Sunday, 15 November 2020

কবি গুরুর শেষ দিনগুলি

শেষ বার শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার সময় চোখে রুমাল দেওয়া। শেষ দিকে সংশয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও, আর কি ফেরা হবে শান্তিনিকেতনে! এর কয়েকদিন পরেই ২২শে শ্রাবন।


" মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোন মানে নেই। আর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জীবনকে না দেখলে অমৃতের সন্ধান মেলে না। এই জীবন মরনের খেলা দিয়েই জগৎ সত্য হয়ে উঠেছে"....... মৃত্যু সম্পর্কে নির্মলকুমারী মহলানবীশ কে প্রায়শ এই কথা বলতেন রবীন্দ্রনাথ।

জীবনে তিনি বহু প্রিয় জনের মৃত্যু দেখেছেন, তাই হয়তো দৃপ্ত স্বরে বলে গেছেন "করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া, দাঁড়াবো আসি তবে দুয়ারে"। জীবনের শেষ লগ্নে রোগশষ্যায় অলংকৃত শরীরে অসুস্থতার কথা একেবারেই বলতে চাননি। খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করলে, একটু পরেই হাত কেঁপে পেশি শিথিল হয়ে পড়ত। সে সময় তিনি মুখে মুখে বলে যেতেন, তাঁর লিপিকার সুধীর চন্দ্র কর লিখে নিতেন। মৃত্যু সম্পর্কে সুধীরবাবু লেখেন " কোনদিনও তিনি মৃত্যুপথের বীভৎসতাকে কিংবা তার অনিশ্চয় ভয়কে মনে আমল দেননি। উপরন্তু জীবনের প্রথম থেকেই দেখি মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি তাঁর কাব্যে একটি বিশেষ ধারায় নানা বাণীতে প্রকাশ পেয়েছে।"  

"জল পড়ে পাতা নড়ে" :: রবি-শিশু
প্রথম জীবনে তিনি "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে" বলে শুরু করলেও মধ্য জীবনে " বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়" এ কথাও ঘোষণা করেন। শেষ জীবনে যে কজন তাঁর সঙ্গে থাকতেন, তাদের সঙ্গে রীতিমতো হাসি-ঠাট্টা করতেন। গভীর আগ্রহ ছিল আশ্রমিক অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের অতিথিদের সঙ্গে রোগ দেওয়ার। কিন্তু শরীর একেবারেই ভেঙে পড়ায় রোগশষ্যায় একেবারেই ঘরবন্দি। সেখানেই একদিন চিনের অতিথি তাই-চি-তাও' কে ঠেকে এনে আলাপ করলেন। ইতিপূর্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি মিস র্্যাথবোন ভারতীয় নেতাদের স্বাধীনতার দাবিকে ব্রিটেনের প্রতি অকৃতজ্ঞা বলে, জওহরলাল সহ অন্যান্য নেতাদের নিন্দা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বে কবি তার উত্তরে যে জ্বলন্ত বিবৃতি লিখেছিলেন, সেটাই ছিল তাঁর সর্বশেষ বিবৃতি। 

তাঁর শুশ্রুষাকারীদের ভার লাঘবের জন্য আর শারীরিক যন্ত্রনা ঢাকার জন্য, এ সময় নানা রকমের মজাদার ছড়া শুনিয়ে পরিবেশ হালকা করতে চাইতেন। ৪-১২-১৯৪০ তারিখে তাঁর সেবারতা পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন " ডাবও ভালো , ঘোলও ভালো / ভালো সজনে ডাটা/ বৌমা বলেন ভালো নহে/ শুধু সিঙ্গি মাছের কাঁটা।" তাঁর নাতনি উদ্দেশ্যে করে লেখেন " ঘড়ি ধরা নিদ্রা আমার / নিয়ম ঘেরা জাগা / একটুকু তার সীমার পারেই / আছে তোমার রাখা। / কি কব আর রবি ঠাকুর / ভয়ে তরস্ত/ এত বড় মানুষ ছোট্ট / হাতের করস্ত।" 

রোগশয্যায় বিশ্বকবি তখন চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। তাঁর গভীর ঘুমের সময় সকলে তটস্থ হয়ে দূর থেকে দেখে ___ শ্বাস প্রশ্বাসযথাযথ হচ্ছে কিনা।  ফিসফিস করে খবর চালাচালি হতে থাকে।  বেশির ভাগ সময় সোফায় আচ্ছন্ন ভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন।  এক সময় নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।  এক দিন রাত বারোটার পর তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলে জানতে চান  "দারোয়ানের যেন পেটে ব্যথা হয়েছিল।  কেমন আছে সে  ? "কোনও দিন কুকুরটাকে খাবার দিয়ে আদর করতেন।  কৌতূহল নিয়ে দেখতেন চড়ুইটাকে। তাদের নিয়ে তাঁর অজস্র প্রশ্ন।  মৃত্যুভয় তাঁকে কখনও কাবু করতে পারেনি।  একদিন মজা করে তাাঁকে বলা হয়েছিল *** বুড়ো বয়সে সবাই ঠাকুর দেবতার নাম জপ করে।  আর আপনি পশুপাখি লোকজন নিয়ে হাসি গল্প করছেন। লোকে কি বলবে আপনাকে।*** কবি আরও ছন্দ গাম্ভীর্যে  বললেন  " সত্যিই তো লোকে কি বলবে!"


