ্যপ্রভাতে সূর্যোদয়ের ৬ মিনিট পূর্বে, ৬ টা ৩৩ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দেবী ভুবনেশ্বরী বিশ্ববিজয়ী পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন।
বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর মোট দশটি সন্তান--
১) পুত্র শৈশবে মৃত।
২) কন্যা শৈশবে মৃত।
৩) হারামণি ২২ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৪) স্বর্ণময়ী ৭২ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৫) কন্যা শৈশবে মৃত।
৬) নরেন্দ্রনাথ ৩৯ বৎসর ৫ মাস ২৪ দিন জীবিত ছিলেন।
৭) কিরণবালা ১৬ বৎসর জীবিত ছিলেন।
৮) যোগীন্দ্রবালা ২২ বৎসর জীবিতছিলেন।
৯) মহেন্দ্রনাথ ৮৭ বৎসর জীবিত ছিলেন।
১০) ভূপেন্দ্রনাথ ৮১ বৎসর জীবিত ছিলেন।
বিরজাহোম করে সন্ন্যাসগ্রহণ কালে নরেন্দ্রনাথের নতুন নাম হয় বিবিদিষানন্দ। পরিব্রাজক জীবনে তিনি সচ্চিদানন্দ ও বিবেকানন্দ নামও ব্যবহার করেছেন। শেষোক্ত নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন।
ॐ নমঃ শ্রীযতিরাজায় বিবেকানন্দসূরয়ে ।
সচ্চিৎ সুখস্বরূপায় স্বামিনে তাপহারিণে ।।
শ্রীমান্, সন্ন্যাসিরাজ, সচ্চিদানন্দস্বরূপ, ত্রিতাপহারী, সর্বজ্ঞ স্বামী বিবেকানন্দকে প্রণাম করি।
#আমি_কচুরি_সম্প্রদায়ভুক্ত_সন্ন্যাসী !
স্বামী বিবেকানন্দ।
বাঙালি মানেই ভোজনরসিক। সেই তালিকায় মধ্যে রয়েছেন বহু মনিষীও। নেতাজীর যেমন লক্ষ্মীনারায়ণের চপ না হলে রাজনৈতিক মিটিং জমত না। রবীন্দ্রনাথ আবার তিনি খান আর নাই খান তাঁর পাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার সাজানো রয়েছে এটা দেখতে পছন্দ করতেন। রামকৃষ্ণদেব আবার সারদামণির হাতের ভাত আর ঝোলেই তৃপ্তি পেতেন। তাঁরই শিষ্য বিবেকানন্দ, তিনি আবার কচুরি খেতে খুব পছন্দ করতেন।
কলকাতার বিভিন্ন দোকান থেকে তিনি কচুরি আনিয়ে তো খেতেন। লন্ডনে তাঁকে কে বানিয়ে দেবে কচুরি তরকারি ? তোয়াক্কা করতেন না। বিদেশে বাড়ির বেসমেন্টে বসেই বানিয়ে ফেলতেন। তারপর তৃপ্তি করে তা উদরস্থ করতেন। ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন স্বামীজি। পথে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বসে, “আচ্ছা, আপনি কোন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী? পুরী না গিরি?” বিবেকানন্দ বরাবরই কথার প্যাঁচে পটু ছিলেন। তাঁর অসাধারন উত্তরে কাবু প্রশ্নকর্তা। তিনি বলেন, ” পুরী গিরি দুটোর কোনোটাই না, আমি কচুরি সম্প্রদায়ভুক্ত।” এমনই ছিল তাঁর কচুরি প্রেম।
মৃত্যুর দিনেও স্বামী বিবেকানন্দ দুপুরে ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন যে “একাদশীতে না খেয়ে পেটটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। স্বস্তি পেলাম।” কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে তাঁর খাদ্য তালিকায় সবার উপরে থাকত কচুরি আর তরকারি। এটা না খেলে তাঁর দিন যেত না। সমস্ত মায়া ত্যাগ করা মানুষটির কচুরি দেখলে লোভ সংবরন করতে মুশকিলে পড়তেন। কচুরি-আলু ছেঁচকি বানানোর কেউ না থাকলে নিজেই বানিয়ে খেয়ে নিতেন। এর প্রতি স্বামীজির দুর্বলতা মারাত্মক ছিল।
শুধু খাওয়া নয় রান্না করতেও ভালোবাসতেন। মাংসের নানা পদ তাঁর প্রিয় ছিল। ফাউল ছিল তার মধ্যে অন্যতম। শিকাগো যাত্রার আগে তৎকালীন বোম্বাইতে স্বামীজি ১৪ টাকা খরচ করে এক হাঁড়ি পোলাও রান্না করে শিষ্যদের খাইয়েছিলেন। কই মাছের তরকারি তাঁর প্রিয় খাবারের আরও একটি।
তখন তিনি শুধুই নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পড়াশোনা করছেন। পেটুক এবং খাদ্যরসিক বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘পেটুক সংঘ’। তাদের কাছে ঘোষণা করেন, “দেখবি কলকাতা শহরে গলির মোড়ে মোড়ে পানের দোকানের মতো চপ-কাটলেটের দোকান হবে।” এখন সত্যি শহরের প্রত্যেক মোড়ে একটি অন্তত চপ বা তেলেভাজার দোকান থাকেই। কিছু না হোক মিষ্টির দোকানের শিঙারা তো পাওয়াই যায়। খেতে পছন্দ করতেন রসগোল্লা এবং আইসক্রিমও।
স্বামীজির আমেরিকায় থাকাকালীন প্রাতঃরাশের তালিকাও ছিল বেশ লম্বা। প্রথমেই খেতেন কমলালেবু এবং আঙুর। এরপরেই খেয়ে নিতেন ডবল ডিমের পোচ। এরপরে দুই পিস টোস্ট এবং ক্রিম ও চিনি সহকারে দুই কাপ কফি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে স্যুপ এবং মাংস বা মাছের সঙ্গে রাতের আহার সেরে নিতেন। এরপর কোনও একটি মিষ্টির পদ থাকতই। আর প্রত্যেকবার খাবার শেষে ধূমপান ছিল অতি আবশ্যক।
স্বামী বিবেকানন্দের বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) ভ্রমনের একাংশ:
১৯০১ সালের ১৮ মার্চ জলপথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন তাঁর মা ও কয়েকজন বন্ধু। পরবর্তীতে কিছু আত্মীয় স্বজনও এসে যুক্ত হন তাদের সাথে । পূর্ববঙ্গে তিনি ১৫ দিনের বেশি অবস্থান করেছিলেন এবং ঢাকায় দুটি ভাষনও প্রদান করেন৷
জগন্নাথ কলেজে প্রদত্ত প্রথম ভাষণের শুরুতে বলেন, "আমি নানা দেশ ভ্রমণ করেছি-কিন্তু আমি কখনো নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশ বিশেষভাবে দর্শন করিনি। জানতাম না, এ দেশের জলে স্থলে সর্বত্র এত সৌন্দর্য ;কিন্তু নানা দেশ ভ্রমণ করে আমার এই লাভ হয়েছে যে, আমি বাংলার সৌন্দর্য বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।"
ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা জানিয়ে লন্তনে অবস্থানরত মিসেস ওলি বুলকে স্বামীজি দুটি চিঠি পাঠান (২০ মার্চ ও ২৯ মার্চ)। আমার প্রিয় মা সম্বোধন করে তিনি লেখেন,
" শেষ পর্যন্ত আমি পূর্ব বাংলায় এসেছি। এখানে আমি এবারই প্রথম এবং কখনো জানতাম না বাংলা এত সুন্দর। এখানকার নদীগুলো আপনার দেখা উচিৎ - নিয়মিত পরিষ্কার জলের প্রবাহ এবং সবকিছু এত সবুজ। গ্রামগুলো সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার ও সুন্দর।"
ঢাকার জীবন সম্পর্কে লিখেছেন, " I am peaceful and calm. I'm finding every day the old begging and trudging life is the best for me after all."