রোগশয্যায় পা ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারেন না। সবাই বলে বিশ্রাম নিতে।  নাতনি ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে চায়। সবার পীড়াপীড়িতে কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করে থাকেন। রাত তিনটের সময় চিরদিনের অভ্যাসমত লিখতে চান।  সবাই বলে __ এখনও ওঠার সময় হইনি।  তাঁর বিশ্বাস হয় না--- " নিশ্চয়ই আমাকে তোরা ফাঁকি দিচ্ছিস।" এরই মধ্যে খাতায় লেখা ভরে ওঠে।  এ রকম শয্যাশায়ী অবস্থায় এক দিন  'প্রবাসী ' থেকে লেখা আছে কি না জানতে চাওয়া হলে,  কবি সেই মজার ছড়াগুলি দিয়ে বললেন "তোমরা তো আমার যা পাও ঠেসে ভরে দাও  প্রবাসীতে। দাও নিয়ে এগুলোও।" যিনি লেখা আনতে গিয়েছিলেন,  তিনি এই নতুন ধরনের মজার ছ্ড়া পেয়ে তো দারুণ খুশি।  রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে বললেন  " আরে  ঠাট্টা করে বললুম তোমাকে।  ছেলেমানুষি এই লেখাগুলো বের হতে পারে না। " অনেক কষ্টে কবির কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে,  সবার রস গ্রহণের সুবিধার জন্য প্রসঙ্গ উল্লেখ করে একটু লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে,  তিনি সকৌতুুুকে বলে উঠেন "তুলো ধুনতে গেলে পরে,  কতকটা সেই তুলো  / লেপের মধ্যে প্রবেশ করে,  কতক ঢাকে ধুলো।" 

জোড়াসাঁকোয় অসুস্থ কবিকে সারাক্ষণ দেখাশোনা করতেন প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী  নির্মলকুমারী মহলানবিশ (রাণী)।কবি তাঁকে মজা করে বলতেন "হেডনার্স"। কবির শেষ দিনগুলির রোজনামচা লিখে গেছেন " বাইশে শ্রাবণ " বইটিতে। শ্রীমতী  মহলানবিশের কোথাও যাওয়ার কথা হলে কবি হুমকি দিতেন " শেষ পর্যন্ত এমন একটা অসুখ করবো, তখন দেখি আমার হেডনার্স কি করে যায়। "কবির   অপারেশন জোড়াসাঁকোয় হবে বলে ঝকঝকে করে পরিস্কার করা হয়েছে।  ডাক্তার সত্যেন্দ্ররনাথ রায় গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়ার পর  ম্যালেরিয়া রোগীর মতো জ্বর এলো। পরের দিন ইনজেকশনেরএই প্রতিক্রিয়া কেটে যাওয়ার পর বেশ হাসিমুখে রানী মহলানবিশকে বললেন  " জানো আজও আর একটা কবিতা হয়েছে সকালে । এ কী পাগলামি বল তো  ? প্রত্যেকবারই ভাবি এই বুঝি শেষ, কিন্তু তারপরেই দেখি আবার একটা বেরোয়। এ লোকটিকে  নিয়ে কি করা যাবে?" লেখাটি ছিল ''প্রথম দিনের সূূূূর্য্"  নামে বিখ্যাত কবিতায়।





দুর্বল শরীরে টানা কাজ করতে পারেন না। কপালের শিরায় ফুটে ওঠে শীর্ণতা। দৃষ্টি ক্ষীন। শ্রবণশক্তিও। দু-তিন জন মেয়ে পালা করে , তাঁর ফরমায়েশী গানগুলো গায়। তাই শুনে বলেন  " ওরে গানটা ভালো করে গা তো। সিন্ধুপারে চাদ তো বুঝি আমার জন্য আর উঠবে না ।" শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার সময় ভুবনডাঙ্গার রাস্তার ধারে নতুন পাওয়ার হাউস  দেখে তিনি নাতনি নন্দিতাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন  " পুরোনো আলো চললো, আসবে বুঝি তোদের নতুন আলো।" উদয়নের দোতলা থেকে নামার পর তাঁর প্রিয় 'বাঙিল' ক্ষিতিমোহন সেনকে বলেন  " একমাস পরে ফিরবো। দেখো ছড়ার বইটা যেন ছাপানো শেষ হয়ে থাকে। " প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন  : " শান্তিনিকেতনের সত্তর বৎসরের  স্মৃতি জড়িত। কবি কি বুঝতে পেরেছিলেন  এই তাঁর শেষ যাত্রা ? যাবার সময় চোখে রুমাল দিচ্ছেন দেখা গেল। "