দ্বিতীয় চিঠিতে লেখেন," এখানে ব্রহ্মপুত্র নদে বিরাট একটি পবিত্র স্নান আছে। যখনই গ্রহ-নক্ষত্রের সংযোগ হয়, যা খুবই কদাচিৎ হয়ে থাকে,তখনই নদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশাল লোকের সমারোহ হয়ে থাকে। এবছর এখানে হাজার হাজার লোকের সমারোহ হয়েছিল; মাইলব্যাপী নদটি নৌকাদ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছিল।.... নদটি যদিও স্নানের স্থানে প্রায় একমাইল প্রশস্ত, তবে স্থানটি কর্দমাক্ত। "
৫ জুলাই, মেরি হলকে চিঠিতে স্বামীজি লেখেন," তুমি জানো, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু এর তাৎপর্য পূর্বে কখনো উপলব্ধি করিনি৷ পূর্ববঙ্গের নদীগুলো যেন তরঙ্গসঙ্কুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয় - সেগুলি এত দীর্ঘ যে, স্টীমার সপ্তাহের পর সপ্তাহ এদের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। "
*অচেনা অজানা বিবেকানন্দ*
স্বামীজির মহাপ্রয়াণ হয় ৩৯ বছর বয়েসে ১৯০২ সালে । বেলুড় মঠে তখন রাত ৯ টা ১০ মিনিট। তখন বেলুড় মঠে বা তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিদ্যূৎ ছিল না । কিন্তু টেলিফোন ছিল তবুও কোন সংবাদমাধ্যম আসেনি এবং পরের দিন বাঙ্গলাদেশের কোন কাগজেই বিবেকানন্দের মৃত্যূ সংবাদ প্রকাশিত হয়নি,এমন কি কোন রাষ্ট্রনেতা বা কোন বিখ্যাত বাঙ্গালী কোন শোকজ্ঞাপনও করেননি ।
ভাবতে পারেন ???
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর স্বল্প জীবনে অপমান, অবহেলা বহু পেয়েছেন,উপেক্ষিত হয়েছেন বার বার। পিতার মৃত্যূর পর স্বজ্ঞাতির সঙ্গে কোর্ট কাছারী করতে হয়েছে তাঁকে ।বহু বার হাজিরা দিয়েছেন কাঠগড়ায় l
নিদারুণ দরিদ্রের সংসারে সকালে উঠে অফিস পাড়া ঘুরে ঘুরে চাকরির খোঁজে বেরুতেন । দিনের পর দিন মা কে বলতেন মা আজ রাতে বন্ধুর বাড়িতে খেতে যাবো। প্রায় দিন দেখতেন সংসারে চাল,ডাল,নুন ,তেল কিছুই নেই কিন্তু ভাই ও বোন নিয়ে 5 টা পেটের খাবার কি ভাবে জুটবে ? মুদির দোকানে ধার করে মাকে এক- দুই দিনের চাল ডাল দিয়ে ... মা কে বলতেন আমার রান্না কোরো না... মা ! দিন দুই বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে কিন্তু..কোথায় নিমন্ত্রণ ? .. আনাহার আর অর্ধপেটে থাকতেন তৎ কালীন নরেন্দ্র .........
ভাবা যায় !!!!!!!
চরম দারিদ্রের মধ্যে সারা জীবনটাই টেনে নিয়ে গেছেন । ২৩ বছর বয়েসে শিক্ষকের চাকরি পেলেন মেট্রোপলিটন স্কূলে । যাঁর প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যাসাগর মশাই আর হেডমাস্টার বিদ্যাসাগরের জামাতা । জামাতা পছন্দ করতেন না নরেন্দ্রনাথ দত্তকে .. শ্বশুরকে বলে..." *খারাপ পড়ানোর অপরাধে"* বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিলেন বিবেকানন্দকে । অথছ, যাঁর জ্ঞান,বুদ্ধি,ব্যুৎপত্তি তর্কাতীত, অন্তত সেই সময়েও।
আবার বেকার বিবেকানন্দ। বিদেশেও তাঁর নামে এক বাঙ্গালি গুরু প্রচার করেন .. বিবেকানন্দ বেশ কয়েকটি বৌ ও দশ -বারো ছেলে পুলের পিতা ও এক আস্ত ভন্ড ও জুয়াখোর। ......
দেশে ও বিদেশে অর্ধপেটে বা অভুক্ত থেকেছেন দিন থেকে দিনান্তে....
চিঠিতে লিখেছিলেন :-
"-কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছি । মনে হয়েছে আজই হয়ত মরে যাবো ... জয় ব্রহ্ম বলে উঠে দাঁড়িয়েছি .... বলেছি . ..আমার ভয় নেই,নেই মৃত্যূ, নেই ক্ষুধা, আমি পিপাসা বিহীন । জগতের কি ক্ষমতা আমাকে ধ্বংস করে ?" ...
অসুস্থ বিবেকানন্দ বিশ্ব জয় করে কলকাতায় এলে তাঁর সংবর্ধনা দিতে বা সংবর্ধনা সভা তে আসতে রাজি হয় নি অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালী ( নাম গুলি অব্যক্ত রইল) শেষে প্যারিচাঁদ মিত্র রাজি হলেও ... তিনি বলেছিলেন .. ব্রাহ্মণ নয় বিবেকানন্দ । ও কায়েত... তাই সন্ন্যাসী হতে পারে না , আমি ওকে brother বিবেকানন্দ বলে মঞ্চে সম্বোধন করবো ।
১৮৯৮, বিদেশের কাগজে তাঁর বাণী ও ভাষণ পড়ে আমেরিকানরা অভিভূত আর বাঙ্গালীরা !
সেই বছরই অক্টোবরে অসুস্থ স্বামীজি কলকাতার বিখ্যাত ডক্টর রসিকলাল দত্তকে দেখাতে যান,(চেম্বার- 2 সদর স্ট্রিট। কলকাতা যাদুঘরে পাশের রাস্তা )। রুগী বিবেকানন্দ কে দেখে সেই সময় 40 টাকা ও ঔষুধের জন্যে 10 টাকা মানে আজ ২০২০র হিসাবে প্রায় ১৬০০০ টাকা নিলেন বিবিধ রোগে আক্রান্ত বিশ্বজয়ী দরিদ্র সন্ন্যাসীর কাছ থেকে . বেলুড় মঠের জন্যে তোলা অর্থ থেকে স্বামী ব্রহ্মনন্দ এই টাকা বিখ্যাত বাঙ্গালী(?) ডক্টর রসিকলাল কে দিয়েছিলেন। ..
আরও আছে .........!!!
বিবেকানন্দের মৃত্যূর কোন ফটো নেই । এমনকি বীরপুরুষের কোন ডেথ সার্টিফিকেটও নেই কিন্তু সে সময় বালি - বেলুড় মিউনিসিপালিটি ছিলো।
আর এই municipality বেলুড় মঠে প্রমোদ কর বা amusement tax ধার্য করেছিলো ।
বলা হয়েছিল ওটা ছেলে ছোকরাদের আড্ডার ঠেক আর সাধারণ মানুষ বিবেকানন্দকে ব্যঙ্গ করে মঠকে বলতো .. "বিচিত্র আনন্দ" বা "বিবি- কা আনন্দ" । ( মহিলা /বধূ / ... নিয়ে আনন্দ ধাম)। এই ছিলো তৎকালীন মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীদের মনোবৃত্তি l
সাধে কি শেষ সময় বলে গিয়েছিলেন- " *একমাত্র আর একজন বিবেকানন্দই বুঝেতে পারবে যে এই বিবেকানন্দ কি করে গেল।"*


