জীবনের গভীর কষ্টের মধ্যেই তাঁর লেখনী যেন আরও গতিময় হয়ে উঠেছে।  তিনিও বলেছিলেন  " জীবনের গভীর দুঃখের সময়ই দেখি লেখা আপনি সহজে আসে। মন বোধহয় নিজের রচনা শক্তির ভিতরে ছুটি পেতে চায়। " একমাত্র নাতি নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ আসায় অনেকে বর্ষামমঙ্গল অনুষ্ঠান বাতিলের কথা বললে তিনি রাজি হননি।  এ সম্পর্কে   মেয়ে মীরাকে বলেন   " নিতুকে খুব ভালোবাসতুম, তাছাড়া তোর কথা ভেবে প্রচন্ড দুঃখ চেপে বসেছিল বুকের মধ্যে।  কিন্তু সর্বলোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে।  ক্ষুদ্র হয় যখন সেই শোক সহজ জীবন যাত্রাকে বিপর্যস্ত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।" এই কারণেই বোধহয় নিজের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট প্রকাশ করতে এত কুন্ঠা। অপরাশনের দিনটি চেপে রাখা হয়েছিল , কিন্ত কবিতার সাথে যার নিরন্তর যাপন, সেই 1941 সালের 30শে জুলাইয়ে রচনা করেন তাঁর শেষ কবিতাটি রানী চন্দের কলম ধরে।  তারপর অপারেশনর কথা শুনে রানীকে বললেন কবিতাটা পড়ে শুনাতে। তিনি কবির কানের কাছে জোরে কবিতাটি আবৃত্তি করলে  তা শোনার পর কবি বললেন  " কিছু গোলমাল আছে, তা থাক _____ ডাক্তারা  তো বলেছে অপারেশনর পরে মাথাটা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভালো হয়ে পরে ওটা মেজে ঘোষে দেবো।"




অস্ত্রোপচারের পরে প্রসাবের সমস্যা দেখা দিল।  তাও অতি ক্লান্ত শরীরে শষ্যার পাশে নির্মলকুমারীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে  " হা: "  করে চেচালে শ্রীমতী মহলানবীশ হেসে ফেলেন। কবি তৎক্ষনাৎ বলে উঠেন  " এই  তো একটু হাসো। তা না গম্ভীর মুখ করে এসে দাড়ালেন। এতো গম্ভীর কেন  ? " এর পর ঘন ঘন   হিক্কা কবিকে বিপর্যস্ত করে।  তখন দেশীয় টোটকা মিছরি এলাচগুরো কয়েকবার দেওয়ার পর কিছুটা কমলে বললেন  " আ: বাচলুম, এই জন্যই তো হেডনার্স বলি।" 

অবশেষে এল 22শে শ্রাবণ,  রাখী পূর্ণিমার দিন। কবির মুখ পূব দিক করে রাখা। অস্তমিত রবির প্রাকমুহূর্ত। আগের রাতে চিনা ভবনের অধ্যাপককে কবির খাটের পাশে অ্যাম্বারের জপমালা নিয়ে জপ করতে দেখার পর থেকেই সে ঘরে ভগবানের নাম ধ্বনিত হয়। অমিতা দেবী কানের কাছে " শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্ " মন্ত্র আর বিধুশেখর শাস্ত্রী পায়ের কাছে মাটিতে বসে  " ওঁ পিতা নোহসি" মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন।  শেষ রাত্রি থেকেই ব্রহ্মসঙ্গীত শুরু হয়। মধ্যাহ্নের ঠিক শেষ মুহূর্তের আগে ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই হাত পড়ে গেল। অস্তমিত হলেন রবি কবি। 

কবির একান্তই ইচ্ছা ছিল কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে " জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দমাতরম্ " এ সব  জয়ধ্বনির মধ্যে শেষ যাত্রা না করে, শান্তিনিকেতনের উদার মাঠে উন্মুক্ত আকাশের তলায় স্তব্ধ প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে। সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন যারা, সেই রথীন্দ্রনাথ তখন শোকে মূহ্যমান , প্রশান্ত মহলানবিশ অসুস্থ শরীরে শষ্যাশায়ী । শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রদ্যোতকুমার সেনও সেই জনতাকে রাজী করাতে পারেনি।সবাই বলছে, শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই সব আয়োজন হয়ে গিয়েছে। শ্রীমতী মহলানবীশ জানান,  বেলা তিনটের সময় এক দল বরবেশী কবিকে তুলে নিয়ে গেল।  সেই মিছিলে যথারীতি গর্জিত হল  " জয় বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম্ ।"